শেষ বিকেলের মেয়ে

প্রিয়ার চাহনি (মে ২০১২)

তানজির হোসেন পলাশ
  • ২৩
  • ৬৬
বিকেল তিনটা। চৈত্র মাস বলেই হয়ত রোদ্রের প্রখরতা বিলীন হয়নি। সরু রাস্তা। লোকজন নেই বললেই চলে। অবশ্য দু-চার জন বখাটে ছেলে তার ব্যতিক্রম। ওদের কাছে রোদ-বৃষ্টি একই কথা। আর সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার পার্থক্য তো মাতৃগর্ভ থেকেই ভুলে গেছে। রাস্তার আশে পাশের দু-একটা দোকান খোলা আছে। দোকানী ঝিমুচ্ছে। ঝিমানি কাটিয়ে নড়ে চড়ে বসে রোদের ঝলকে। দুই আঙ্গুলে চোখটা পরিষ্কার করে তাকিয়ে থাকে যতদূর চোখ যায়। সরু রাস্তা দিয়ে আসছে এক সুদর্শিনী। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, সোনালী-কালো বর্ণের কেশরাজি বিন্যস্ত হয়েছে কোমর পর্যন্ত। নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে চলেছে রাস্তার ধূলাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে। পেছন থেকে দেখে মনে হয় বহুপথ হেঁটে সে বোধকরি কিছুটা ক্লান্ত। অথচ চেহারায় তার ক্লান্তির ছাপ নেই বিন্দুমাত্র। বরং তার অদ্ভুত হাসি জানিয়ে দেয় বিধাতার সৃষ্টিতে সে পরিপূর্ণ। চন্দ্রের কলঙ্ক আছে বলেই তার নাসিকায় আশীর্বাদের ছাপ।
মেয়েটির বয়সের ঠিকানা খুঁজে না পেলেও বয়:সন্ধিকালের পরিপূর্ণতা তার দেহকাঠামোতে বিদ্যমান এটি হলফ করে বলা যায়। সরু গলির এক পাশ দিয়ে হাঁটছে মেয়েটি। চেহারায় যে অন্যমনস্ক। সামনের কয়েকটা চুল মৃদু বাতাসে মুখমণ্ডলে খেলা করছে। রাস্তার ওপাশ দিয়ে তিনজন যুবক আসছে। বর্ণনায় যারা বখাটে। হাতে মোবাইল। বাবার অন্ন ধ্বংস করা ক্যামেরা মোবাইল। মেয়েটিকে দেখামাত্রই ক্যামেরা অন করে তাদের মধ্যে একটি ছেলে। ওরা মেয়েটির কাছাকাছি আসতেই ক্লিক শব্দ সৃষ্টি হয়। মৃদু আলোর ঝলকানিতে ক্যামেরা বন্দি হয় হাস্যোজ্জ্বল মুখের অবয়ব। তখনো সম্বিত ফিরে পায়নি মেয়েটি। ওকে পেছনে ফেলে ছেলেগুলো হাসাহাসি করছে মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে। যেখানে আঁকা হয়ে গেছে নিষ্পাপ মুখের ছবি।
এ দৃশ্য চোখের অগোচরে না হওয়ার কারণে মেয়েটিকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারল না তন্ময়। পেছন থেকে দ্রুত হাঁটল মেয়েটিকে দেখার উদ্দেশ্যে। কয়েক কদম যেতে না যেতেই চোখের আড়াল হয়ে গেল স্বপ্ন হরিণী। মেয়েটিকে না দেখলেও বাড়ি চিনতে ভুল হল না তন্ময়ের। মূহুর্তের মধ্যেই বদলে গেল তন্ময়ের দৈনন্দিন রুটিন। শুরু হল জীবনের প্রথম অনিয়ম। খাওয়া থেকে শুরু করে লেখাপড়া, ঘুম, কলেজে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, এমন কি কথা বলাতেও অনিয়ম তন্ময়ের।
ছেলের হঠাৎ এই পরিবর্তনে চিন্তিত তন্ময়ের বাবা মা। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেই বলে কিছু না। আমি ঠিক আছি। আর একটুতেই রেগে ওঠে। কোন কারণ ছাড়াই গতকাল ছোট বোন তানিয়াকে বেদম মেরেছে তন্ময়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। তবুও কাউকে কিছুই বলেনি। এখন তন্ময়ের সারাটি দিন কাটে গলির মুখের ঐ বাড়িটার সামনে। যদি এক নজর দেখতে পারে এই আশায় অপেক্ষা করে সকাল-সন্ধ্যা। কোন মেয়েকে গলিতে দেখলেই দৌড়ে যায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। কিছুতেই মেলাতে পারে না কল্পনার সুদর্শিনীর সাথে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ছবি বারবার।
আকাশী রং মাখা স্যালোয়ার কামিজ, সোনালী-কালো বর্ণের কেশরাজি, গলায় প্যাঁচানো ওড়না নামের এক খণ্ড কাপড়, কপালে তারকা খচিত নীল টিপ, ঠোঁটে কমলার মত লিপস্টিক, দু'হাতের আঙুলিতে মেহেদীর পরশে হৃদয় খচিত আংটি, সামনের কয়েকটি চুল কপোলের স্পর্শ পেতে মরিয়া, চোখ যেন মৃত গোলাপ পাপড়িতে আবৃত জীবন্ত আলোক বর্তিকা আর নাসিকা তো বিধাতার পদতলে সুযোগহীন বেড়ে ওঠা বাঁশি।
অপূর্ব মানবীর হাসিতে থমকে যায় পৃথিবী। তার পায়ের শব্দে কুর্নিশ করে রাস্তার দু'পাশের গাছ-পাখি। হাসির মাধুর্যে বিলীন হয়ে যায় পাখিদের গান। রূপের জ্যোতির কাছে হার মানে সূর্য কিরণ। আর নূপুরের ঝংকার যেন আহ্বান করে পূর্ণিমা চাঁদকে।
তন্ময়ের কল্পনার রাণী যে এত কাছে এসেও হাতছাড়া হয়ে যাবে এ কথা ভাবতেই তছনছ হয়ে যায় ওর বাস্তব রাজ্য। ভুলে যায় পৃথিবীর সাথে ওর সম্পর্কের কথা। তবুও বেঁচে থাকার তাগিয়ে দু'মুঠো ভাত খাওয়া। ঘুমোনোর চেষ্টা করা। আর বাবা-মায়ের মন রক্ষার্থে কলেজে যাওয়া। যন্ত্রের মত একই ভাবে চলছে তন্ময়ের জগত।

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই সত্যপলব্ধি তন্ময়ের জীবনকে নিয়ে এসেছে তিন মাসের আত্মবিসর্জন শ্বশানে। বিকেলের সময় পার হওয়ার উপক্রম। বিষণ্ণ চিত্তে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়। পাশের মাঠে ওর বন্ধুরা খেলায় মগ্ন। যেখানে তন্ময়কেও দেখা যেত তিন মাস আগে। বিগত তিন মাস যাবত তন্ময়ের জন্য ছাদ রিজার্ভ করা হয়েছে। বৃষ্টি-বাদল কখনোই ওর একাকীত্বকে বরণ করতে পারেনি।
পশ্চিমাকাশে আলোর স্বর্ণালী আভা থাকলেও মূহুর্তের জন্য তা তন্ময়ের দু\'চোখে ঝিলিক দিয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি চলে গেল দূরের রাস্তায়। হেঁটে আসছে দুইটি মেয়ে। একজন তন্ময়ের ছোট বোন তানিয়া। অন্যজন .......... ?
ওর হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়া সেই আকাশী স্যালোয়ার কামিজ, সোনালী-কালো বর্ণের চুল, কপালে নীল টিপ, কমলার আবরণে আবৃত ঠোঁট, হালকা বাতাসে কপোলের উপর খেলা করছে কয়েকটি চুল। অদ্ভুত মিল কল্পরাজ্যের সুদর্শিনীর সাথে। তানিয়ার সাথে মেয়েটি আসছে ওদের বাড়ির দিকে। অস্থির তন্ময়ের দৃষ্টি। ইচ্ছে করে ছাদ থেকে লাফ দেয় মেয়েটির সামনে। কিন্তু পারে না বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মেয়েটি তানিয়ার সাথে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। আনন্দে আত্মহারা তন্ময়। হৃৎস্পন্দন বেড়েই চলেছে ওর। ছাদ থেকে এক দৌড়ে নিচে নেমে আসে। সোজা তানিয়ার রুমে। এসেই থমকে দাঁড়ায় দরজার সামনে। কি বলবে ভেবে পায় না তন্ময়। তিন মাস তানিয়ার সাথে কথা বলেনি তন্ময়। সেই ভাইয়াকে দেখে অস্থির হয়ে জড়িয়ে ধরে তানিয়া। দু'জনের চোখে আনন্দের অশ্রু। এরই মধ্যে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে। মেয়েটি এতক্ষণ অবলোকন করছিল ভাই-বোনের মধুর সম্পর্ক। এবার সুললিত ভঙ্গিতে বলল,
: আমি এখন যাই রে তানিয়া।
তন্ময়ের কানে যেন কোকিলের আগমনী বারতা বেজে ওঠে। তানিয়াকে ছেড়ে দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মুখে হাসির আভা টেনে মেয়েটি বলে,
: দেখ তানিয়া, তোর ভাইয়া ............... ।
মেয়েটিকে থামিয়ে দিয়ে তন্ময় বলে,
: দুঃখিত । আসলে ................. ।
: ভাইয়া, তোমার আর সাফাই গায়তে হবে না। পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে আমার ভাইয়া। আর ও আমার বান্ধবী ............. ।
তানিয়াকে থামিয়ে দিয়ে তন্ময় বলে,
: তানিয়া, সুন্দর মুখে সুন্দর নাম ভালো শোভা পায়।
: ঙ.ক। আমি তাহলে আসছি। তোমরা নাম জানাজানি কর।
তানিয়া রুম থেকে বের হয়ে যায়। ঘরে আর কেউ নেই। তন্ময় আর একটি অপরিচিত মেয়ে। এভাবে কখনো তন্ময়কে দেখা যায়নি। তবুও আনন্দের বন্যা বইছে তন্ময়দের বাড়িতে। ছেলে তার স্বাভাবিক। তন্ময় একভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। আর মেয়েটি লজ্জাবনত হয়ে মাঝে মাঝে দেখছে তন্ময়ের দৃষ্টটা। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মেয়েটি। তানিয়ার কাছে ওর ভাই সম্পর্কে সবই শুনেছে। দেখার খুব সাধ ছিল। আজ তা পূরণ হয়েছে। এখন কি করবে ও ? ভেবে কূল পাচ্ছে না। এর মধ্যে অবশ্য তানিয়া এসে দরজার ওপাশ থেকে দেখে গেছে ওদের দৃশ্য। এভাবে বসে থাকাতে মেয়েটি ইতস্তত বোধ করে। তবু সাহস করে বলে,
: আপনি তখন নাম শুনতে চেয়েছিলেন। আমি তানিয়ার বান্ধবী তমা।
: তমা! মানে প্রিয়তমা। বেশ সুন্দর নাম তো। একেবারে বর্ণনায় অপূর্ব, অন্য মনষ্কভাবেই বলল তন্ময়।
: কি বললেন ?
তন্ময় কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে,
: না, না। কিছু না। বলছিলাম যে, আপনি তমা। বেশ সুন্দর নাম। আপনার সাথে নামের অতুলনীয় মিল। বিধাতার আশীর্বাদের সাথে সুর মেলাতে ভুল করেননি আপনার বাবা-মা।
: তা না হয় করেন নি। কিন্তু আপনি যে ভুল করছেন বারবার।
: হয়ত অজান্তে।
: জী না। আপনার নিশ্চয় জানা আছে আমি তানিয়ার বান্ধবী। আপনার কাছে তুমি হওয়ার যোগ্য।
তন্ময় মনে মনে ভাবে আমি তো তোমাকে 'তুমি' করতেই চাই।
: কি ব্যাপার, কিছু বলছেন না যে?
: হয়ত বলার নেই। কিংবা তুমি বললেই পৃথিবী থমকে যায়। আমার কথা কে শোনে?
: আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।
: আর সুন্দর করে কথা বলতে হবে না। তানিয়া নাস্তা নিয়ে এসেছে, তানিয়া কর্কশ গলায় বলে।
তন্ময়ের মনে হচ্ছে তানিয়াকে খুন করে এখনই কবর দেয়। এত সুন্দর একটা মূহুর্ত নষ্ট করে দিল। ওর চোখের রঙিন আলো নিভিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে থাকতে ভাল লাগল না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে রঙিন জগতের স্বপ্ন রচনা করে তন্ময়।

ভোরের আলো তন্ময়ের স্বপ্ননিদ্রা কেড়ে নিলো। বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেল। ফ্রেস হয়ে মাকে ডেকে খাবার খেয়ে কলেজে গেল। কলেজে বন্ধুদের সাথে আড্ডা চলল। সকলকে চা অফার করল। বিকেলে খেলার মাঠে। ঠিক তিন মাস আগের তন্ময়। তমার বদৌলতে তন্ময়ের এই কাম ব্যাক। স্বাভাবিক ভাবেই তমাকে দৈব বাণী ভাবতে শুরু করেছে কেউ কেউ। বিশেষ করে তন্ময়ের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব। পারিবারিকভাবে তমাকে আসা যাওয়ার অধিকার দিয়েছে তন্ময়ের পরিবার। অথচ তমাকে কোন কিছুই আঁচ করতে দেয়নি। প্রায় প্রতিদিন একবার করে আসে তমা। তমাকে একদিন না দেখলে অস্থির হয়ে যায় তন্ময়। আর তন্ময়ের মা জিজ্ঞাসা করে কাল আসনি কেন, শরীর খারাপ হয়েছিল কি না, তন্ময়ের সাথে রাগারাগি হয়েছে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তমাকে। যা ওর ভাল লাগে না। এজন্য অবশ্য চার পাঁচ দিন রাগ করে আসেনি তমা। তারপর তন্ময়ের মা গিয়ে নিয়ে আসে তমাকে। তারপর থেকে সে নিয়মিত। কখনও সকাল, কখনওবা বিকেলে তন্ময়দের বাড়িতে দেখা যায় তমাকে।
এ জগতের কেউই ষোল কলায় পূর্ণ নয়। সকলেই সৃষ্টি রহস্যের বেড়াজালে বন্দি। তমার সৌন্দর্য নজর কাড়ার মত হলেও বিদ্যা দেবীর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত মেয়েটি। তা না হলে এবার এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত সে। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই সৌভাগ্যে অর্জনে তার আরও কয়েক বছর লাগবে। এবার অবশ্য গতবারের মত একই ক্লাসে ড্রপ করতে হবে না। আগের তুলনায় তমা পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী। ওর এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে তন্ময়ের মাধ্যমে। তন্ময় ওর বাসার শিক্ষক। তমা তন্ময়কে স্যার বলে ডাকে। তন্ময়ের ভীষণ লজ্জা লাগে নিজেকে স্যার ভাবতে। তবুও তমা তো। ওর সব কিছুই তন্ময়ের ভাল লাগে। অবশ্য তন্ময় জানে সব ভাল লাগার একটা মাত্রা থাকে। ইদানীং তমার চঞ্চলতা বেড়েই চলেছে। যার মধ্যে ওর অতিরিক্ত কথা বলা অন্যতম। তন্ময়দের বাসার সব কথা বাবা-মার সাথে শেয়ার করে তমা। এমন কি তন্ময়কেও সবই বলে। না শুনতে চায়লেও বলে। এটা অবশ্য তমার ছেলে-মানুষীর বহি:প্রকাশ। তবুও তন্ময় কেন জানি মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রেগে যায় তমার উপর। ঘৃণা করে তমার কার্যকলাপ। আবার ভাল লাগে।

সব রাতে পূর্ণিমা চাঁদ ওঠে না। উঠলেও সবার কাছে ভাল লাগে না সব সময়। নিষেধাজ্ঞা না শুনে বলতে চাওয়া ভাল লাগেনি তন্ময়ের। তাই তমাকে বেশ বকেছিল তন্ময়। কিন্তু ও জানত না তমা এতটা আপসেট হবে। তমার মুখে হাসি ছাড়া কোন কথা শোনেনি তন্ময়। সেই তমার কান্নার শব্দ! এ যেন মৃত মানুষের কথা বলা। ওর কান্নার সৃষ্টি তন্ময়ের দেওয়া কষ্টে- তা ভাবতে পারে না তন্ময়। তমার কান্নার শব্দে স্থবির হয়ে গেছে সূর্যের হাসি। থেমে গেছে পাখিদের গান। স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর গতি। তমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না তন্ময়। সমস্ত রাগ মুছে ফেলে তমার দিকে তাকায়। স্বপ্নহরিণীর দু'চোখ বেয়ে পড়া বিধাতার আশীর্বাদের নহর তন্ময়ের হৃদয়ে কষ্টের মহাসাগর তৈরি করে। ওর মনে হয় আমিও তমার সাথে কান্না করি। কিন্তু পারে না ওর কষ্ট তমাকে বোঝাতে। বুঝে উঠতে পারে না কি করে তমাকে সান্ত্বনা দেবে। সাহস নিয়ে তমার কাছে যায়। মাথায় হাত রাখে। ওর কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে বলে-
: তমা ..........।
এরপর আর কথা বলতে পারে না তন্ময়। চুপচাপ থাকে কিছুক্ষণ। তমার কান্নার শব্দ বেড়ে যায়। জীবনের প্রথম বুঝি এত কষ্ট পেয়েছে তমা। পাবারই তো কথা। প্রিয় মানুষদের কাছে কষ্ট পেলে এমনই তো হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে তন্ময়ের। জল এসে পড়ে কয়েক ফোঁটা। হাতের মধ্যে জলটুকু বন্দি করে আবার বলে,
: তমা, Please তমা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আসলে আমি জানতাম না এই সামান্য কথাতে তুমি এত কষ্ট পাবে। Please তমা, চুপ কর। নইলে কিন্তু তোমার সাথে আমিও কেঁদে ফেলবো। তমা, এই তমা, মাথা উঁচু কর। আমার দিকে তাকাও। তুমি এরকম করলে কি করে চলবে?
এরপরও তমার কান্না থামে না। মাথা নিচু করে একভাবে কান্না। এরই মধ্যে তানিয়া একবার এসে দেখে গেছে তমার কান্না। তানিয়া আসতে চায়লেও হাতের ইশারাই না করে দিয়েছে তন্ময়। অপরাধবোধ জেগে ওঠে তন্ময়ের মধ্যে। সত্যিই তমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে ও। এটা ঠিক করেনি তন্ময়। তমার মাথাটা উঁচু করে থুতনি ধরে নিজের দিকে মুখ করে বলে,
: তমা, অপরাধ করেছি। Sorry. Sorry. Sorry আর কখনো তোমাকে দু:খ দেবো না Promise করছি। এবার একটু হাসো। তাকাও আমার দিকে। ঠিক আছে, তোমার সব কথা শুনবো। বল আমাকে। তবুও একটু হাসো। Please তমা, তোমার চোখের জল আমার জন্য অভিশাপ। আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।
এবার কথা বলে তমা-
: আপনার ওপর আমি রাগ করিনি।
: তাহলে কাঁদলে কেন ?
: এমনি।
: এটা তো কাঁদার কারণ না। নিশ্চয় আমার কথাতে কষ্ট পেয়েছো।
: আপনি তো কিছুই বলেন নি।
: তোমার কথা শুনিনি বলে কষ্ট পেয়েছো?
: আমার মত মানুষের কথা ক'জনই বা শোনে? আমি তো বেশি কথা বলি, বাচাল, অভদ্র, সামাজিকতা জানি না ...।
: আরও কিছু বল।
: যত খারাপ আছে সবই আমি।
: আমি কি কখনও এসব বলেছি?
: বলেন নি। বলতে কতক্ষণ। আমার বাবা, মা, ভাইয়া, চাচ্চুরা সবাই বলে। সবাই। আপনিই বা ছাড়বেন কেন? বলুন না একটু।
একটু থেমে চোখের জল মুছতে মুছতে আবার বলে,
: আমার আপনজনেরা কেউ দেখতে পারে না। আপনিও তাদের দলে।
: আমি কি তোমার আপনজনদের একজন হতে পেরেছি?
: হয়েছেন বলেই তো আমাকে এত কষ্ট দেন।
: কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না। তবে হ্যাঁ, তোমাকেও কথা দিতে হবে।
: কী?
: আমার সামনে আর কাঁদবে না। মন খারাপ করে থাকবে না। সব সময় হাসি খুশি থাকবে।
: কেন?
: কেন তা জানি না। শুধু জানি তোমার কান্নার শব্দ আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ করে দেয়। কেড়ে নেয় সমস্ত সুখ।
তমা ওয়াদা করে তন্ময়ের কাছে আর কখনো মন খারাপ করে থাকবে না। তন্ময়ের সামনে চোখের জল ফেলবে না।
ওয়াদাবদ্ধ তমা লেখাপড়া নিয়েই বেশি সময় ব্যয় করে। এজন্য অবশ্য বেশি কথা বলা বন্ধ হয়নি ওর। ওর হাসি, অতিরিক্ত কথা বলা আর চঞ্চলতা অনেক শিক্ষকের বিরক্তির কারণ হয়। মাঝে মাঝে শিক্ষকদের বকা শুনতে হয় তমাকে। এমন কি বন্ধুদের সাথে মনো-মালিন্য ঘটে মাঝে মধ্যে। সব কিছু জানে তন্ময়। অথচ ঘৃণা করতে পারে না তমাকে। প্রতিদিন পড়ার সময় তন্ময়কে হজম করতে হয় তমার স্কুলের প্যাঁচাল। বিশেষ করে সেই একজনের কথা গণিত স্যার। উনার কথা শুনে তন্ময়ের খুব হিংসে হয়। তবুও শুনতে হয় তমার জন্য। সেদিন তো গণিত স্যারকে পেলে খুন করতেও দ্বিধা করত না তন্ময়। কারণ তমা এসে হঠাৎ বলল,
: আজকে আর আপনার সাথে বেশি কথা বলব না।
: কেন বল তো?
: আমার ইচ্ছে তাই।
: তোমার এই পরিবর্তনটা কে করল বল তো?
: জানেন, আজ ক্লাসে আমার খুব মন খারাপ ছিল।
: তোমার মন খারাপ! এ তো হঠাৎ বৃষ্টির মত।
: বিশ্বাস করুন । সত্যিই বলছি।
: তা না হয় করলাম। তবে মন খারাপের হেতু?
: তানজীর স্যার খুব বকেছিল।
: তাতে কী ? স্যাররা তো বকতেই পারে।
: ঐ স্যারের ব্যাপার ভিন্ন।
: কেন? ভিন্ন কেন? তিনি কি তোমার বাবা?
: আরে বুদ্ধু, বাবা হবেন কেন?
: তাহলে?
: আমার সবচেয়ে প্রিয় স্যার। শুধু আমার হবে কেন, আমাদের স্কুলের সকলের সবচেয়ে প্রিয় স্যার।
: তোমার প্রিয় স্যার কী বললেন শুনি?
: ওভাবে স্যারকে ওহ হ্যাঁ করার অধিকার কিন্তু আপনার নেই।
: আচ্ছা, বলো।
: স্যার বলেছেন, "অপ্রয়োজনে কথা বলবে না। নিরবতা নারীর অলংকার। রূপ নারীর অহংকার। সুতরাং এই দুইটাকে কেউ বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না। আর জ্ঞানার্জন জীবনকে বুঝতে শেখায়। তাই অন্য চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে লেখাপড়া কর ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। সবেমাত্র এইটে পড়। এখনো হাতে অনেক সময় আছে। তুমি পারবে। তোমার মধ্যে লুকায়িত মেধা দেখতে পাচ্ছি। যা তোমার চঞ্চলতার মত প্রস্ফুটিত হলে নিশ্চয় তুমি জগৎটাকে দেখাতে পারবে তুমিও পারো।"
তারপর কি বলল জানেন?
: কী?
: বলল, "তোমার সৌন্দর্য নজর কাড়ার মত। এর সাথে যদি তোমার বিদ্যা থাকে। তবে তুমিই জয় করবে বিশ্ব।"
: ঠিকই তো বলেছে তোমার তানজীর স্যার। তাঁকে একটা ধন্যবাদ জানানো দরকার। তাঁর সাথে দেখা করাতে পারবে?
: কেন করাবো? আপনি স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসেন।
: কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তমা?
: মনে করব কেন? করুন।
: তোমাদের তানজীর স্যার কি বিয়ে করেছেন?
: আরে স্যারের তো এক মেয়েও আছে।

আল্লাহর কাছে হাজার শোকর করে তন্ময়। যদি স্যার অবিবাহিত হত, তাহলে তন্ময়ের সুইসাইড করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। এই তমা কি হতভাগ্য তন্ময়ের কাছে আসত? কখনোই না। এই ভেবে সারাটি রাত অতিবাহিত করেছিল তন্ময়। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিল না তানজীর স্যারের সাথে নিজেকে। রাতের ঘুমকে মাটি করে সকালে ছুটে গেল তমাদের স্কুল কচিকণ্ঠ আইডিয়াল একাডেমীতে। দেখা হল তানজীর স্যারের সাথে। স্কুলের নির্ধারিত ড্রেস সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো সু আর টাই। নিজস্ব ভঙ্গিমায় চোখে চশমা। মাথায় বাবরি চুল। হালকা কোঁকড়ানো। দেখে মনে হয় সাহিত্য জগতে বিচরণ আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আসলেও তাই। তন্ময়ের আলাপ করে মনে হল তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যার পরশে মাটি সোনা হওয়া সম্ভব।

নবম শ্রেণী। প্রথম ক্লাস। অষ্টম পাশ করে আসা সকল ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত। সাথে নতুন মুখ কয়েকটা। ঘড়িতে সকাল আটটা। জানুয়ারি মাস। বলা চলে ১লা জানুয়ারি। ক্লাসে ঢুকলেন স্যার। সবাই উঠে দাঁড়ালো। অনেক দিন পর দেখা। কুশলাদী জিজ্ঞাসা করা বাঞ্ছনীয়। কিছুই হল না। সমবেত কণ্ঠের সালাম এবং একক কণ্ঠের জবাব শোনা গেল। তারপর .......... । তারপর নিরবতা। প্রায় দুই মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে। বসতেও বলেন নি স্যার। নতুনেরা তো ভয় পেয়ে গেছে। আর পুরাতনরা ভাবছে স্যার ওদের সাথে এরকম করছে কেন? ওরা তো কোন অপরাধ করেছে বলে মনে হয় না। সকলের ভাবনার অবসান ঘটাতে মুখ খুললেন ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রদের উদ্দেশে।
: "তোমাদের সাথে প্রায় দুই মিনিট কথা বলিনি। ভাবছ কি ঘটনাই বা ঘটল। আসলে কিছুই ঘটেনি। তোমাদের এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম সবকিছু চাইলেই পাওয়া যায় না। জীবনটা বড় বিচিত্র। এখানে প্রত্যেকটা মানুষের স্বপ্ন আছে। কেউ স্বপ্ন দেখে কোটিপতি হবার। কেউ ডাক্তার হবার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবার। কেউ কোনোমত একটা চাকরী করে বেঁচে থাকতে চায়। সকলের আশা পূরণ হয় না। কেন জানো? কারণ কেউই এই ধাপ সহজে পেরোতে পারে না। যে পারে সেই সফল। ক্লাস নাইন। মনে অনেক রঙিন স্বপ্ন আসে। যার বাস্তবতা সম্ভব না। অথচ সেটাকে সোনার খনি ভেবে যারা ভুল করে তাদের জায়গা ছেলেদের ক্ষেত্রে মাস্তান। আর মেয়েরা বাল্যবিবাহের খোরাক। এখন সিদ্ধান্তের ভার আমি তোমাদের দিলাম। জীবনটাকে কিভাবে গড়বে? লেখাপড়া করবে? না কি সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে বাবা-মার মুখে চুনকালি দেবে? আমি কিছু না তোমাদের জীবনে। শুধু একজন পথ প্রদর্শক মাত্র। আজ আছি তোমাদের সুখে-দু:খে। কাল হয়তবা থাকবো না। এবার বল কেমন ছিলে তোমরা? বেশ কয়েকজন নতুন মুখ দেখছি। তাদের সাথে পরিচিত হই।"
এই টুকুই আবার সকলের মনে স্থান করে দেয় তানজীর স্যারকে। কি করে ভুলবে এই অভিভাবকের উপদেশ বাণী আর নীতি কথা। তমা তো তানজীর স্যার ছাড়া আর কিছুই যেন চোখে দেখে না। ক্লাস শেষে স্যারকে জিজ্ঞাসা করে ও কোন গ্রুপ নেবে? তিনি সাইন্স নেবার কথা বলেছিলেন। সেই কথাকে জের ধরে বাসার সবার সাথে এক চোট ঝগড়া করেছে ও। এমন কি তন্ময়ের কথাও মেনে নেয়নি। ওর একটাই কথা স্যার বলেছেন, আমার বিশ্বাস তুমি সাইন্স নিলে খারাপ করবে না।
স্যারের বিশ্বাসের মান রাখতেই লেখাপড়া শুরু করে তমা। সবাই মিলে স্যারের কাছে পড়তে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই মানুষ হতে হবে। পৃথিবীতে স্মরণীয়দের একজন হতে হবে। বাবা-মা সবাই খুব খুশি মেয়ের এই পরিবর্তনে। কিন্তু তন্ময়ের সাথে সখ্যতা তার কমেনি। কি করে কমবে? তানিয়ার সাথে সখ্যতা থাকলে তো তন্ময়ের সাথেও থাকবে। অবশ্য তন্ময় ভাবে অন্য কিছু।
বছর কেটে গেল কিভাবে কিছুই ভেবে পেল না তন্ময়। বুঝে উঠতে পারে নাই কখন যে ভালোলাগা তমা ভালবাসা হয়ে গেছে। এখন জানানো দরকার তমাকে ভালবাসার কথা। অনেক সময় বলতে গিয়ে আটকে গেছে। অথবা তমা থামিয়ে দিয়ে তানজীর স্যারের গল্প শুরু করে দিয়েছে। কিংবা নোট আনতে তানিয়ার কাছে গেছে। এটা এক ধরনের এড়িয়ে চলা সেটা বুঝতে পারে তন্ময়। কিন্তু বুঝতে পারে না যখন তমা ফোনে কথা বলে। ফোনে কথা বলার সময় মনে হয় তমার চেয়ে আর আপন কেউ নেই পৃথিবীতে। পরক্ষণে দেখা হলে ভুলে যায় সব। অন্য তমা মনে হয় তন্ময়ের কাছে। তবুও অপেক্ষা করে তমার পরীক্ষা পর্যন্ত। এই অপেক্ষার দিন যে কত ধীরে চলে তা বোধ করি তন্ময়ের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। অবশেষে অবসান ঘটে তন্ময়ের প্রতীক্ষার। তমার পরীক্ষা হয়। খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছে ও। কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাই সাইন্স নিয়ে সে পারবে। সবই অবশ্য স্যারের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। সবাই স্বীকার করে সে কথা। এ জন্য অবশ্য সবাই স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
বড় ধরনের চাপের মধ্যে থেকে বের হওয়ার পর সবাই একটু হাওয়া পরিবর্তন করতে চায়। তার ধারাবাহিকতায় পরীক্ষার পর সবাই গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যায়। তমাও বেড়াতে যাবে আগামীকাল। তন্ময়কে কিছুই জানায়নি। কিন্তু শুনেছে তন্ময়। তাই সকাল থেকেই ওর মন খারাপ। যেভাবেই হোক তমাকে জানাতে হবে ওর ভালবাসার কথা। প্রয়োজনে তমার বাবা-মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। আবার ভাবে, এটা তো পাগলামি। এস.এস.সি পরীক্ষার পর শহরের কোন বাবা-মা মেয়ে বিয়ে দেয় না কি? তার থেকে তমাকে জানাবে ভালবাসার কথা। কিন্তু আবারও সেই একই প্রশ্ন কিভাবে জানাবে তমাকে? অস্থির সারাটি দিন কাটলেও রাতে ঘুম আসে না তন্ময়ের। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রাতের জ্যোৎস্নাদের সাথে ওর একাকীত্বটা ঘোষণা করে।

গভীর রাত। চারিদিকে নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দূরের রাস্তায় চলা নাইট কোচ বা ট্রাকের শব্দ কানে আসছে। শব্দগুলো তন্ময়ের নি:সঙ্গতাকে বাড়িয়ে দেয় শতগুণ। তন্ময়ের ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে আকাশে বাতাসে জানিয়ে দেয় তমা ওর ভালবাসা। ভাবনা শেষ হতে না হতেই সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসে তন্ময়ের কানে "ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও, এ গান আমার, ও এ গান আমার ............ ।" এটা তন্ময়ের মোবাইলের রিং টোন। ছুটে আসে বিছানায় রাখা মোবাইলের কাছে। স্কিনে দেখে হৃদয় কাঁপানো সেই নাম তমা। হৃদয়ের কম্পন বেড়েই চলেছে তন্ময়ের। হাতে তুলে নেয় মোবাইল। রিসিভ করে কল। সেই অমায়িক হাসিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তন্ময়ের। ও দিক থেকে ভেসে আসে তমার কণ্ঠ-
: ঘুম ভাঙ্গালাম না তো?
: চেষ্টা করেও তো বিছানায় যেতে পারছিলাম না।
: কেন?
: অপেক্ষায় ছিলাম তোমার ফোনের।
: আপনি কি করে জানেন আমি ফোন করব?
: আমি জানব কেন?
: তাহলে?
: আমার মন বলছিল তুমি ফোন করবে। কারণ কাল গ্রামে যাচ্ছ। আমার সাথে কথা না বলে তুমি গ্রামে যেতে পারো না।
: আমার প্রতি আপনার এত বিশ্বাস? এত বিশ্বাস করা কি ঠিক?
: না হয় তোমার জন্য জীবন ডায়েরীর পাতায় একটা ভুল শব্দ লেখা হল। তবুও এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো, বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টির কাছে আমি হেরে গেছি।
: সে বাদ দিন, যে জন্য ফোন করা। আমি তো আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি।
: জানি। তারপর ........... ।
: জানানোর জন্য ফোন করলাম।
: আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে যাওয়ার অফার করবে।
: আসলে, ওভাবে তো ভেবে দেখিনি। তাছাড়াও ফ্যামিলি সফর তো।
: ফিরবে কবে?
: সেটা ঠিক হয়নি। তবে আপনাকে ফোন করব।
: তা না হয় করবে। কিন্তু তুমি যাবার আগে যে আমার কিছু বলার ছিল।
: নিশ্চয় আমি জানি।
: বল তো?
: আপনি বলবেন, গ্রামে যেয়ে সাবধানে থেকো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এসো। প্রতিদিন ফোনে খোঁজ খবর নিও। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
: ওসব নয় তমা। আমি খুব সিরিয়াস কথা বলব।
: বলুন।
: আমি তোমাকে ভালবাসি তমা।
তন্ময়ের মুখে এ কথা শুনে তমা হাসতে হাসতে বলে,
: আপনি যে কি বলেন? আপনি আমাকে ভালবাসতে যাবেন কোন দু:খে?
: সত্যি তমা, তুমি বিশ্বাস কর। আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। তুমি শুধু আমার। আমার তম।
তমা আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। ও পাশ থেকে কোন শুনতে পায় না তন্ময়। মাঝে মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় তন্ময়। তবুও বলে -
: তম, তুমি কথা বলছো না কেন? তম আমার ভালবাসার মধ্যে কোন কলঙ্ক নেই। সেই প্রথম দেখার পর থেকেই আমি তোমাকে ভালবাসি তম। please তম, কথা বল। এই তম, তুমি কি কাঁদছো? তোমার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি যে। ঠিক আছে, আমার ভালবাসাকে গ্রহণ না করলেও তুমি কেঁদো না। তোমার কান্না আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। আমি তোমার কষ্টের কারণ হতে চাই না। শুধু তোমার প্রতীক্ষায় থাকবো। যদি কখনো মনে হয় এসো। তোমার জন্য খোলা থাকবে আমার হৃদয়ের দ্বার।
মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তন্ময়। সারা রাত চোখের পাতা এক করেনি তন্ময়। সকালে দরজা খোলেনি। নাস্তা করেনি। আবার এক অনিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ে তন্ময়ের জীবন।

ঘড়ির কাঁটা দ্রুত চলত তমার জীবনে। ঠিক তার উল্টো ছিল তন্ময়ের জন্য। দেখতে দেখতে এক বছর অতিক্রান্ত করল তন্ময়ের দূর্বীসহ জীবন। বারান্দার করিডোরে বসে আছে তন্ময়। একটা লোককে আসতে দেখে। হাতে তার কিছু চিঠি। হয়ত ডাকপিয়ন হবে। কিন্তু মোবাইলের যুগে ডাকপিয়ন আসতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুস্কিল। লোকটি তন্ময়ের কাছে এসে বলে, ভাইজান তন্ময় সাহেবের চিঠি। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয় তন্ময়। একটা নীল খাম ধরিয়ে দেয় তন্ময়ের হাতে। নীল খাম! আবার মনে করিয়ে দেয় তমার তারকাখচিত নীল টিপের কথা। খামের উপর ঠিকানা থাকলেও প্রেরকের নাম লেখা নেই তাতে। খামটা হাতে নিলে হৃদয়ে মোচড় দিল তন্ময়ের। খামটা খুলে বের করে আকাশী বর্ণের এক পৃষ্ঠা কাগজ। তাতে মেহেদী রং এ গোটা গোটা হাতে লেখা শব্দ সম্ভার। কোন সম্বোধন নাই প্রাপকের।

'তুমি' শব্দটি অতি আপনজনকে ছাড়া মানায় না। অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে আমার 'তুমি' বানাতে পারি নাই। আজও পারবো না হয়ত। শুধু তোমার ভালবাসার অধিকার নিয়ে জীবনে প্রথম ও শেষ বারের মত তোমাকে 'তুমি' বললাম। অপরাধ মনে করলে ক্ষমা করো। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। তবুও লিখছি অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। তুমি আমাকে খুব ভালবাসি। আমি জানতাম। আর জানতাম বলেই তোমার কাছে কাছে থাকতাম। কিন্তু যেদিন তোমার মুখে ভালবাসার কথা শুনতে পেলাম, সেদিন বড় ভয় হল তোমাকে হারানোর। কিছুতেই তোমাকে বঞ্চিত করতে মন সায় দিল না। তাই নীরবে নিভৃতে চলে এলাম জীবন থেকে দূরে। এখানে আমি খুব কষ্টে আছি গো। আমাকে তোমার তম করে শক্ত করে ধরে রেখো। শুধু স্মৃতির পাতায় আমি থাকতে চাই না। তোমার তম হতে চাই। তোমার তম। তুমি কি আমাকে আদর করে বলবে না "এই তম, কথা বল"? আমি কিন্তু তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না গো। শুধু দেখবো দু\'চোখ ভরে। তুমি কি একবার আসবে তোমার তমকে দেখতে?
জানি না এই চিঠি তোমার কাছে পেঁৗছবে কি না? পেঁৗছলেও এই চিঠি পড়ার সময় তুমি আমাকে কি ভাববে? ঘৃণা করবে হয়ত। নতুবা ভালবাসতে সম্মতি জানাবে। আমার অপরাধ মার্জনা করলে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকবো। তোমার সাদা বেনারসির অপেক্ষায়-
তোমারই তম।
এক মূহুর্তও দেরি করে না তন্ময়। ছুটে চলে তমার কাছে। কাউকে কিছু বলার সময় পর্যন্ত নেই ওর। শুধু যাবার বেলায় তানিয়াকে বলে গেছে তমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।

বিকেল পাঁচটা। সূর্য পশ্চিমে যেতে উদ্যোত। ট্রেন এসে থামে টি.টি পাড়া স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামে এক যুবক। সাদা পাঞ্জাবী। মাথায় হ্যাট। চোখে কালো চশমা। একেবারে সাহেবি কায়দা যাকে বলে। হাতে তার লাল বেনারসি। সকলের অপরিচিত চেহারা। তন্ময়ের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে সকলে। স্টেশনের অদূরে তমাদের গ্রামের বাড়ি। শুনেছে প্রচুর আম-কাঁঠালের গাছ আছে ওদের বাড়িতে। সামনের ডান দিকে বাগান বাড়িতে প্রচুর লোকজনের সমাগম দেখতে পায় তন্ময়। তন্ময়ের মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে। এক রিক্সাওয়ালাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে ওখানে কী হয়েছে? সে জবাব দেয়, কি আর বলব সাহেব, আমাদের মামনি বিদায় নিয়েছে। কী হয়েছিল প্রশ্নের জবাবে সে বলে , ক্যান্সার। তন্ময় ক্যান্সার শব্দটা কয়েকবার মনের মধ্যে আওড়ায়। তারপর হাঁটতে থাকে বাড়িটার দিকে। লোকজনের মুখে মেয়েটির বয়স এবং বর্ণনা শুনে খুব কষ্ট হয় তন্ময়ের। কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় পিছনের সব। এমন কি এখানে আসার উদ্দেশ্য। দেখতে ইচ্ছে করে মেয়েটিকে। আনমনে হাঁটতে থাকে বাড়িটার দিকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় তন্ময়। খাটিয়ায় শোয়ানো লাশের দিকে তাকায়। অজান্তেই হাত থেকে খসে পড়ে লাল বেনারসি। ঝাপসা হয়ে আসে তন্ময়ের পৃথিবী। বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে পড়ে চোখের লোনা জল। নিচু হয়ে মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলে, "এই তম, কথা বল।"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জাহাঙ্গীর আলম ভালো লেগেছে . ধন্যবাদ লেখককে.
মোঃ আক্তারুজ্জামান আমার কাছেও গল্পটা বেশ ভাল লাগল। কোথাও কোথাও মনে হয়েছে এত বাহুল্য না থাকলেও চলত। তবে লিখতে লিখতে এক সময় সবারই এই ব্যাপারগুলি এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। অনেক অনেক শুভ কামনা।
ধন্যবাদ আখতারুজ্জামান ভাই.
সোহেল গল্প কবিতায় আমার পদচারণা শুরু হলো এই লেখাটি দিয়ে . ধন্যবাদ লেখককে /
স্বাধীন ভালই লাগল আমার।
সূর্য ভাল লাগলো বেশ।
প্রিয়ম আমার মন মজাইয়া রে , দিল মজিয়া গেল |
ধন্যবাদ প্রিয়ম আপনার মন্তব্যের জন্য.
মিলন বনিক গল্পটা অনেক বড় এবং বর্ণনাত্মক..ভালো লাগলো ..শুভ কামনা...
আহমেদ সাবের সাবলীল লেখা। রোমান্টিক গল্প। তবে, ছোট গল্প হবে "নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা - ( রবীন্দ্রনাথ) "। সেদিকে গল্পকার খেয়াল রাখবে আশা করি।
আপনার মন্তব্যের অপেক্ষায় সব সময় থাকি . ধন্যবাদ আমার মত ক্ষুদ্র লেখকের গল্প পড়ার জন্য .
আশিক বিন রহিম bes boro- bes sondor-bes valo laglo..
Irfan Mama আকাশী রং মাখা স্যালোয়ার কামিজ, সোনালী-কালো বর্ণের কেশরাজি, গলায় প্যাঁচানো ওড়না নামের এক খণ্ড কাপড়, কপালে তারকা খচিত নীল টিপ, ঠোঁটে কমলার মত লিপস্টিক, দু'হাতের আঙুলিতে মেহেদীর পরশে হৃদয় খচিত আংটি, সামনের কয়েকটি চুল কপোলের স্পর্শ পেতে মরিয়া, চোখ যেন মৃত গোলাপ পাপড়িতে আবৃত জীবন্ত আলোক বর্তিকা আর নাসিকা তো বিধাতার পদতলে সুযোগহীন বেড়ে ওঠা বাঁশি। - অদ্ভুদ বর্ণনা . ধন্যবাদ লেখককে.

২২ নভেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪