এক.
লাবণ্য বেশ অনেকক্ষন ধরেই বারান্দায় বসে ছিল। শীতের শেষ বিকেলের রোদে পিঠ দিয়ে খাতা কলম নিয়ে কিছু আঁকিবুকি করার চেষ্টা করছিল। কাল সকাল আটটায় একটা ক্লাস আছে, তারপর মাঝে তিন ঘন্টা বিরতি দিয়ে এগারোটায় দিনের শেষ ক্লাস নিয়েই ছুটতে হবে তাদের সংগঠন ‘আমরাই শক্তি’র এক জরুরী মিটিং্যে। আজ সকালেই মায়া এসেছিল। ছুটির দিন বলে বেলা এগারোটার দিকে লাবণ্য সবেমাত্র দিনের দ্বিতীয় কাপ চা নিয়ে বসেছে, এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠে। ছোট মেয়ে টুকী দরজা খুলে দিতেই মায়ার গলা শোনা গেলো। লাবণ্য, লাবণ্য করে হাঁক ডাক করতে করতে মুহূর্তেই মায়া লাবণ্যর কাছে চলে এলো। এসে প্রথম কথাই বললো, “লাবণ্য, ঝুমুরের কথা মনে আছেতো! সেই যে একদিন এসেছিল আমাদের প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখবে বলে। দেখতে পরীর মত সুন্দরী, সেই ঝুমুর আজ সকালে ক্লাবে এসে উপস্থিত। সাথে করে নিয়ে এসেছে দুই বছরের ছেলে আর একটা স্যুটকেস। ঘটনা খুব একটা সুবিধের মনে হলোনা। শরীরের নানা জায়গায় চড় চাপড়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ঘাড়ের কাছে, ফর্সা হাতে কালসিটে পড়ে গেছে। কতভাবে জানার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছে, কেউ মেরেছে কিনা, তা মেয়ে কিছুই বলেনা, শুধু বলেছে তাকে যদি কয়েকটা দিন আমাদের কাছে থাকার সুবিধা করে দিতে পারি, তাহলেই বাকীটা সেই নাকি সামলে নিবে।“ লাবণ্য এতটুকু শুনেই বুঝে ফেলেছে যাই ঘটে থাকুক, ঘটনা অবশ্যই জটিল, খুব সহজে সমস্যার সমাধান মিলবেনা।
ঝুমুরের সাথে কথা বলতে হবে, ওর সাথে সরাসরি কথা না বলতে পারলে কিছুই বোঝা যাবেনা। ঝুমুরকে এর আগে একবারই দেখেছে লাবন্য। ওর বান্ধবী পায়েলের কাছে সংগঠনটির কথা শুনে একদিন দেখতে এসেছিল। লাবন্য সেদিন ওখানেই ছিল, ঝুমুরের সাথে গল্প করেছে, ধনী বাড়ির বউ তা মেয়ের সাজগোজ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কিনতু একবারও মনে হয়নি মেয়েটির জীবনে এত বড় অশান্তি চলছে। পায়েল অবশ্য পরে বলেছে ঝুমুরের কথা। ঝুমুর খুব সুন্দরী বলে ওর মা বাবা মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। ঝুমুরের শ্বশুরবাড়ী থেকে ঝুমুরকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়াতেই ঝুমুর বিয়েতে মত দেয়। কিনতু বিয়ের পরেই ঝুমুরের স্বামী, ননদ, শাশুড়ী থেকে শুরু করে সকলেই তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে ঝুমুরের উপর নানা বাধা নিষেধের কড়াকড়ি আরোপ করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ঝুমুরও বিগড়াতে শুরু করে, নিজে নিজেই ভর্তি হয়ে যায় কলেজে, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্টও করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পেয়ে যায়, কিনতু শ্বশুড় বাড়ী থেকে আর কোনভাবেই পারমিশান পায়নি ইউনিভারসিটিতে পড়ার ব্যাপারে। এর মধ্যেই ঝুমুরের একটি ছেলে বাচ্চা হয়, বাচ্চাটিকে নিয়ে ভালোই কাটছিল ঝুমুরের সময়। হঠাৎ করেই আবার নাকি ইদানিং ঝুমুরের উপর সবার অত্যাচার বেড়েই চলছিলো। তখনই পায়েলের কাছে লাবণ্য ও মায়ার গল্প শুনে একদিন এসেছিলো ঝুমুর, শুধুই দেখে যেতে। পায়েলকে লাবণ্য ভালো চিনে, বেশ ক’বছর আগে লাবন্যর ছাত্রী ছিল, এখনও লাবন্যর কাছে মাঝে মাঝেই আসে পায়েল, এমনি দেখা করতে। একাও আসে আবার কখনও তার বর ইমনকে নিয়েও আসে। পায়েলের স্বামী ইমন খুব শ্রদ্ধা করে লাবন্যকে। পায়েল যদিও লাবণ্যকে আগের অভ্যাসমত ম্যাডাম ডাকে, ইমন সরাসরি দিদি বলে ডাকে। লাবণ্যকে দেখলেই নাকি ইমনের নিজের বড় বোনের কথা মনে পড়ে যায়।
লাবণ্যর বয়স চল্লিশ পার হয়েছে এই গত আশ্বিনে। তবে চুলে পাক ধরেনি এখনও, চেহারাতেও ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। গত বা্রো বছর যাবত একটি কলেজে বাংলা পড়াচ্ছে সে। কলেজে সে খুব জনপ্রিয়। কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা অন্য ক্লাস ফাঁকি দিলেও লাবন্য ম্যাডামের ক্লাস ফাঁকি দেয়না। লাবন্য এমনিতে কখনও কোন স্টুডেন্টের উপর বিরক্ত হননা সহজে। তাঁর গলার আওয়াজে, কথা বলার স্টাইলে এমন কিছু আছে, যা ছোট বড় সকলকেই খুব কাছে টানে। তার লাবণ্য নাম যেই রেখে থাকুক, তার দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেই হয়। লাবন্যর সারা দেহে মুখে লাবন্য যেনো মাখামাখি করে থাকে। মানুষটি লম্বায় পাঁচ ফিট হবে হয়তো, গায়ের রঙ শ্যামলা, কিনতু মুখের চেহারায় এমন স্নিগ্ধ ভাব আছে যা দেখলে তার উপর ভরসা করতে ইচ্ছে করে। তার চোখ দুটোতে বুদ্ধি খেলা করে, গভীর কালো চোখ, আর হাসিতে গালে টোল না পড়লেও এমন হাসি দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। তাঁর পড়ানোর স্টাইলটাও অন্যরকম। ছেলেমেয়েদেরকে কখনও গৎবাঁধা মুখস্ত করতে উৎসাহিত করেননা, সব সময় বলেন, যে কোন একটা বিষয়ে নিজের চিন্তা ভাবনাকেই গুছিয়ে লিখতে। পড়ানোর সময় এতো সুন্দর সুন্দর গল্প বলে বলে পড়া বুঝিয়ে দেন যে ছাত্র ছাত্রীদের বই মুখস্ত করার যন্ত্রনা পেতে হয়না। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, তা লাবন্যর বেলায় পুরোপুরি সত্যি। কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে কলেজের কেয়ারটেকার পর্যন্ত সবার কাছেই লাবন্যর গ্রহনযোগ্যতা ঈর্ষনীয় পর্যায়ে পড়ে। অনেকেই আসে তার কাছে পরামর্শ চাইতে। এত ধীর স্থির মানুষটার পরামর্শের অনেক মূল্য সবার কাছে।
তা আজকে মায়ার মুখে ঝুমুরের ঘর ছেড়ে চলে আসার কথাটা শুনে লাবন্যর মনটা একটু অস্থির লাগছে। কম শিক্ষিত মানুষের সমস্যা সমাধান করা অনেক সহজ, ঝুমুরের স্বামীর মত উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধান করা চারটিখানি কথা নয়। তারা আর কতটুকুই বা করতে পারে, শুধুই কাউন্সেলিং করে কি আর কারো ভাঙ্গা সংসার জোড়া দেওয়া যায়! ‘আমরাই শক্তি’র শুরু থেকেই মায়া মোর্শেদ লেগে আছে সংগঠনটির ভালো-মন্দ সব কিছুতেই। মায়ার স্বামী মোর্শেদ আর লাবন্যর স্বামী অতীন, একই প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত আছে। সেই প্রতিষ্ঠানের এক পার্টিতে লাবন্যর সাথে মায়া মোর্শেদের পরিচয়। পরিচয় আস্তে আস্তে সখ্যতায় রূপ নেয়। তখনই একদিন মায়া লাবণ্যকে বলে, “ লাবণ্য, জানোতো আমার টাকা পয়সার অভাব নেই, ছেলেপুলেও হলোনা, মাঝে মাঝেই খুব পাগল পাগল লাগতো, সময় কাটতে চাইতোনা। আমি করেছি কি জানো, আশেপাশের মেয়েদেরকে নিয়ে একটি ছোট ক্লাব করেছি। মেয়েদের হাতের কাজ শেখাই, একটু আধটু গান বাজনা শেখাই, এসব নিয়েই আছি, তুমি কি আসবে একদিন আমার ক্লাবে?” লাবণ্য গিয়েছিল, এমনি এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিল। মায়ার অনুরোধে এরপরেও আরও কয়েকবার ক্লাবে গিয়েছিল। মায়ার কাজে একটু আধটু সাহায্যও করার চেষ্টা করতো লাবণ্য। এভাবেই মায়াকে একটু সাহায্য করতে এসে নিজের অজান্তেই লাবণ্য এইসব কাজে খুব বেশী জড়িয়ে পড়েছে মনে হয়। লাবন্যকে সাথে পাওয়াতে ‘আমরাই শক্তি’ অনেক গতি ফিরে পায় কাজে। লাবণ্য গত সাত বছরে সংগঠনটির চেহারাই পালটে ফেলেছে।
‘আমরাই শক্তি’ অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। এটা যখন গড়া হয়েছিল, তখন শুধু মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো হতো। কিনতু লাবণ্য এসেই অনেক কিছু যোগ করতে লাগলো। লাবণ্য ছোটবেলাতে দেখেছে তাদের পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরের মেয়েরা সারাক্ষন পরনিন্দা পরচর্চ্চা করতেই বেশী ভালোবাসত। অথচ তার মা’কে কখনও ওইসব আসরে যেতে দেখেনি। তার মা সব সময় অবসর পেলেই গল্পের বই পড়তেন। সেই থেকে লাবণ্যও বই পড়তে প্রচন্ড ভালোবাসে। তখন থেকেই লাবণ্যও চিন্তা করে দেখলো, শুধু হাতের কাজ না শিখিয়ে মহিলাদের নিয়েতো একটু গঠনমূলক আড্ডা আসরের ব্যবস্থা করা যায়! মহিলাদের বিনোদনের দিকটা অবহেলিত থেকে যায়। লাবন্য বড় হয়েছে খুবই আধুনিক চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে, তার উপর বেশ ক’বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেছে, তার চিন্তা ভাবনা বরাবরই একটু অন্যরকম। তার বাবার কাছ থেকেই সে শিখেছে যে যতদিন মেয়েদের মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ না দেয়া যাবে, ততদিন সংসারে অশান্তি লেগেই থাকবে। তাই মেয়েদের একটু বিশ্রাম, একটু অবসর, অবসরে ভালো কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা, এইসব চিন্তা থেকেই এই ক্লাবটিকে আরও বড় করা হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে অনেকে নানা সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করেছে। সবাইকে একটু আধটু পরামর্শ দিতে দিতে কখন যে লাবন্য কাউন্সেলারের মর্যাদা পেয়ে গেছে, তা সে নিজেও জানেনা। মায়া বড়লোকের গিন্নী হলেও খুবই সংবেদনশীল, পরোপকারী মানুষ। তাই লাবণ্যর সাথে মায়ার কখনও কোন মতবিরোধ হয়না।
এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার যেটা সেটা হলো ‘সন্ধ্যার আড্ডা’ নামে দুই ঘন্টার এক আসর। এই সময়টুকু গৃহিণীদের জন্য নির্ধারিত করা আছে। এখানে যারাই আসে, তাদের সবাইকেই দৈনিক পত্রিকা পড়ে আসতে হয়, কারন এখানে প্রতি সন্ধ্যায় সাধারন আলোচনা্ হয়, কার কাছে পত্রিকার কোন খবরটা বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে, কেন এটা ইন্টারেস্টিং মনে হলো, সব কিছু হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে আলোচনা হয়। এইসব আলোচনায় পয়েন্ট দেওয়া হয়, মাসের শেষে যে সবচেয়ে বেশী পয়েন্ট পায়, তাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হয়, অবশ্যই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস। ঘরের পুরুষেরাও খুব খুশী তাদের স্ত্রী আর জননীর এই ধরনের ব্যস্ততায়। লাবন্যের গল্পের ঝুলিতে গল্পের শেষ নেই, রামায়ন, মহাভারত, বিষাদ সিন্ধু থেকে শুরু করে রবীন্দ্র, নজরুল, শঙ্কর, বিভুতিভূষন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আহমেদ কে নেই! শরৎচন্দ্র খুব প্রিয় সবার কাছে, সবাই বুঝতে পারে শরৎবাবু মেয়েদের পক্ষে কথা বলে গেছেন, আশাপূর্ণা দেবী আর তসলিমাকেও অনেকে পছন্দ করে, তবে সবার মত হচ্ছে আশাপূর্ণা দেবীর লেখা তসলিমা নাসরিনের চাইতেও বেশী ভালো। তসলিমার লেখা ভালো লাগে, তবে ভাষাগুলি একটু খারাপ লাগে শুনতে। সেদিন মুনিয়ার মা বলছিলো, “ তসলিমা নাসরিনের লেখা অনেক শক্তিশালী, ঠিক কথাই কয় পুরুষ জাত সম্পর্কে”। সাথে সাথে মঞ্জু খালা বলে উঠলো, “শক্তিশালীতো বুঝলাম, তবে এত খোলামেলা কথা পড়তে ভাল লাগেনা, শুনতেও ভাল লাগেনা, যতই আমাগো পক্ষে হোক।“। এই ধরনের আলোচনা চলে ‘’সন্ধ্যার আড্ডায়’।
দুই.
লাবন্যরা থাকে কলেজের কাছাকাছি এক বাড়ীতে। বেশীদিন হয়নি বাড়ীটা ওরা কিনেছে। খুব বেশী বড় বাড়ি নয় এটা, তবে নিজের বাড়ী বলে কথা। বিয়ে হয়েছে তাওতো বাইশ বছর হয়ে গেলো। লাবন্যরা চার ভাই এক বোন। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। লাবন্যর বড় তিন ভাই, ছোট এক ভাই। লাবন্যর বাবা খুব সাধারন চাকুরী করতেন, মা ছিলেন একটি গার্লস স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। খুবই সাধারন মধ্যবিত্তের সংসার বলতে যা বোঝায়, তার চেয়েও সাধারনভাবে ওরা বড় হয়েছে। লাবন্যদের ছোটবেলাটা কেটেছে শীতলক্ষ্যা নদীর পারে, ফিনলে কোম্পাণীর কোয়ার্টারে। লাবন্যর এখনও মনে আছে, ওদের ঘর থেকে বের হলেই চওড়া কালো পীচঢালা রাস্তা, রাস্তার পরেই শীতলক্ষ্যার শাখা, সেই শাখানদীর এক পাড়ে ছিল লাল সুরকী বিছানো রাস্তা, যা চলে গেছে অনেকদূর পর্যন্ত, শেষ হয়েছে গিয়ে সাহেব বাংলোতে। আরেক পাড়ে চওড়া বড় মাঠ, মাঠের শেষ প্রান্তে ছিল ‘বরফকল’ নামে বরফ তৈরীর কারখানা। লাবন্যদের ঘরগুলো ছিল টিনের চাল ও টিনের বেড়া দেওয়া, কিনতু মেঝে ছিল সিমেন্টের পাকা মেঝে যেমন হয় তেমন।
লাবন্যর মা ছিলেন অনেক সুন্দরী, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, কালো গভীর চোখ, কালো কোঁকড়ানো চুল, অনেকটাই লক্ষ্মী দেবীর মত দেখতে, কিনতু লাবন্যর বাবা ছিলেন কালো। লাবন্যের তিন ভাই পেয়েছে মায়ের গায়ের রঙ, আর লাবন্য ও তার আরেকভাই পেয়েছে বাবার গায়ের রঙ। একটা মাত্র মেয়ে, লাবন্যর বাবা কি যে করবে মেয়েকে নিয়ে, তার কোন থৈ কিনারা পেতোনা। এমনিতে লাবন্যর বাবাকে সবাই খুব মেজাজী বলেই জানতো, কিনতু সেই মেজাজী মানুষটাই প্রতি রবিবার ছুটির দিনে মেয়েকে নিয়ে পড়তেন। মেয়ে মাথার চুল পেয়েছে মায়ের দিক থেকে, ঘন কালো কোঁকড়া চুল, কেমন রিং রিং হয়ে থাকতো, খুব ভালো লাগতো দেখতে। লাবন্যর বাবার তেমন পয়সাকড়ি ছিলনা, বিলাসিতাও ছিলনা, কিনতু মেয়ের জন্য সেই পাকিস্তান আমলেই শ্যাম্পু, চুলের ক্রীম নিজে কিনে নিয়ে আসতেন। প্রতি রবিবারের দুপুরে নিজে হাতে ছোট্ট পাঁচ বছরের লাবন্যকে শ্যাম্পু করে স্নান করাতেন। তারপর চুল শুকালে মাথার চুলে ক্রীম মাখতেন আর বলতেন, “ আমার একটা মাত্র মাইয়া, কালো হইছেতো কি হইছে, আমার মাইয়ারে আমি ইন্দিরা গান্ধী বানামু। সাহসী মাইয়া হইব, সরোজিনী নাইডু বানামু, না হইলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বানামু। কেউ যদি আমার মাইয়ারে কালো কয়, আমার সামনে তারে লইয়া আইবা, মজা বুঝামু, আমার মাইয়ারে কালো না কইয়া কইবা ইন্দিরা গান্ধী”। লাবন্য এখনও মাঝে মাঝে ভাবে, তার বাবা তাকে ইন্দিরা গান্ধী বানাতে চেয়েছিলেন, বাবার সেই চাওয়াটাই কি তার ভেতর একধরনের দৃঢ়তা তৈরী করেছে! নাহলে যে কোন অন্যায় দেখলেই তার মন কেন শক্ত অবস্থান নিয়ে ফেলে সেই অন্যায়ের বিরূদ্ধে!
লাবন্যর বাবা ছিলেন খুবই উদার মনের মানুষ। তার চেয়েও বড় কথা উনি ছিলেন নারী প্রগতির পক্ষে। লাবন্যর মায়ের যখন বিয়ে হয়, ওর মা তখন মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। লাবন্যর বাবা সেই চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বছর আগে কারো কোন কথার তোয়াক্কা না করে লাবন্যর মা’কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আশেপাশে মেয়েদের জন্য কোন কলেজ ছিলনা বলে ওর মায়ের আর কলেজ পড়া হয়নি। তাই বলে লাবন্যর বাবা থেমে থাকেননি। ঐ বছরই মেয়েদের জন্য একটি হাই স্কুল চালু হয়, লাবন্যর মা’কে ঐ স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। উনার বক্তব্য ছিল, “ মাইয়া মানুষ ঘরে থাকলে খালি কুটকচালি করবে, পরনিন্দা পরচর্চা করবে, এতে সংসার উচ্ছন্নে যায়, যেই ঘরের মা মনের দিক থেকে খুব শক্তিশালী, সেই বাড়ির পোলাপানও হয় সাহসী আর বিদ্বান”। লাবন্যর মা নিজেও ছিলেন খুব পড়ুয়া টাইপ, গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতেন। লাবন্য আর তার এক ভাই পেয়েছে মায়ের এই গল্পের বই পড়ার নেশা। লাবন্য দেখেছে, তাদের মা পাড়ার অন্য মায়েদের চেয়ে আলাদা ছিল। পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে মিশতো কিনতু কোন পরনিন্দা পরচর্চাতে থাকতেননা। কি ব্যক্তিত্ব, অংকে যেমন ভালো ছিলেন উনি, সাহিত্যেও তেমন ভালো। কে বলবে যে উনি ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর কলেজে পড়ার সুযোগ পান নাই। লাবন্যর বাবার কথাই ঠিক হয়েছে, লাবন্যদের পাঁচ ভাইবোনের সবাই দারুন দারুন রেজাল্ট করেছে সারা শিক্ষা জীবনে। লাবন্যর বাবা শুধু নিজের ছেলে মেয়েকেই না, গ্রাম থেকে উনার জ্ঞাতি বোনদেরকে নিজের কাছে এনে সবাইকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। আর নিজের দিদির ছেলেকেতো সেই ছোট্টবেলা থেকেই নিজের কাছে রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব দরজা ঘুরিয়ে এনেছেন। সেই ভাগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসাইটে প্রফেসার, লাবন্যর ভাই ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, প্রফেসার আর লাবন্য নিজেতো অধ্যাপনা করছেই।
এখন লাবন্য যেমন করে ‘আমরাই শক্তির’ ‘সান্ধ্য আড্ডায়’ সবাইকে গল্প শুনায়, লাবন্যর মা সব সময় ছেলেমেয়েদের কাছে যত স্বদেশী আন্দোলনের গল্প শোনাতেন। মানুষটার স্বদেশীদের প্রতি মমতায় হৃদয় আর্দ্র হয়ে থাকতো। এমন বাবা মায়ের সংসারে থেকে লাবন্য সেই কোন ছোটকালেই ক্ষুদিরাম, মাষ্টার’দা, বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা জানতো, আর ইন্দিরা গান্ধীর কথাতো জানতোই যেহেতু বাবার স্বপ্নই ছিল মেয়েকে ইন্দিরা গান্ধী বানাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা দিনের কথা প্রায় প্রায় মনে পড়ে। সোনারগাঁওয়ে দুইমাস লাবন্যরা ছিল, এরপরে আর দেশে থাকাটা নিরাপদ ছিলনা বলে সবাই বসে আলোচনা করছিল কিভাবে ইন্ডিয়া যাওয়া যায়। প্রায় প্রায় শোনা যেতো ওখানে পাকিস্তানী মিলিটারী মানুষ মারছে, আবার শোনা যেতো দুই দিন পরেই গ্রামে হানা দিবে, লাবন্যর দাদু, বাবা, মা, ঠাকুমা ,দিদিমা সকলেই ভয়ে অস্থির ছিল। তাদের এমন ভয়ার্ত মুখ দেখে ছয় বছরের লাবন্য একবার বলেই ফেললো, “আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে চাই, মিলিটারী আসতে লইলে আমি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মত বুকে বোমা বাইন্দা মিলিটারী ট্রাকের নীচে শুয়ে পড়মু, ট্রাক মিলিটারী লইয়া ধ্বংস হইয়া যাবে। আমাদের এখানে আর আসতে পারবোনা”। লাবন্যর মুখে এই কথা শুনে কেউ অবাক হয়নি, যেনো জানতোই লাবন্য এমন কথাই বলবে।
তিন.
সেই লাবন্যই যখন কলেজে পড়ে, লাবন্যর মা মাঝে মাঝে মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন দেখতেন, দুঃশ্চিন্তা করতেন। ভাবতেন, কালো মেয়ে লাবন্য, কেমন বাড়ীতে বিয়ে হবে কে জানে, যৌতুকও দিতে পারবেননা তারা, মেয়েটা ভাল বর পাবেতো! শাশুড়ী ননদে জ্বালাবেনাতো! লাবন্যর খুব খারাপ লেগেছে এমন কথা জানতে পেরে, সে তার মা’কে বলেছে, “আমি বিয়েই করবোনা। যদি বিয়ে করি, আর শাশুড়ী জ্বালাতন করে, তাইলে পরদিনই আমি ঐ বাড়ী ছেড়ে চলে যাব। আমি নিজে চাকরী করে সমাজসেবা করে বেড়াব”। আর লাবন্যর বাবা বলে দিয়েছিলেন, “ মেয়ের বিয়ে নিয়া চিন্তা করবানা, মেয়ে এমএসসি পাশ না করায়ে আমি বিয়া দিতেছিনা। মাইয়াগোর একবার বিয়া হইয়া গেলে পড়াশুনা আর হয়না। আমার মাইয়ারে আমি নিজের কাছে রাইখা এ্মএসসি পাশ করায় দিমু, আমার এমুন শিক্ষিত মাইয়ারে যদি কেউ বিয়া না করতে চায়, আমার মাইয়ার বিয়া করনের দরকার নাই। মাইয়া প্রফেসারী করবো, সেইটাই ভালো, নিজের সম্মান লইয়া থাকবো”। সেই লাবন্যর জীবনে হঠাৎ করেই যেনো এক পরিবর্তন চলে এলো। লাবণ্যর জীবনে এলো অতীন। পুরো ব্যাপারটা একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মনে হয়েছে লাবন্যর বাবার কাছে। মেয়ে মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে, এখনই যদি বিয়ে করে ফেলে তাহলেতো মেয়ের পড়ালেখা এখানেই সাঙ্গ হয়ে যাবে। একটামাত্র মেয়েকে ছেলেদের সমান যত্ন করে বড় করেছেন উনি। এখন মেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সারা জীবনের জন্য যে পস্তাতে হবে, তা তো মেয়ে বুঝতে পারছেনা।
লাবন্য বাবার আশঙ্কা একেবারেই বুঝতে পারেনি, কথাটা ঠিক না। লাবন্য বাবার মনের অবস্থা ঠিক বুঝেছে। কিনতু বাবাতো অতীনকে চিনেনা, তাই ভয় পাচ্ছে। একদিন লাবন্য তার মায়ের কাছে বললো, “ মা, আমিও ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো। বাবাকে বলো, অতীন খুব ভালো ছেলে, আমি তোমাদের মেয়ে, আমি যদি মানুষ চিনতে না পারি, তাহলেতো তোমাদের এতদিনের শিক্ষার কোন মূল্য থাকেনা। বাবাকে আরও বলবা, আমি বিয়ের পরে পড়া চালায়ে যাব, মাস্টার্স ঠিক কম্পলীট করবোই করবো। নাহলে আমার নাম ইন্দিরা গান্ধী থাকবেনা।“ অতীনের সাথে কথা বলে লাবন্যর বাবা অনেকটাই আশ্বস্ত হলেন, আরও বেশী খুশী হলেন যখন শুনলেন অতীন যৌতুক নিবেনা, শুধু লাবন্যকেই পেতে চায়, অতীন এও বলেছে, লাবন্য বিয়ের পরে পড়তে চাইলে অতীন সহযোগীতা করবে তবে জোর করবেনা। কারো উপর জোর করা অতীনের স্বভাবে নেই। শুভ লগ্নে লাবন্যর সাথে অতীনের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরে লাবন্য ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কম্পলীট করেছে, আরও অনেক পরে বিএড করেছে, বরের সাথে কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেই এই কলেজে জয়েন করেছে। তার নিজের তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে। নিজের বাবা মায়ের মতো করেই লাবন্য নিজের ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করার চেষ্টা করছে। খুব লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে হয়েছে ওরা। লাবন্যরাতো অনেক সাধারন জীবনযাপন করে বড় হয়েছে, কোন বিলাস ছিলনা, শুধুই স্বপ্ন ছিল মনে, লাবন্য নিজের সন্তানদেরকেও তেমন বিলাসিতা করতে দেয়না, কিনতু স্বপ্ন দেখায়, নিজের জীবনের গল্প শোনায়। আর কেমন করে যেনো লাবন্যর তিনটি ছেলেমেয়েই মায়ের মত বই পড়ার নেশা পেয়েছে। ফলে তারাও অনেক কিছুই জানে, বুঝে। বড় ছেলেটা ফুল স্কলারশীপ পেয়ে ডাক্তারীতে চান্স পেয়েছে, মেয়েটা গতবার ম্যাট্রিকে গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে, ছোট মেয়েটি সবার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমতী হয়েছে, এখনই তা বুঝা যায়। লাবন্য ও অতীনকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অহেতুক ভাবনা ভাবতে হয়না।
এতক্ষনে রোদ মরে এসেছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাবন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার ঝুমুরের কথা মনে পড়ে গেলো। গত সাত বছরে কত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন ‘আমরা শক্তির’ সদস্যদের মধ্যে। ক্লাবে আসা যাওয়ার পর থেকে শীলার শাশুড়ীওতো এখন কত নরম হয়ে গেছেন, শীলার সাথে কত ভালো ব্যবহার করেন। লাবন্য এখনও বিশ্বাস করে, মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে নেই, মেয়েদেরকে একটু আলোর মুখ দেখাতে হয়, মেয়েরা হলো সংসারের চাবিকাঠি। সন্তান জন্মেই মায়ের কাছাকাছি থাকে বেশ অনেকটা সময়। তাই মায়ের কাছ থেকেই সন্তান পায় তার জীবনের প্রথম শিক্ষা। একজন মুক্তমনা স্বাধীন মায়ের সন্তানেরাও হয় বিদ্বান, সাহসী, তেজস্বী। ঝুমুরের স্বামীটাকে এনে বুঝাতে হবে, ঝুমুর মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী, এমন স্ত্রী সংসারে থাকাটাই বিরাট সৌভাগ্যের লক্ষ্মণ, কাজেই কানকথা শুনে লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই। কে জানে, কতটুকুই বা বুঝতে চাইবে লাবণ্যদের কথা! তবুও চেষ্টা করে দেখা। নাহলে ঝুমুরের পাশে দাঁড়াতেই হবে, এমন একটি প্রতিভা নষ্ট হতে দেয়া ঠিক হবেনা। এইসব পাঁচ রকমের কথা ভাবতে ভাবতেই লাবন্য ঘরের ভেতর ঢুকে গে্ল, এরপর প্রতিদিনের মত একইভাবে একটা একটা করে প্রতিটি রুমে আলো জ্বেলে দিতে লাগলো।