এক.
এই সময়ে ভাষা আর কোন প্রতিবন্ধকতা নয়।
এক সময় ভাষার আধিপত্য বিস্তার করার জন্য কত কিছুই না করা হতো। কত শত ভাষা সেই আধিপত্যের কারণে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অল্প প্রচলিত ভাষা গুলো প্রযুক্তি গত উন্নতির সাথে সাথে কোণঠাসা হয়ে পরে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার জন্য। উন্নত প্রযুক্তির দেশের ভাষা গ্রাস করে নেয় অনেক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভাষা। তথাপিও অনেক ভাষাই শেষাব্দি টিকে গিয়েছিল। প্রায় ১৮০ বছর আগে মায়ের ভাষার প্রতি এক অন্য রকম আবেগ দেখিয়েছিল বাংলা ভাষাভাষী। তাদের সেই আত্মত্যাগের ঘটনাটি পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে চিন্তা করতে সহায়তা করেছে। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে তাদের মায়ের ভাষাকে জিইয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছা জাগিয়ে রেখেছে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কিছু মানুষ। যেই বাংলার জন্য এত আত্মত্যাগ সেই ভাষাটিকেও কিন্তু দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল সেই সময়ে। সেই রকম অদম্য কিছু মানুষের ভালবাসায় যুগে যুগে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার জন্য আত্ম ত্যাগের গাঁথা স্ব মহিমায় আজও পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের মনে প্রজ্বলিত। আজও মানুষ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এই বাংলা ভাষাই অতনুর নিজের মায়ের ভাষা, সেজন্য নিজেকে একজন গর্বিত মানুষ মনে করে সে। এসময় পৃথিবীর কোন মানুষকেই একাধিক ভাষা শিক্ষা করতে হয়না। প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোন ভাষাভাষী যে কোন ভাষা বুঝতে পারে এবং মর্মার্থ অনুভব করতে পারে। কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকলেও শিল্প সাহিত্যের রসও সহজেই আরোহণ করা যায়।
অতনু একজন গল্পকার। সারা পৃথিবীতে তার তৈরি করা গল্পের ভীষণ রকম চাহিদা। তার গল্পের উপর ভিত্তিকরে যে কয়টা চিত্রনাট্য হয়েছে, সে গুলোও মার-মার, কাট-কাট ব্যবসা করেছে। পঁয়ষট্টি বছরের এই জীবনে পৃথিবীকে দ্রুত পাল্টে যেতে দেখেছে অতনু। সেই ২০০০ দশকের তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির পর থেকে পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতি সুপারসনিক গতিতে এগিয়ে চলছে। এখন পৃথিবীর সভ্যতা এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, যা কিনা সাধারণ মানুষ দশ বছর আগে কল্পনাও করেনা। এই দ্রুত পরিবর্তনের সাথে মানুষকে তাল মিলিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়। তাই মানুষের জীবন এখন মোটেই সরল নয়, অনেক জটিল এবং অনেক বেশী অনিশ্চিত। এই সকল মানুষের কষ্টের কথা, আনন্দের কথা, অনুভূতির কথা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারে অতনু। তাই তার প্রতি তার ভক্তরা এত বেশী অনুরক্ত।
মানুষ তার শারীরিক ক্ষমতা ব্যবহারের চেয়ে মস্তিষ্ককে এত বেশী ব্যবহার করে যে, তাদের গড় আয়ু অনেক কমে গেছে। অতনুর সম সাময়িক অনেক বন্ধু বান্ধব এখন আর বেঁচে নেই। অতনুও এখন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। যে কোন দিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়া, কিন্তু কোথায়? কেউ জানে না। এখানেই কি শেষ? নাকি এটা অসীম এক জীবনের ধাপ পরিবর্তন। আজ সকালে ঘুম থেকে জেগে তার এপার্টমেন্টের বেলকোনিটা সূর্যের দিকে প্রসারিত করে নিয়ে একটা আরাম কেদারায় বসেছে অতনু। ব্যবহারের সুবিধা অনুসারে এপার্টমেন্টটাকে প্রয়োজন মাফিক পরিবর্তন করে নেয়া যায়। ১৩৫ তালায় তার এপার্টমেন্টের কিছু উপর দিয়েই মেঘ খেলতে খেলতে ভেসে যায়। কখনো কখনো মেঘ নিচে নেমে তার জানালা গলে ঢুকেও পড়ে। আজ মেঘ মুক্ত আকাশ, সূর্য রশ্মি তেছড়া ভাবে তার মুখের উপর আছড়ে পড়েছে। আলোর তেজটুকু আরামদায়ক। তার হাতের কফির মগটাতে চুমুক দিয়ে আরামটুকু নিতে নিতে জীবন আর মৃত্যু নিয়ে এরকমই ভাবছিল অতনু। চমৎকার হিমেল বাতাস বইছে। বাতাসে তার কাঁচা-পাকা চুল গুলো নড়ছে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার ভাবনায় ডুবে গেল অতনু। প্রতিটি মানুষকেই মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিতে হয়। যারা আজ পৃথিবীতে নেই, চলে গেছে মৃত্যুর ওপারে, তাদের সবাই এই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন? লেখক অতনুর মাথায় হঠাৎ ঝিলিক খেলে গেল যেন, কোথাও কি আছে সেই বর্ণনা? কেউ কি সেই বর্ণনা রেখে যেতে পেরেছিল?
কমিউনিকেশন ডিভাইসটাকে সচল হতে বলল অতনু। যে কোন জায়গা থেকেই ডিভাইসটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ডিভাইসটার বুদ্ধিমত্তার মাত্রা ৬। একজন গড়পড়তা মানুষের বুদ্ধির সমান তার বুদ্ধি। ওটাকে অতনু রিরা বলে ডাকে, রিরা দেখত মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে কি কি লেখা আছে?
: যে কোন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নাকি তুমি বিশেষ কোন মৃত্যুর অভিজ্ঞতার বিষয় জানতে চাইছ? মায়াবী এক নারীর কণ্ঠে জানতে চাইল রিরা।
: একটা স্বাভাবিক মৃত্যুর বাস্তব এবং প্রকৃত অভিজ্ঞতা।
ক্ষণিকের মধ্যে অতনুর চোখের সামনে একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিন ভেসে উঠল। অতনু অবাক হলনা। এই রকম প্রকৃত অভিজ্ঞতার কোন বিষয় পাওয়া যায়নি। তবে অসংখ্য কল্প ব্যাখ্যার বিষয় পাওয়া গেল। তার মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়ল অতনু। বৈজ্ঞানিক কিছু ব্যাখ্যাও আছে।
নীল আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘের আবির্ভাব হল। সেখানে চোখ পড়তেই আরাম কেদারায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে উদাস হয়ে তাকাল, মেঘটার খেলা দেখল কিছু সময়। বড় করে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব বুকের ভেতর আবেশের সৃষ্টি হল। ভাবল, আচ্ছা মৃত্যুর প্রকৃত অভিজ্ঞতাটা নিয়েই তো একটা গল্প তৈরি করা যেতে পারে।
দুই.
: রিরা আমি ঠিক করেছি, আমার মৃত্যুর অভিজ্ঞতার বিষয়টি আমি আমার নতুন গল্পে লিখে রেখে যাব। তুমি কি মনে কর? সিদ্ধান্ত টা কেমন?
: তুমি বুদ্ধিমান, তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার কথা। কিন্তু আমার হিসাবে, তুমি তা পারবে সেই সম্ভাবনা অনেক কম দেখাচ্ছে।
: তোমার হিসাব হয়তো ঠিকই আছে।
ভাবনায় ডুবে গেল অতনু। সে কোন বিজ্ঞানী নয়, এটা তার কোন সায়েন্স প্রজেক্টও নয়। অনুভূতিটা তার গল্পের মধ্যেই আঁকতে চায়। যদিও এই নিয়ে গল্পের অভাব নেই পৃথিবীতে কিন্তু সেগুলো সবই কাল্পনিক। তার গল্পে থাকবে মৃত্যুর বাস্তব অভিজ্ঞতা, যেন মৃত্যুর আগেই মানুষ মৃত্যুর স্বাদ সম্পর্কে বুঝতে পারে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা হাসির আভা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। হাসিটা চেপে রাখতে পারল না। শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই অস্পষ্ট স্বরে বলল, মৃত্যুর আগে মৃত্যু...... বলেই আবার শব্দ করে হেসে উঠল।
নার্স রোবটটা ছুটে আসল অতনুর কাছে। কয়দিন আগেই এটাকে কেনা হয়েছে। রিরার চাপা চাপিতেই এটাকে ঘরে তোলা। প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা উপাদান। কাশি দিলে, একটু জোরে হাসলে, অনেক ক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকলেও ছুটে আসে রোবটটা। তাকে নিয়ে নানা কীর্তিকলাপ শুরু করে দেয়। জোর করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, ব্লাড প্রেশার, সুগার মেপে নিয়ে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করে। খাবারের আগে তার গুনাগুণ বাছাই চলতে থাকে। এটা খাওয়া যাবেনা, এটা খাও। আরে কি মহা জ্বালা!
রোবটটার চেহারা দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে উঠল অতনু। চিৎকার করে বলল, “রিরা এটাকে এখান থেকে এখুনি সরে যেতে বল, নয়তো আমি এর পাওয়ার সার্কিট ছিঁড়ে ফেলে দেব।”
: আমার করার কিছু নেই অতনু। তুমি ওর কথা শোন। ওকে ওর কাজ করতে দাও।
: ওফ! জ্বালা.....।
রোবটটা অতনুকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল, “চুপচাপ শুয়ে থাক। বিশ্রাম নাও। তোমার রক্ত চাপ কিছুটা বেড়েছে। যা নিয়ে ভাবছিলে তা একদম ভুলে যাও।”
প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেল অতনু, বুঝতে পারছে তার ব্লাড প্রেশার অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সে অন্য কোন কারণে নয় রোবটটার কারণেই। এই হারামজাদীকে ঝাটিয়ে বিদায় করার জন্য মনস্থির করে ফেলল অতনু।
তিন.
নার্স রোবট টাকে তার ম্যনুফেকচারারকে বলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ওর স্বাস্থ্য এখন পর্যন্ত এমন খারাপ হয়ে যায়নি যে তার একটা নার্স দরকার। পরে আবার দরকার হলে ওদেরকে জানানো হবে বলে ওদেরকে আসস্থ করেছে।
: কাজটা তুমি ভাল করনি। তোমার একজন সাহায্যকারী দরকার।
: কোন কাজটা? রিরা কথাটা ধরতে না পেরে জানতে চাইল অতনু।
: নার্সটাকে ফেরত পাঠানো দরকার ছিল?
: ওটা থাকলে আমাকে আমার কাজ করতে দিবে না, তুমি বুঝতে পারছ না।
: ও তোমার কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটায় নি। তুমি শুধু শুধু ওর উপর চটেছ।
: যাক এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে আমি আর আলোচনা করতে চাইনা। আমাদের কাজ হচ্ছে, আমি যে গল্পটা তৈরি করতে চাইছি তা সাজিয়ে নেয়া।
নিজের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা দিয়েই গল্পটা তৈরি করতে চায় অতনু। রিরার সাথে পরিচয়ের মজার পর্বটা দিয়েই গল্পটা শুরু করল অতনু। তার কানের পেছনে চামড়ার নিচে একটা ন্যানো চিপ বসানো আছে সেটা তার মস্তিষ্কের সাথে রিরার মেমোরির সিংকোনাইজেশন করা আছে। সে তার মাথার মধ্যে গল্পটা সাজিয়ে নিচ্ছে, রিরা সেটা তার মেমরিতে সংরক্ষণ করতে থাকল। গল্প তৈরির সময় রিরা সাধারণত কোন রকম প্রশ্ন করে না, কিন্তু আজকে অতনুকে প্রশ্ন না করে পারল না, “রিরার সাথে প্রথম পরিচয় বলছ কেন, তোমার বান্ধবীর নাম তো ছিল রিওনা।”
: হুম্ রিওনা। কিন্তু ওকে আমি রিরা বলেই ডাকতাম। তোমার নামটা ওর নাম থেকেই দেয়া হয়েছে। ওর কণ্ঠস্বরটাই তোমার ভয়েস হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তুমি জান, ও ছিল একজন বিজ্ঞানী। তার ল্যবে ভয়ানক এক দুর্ঘটনায় ও এবং ওর দুই সহকর্মী মর্মান্তিক ভাবে মারা যায়। আমি কোন ভাবেই মানতে পারছিলাম না ও আর আমার সাথে নেই। কিন্তু আমি ভাবতে চাই, রিওনা সব সময় আমার সাথে সাথেই আছে। তাই তোমাকে বিশেষ ভাবে তার মত করেই তৈরি করা হয়েছে।
কথা গুলো বলতে বলতে, অতনুর চোখ ভিজে উঠল। রিরা মানুষের আবেগ কি বুঝতে পারে না, কিন্তু অতনুর চোখের পানি যেন তাকেও একটু নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
রিওনার সাথে অতনুর মজার, আনন্দের এবং মনমালিন্যের অনেক চমকপ্রদ ঘটনা দিয়ে গল্পটাকে একেবারে জীবন্ত করে তুলছিল অতনু। রিরা বুঝতে পারছে, নিঃসন্দেহে এটা একটা দুর্দান্ত সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। রিওনা সব সময় একটা ফুটফুটে শিশুর স্বপ্ন দেখত। তারা পরিকল্পনা করেছিল, শিশুটাকে নিয়ে সুন্দর একটা ঘর তৈরি করবে। সব কিছুই প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। একটা দুর্ঘটনা সব এলোমেলো করে দিল। রিওনার সেই দুর্ঘটনার বিষয়টি এমন চমৎকার ভাবে বর্ণনা করল অতনু যেন, সে দুর্ঘটনার সময় ওর সাথেই ছিল। দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে জখম রিওনার, কষ্টের অনুভূতি গুলো এমন ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠল যেন কষ্টটা অতনু নিজেই অনুধাবন করেছে। গল্পটা সাজাতে অতনুর কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিল রিরা।
এই পর্যন্ত গল্পটা সাজিয়ে অতনু অনেক বেশী বিমর্ষ হয়ে পড়ল। দুই দিন আর গল্পটা নিয়ে বসল না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়াও করল না। দুই দিন বাদে আবার গল্পটা নিয়ে বসল অতনু। তার একাকী জীবনের গাঁথা। গল্প তৈরি করা, মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার বর্ণনা। গল্পটা সাজাতে সাজাতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। রিরা তাকে থামিয়ে বলল, “অনেক রাত হয়ে গেছে, তুমি কি একটু বিশ্রাম নিবে?”
: হুম্, ঠিকই বলেছ। বুকের ডান পাশে একটু ব্যথাও অনুভব করছি। এখন ঘুমানোটাই মনে হয় ঠিক হবে।
তিন.
রিরা অতনুর শেষ অসমাপ্ত লেখাটা অতনুর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকাশের ব্যবস্থা নিল। গল্পের পরিশিষ্ট হিসাবে, অতনুর শেষ কথা গুলো জুড়ে দিল।
: রিরা।
: শুভ সকাল অতনু। তোমার শরীরটা এখন কি ভাল লাগছে?
: বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, ভীষণ ঘুম। গল্পটা নিয়ে তোমার সাথে পরে বসব।