আই.এ. পাশ করে কলকাতায় চলে যায় হরিপদ। দেশ ছেড়ে যাওয়ার, আদৌ কোন ইচ্ছাই ছিলনা তার। তবুও “পিত্রী আজ্ঞা শিরোধার্জ।” দেশ ভাগের পর, অনেক হিন্দু পরিবার বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়্ পাড়ি জমায় ওপাড়ে। কিন্তু হরিপদর বাবা তারাশঙ্কর বাবু, থেকেই যান দেশে। ছাড়তে পারেন না দেশের টান, মাটির টান। ছেলের ভবিশ্বতের কথা চিন্তা করে, ছেলেকে তিনি ওখানেই পাঠিয়ে দেন।তা ছাড়া দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও ভাল না।কখন কি হয় বলা ,যায় না কিছু।হরিপদ ভর্তি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।ভর্তি হলে কি হবে,পড়াশুনাইয় তেমন মন বসছিল না তার।পূর্ব বঙ্গের অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে সে। কলকাতার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিল না কিছুতেই। ওখানে সবাই কেমন যেন স্বার্থপর। মন তার সব সময় পড়ে রইত গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে। কখনও মনে পড়ত, ছেলে বেলার কথা,ফেলে আসা সহপাঠীদের কথা। দুরন্ত হরিপদ, ঘুরে বেড়াত বন্ধুদের সাথে মাঠে-ঘাটে,বনে-বাদাড়ে।কখনও পাখির ডিম খুঁজত গাছে গাছে,আবার কখনও পাখির ছানা। বন্ধুদের সাথে অন্যের পুকুর পাড় থেকে ফল চুড়ি করে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। আর শীতের রাতে খেজুর গাছ থেক, রস চুরি করে খাওয়ার তুলনাই হয়্না।ধীরে ধীরে মনের পর্দায় ভেসে উঠত এক এক করে ছোট বেলার বন্ধুরা। বুকের ভিতর একটা চাপা কস্ট অনুভব করত সে।বার বার ফিরে যেতে ইছে হত, আপন গাঁয়ে,আপন দেশে। ক্লাশে প্রায়ই মন মরা হয়ে বসে রইতো সে। বেশ কয়েক দিন ধরেই, ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল অনুরাধা। অনুরাধা রায়। ধনী বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা। এক কথায় যাকে বলে, ধণীর দুলালী। হরিপদর সাথে সে একই বিভাগে পড়ত।কলকাতার আধুনিক মেয়ে সে। তবু কেন যেন,পুর্ব বঙ্গের এই গেঁয়ো ছেলেটির যন্য তার মন কেমন করত। সুযোগ পেলেই সে হরিপদর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলত। আবার কখনও হরিপদর দেশের কথা জিজ্ঞেস করত। কখনও জানতে চাইত, তার বাবা-মায়ের কথা। প্রথমে হরিপদ অনুরাধাকে ভাল চোখে দেখত না। কিন্তু তার ব্যাবহারে ক্রমে ক্রমে সে বুঝতে পারলো, অনুরাধা ছাড়া এই বিদেশ-বিভূইয়ে, তার মনের দুঃখ বোঝার মতো আর কেউ নেই।
ধীরে ধীরে কখন যে হরিপদ, অনুরাধার মনের ফ্রেমে আটকা পড়েছিল, তা সে নিজেও জানত না। অনুরাধাকে পাশে পেয়ে, বেশ ভালই কেটে যচ্ছিল তার দিনগুলো। তবুও তার ফাঁকে-ফাঁকে মনে পড়ে যেত, বাবা-মায়ের কথা, দেশের কথা। মাতৃ ভুমীর যন্য তার মমতার শেষ ছিল না। দুশো বছরের ইংরেজদের গোলামী ছিন্ন করে তার পূর্ব পুরুষেরা পেয়েছিল স্বাধীন দেশ। স্বাধীনতার জন্য কত মূল্য দিতে হয়েছিল তাদের। কত প্রাণ দিতে হয়েছিল বলিদান। ইতিহাসের ছাত্র হরিপদ ভাবতে ভাবতে আত্মহারা হয়ে যেত। কিন্তু এ কোন স্বাধীনতা পেল তারা। এক উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে, আর এক উপনিবেশীদের হাতে বন্দী!এর জন্যেই কি প্রাণ দিয়েছিল তার পূর্ব পুরুষেরা? পাকিস্তানী সাশকেরা পূর্ব বঙ্গকে তাদের উপনীবেশে পরিণত করেছিল।এদেশের পাট,তামাক, চামড়া, চা বিদেশে রপ্তানি করে পশ্চিম পাকিস্তাণের উন্নয়ন করা হত। কল-কারখানা,রাস্তা-ঘাট,দালান- কোঠা গড়ে তোলা হত পশ্চিম পাকিস্তানে। সরকারী চাকুরীর গুরুত্ত পূর্ন পদে অবস্থান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের। একই পদে চাকুরীরত বাঙালীদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছিল বেশি। বাঙালীদের তারা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে দেখত। উর্দুকে তারা পাকিস্তানের একমাত্র রাস্ট্র ভাষা করতে চেয়েছিল। সেদিনও বাঙালীরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে তারা সেদিন মায়ের ভাষার মান রেখেছিল। ১৯৭০ সাল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্তে আওয়ামী লিগ সাধারন নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসী করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মূ্লত স্বাধীনতার ডাক দেন। জাতিকে মুক্তি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ, তাকে উদ্দেলিত করেছিল। দেশের যন্য, দেশের মুক্তির যন্য, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতেও সে প্রস্তুত হয়।
স্মৃতির পর্দায় ভেষে উঠে ক্ষুদিরামের মুখ। স্বাধীনতার জন্য যে হাঁসতে হাঁসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিল। একে একে মনে পড়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, মাস্টার দা সূর্য সেন, তীতু মিরের কথা। তারাও তো দেশের যন্য প্রাণ দিয়েছিল।তবে সে কেন পারবে না? হঠাত যানতে পারে হরিপদ, ২৫ শে মার্চ মধ্য রাতে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকার নিরীহ জনগনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। চালায় নির্মম গনহত্যা। অপারেশন সার্চলাইট! কলকাতায় থেকে সব খবরই পায় হরিপদ।বাঙালীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে, বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। গন মাধ্যমে শুনতে পায় হরিপদ,পূর্ব বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে,নির্বিচারে চলছে গনহত্যা।লুন্ঠিত হছে ধন-সম্পদ। প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে মা- বোনেরা।পূর্ব বঙ্গ থেকে বণ্যার পানির মত স্বরনার্থীরা ঢুকছে পশ্চিম বঙ্গে।মিত্র শক্তি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষন চলছে পুরোদমে। প্রতি দিন শত শত লোক, মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে। ওদের জন্য গর্বে বুকটা তার ভরে উঠতে লাগল। ধন্য মায়ের ধন্য সন্তান ওরা। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে লাগল তার। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না সে।এক দিকে অনুরাধা, অন্যদিকে জন্মভূমী মা। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল সে। ছোট বেলায় কোথায় যেন সে পড়েছিল,‘‘জননী-জন্ম ভূমীচ্, স্বর্গাদপী গরিয়সী।কিন্তু, অনুরাধাকে সে কি বলবে? একবার সে ভাবল, পালিয়ে গেলে কেমন হয়? না! তাহলে যে অনুরাধা অনেক কস্ট পাবে। কিছু না যেনে, ভুলও ত বুঝতে পারে তাকে। এই যাওয়াই যদি তার শেষ যাওয়া হয়? আর যদি কোনদিন অনুরাধার সাথে তার দেখা না হয়? তাহলে তো মরেও শান্তি পাবে না সে। তাই সে অনুরাধাকে সব কিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল। আজ সে বাসা থেকে একটু আগেই বেরোল।বিশ্ববিদ্যালয় গেটেই দেখা পেয়ে গেল অনুরাধার।সামনা সামনি চোখ পড়তেই, হরিপদ তাকে বলল, আজ একটা দিন ক্লাশ না করলে হয় না অনুরাধা?
হরিপদর কথায় অবাক হল সে। আজানা আশঙ্খায় তার বুকটা যেন কেপে উঠল। কম্পিত ওষ্ঠে, অনুরাধা জানতে চাইল, কেন?
হরিপদ আলতো করে অনুরাধার হাত ধরে হাটতে লাগল ক্যামপাশের দিকে। বসল গিয়ে কৃঞ্চচুড়া গাছের তলার খালি বেঞ্চিটাতে। অনুরাধা তাকাল হরিপদর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই হরিপদ চোখ নামিয়ে নিল।কিছুই বলতে পারল না সে। অনুরাধাই শুরু করল,- কি বলবে বল?
-তুমি তো সবই জান অনুরাধা। আমার জন্মভূমী মা আজ ঘোর বিপদে। দেশের জনগন আজ অত্যাচারীত,নিপিড়ীত।তাদের পাশে আজ আমার দাঁড়ান উচিত। আমি মুক্তি যুদ্ধে যেতে চাই।
সব কিছু শুনে, স্তব্ধ হয়ে রইল অনুরাধা।শুধু নিরবে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল, তার দু চোখ বেয়ে। আচলে দুচোখ মুছে, হরিপদর দুহাত ধরে দৃঢ় কন্ঠে বলল,‘‘আমি তোমাকে একটি বারের যন্যও, যেতে নিশেধ করব না। তাহলে যে আমার পাপ হবে। ক্ষুদ্র সার্থের জন্য আমি তোমাকে বৃহত কল্যানের পথে বাধা দেব না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থকব,বিজয়ীর মালা হাতে নিয়ে।তুমি বিজয়ীর বেশে, তোমার স্বধীন দেশের স্বাধীন মাটিত, আমাকে নিয়ে যেয়ো। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় রইব।