জ্বালানি কাঠির আঁটি বাঁ কাঁখে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আফিয়া খাতুন যখন ঘরের দাওয়ার কাছাকাছি এসে পৌঁছুলো, বাইরে রোদের তেজ কমে গেছে তবে দিনের আলো মরেনি। আফিয়া খাতুন গেছিলো মরণী ঘোষের বাগে কাঠকূটা টোকাইতে। মাসকাবারী লাকড়ি ফুরিয়ে গেছে, মাসের আরও তিন দিন বাকী। টানাটানির সংসার, মাসের শেষ এক পয়সাও বাড়তি খরচ করার উপায় নেই আফিয়া খাতুনের। এই জন্যই কাঠ কূটা কুড়াতে তাকে মরণী ঘোষের বাগে যেতে হয়। এত বড় বাগ এই তল্লাটে আর একটিও নেই। কত যে গাছ বাগে, বাগে ঢুকলে কেমন আন্ধাইর লাগে চারদিক। আফিয়া খাতুনের গা ছমছম করে। বাগে না গিয়েও উপায় নেই, ঘরে চূলা না জ্বললে চলে?নাতি নাতনি দুইটারে ভাত আর একখান সালুন রাইন্দা দিতে হয় তো। নিজেরও এক মুঠ ভাত না হইলে রাইতে ঘুম আসে না। রমার কথা আলাদা। এই মাইয়া মুখে পানের পোঁটলা থাকলে সারা দিনমান খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হয়না। তাছাড়া রমা যেই তিন বাড়িতে কাম করে, তারাও রমারে কিছু না কিছু খাইতে দেয়। তাতেও রমার পেট ভরাই থাকে।
রমার আসল নাম রোমেজা। রমা নাম দিছিল মাস্টার মাসী। রমা তখন খুব ছোট, আফিয়া খাতুন কাজ করতো মুন্সিবাড়ির মাস্টার মাসীর ঘরে। রোমেজারে কোলে করে মাস্টার মাসির বাড়িতে যেতো আফিয়া খাতুন, তখন মাসী বলেছিল, তোমার মেয়েটা এত সুন্দর ওরে আমি রমা ডাকবো। সুচিত্রা সেনের নাম শুনেছো? বাংলা সিনেমার বিখ্যাত নায়িকা। সেই সুন্দরী নায়িকার নামও রমা”।
আফিয়া খাতুন অবশ্য নায়ক নায়িকার খোঁজ রাখতোনা। মাস্টার মাসি কার কথা কইলো তা নিয়েও মাথা ঘামায়নি। পান খাওয়া মুখে একটা বিগলিত হাসি দিয়ে বলেছিল, “ মাসি, রোমেজা আপনের নাতনি, নাতনিরে যেই নামে ডাকতে মন লয় ডাইকেন”। সেই থেকে রোমেজার ডাক নাম হয়ে গেছে রমা।
মরণী ঘোষের বাগ থেকে ফেরার সময় আফিয়া খাতুন পা টেনে টেনে হাঁটছিল, ঘরের দরজার কাছে পৌঁছতেই আফিয়া খাতুনের ঝুঁকে থাকা কোমড় নিমিষেই সোজা হয়ে গেলো। কপালটাও কুঁচকে গেলো, বিষয় কি? ঘরের দরজা খোলা ক্যান? এই অসময়ে কে আইলো? বাগে যাওয়ার সময় ঘরের দরজায় শিকল তুলে টিপতালা নিজে হাতে লাগিয়ে দিয়ে গেছিল সে। চাবি তার আঁচলে বান্ধা আছে, আরেক চাবি রমার কাছে। রমার এখন ফিরার সময় হয় নাই। নাতি নাতনিও মাদ্রাসা থেকে ফিরবো সন্ধ্যা লাগার আগে। তাইলে ঘরের দরজা খুললো কে? চোর ঢুকে নাই তো ঘরে? কাঁখে ধরে রাখা শুকনো কাঠির আঁটি ঘরের এক কোণে ঝুপ করে ফেলেই আফিয়া খাতুন হাঁক দিল, “ ঘরের ভিতরে কেডা? কেডা আমার ঘরের ভিতরে? বাইর অইয়া আয়। নুরু, অ নুরু, ঘরের ভিতরে কেডা রে? নুরু নি?”
ঘরের ভেতর থেকে রোমেজার কথা শোনা গেল। “ অ মাইও, চিল্লাইতাছো ক্যা? আমি আইছি গো মাইও”
-তুই আইছস? আমার বুকের ভিতরে ধড়াস ধড়াস করবার লাগছে। এমুন অসময়ে কেডা ঘরের দরজা খুলল, যেই ডরাইছি।
-মাও, এত্ত ডরাইলে চলব কেনে? কিয়ের ডর?
-যদি চোর ঢুকতো ঘরে? সব সাফা কইরা লইয়া যাইতোনা?
-মাইও, আমগোর ঘরে কি এমুন ধন সম্পত্তি আছে যে চোরে আইয়া লইয়া যাইত? আর আশেপাশে মানুষজন আছেনা, সবাইর চউখ ফাঁকি দিয়া চোরে আমগো ঘরে ডুকবো, এত্ত সাহস চোরের অইব?
-তুই এত সকালে আইয়া পড়লি, শইল বালা নাই?
-আম্মা, জলদি আও ঘরে। শইল বালা আছে, চিন্তা কইরোনা। অন্য বিষয়ে কথা কমু।
আফিয়া খাতুন ঘরে ঢুকতেই রোমেজা বলল, “ আম্মা, পরামর্শ দরকার। আল্লায় মনে লয় এইবার আমগোর দিকে মুখ তুইলা চাইছে।
-কি অইছে, খুইলা কইবিতো।
-মাইও গো, বিরাট একখান সুযোগ আইছে। তুমি যদি ইট্টু সাহস দ্যাও আর মত দ্যাও, তাইলেই সুযোগটা হাতছাড়া করিনা!
দুই
রোমেজারা তিন বোন। খোদেজা, রোমেজা, রোমেলা। তিন বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। খোদেজা থাকে শরীয়তপুর, রোমেলা থাকে সিলেট। জামাই বাবাজীরা মাইয়া দুইটারে কুতুবপুর মায়ের কাছে পাঠায়না। দুই তিন বছরে এক দুইবার খোদেজা রোমেলার সাথে দেখা হয় আফিয়া খাতুনের। তাতেই খুশি আফিয়া খাতুন, মেয়েদের নাইওর আনতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু নাইওর আনতে গেলে অনেক টাকা লাগে। এত টাকা পাইব কই? রমার লগে রমার সোয়ামির বিচ্ছেদ হইয়া গ্যাছে। দুই পোলা মাইয়া লইয়া রোমেজা থাকে মায়ের সাথে। খারাপ লাগেনা আফিয়া খাতুনের।
আফিয়া খাতুনের এই ঘর দুটো বাপের কাছ থেকে পাওয়া ভাগের সম্পত্তি। কাছাকাছি আফিয়া খাতুনের অন্য ভাই বইনেরা থাকে, সকলেই বাপের কাছ থিকা দুইখান কইরা ঘর পাইছে। আফিয়া খাতুন বাদে বাকি সক্কলেই চালা ঘর ভাইঙ্গা শক্ত খুঁটি নতুন ডেউটিনের চাল দিয়া মজবুত কইরা ঘর তুইলা নিছে।
আফিয়া খাতুনও এমন পাকাপোক্ত ঘর ব্যবস্থা করতে পারতো, কিন্তু অসময়ে রমার বাপ কইরা গেলোগা। তাতেই চরম আতান্তরে পড়ে গেছে আফিয়া খাতুন। রোমেজার বাপ মারা গেছে আট বছর আগে, রোমেজার তখন নয় মাসের ভরা পেট। যখন তখন প্রসব বেদনা উঠার অপেক্ষা। এর মধ্যেই রোমেজার বাপ অসুস্থ হয়ে পড়লো। অসুস্থ সোয়ামী নিয়ে রোমেজার মা আফিয়া খাতুন দিশেহারা, কে কবিরাজের কাছে যায়, কেইবা বুড়াকে একটু অষুধ পথ্যি এনে দেয়! তখনই পাঁচ বছর বয়সী হানিফের হাত ধরে দ্বিতীয় দফা পোয়াতি রমা সোয়ামির সাথে রাগ করে মায়ের বাড়ি এসে উঠে।
রোমেজার বয়স তখন ১৬ কি ১৭, মাস্টার দিদিমার বাড়িতে রোমেজা থাকতো। মাস্টার দিদিমার ছোট ছেলে সঞ্জু জন্মানোর পর দিদিমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রোমেজার মা দিদিমার বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করতো। দিদিমা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো, রোমেজার মা একা হাতে দিদিমার সংসার সামলাতে পারছিল না। তখন রোমেজাকে সাথে নিয়ে যেতো। মাস্টার দিদিমা রোমেজাকে খুব পছন্দ করতো, এই দিদিমাইতো রোমেজার নাম দিয়েছে রমা।
মাস্টার দিদিমারা জাতিতে হিন্দু হলেও জাত পাতের বাছ বিচার ছিলনা। বাড়ি ঘরে মুসলমানের অবাধ যাতায়াত ছিল। দিদিমারা কোনদিন মুসলমানে ছুঁয়ে দিয়েছে বলে ভাতের পাতিল ফেলে দেয়নি। রোমেজার মা কতদিন দিদিমার বাড়ির ভাত রান্না করেছে। তাদের বাড়ির পাতকুয়ার পানি যেমন ঠান্ডা তেমন মিষ্টি। পাতকূয়া থেকে পানি তুলতে আসতো হিন্দু মুসলমান মেথর নাপিত সকলেই। দিদিমা ভাল, দাদায় আরও বেশি ভাল। বাইরের মানুষ কুয়ার জল নিতে আসে, দাদা নিজে হাতে কুয়ার চারদিক পরিষ্কার করতো যেন শ্যাওলা ধরে কুয়াতলা পিচ্ছিল না হয়। গোসলের বালতি আর খাওয়ার জলের বালতি ছিল আলাদা, ঝকঝকে পরিষ্কার। অনেক ভালো মানুষ দাদা দিদিমা দুইজনেই।
দিদিমাদের বাড়ির বাজার সরকার ছিল জয়নাল মিয়া। ছোট ছেলে জন্মের পর দিদিমা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো, রোমেজা দিদিমার ফাইফরমাশ খাটতো। তখনই জয়নাল মিয়ার সাথে চোখাচোখি হতো। চোখাচোখি করতে করতেই জয়নাল মিয়াকে রোমেজার মনে ধরে যায়, মনের অজান্তে রমা জয়নাল মিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। জয়নাল মিয়া রোমেজাকে ফুঁসলায় লুকিয়ে বিয়ে করার জন্য। রোমেজার বয়সটাই ছিল সর্বনাশের মূল, জয়নাল মিয়া বয়সে রোমেজার চাইতে ১৫/১৬ বছরের বড় সেকথা যেন মনেই এলোনা, রোমেজা জয়নাল মিয়ার সাথে পালিয়ে যায়। তিন দিন পর জয়নাল মিয়ার বিবি হয়ে দিদিমার বাড়ি এসে দিদিমাকে সালাম করে রমা দোয়া চায়।
“এমন বুড়া এক বেডার লগে বিয়া বইছে মাইয়া?” বলে রোমেজার মা সেদিন বুক চাপরে কেঁদেছিল। দাদা বাড়িতে ছিলনা, দিদিমা তখন রোমেজার মাকে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল।
জয়নাল মিয়ার সাথে রোমেজার সংসার ভালোই চলছিল। ১৬ বছরের রোমেজা দেখতেও ছিল সদ্য ফোটা পদ্মফুলের মত। চোখ দুটো কাজলটানা, ছোট কপাল, মাথা ভর্তি কালো কোঁকড়া চুল, টিকলো নাক পুরু ঠোঁট। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মুখের চেহারায় লাবণ্য ফুটে থাকতো। জয়নাল মিয়া দিদিমার বাড়ির কাজ ছেড়ে সিনেমা হলের টিকেট চেকারের চাকরি নিল। টিকিট ব্ল্যাক করে বেশ কিছু উপরি আয় হতে লাগলো। ততদিনে রোমেজার কোলে হানিফ এসেছে। উপরি আয় বাড়তে লাগলো, জয়নাল মিয়ার আনন্দ ফূর্তি বাড়তে লাগলো। মাঝে মাঝে বাইরে রাত কাটাতে শুরু করলো, এরপর একদিন রোমেজা টের পেয়ে গেলো জয়নাল মিয়া প্রায় দিন বেশ্যাবাড়ি যায়।
দুই বছরের হানিফকে কোলে নিয়ে রোমেজা মাস্টার দিদিমার বাড়ি চলে এলো। জয়নাল মিয়ার নামে নালিশ করলো, কানতে কানতে বলল, দাদা যেন জয়নাল মিয়ার বিচার করে। রোমেজার দাদা জয়নাল মিয়াকে তলব করে আনলেন, বকা ঝকা করলেন, থানা পুলিশের ভয় দেখালেন, রোমেজা আবার হানিফকে কোলে নিয়ে নিজের সংসারে ফিরে গেলো।
হানিফের বয়স যখন পাঁচ, রোমেজা আবার সন্তানসম্ভবা হলো। ঠিক সে বছর রোমেজার আব্বা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো। সেই যে অসুখে পড়লো, আর সারলোনা। বিছানাতেই হাগা মুতা, বিছানাতেই শুয়ে থাকা। বুড়া স্বামীকে নিয়ে বিপদে পড়ে গেলো আফিয়া খাতুন। রোমেজাকে খবর দিতেই হানিফকে হাতে ধরে রোমেজা চলে এলো। নয় মাসের গর্ভবতী হলেই কি, রোমেজা অসুস্থ বাপের সেবাযত্নে ত্রুটি রাখেনা। একটাই সমস্যা, ভরা পেট নিয়ে বাপকে বিছানায় এপাশ ওপাশ করাতে পারেনা।
জয়নাল মিয়ার তখন চরম ব্যস্ততা, বেদের মেয়ে জোছনা হাউজফুল যায়। টিকিট ব্ল্যাক হয়ে যায়, জয়নাল মিয়ার পকেট ভারী হয়ে ওঠে। তেমন রমরমা সময়েও জয়নাল মিয়া কাজ ফেলে শ্বশুরকে দেখতে এসেছিল এবং পরবর্তি সাত দিন শ্বশুরের সেবা করেছিল। ঐ সাতদিন রোমেজা বিশ্রাম পেয়েছিল। মেয়ে জামাইয়ের সেবা যত্নটুকু নিয়ে রোমেজার বাপ আট দিনের দিন চোখ বুজেছিল।
রোমেজার মা এত শোকের মাঝেও জামাইয়ের কাজ কর্ম দেখে খুব খুশি হয়েছিল। মাস্টার মাসির কাছে খুব খুশির কন্ঠে বলেছিল, “ বয়সে রোমেজার চাইতে এত বড় হইলেও জামাইয়ের দিলে মহব্বত আছেগো মাসি। রোমেজার বাপেরে শেষ কয়ডা দিন যেই সেবা দিছে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতেন না”।
কিছুদিন পর রোমেজা কন্যাসন্তান প্রসব করলো। জয়নাল মিয়া কন্যার নাম রাখলো মিনা। মিনা রাতে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে, সারারাত রোমেজা মেয়ের মুখে স্তনের বোঁটা গুঁজে দিয়েও মেয়ের কান্না থামাতে পারেনা। রোমেজা বুঝে উঠতে পারেনা মেয়ের সমস্যা কোথায় হচ্ছে। জয়নাল মিয়াকে বলে, কুসুম কাকার কাছে সব বলে দুই পুরিয়া ‘হোমোপেতি’ অষুধ নিয়ে আসতে। রোমেজা যত বেশি উতলা হয় মিনার জন্য, জয়নাল মিয়া ততই বেখেয়ালি হয়ে থাকে। কাজে যায়, বাড়ি ফিরে ভাত খায় অথচ কুসুম কাকার কাছে যাওয়ার কথা ভুলে যায়। মাঝে মাঝে রাতে বাড়ি ফিরতেও ভুলে যায়।
রোমেজা মায়েরে সংবাদ দিল, মা নিজে কুসুম কাকার কাছ থেকে পুরিয়া এনে দিল। পুরিয়া খেয়েই মিনার কান্না থেমে গেল। এদিকে জয়নাল মিয়ার কাজের চাপ বেড়ে গেলো, রাতে বাড়ি ফেরার তাগিদ কমে গেলো। এক সময় রোমেজা জানতে পারলো, এবার জয়নাল মিয়া এদিক সেদিক না গিয়ে আরেকটা বিয়েই করে ফেলেছে। এবার রোমেজা জয়নাল মিয়ার নামে নালিশ নিয়ে ্মাস্টার দিদিমার কাছে গেলো না। এক বছরের মিনাকে কাঁখে করে, সাত বছরের হানিফের হাত ধরে রোমেজা মায়ের বাড়ি চলে গেলো। ন যেদিন
মায়ের বাড়িতে থাকলেও ছেলেমেয়ের ভরণপোষণের দায় রমা বিধবা মায়ের কাঁধে চাপায়নি। কাছাকাছি একটা মেয়েদের স্কুল আছে, সেই স্কুলে মর্নিং শিফটে রোমেজা আয়ার চাকরি করে, এরপর দুই বাড়িতে ঠিকা কাজ করে। যা উপার্জন হয় তাতে কায়ক্লেশে ওদের সংসার চলে যায়। ঘর ভাড়া দিতে হয়না কারণ মায়ের ঘর দুইটা মায়ের নিজস্ব সম্পত্তি, মা পাইছে তার মায়ের কাছ থেকে।
ছেলেটাকে ছোট বেলাতেই মাদ্রাসায় ভর্তি করেছে রোমেজা, প্রথম দুই বছর মাসে বেতন দিতে হতো ৮০০ টাকা। তখন সংসারে খুব টানাটানি হতো। এখন বেতন দিতে হয়না। বড় হুজুর এতিম ছাত্রদের বেতন ফ্রি করে দিয়েছে।
হানিফ অবশ্য এতিম না, হানিফের বাপ মা দুইজনেই জিন্দা আছে। তারপরেও হানিফের বেতন ফ্রি করে দেয়ার পেছনে ছোট্ট কিন্তু চোখে পানি আসার মত ঘটনা আছে। হ্যাঁ, হানিফের মুখে গল্পটা শুনে রোমেজার চোখে পানি এসেছিল।
গল্পটা এরকম, হানিফ তখন আরও ছোট, দুই বছর হয়েছে মাদ্রাসায় পড়ছে। একদিন বড় হুজুর সব ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উপস্থিত বাচ্চাদের মধ্যে কে কে এতিম? কার কার আব্বা নাই? হাত উঠাতে বলেছিলেন হুজুর। কয়েকজন ছাত্র হাত উঁচু করেছে, হানিফ পড়ে গেছে বিপদে। ওর আব্বা আছে কিন্তু আব্বাতো ওদের খোঁজ খবর নেয়না। আম্মা কত কষ্ট করে, মানুষের বাড়িতে বাসন মাজে, ইস্কুলে আয়াগিরি করে। আব্বা যদি ওদের সাথে থাকতো তাহলে কি আম্মাকে এত কষ্ট করতে হতো? হানিফ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিল। বড় হুজুর হানিফকে দাঁড়াতে বললেন, কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
হানিফ কানতে কানতে বলল, “ হুজুর, আমি এতিম না, কিন্তু আমার আব্বা আমাদের ছেড়ে অন্য জায়গায় সংসার পাতছে। আমরা নানীর লগে থাকি, আমার মায় বাড়িত বাড়িত ঝিয়ের কাম করে, ইস্কুলে আয়ার কাম করে। অনেক কষ্ট আমার মায়ের”।
হানিফের কথা শুনে বড় হুজুর বলে দিলেন, এখন থেকে হানিফও মাদ্রাসায় ফ্রিতে লেখাপড়া করতে পারবে। সেদিনটার কথা মনে পড়লে বড় হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আজও রোমেজার বুক ভরে যায়।
তিন
আফিয়া খাতুনের চোখে ঘুম নেই। ছোট দুইটা ঘরের এক ঘরে আফিয়া খাতুন ঘুমায় নাতিরে লইয়া, অন্য ঘরে রমা আর মিনা। হানিফ মাদ্রাসায় পড়ে, হুজুর কইছে হানিফ খুব মেধাবী। মাস্টার মাসি কইছিল তার ইস্কুলে ভর্তি করাইতে হানিফ আর মিনারে। আফিয়া খাতুন কিছু কওয়ার আগেই রমা কইলো, ওর খুব শখ তার ছাওয়াল মাদ্রাসায় লেখাপড়া কইরা অনেক বড় আলেম হইব। মাস্টার মাসির কোন কথাতেই আফিয়া খাতুন আপত্তি করেনা, এই কথাতেও রাজী হইছিল। কিন্তু রমা দিলনা পোলারে মাস্টার মাসির ইস্কুলে। মাস্টার মাসি রমারে জিগাইছিল, “ কি রে রমা, পোলারে মাদ্রসায় যে ভর্তি করাইলি, বড় হইয়া পোলাতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হইবোনা, হইবো একজন হুজুর। বাংলাদেশে কি হুজুরের অভাব যে তুই ছেলেরে হুজুর বানাইতে চাস?”
রমা কইছিল, “ হ দিদিমা, পোলা মাদ্রাসাতেই পড়বে। কেন জানো? আমার খুব শখ, আমার মরণের পরে আমার পোলা আমার জানাজায় ইমামতি করবো। এইটা আমার অন্তরের ভিতর থিকা কইলাম।“
-দারুণ কথা বললিতো রমা। তোর ছেলে তার মায়ের মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবে। খুব ভাল।
-হ দিদিমা, এইটা আমার অনেক দিনের সাধ।
হানিফের বয়স এখন ১৩, মিনার আট। এই দুইটারে মায়ের কাছে রাইখা রমা ঢাকা শহরে যাইতা চায়। অনেক মোটা বেতনে এক বাড়িতে কাজ করার একটা সুযোগ আসছে। মাস্টার দিদিমার কাজ এইটা, তাইনের আত্মীয় লাগে। রমা মায়ের মত চায়, আফিয়া খাতুন বুঝতে পারেনা কি বলবে! সে হইলো কাউয়া, ঘরে বইসা কোকিলের ডি্মে তা দেয়। তা দিতে সমস্যা নেই, সমস্যা ঢাকা শহরে গিয়া রমার বিপদ হইবোনাতো? ঢাকা শহর কত্ত বড়, কত্ত মানুষ গাড়ি ট্যাক্সি চাইরদিকে। রমার যদি কোন বিপদ ঘটে যায় তবে ছোট দুই নাতি নাতিন নিয়ে আফিয়া খাতুন কই যাবে। কিন্তু টেকাওতো কম নয়। মাস যাওতেই কড়কড়া ১২ হাজার টাকা আফিয়া খাতুনের কাছে আসবে। রমা কইছে, চার হাজার টাকা আফিয়া খাতুন সংসারে খরচ করবে, বাকি টাকা জমা রাখবে মাস্টার দিদিমার কাছে। এক থোকে জমলে সেই টাকায় রমা মায়ের দুই খুপরির ঘর ভাইঙ্গা সিমেন্টের পাকা দেয়াল, সিমেন্টের পাকা মেঝে আর ঢেউ টিনে চাল দিবে। পানি আনতে মামুগো বাড়িত যাইতে হয়, মামী কট কট করে কথা শুনায়। রমা নাকি নিজেগো ঘরের কোণাতেই টিউবকল বসাইব। হানিফরে মাদ্রাসায় পড়াইতেছে, মিনারে দিদিমার ইস্কুলে ভর্তি করায়ে দিব।
আফিয়া খাতুন যদি রমারে আশ্বস্ত করে, রমা ঢাকা গেলে হানিফ আর মিনারে মাইও দেইখা রাখতে পারব, তাইলেই রমা কাইল সকালবেলায় মাস্টার দিদির কাছে গিয়া মত দিয়া আসব।
আফিয়া খাতুন হয়তো সকাল হওয়ার আগেই মন স্থির করতে পারবে।
চার
মিনারে বুকের কাছে জড়ায়ে শুয়ে আছে রোমেজা। রাত কত হইলো কে জানে! চোখে ঘুম নাই। কাইল সকালের মধ্যে মাস্টার দিদিমারে জানাইতে হইব, রমা ঢাকা যাবে কি যাবেনা। রমা বুঝতে পারছেনা, এইটা কি আল্লারই ইশারা কিনা। নাহলে এভাবে প্রস্তাব আসবে কেন। রমা মাস্টার দিদিমার বাড়িতে মাঝে মধ্যে যায়, গেলে দিদিমা রমাকে দিয়ে এই কাজ সেই কাজ করিয়ে রাখে। এই মাস্টার দিদিমা আর দাদা হইতেছে ওদের কাছে অনেক বড় মানুষ। হিন্দু বাড়িতে কাজ করে বলে রমাদের আত্মীত স্বজন পাড়া প্রতিবেশি দুই তিনবার হাউ কাউ করেছিল। মাদ্রাসায় গিয়ে নালিশ করেছিল যেন হানিফকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়। কিন্তু বড় হুজুর ওদের নালিশ কানেই তোলে নাই। আর শয়তানী করছিল মসজিদের ইমাম সাহেব। রমার মাকে একঘরে করে দিবে বলেছিল হিন্দু বাড়িতে কাজ করে বইলা। মরলে নাকি মায়ের জানাজা পড়াইবোনা।
রমা তখন শাড়ির আঁচল কোমরে বাইন্দা ঘর থেকে বের হয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, মসজিদের ইমাম সাব আমগোরে একঘইরা করার আগে এতদিন যে মসজিদে চান্দা দিছি, সব হিসাব কইরা আমগোরে ফেরত দিতে হইব। নাহইলে দেখমু হিন্দু বাড়িত কাম করই দেইখা কেমনে আমগো একঘইরা করে। গত মাসেও চান্দা দিছি, এই টাকা কইত্তনে আইছে? হিন্দু বাড়িত কাম কইরাইতো টাকা আনি। আর জানাজা পড়াইতেননা? আপনে জানাজা না পড়াইলে কোন ক্ষতি নাই, আমগো জানাজা পড়াইব আমার পুতে। আমার পুতে পাশ কইরা যখন বড় আলেম হইব, তখন আমার পুতেই আমার জানাজা পড়াইব, বুঝছেন? এইবার কন, আমগোরে একঘইরা করবেন কবে?
এরপর থেকে অনেকদিন কেউ আর কিছু বলেনা। রমা আজ মাস্টার দিদিমার সাথে দেখা করতে গেছিল। রমা মাস্টার দিদিমার বাড়ি গেলেই দিদিমা রমাকে দিয়ে টুকটাক কাজ করিয়ে নেয়। আজও রমাকে দেখা মাত্র বলল, “ ও রমা, তুই এসেছিস, খুব ভাল হয়েছে। আমার মাথায় একটু তেল দিয়ে দে নয়া সোনা”।
রমা তেলের বাটি নিয়ে বসে গেলো। দিদিমার মাথায় রাশি রাশি চুল, এই চুল তেল দিয়ে ভিজাইতে গেলে আধা বোতল তেল শ্যাষ হইয়া যায়। দিদিমার চুলে বিলি কাটছিল, এমন সময় দিদিমার মোবাইল ফোন বাইজা ওঠে। দিদিমা ফোন কানে লাগাইয়া কথা কইতে গেলে চুলের তেল কান বাইয়া ফোনের মধ্যে লাগলে ফোন নষ্ট হইয়া যাইব, হেই ডরে স্পিকার ছাইড়া লইছিল। ফোন করছে দিদিমার বইনঝি ইলা। ইলা মাসিরে রমা চিনে, দিদিমা যেমন গম্ভীর, দিদিমার বইনঝি হেইর উলটা। সব সময় ফূর্তি করে। এই বাড়িত বেড়াইতে আইসা হই চই করবোই। রমারেও খুব ভালোবাসে।
ইলা মাসির মন খারাপ, উনার শাশুড়ি খুব অসুস্থ, সব শুইনা মনে হইল এক্কেরে বিছানা লইছে। বুড়িরে সেবাযত্ন করার লোক দরকার। ইলা মাসি নিজেও চাকরি করে, মাসির স্বামীও চাকরি করে। দুই জনের কেউই দিনের বেলা বাসায় থাকতে পারেনা। বুড়ি শাশুড়ির সেবা করার জইন্য কুন এক দালালের লগে কথা হইছে। হেই দালাল বেটা যে এক নাম্বারের বাটপার, মাসিরা আগে বুঝে নাই। দালাল বেটা মাসিগো কইছে, হের অনেক বড় কোম্পানী, সবাইর বাড়িতে লোক সাপ্লাই দেয়। লোকে সব কাজ করে দিব। আরও কত কিছু কিন্তু বেতন দিতে হইব মাসে ১২ হাজার টাকা। এডভান্স ১৭ হাজার টাকা।
মাসিরা দিশা না পাইয়া রাজী হইছে এই চুক্তিতে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিছে গত পরশু দিনের পর থেকে। মাসির স্বামী গেছিল সেই দালালের অফিসে, গিয়ে দেখে ঐ নামে ঐ ঠিকানায় কোন অফিস নাই। বেটারে ফোন করতেই বেটা লুঙ্গি পরা অবস্থায় কোন চিপা গলির থিকা বাইর হইয়া আসছে। মাসির স্বামীরে বলে কইছে, তার অফিস চিপা গলির ভিতরে। গলির ভিতরে ঢুইকা মাসির স্বামীতো ডরায় গেছে। এই চিপা ঐ চিপা দিয়া খালুরে দালাল বেটায় যেই ঘরের সামনে লইয়া গেছে, সেইটা মহাখালি যক্ষ্মা হাসপাতালের বস্তি। ঘরের ভিতরে অনেক বেটি, দালালে তাগো বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়া রাখছে। তালা খুইলা এক বেটিরে ডাকছে, সেই বেটির চেহারা সুরত দেইখা খালুর মনে সন্দেহ হইছে, এরা পুরা একটা দল। বেটি রোগির কথা জানতে চায় নাই, প্রথমেই বলছে, “ আমারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দিতে হইব, ঘরের কোন কাজ করতে কওয়া যাইবনা। আমি রোগির ডাইপার বদলাইতে পারুমনা, তাইলে আমার নামাজ কাজা হইয়া যাইব”।
খালু সব কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলে ১৭ হাজার টাকা পুরাটাই দিয়া আসছে। কিন্তু বাসায় ফিরেই খালু দুশ্চিন্তায় পরে গেছে।
স্পিকারে কথা চলছে, রমা সবই শুনছে। কি মনে হলো, রমা বলে ফেলল, “ ১২ হাজার টাকা পইত্যেক মাসে? ও দিদিমা, ইলা মাসিরে কন, আমারে লইয়া যাইত। আমি মাসির ঘরের কাজও করুম, মাসির শাশুড়ির সেবাও করুম”।
রমার কথা শুনে দিদিমা ইলা মাসিকে বলছিল, “ ইলা, শোন রমা কি বলছে! বলছে রমাকে নিয়ে যাবি কিনা। তাহলে ঐ দালালকে মানা করে দিতে পারিস। কারণ দালালের কথা শুনে আমার ভয় লাগছে। এরা সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। বাড়িতে আসবে, তোরা কেউ থাকবিনা বাসায়, দল এসে ঘর খালি করে নিয়ে যাবে”।
ইলা মাসি সাথে সাথে রমাকে বলছিল, “ ও রমা, সোনা তুই সত্যি আসবি ঢাকায়? তোর মা রাজী হবে? আয়না সোনা, আমার শাশুড়ি মা একটুও যন্ত্রণা করেনা, তোর কাজ একটুও কঠিন হবেনা। মায়ের ডায়পার আমিই বদলে দেব। আর তুই নামাজ রোজা সব করতে পারবি”।
ইলা মাসির কথা শুনে রমার হাসি পেয়ে গেছিল। মাসি কি কয়, মাসিই বলে শাশুড়ির ডায়পার বদলাইব, তাইলে আমারে নিয়া লাভ কি? আর নামাজ রোজা? আমি মনে মনেই আল্লাহরে ডাকি, যামু রোগীর সেবা করতে। রোগীর সেবা ঠিকমত করলেই আল্লাহপাক খুশি হবে। এইসব কথাতো আর ইলা মাসিরে বলা যায়না। রমা ইলা মাসিরে শুধু কইল, “ মাসি, আমারে আইজকার দিনটা সময় দ্যান। বাড়িত গিয়া মার লগে আলাপ করি। কাইল দিদিমারে জানাইমু”।
রোমেজার মন তৈরী হয়ে গেছে। সন্ধ্যার সময় হানিফকে বুঝিয়ে বলতেই হানিফ বলেছে, “ আম্মা, আমাগোরে লইয়া চিন্তা কইরোনা। তুমি যাও ঢাকা।“ মিনা অনেক ছোট, মিনা কয়দিন কানবো মায়েরে কাছে না পাইলে। মিনারে কইতে হইব, ঢাকা থিকা লেহেঙ্গা কিনা আনুম। তাইলেই মিনা রাজী হইব। এই কামডা লওন দরকার।
এইভাবে বাঁচা যায়? বর্ষার দিন ঘরের চাল ছেইদা বৃষ্টির পানি পইড়া সারা ঘর ভিজা যায়, বিছানা বালিশ ভিজা ত্যানা হইয়া যায়। ঘরের খুঁটিগুলি লড়বড় করে, ঝড় বাদলা দমকা বাতাসে খুঁটি কাঁপে, মিনা আর হানিফ ঐ সময়টায় অনেক ডরায়, যদি ঘর ভাইঙ্গা চাপা পড়ে! কিন্তু ঘর সারানোর উপায় নাই। কে দিব টাকা? মায়ের শইল ভাইঙ্গা গেছে, মায় এখন বাসা বাড়িত কাম করতে পারেনা। যেই কয়ডা টাকা রোমেজা কামাই করে, পুরা মাস চলে না। এইভাবে কতকাল যাইব? ওর নিজেরও বয়স হইব, সংসারে বুড়ি মা, দুই ছোট ছেলেমেয়ে ছাড়া রমার যে আর কেউ নাই।
ইলা মাসির বাড়িতে কয়েক মাসও যদি কাম করতে পারে, তাইলেই রমা সংসারের চেহারা পাল্টায়ে দিতে পারব। ইলা মাসি মানুষ ভাল, নিশ্চয়ই রমার সুখ সুবিধা বুঝবে। রমার যে একেবারেই ভয় লাগছেনা তা নয়, অনেক দূরের পথ, সেই ঢাকা। জীবনে কোনদিন ঢাকা যায়নি, এত মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেলে কুতুবপুর ফিরবে কি করে! অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। পরক্ষণেই রমার মনে হলো, আমি হারিয়ে যাব কেন? ইলা মাসি, খালু আছেনা? উনারা আমাকে হারিয়ে যেতে দিবে কেন? একটু সাহস করে ঘরের বাইরে পা রাখতে পারলেই হলো! সাহসীর সাথে আল্লাহপাক থাকেন, এটুকু মনে হতেই রোমেজার মনে সাহস ফিরে এলো।