অবান্তর প্রশ্ন

প্রশ্ন (ডিসেম্বর ২০১৭)

হাবিব রহমান
মোট ভোট ৩১ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৭৬
  • ২৮
  • ৪১
এক.

: একটা প্রশ্ন করবো বাবা?
: কি প্রশ্ন, বল?
: আমরা মানুষ না রোবট?
: তোমার কি মনে হয়?
: আমার মনে হয় আমরা মানুষ, নইলে আমাদের এত কষ্ট কেন?

ছোট বাচ্চাটার মুখের কথায় অনেক কষ্ট পেল আবির। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে পাশের দেশের এক জঙ্গলের কাছে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে ওরা। কোন দেশে সংখ্যা লঘু হয়ে থাকা বড়ই যাতনার বিষয়। অধিকার নেই, নেই বেঁচে থাকার অবলম্বন। ওখানকার সংখ্যা গুরু দলের লোকেরা তাদের উপর লেলিয়ে দিয়েছে কত গুলো যান্ত্রিক দানবকে। রোবট সৈনিকেরা পুড়িয়ে দিয়েছে সংখ্যা লঘুদের গ্রাম একে একে। গুলি করে মেরেছে যাকে সামনে পেয়েছে। কিশোরী আর কম বয়স্ক নারীদের কে ধরে নিয়ে গেছে মানুষ জেনারেলদের উপভোগের সামগ্রী সরূপ। ওরা এখন দেশহীন মানুষ। আবির বুকের কষ্টটা চেপে কোন রকম বলল,
: ঠিক বলেছো বাবা আমরা মানুষ। এ জন্যই আমাদের এত কষ্ট। আমাদের খাবার খেতে হয়। বেঁচে থাকতে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়।
: রোবটরা এত ভাল থাকে কেন বাবা।
: পৃথিবীতে ওদের এখন অনেক সুযোগ সুবিধা। ওদের ধর্ম বিশ্বাস করতে হয় না। ওদের কোন গোত্র নেই, শ্রেণী নেই। ওরাও সাংবিধানিক ভাবে নাগরিক। কিন্তু দেখো আমরা ধর্ম মানি বলে, আমদের আজ দেশ ছাড়তে হলো।

ওরা যে গ্রামে থাকতো রাষ্ট্রীয় ভাবে সেখানে কোন বিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট বা কোন ধরনের সরকারী সুবিধা ছিল না। বর্বরের মত বসবাস করতো ওরা। সরকার চাইতো না ওরা শিক্ষিত হোক। চাইতো না শিক্ষিত বেকারে দেশ ভরে যাক। নাগরিকের তালিকায় নাম না থাকায়, দেশে দরিদ্রও তেমন ছিল না। এই সব দরিদ্র দের বেসিক নিড ফুলফিল করতে গেলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয়ে যাবে। এত কর্ম সংস্থান কোথা থেকে হবে? অথর্ব মানুষ দিয়ে তো আর প্রতিষ্ঠান চলে না। বাজারে সহজেই কিনতে পাওয়া যায় ডাইনামিক, ফেবুলাস সব রোবট। মানুষ শ্রমিক লাগবে কেন রাস্তায় চলছে স্ব চালিত গাড়ী, ট্রেন। কিছু মেজর, আর জেনারেল ছাড়া পুলিশ বা সেনাবাহিনীতেও মানুষ নেয়া হচ্ছে না। মানুষের যেন আর প্রয়োজনই নেই।

আবির নিজের পরিচয় গোপন করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়েছে। ফিরে এসেছে গ্রামে এই সব নিঃস্ব লোক গুলোকে শিক্ষার আলো দিতে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে, সে সম্পর্কে বিন্দু মাত্র ধারণা নেই এই দেশ হীন মানুষ গুলোর। স্ব-উদ্যোগে একটি স্কুল বানিয়েছিল ও। সেখানেই গুটি কতেক ছেলে মেয়েকে পড়াতো। চেষ্টা করতো পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা দিতে।

যে দেশের জঙ্গলে ওরা আশ্রয় নিয়েছে সেখানে কয়দিন যাবত তারা মানবিক সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে সরকারকে সেজন্য ভীষণ সমস্যায় পরতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সেটা করার জন্য অনুমোদন পাচ্ছে না। অন্য কোন দেশও সহায়তা করতে নারাজ। বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে কেউ কোন কথা বলছে না। ওর নিজের দেশও কোন ভাবেই তাদেরকে ফিরিয়ে নেবে না।

আজকে রিলিফের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিল ওরা। কেউ আসেনি রিলিফ নিয়ে। যে সকল রোবটেরা পাহারা দিচ্ছিল, তাদেরকেও কোথাও দেখা যায়নি আজ। তার মানে ওদেরকে বাঁচানোর দায় নিতে এরাও নারাজ। শরণার্থী শিবিরে যে খাদ্য গুদাম ছিল সেখানে হানা দিয়েছিল ক্ষুধার্ত মানুষ গুলো। আজ সেখানে কেউ পাহারায় নেই। খাদ্যও তেমন নেই। যা কিছু ছিল তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত লেগে গেল। নিজেরা নিজেরা সংঘাতে মরা পড়লো কত গুলো অসহায় মানুষ। আবির কোন রকমে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে পালাতে পারলো সেইখান থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয় যারা মরে গেল হয়তো তারাই বেঁচে গেল। পশুর মত বাঁচার চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভাল। কিন্তু ওকে বাঁচতে হবে শুধু মাত্র ঋভু’র জন্য। জন্মাবধি নৃশংসতা দেখে চলছে মা মরা অবোধ শিশুটি।

সন্ধ্যা রাতে ক্ষুধায় কাঁদতে শুরু করেছে ঋভু। বস্তা পেটরা থেকে খুঁজে পেতে কিছু বিস্কুট পাওয়া গেল। ক্ষুধার্ত ছেলেটা সেগুলো খেয়ে ওর শরীরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অবহেলায় ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে। খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, গোছল নেই, পরনের পোশাক ময়লা হয়ে গেছে। কালে সকালে ছেলেটার মুখে কিছু দিতে পারবে কিনা কে জানে? ঘুমন্ত ছেলের মলিন চেহারা দেখতে দেখতে হাত দিয়ে চুল গুলো নাড়িয়ে দিচ্ছিল। চোখ ভিজে উঠলো, কান্না চেপে রাখতে চেষ্টা করল, পারলো না ডুকরে কাঁদলো আবির।

মানুষের মায়া, মমতা বিষয় গুলো এখন আর নেই। কারণ তারা তৈরি হয় ল্যাবে, বেড়ে উঠে পরিচালনা কেন্দ্রে। বিত্তবান লোকেরা নিজেদের ভ্রূণ বিন্যাস করে নিজেদের উত্তরসূরি তৈরি করে। ওদের ভাষায় এরা নিখুঁত মানুষ। ধর্ম ও বিভেদকে তারা জিনের মধ্যে ধারণ করে। মায়ের পেটে জন্মে মা-বাবার ভালবাসায় বেড়ে উঠে যারা ওদেরকে ওরা বলে আদিম বর্বর। আবির ওদের সাথে মিশে এটাই বুঝতে পেরেছে। আবির বুঝতে পারে না কেন মানুষ এমন হয়ে গেল? নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তর খুঁজে পায়নি সে। এই সব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

সাইরেনের শব্দ আর তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঘুম থেকে জেগে উঠল। মাথার উপর দিয়ে আলো জ্বালিয়ে শাই শাই করে উড়ে গেল কয়েকটা ড্রোন শিপ। ছেলেটাও ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলো, ভয়ে বাবাকে জরিয়ে ধরে আছে। আবির দেখতে পেল গাছ পালা ভেঙ্গে কিছু যন্ত্র যান এগিয়ে আসছে, সার্চ লাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো এলাকা। ভীত কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ গুলো বজ্রাহত হয়ে স্থির দাড়িয়ে সেগুলোকে আসতে দেখছে। যন্ত্র যান গুলোর সামনে হেটে আসছে বিশাল দেহী কতগুলো রোবট। তাদের হাতে ভয়ংকর দর্শন একেকটা অস্ত্র। মানুষ গুলোর কাছে এসে হাতের অস্ত্র তাক করে আগুনে শিখা ছুড়ে মারলো। পিছনের যান গুলো থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকলো। গুলি বিদ্ধ মানুষ গুলো মাটিতে লুটিয় পড়লো, অন্যরা দিক্বিদিক ছুটাছুটি শুরু করে দিল। আবির ঋভুকে কোলে তুলে ছুটলো সামনের নদীটার দিকে। পিছন ফিরে যা দেখলো তা দেখার মত নয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া লোক গুলোকে আগুনে ভস্ম করে ফেলা হচ্ছে। কোন নিশানা যেন না থাকে। শিশু, কিশোর, মহিলা, বৃদ্ধ কেউ রেহাই পেল না। পুরো দলটাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্যই যেন পাঠানো হয়েছে এদেরকে।

আবির দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়েই নদীতে ঝাঁপ দিল। যে কোন উপায়ে অন্য প্রান্তে যেতে চায় সে। সরু নদী হলেও নদীতে প্রবল স্রোত। আরো অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে বাঁচার তাগিদে। পানিতে হুড়াহুড়ি লেগে গেল। আবির ছেলেটাকে ঝাপটে ধরে প্রাণ পণে সাঁতরে দূরে চলে যেতে চাইছে। নদীর স্রোতের সাথেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে ওকে। এক হাতে ঋভুকে ধরে এক হাতে সাঁতরে যাওয়া দুরূহ। ছেলেটাও দুই হাতে যার পর নাই শক্তিতে ধরে রেখেছে বাবাকে। সেই ড্রোন গুলো তীক্ষ্ণ আলো জ্বালিয়ে নদীর উপরে উড়ে এলো। সেগুলো থেকে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকলো। আরেকটা ড্রোন এসে দাহ্য তরল ছিটিয়ে দিল পানির উপরে। আগুন ধরিয়ে দিতেই নদীটা পরিণত হলো আগুনের নদীতে। এটাই যেন ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখিত নরক প্রকৃত রূপ। আবির ততোক্ষণে নদীর তীরে চলে এসেছে। আরো মানুষ হুড়মুড় করে তীরে উঠার চেষ্টা করছে। ভীত মানুষ গুলোর কোন হুশ জ্ঞান নেই। কেউ একজন ধাক্কা দিল ওকে। সজোরে ধাক্কাটা সামলাতে পারলনা, হাত থেকে ছুটে গেল ঋভু। প্রচণ্ড পানির স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেল আড়াই বছরের কোমল দেহ টাকে। আবির অন্ধকারে হাতড়াতে থাকল, চিৎকার করে ডাকছে ছেলে টাকে। পানির স্রোত তাকেও ভাসিয়ে নিতে থাকলো। বেঁচে থাকার একমাত্র স্পৃহাটাকেও হারিয়ে ফেলল।


দুই.
বনের মাঝে নদীটার তীক্ষ্ণ বাঁকটাতে সকালের কাঁচা রোদ যখন এসে পড়ল সোনার আলোয় ঝলমল করে উঠলো চারদিক। নানা রঙের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে পাতা কাঁপার শব্দ, আর তাদের কলরব। ভাটার টানে পানি নেমে গেছে। জেগে উঠেছে কর্দমাক্ত নদীর দুই পাড়। সেখানে ডাহুক, কানা বগেরা হেটে হেটে শামুক কুড়িয়ে খাচ্ছে। ওদের কিছুই আসে যায়না যদিও কাঁদার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে কত গুলো লাশ। একটা ডাহুক ঝট করে উড়ে পালালো। তার সাথে আরো কয়টা কানা বক ডানা ঝাপটা দিয়ে উড়ে চলে গেল। কিছু একটা নড়ে উঠেছে।

আবির! আবার একটু নড়ে উঠল। শরীর কাঁদা পানিতে একাকার হয়ে আছে। অবশিষ্ট শক্তি টুক দিয়ে কোন রকমে উঠে বসলো। হঠাৎ গত রাতের কথা মনে হতেই, ঝট করে উঠে দাঁড়াল। বিশ্বাস হচ্ছেনা সে বেঁচে আছে। বৃষ্টির মত গুলি, আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে থেকে সে বেঁচে আসতে পারবে ভাবতেই পারে নি। বাঁচার চেষ্টাও সে করে নি। ঝিঙুর জন্য ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডানে বামে ঋভুকে খুঁজতে থাকলো। কিছু দূরে একটা শিশুর লাশ দেখে দৌড়ে গেল, হাঁটু গেড়ে বসে শিশুর শরীরটা কোলে তুলে নিলো। নিথর শরীরটা বুকের মাঝে চেপে ধরল। পরম মমতায় তাকে মাটিতে শুইয়ে দিল। ভাল করে দেখলো, এ ঋভু নয়। ঋভুর বয়েসি একটি শিশু। আবির কাঁদার মধ্যে হেটে হেটে লাশ গুলো দেখছে। হাটতে কষ্ট হচ্ছে পা ডুবে যাচ্ছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত।

কাঁদায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একটা শিশু, ঋভু! আবির চিনতে পারল তার পড়নের কাপড় দেখে। মুখটা ডুবে আছে কাঁদার মধ্যে। কাছে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, পা গুলোকে টেনে নিতে পারছে না। হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে কোন রকমে পৌঁছল ছেলেটার কাছে। টেনে তুলল, কোলে তুলে ছেলেটার মুখের দিকে তাকলো। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে প্রবল ক্রোধে বিধাতাকে প্রশ্ন করলো, কেন? কেন? কি চাও তুমি?

বিধাতার কাছে এই সব অবান্তর প্রশ্ন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রণতূর্য ২ ভালো লেগেছে :)
কাজী জাহাঙ্গীর অনেক অনেক অভিনন্দন
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৮
রতন কুমার প্রসাদ কনগ্রাচুলেশনস!
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০১৮
সেলিনা ইসলাম অনেক অনেক অভিনন্দন রইল।
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অনেক অভিনন্দন।
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮
মাইনুল ইসলাম আলিফ অনেক অনেক অভিনন্দন প্রিয় হাবিবুর রহমান ভাই।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৮
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮

১৬ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৩২ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৭৬

বিচারক স্কোরঃ ৩.৬৯ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.০৭ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪