লাইভ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে আজিফাত হোসেন চৌধুরীকে। কিছুক্ষণ আগে তাকে আনা হয়েছে আই সি ইউতে । দুর্দান্ত দাপটের সাথে তার ৮৬ বছরের জীবন অতিবাহিত করেছেন । পলিটিক্যাল ময়দানে তেমন বেশী সক্রিয় না থাকলেও তিনি যে সামাজিক এবং বেসরকারী সেবা সংস্থার মাধ্যমে সমাজে অনেক অবদান রেখে যাওয়ার দাবীদার এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সিংগাপুর থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে তাকে। এমন সুস্থ্য তরতাজা মানুষ এত দ্রুত এভাবে আই সি ইউ তে লাইফ সাপোর্টের অধীনে চলে যাবেন তা ভাবতেই পারছেন না অতি ভক্তিতে ভক্ত কিছু লোকজন ।
সিংগাপুরে যাবার আগের দিন সকালে ঢাকার সবচে দামী চিকিৎসা কেন্দ্র এঞ্জেলো হসপিটালস এ তিনি এলেন, সামান্য কারণেই। তার অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে শুভাকাংঙ্খিগন খূব দ্রুতই ভিজিটরর্স কক্ষে ভিড় জমিয়েছিলেন গতকাল । নিকট আত্মিয়ের মধ্যে চৌধূরী সাহেবকে আমার বরাবরই খুব একটা পছন্দ হত না। প্রয়োজন না হলে তেমন একটা যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছে হত না। অসুস্থ্যতার খবর শুনে অনিচ্ছা হলেও নাড়ির টানেই ছুটে এলাম। দেখলাম বিশাল দেহ নিয়ে ভিজিটর্স রুমে অনেকের সাথে বসে মৃদু কথা বলছেন। ডাক্তার আসার অপেক্ষায় তখনও পর্যন্ত উপস্থিত অনাকাংখিত শুভাকাংঙ্খিগন কফি পান করতে করতে একে অন্যের সাথে প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় অনেক রকম গাল গপ্পের মধ্য দিয়ে তাদের নিজেদেরকে যেমন জাহির করছেন তেমনি চৌধুরী সাহেবের জীবনের অনেক উদ্ভট, বানোয়াট সব কাহিনী সত্য মিথ্যা জুড়ে দিয়ে তার স্মৃতিচারিত, চর্বিত, চষ্যিত, তৈলিত হচ্ছিল। চৌধূরী সাহেবও তা বেশ পুলকের সাথেই উপভোগ করছিলেন এবং বরাবরের মত এমন অসুস্থ্য অবস্থায়ও তার অতিমূল্যায়িত যোগ্য ছেলেদের গুনকীর্তন করতে তিনি একটুও ভোলেন নি। কৃত্রিম সেসব গুনগান শুনতে শুনতে সমাগতের অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতে দেখা গেল। অনেকেই সত্য মিথ্যা যাই থাক, জানলেও চুপ চাপ হজম করছেন। কেননা যারা হজম করছেন , তারাও ফাক পেয়ে নিজেদের সম্বন্ধে যা নয় তাই অনেক বেশী প্রচার করে ফেলেছেন। অনেক মিথ্যা, অবান্তর, অবিশ্বাস্য এবং নানারকম তৈল মন্থিত কথ- কাহিনী চলাকালে আমি বেশ খানিকটা বিব্রত হয়ে একটু দূরে সরে গেলাম। কে কতটা নিজের নিজত্বকে আর একজনের সামনে উপস্থাপন করতে পারে এ যেন তার এক প্রতিযোগীতা চলছে। ডাক্তার এলেন। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও অসুস্থ্য প্রতিযোগীতার দৌড় বন্ধ হল । পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিছু ইনভেস্টিগেশন করার সাজেশন দিয়ে সেদিনকার মত বিদায় দিলেন। এদিনই রাতে বাথরুমে হোচট খেয়ে কোমরে আর বুকে একটু খানি ব্যাথা পেলেন আজিফাত হোসেন চৌধুরী সাহেব। যথারীতি তাৎক্ষনিক রেসপন্ড ছোট ছেলে জহরত চৌধুরীর। সে রাতেই আবার তাকে নিয়ে এল এঞ্জেলোতে। এ হসপিটালের এম ডি সাহেবের সাথে জহরত চৌধুরীর অনেক দহরম মহরম আছে। সুতরাং তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া হল।
-খবর খুব খারাপ। ব্রেইনে হাল্কা রক্তক্ষরণ হয়েছে। কুইক ডিসিশন নিল যোগ্য বাবার যোগ্য ছেলে জহরত চৌধুরী। ঐদিনই কনফার্ম করা হল সিংগাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে নেয়ার। শত শত শুভাকাংঙ্খিগনের (?) কৃত্রিম অশ্র“ বিসর্জিত এক সন্ধ্যার ফ্লাইটে সিংগাপুর নেয়া হল।
প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়েই আমাদের বাসার অদূরে পার্কের ওয়াকওয়েতে হাটতে যাই । শহরের অনেক অভিজাত মানুষ তাদের বিলাসী জীবনের বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে এখানে আসেন তাদের দেহের ওজন কমাতে। অধিকাংশের দেহের ওজন ১২০ থেকে ১৮০ কেজি বানিয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে সেসব অভিজাত ঘরের মহিলাদের অবস্থা আরো ভয়ানক। ডাক্তার নির্দিষ্ট খাবার তালিকা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কত দামী দামী খাদ্য খাবার টেবিলে সাজানো থাকে, কত নামী দামী মেহমান-অতিথি আসে-যায়, খায়-দায়। এসব সাহেব, সাহেবানরা কেবল তাকিয়ে দেখেন আর আফসোস করেন। কোথায় গেল সে দিনগুলো ? এসব ওজনওয়ালা দামী মানুষেরা সাধারণত সকাল সাতটা বা আটটার আগে পার্কে আসতে পারেন না। আর আমার জন্য বড় সুবিধা এটাই। ভীড় জমার আগেই আমার এক ঘন্টা পার হয়ে যায়। সংগত কারণেই এরকম দামী মানুষদের পার্কে হাটতে দেখার সৌভাগ্য আমার তেমন একটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেদিন ফজরের নামাজ পড়ে বাচ্চার ঘুম ভেংগে যাওয়ায় তাকে একটু সময় দিয়ে বের হতে দেরী হল। ছুটির দিন থাকায় একটু আলসেমীর আমেজে ছিলাম। বেলা বাড়ছে আর হেলে দুলে থলথলে বিরাটকায় শরীর বিশিষ্ট মহিলারাও ভীড় করছেন। ইনারা জোরে হাটতে পারেন না। দল বেধে দু’তিনজন করে হাতে হাত ধরে গল্প করতে করতে হাটেন। একটু দ্রুত হাটার কারণে উনাদের পেছনে এসে একটু গলা খাকরিয়ে নেই। কেউ একটু সরে যেতে পারেন, কেউবা দেহের ভারে তা পারেন না। সেক্ষেত্রে আমি ওয়ে থেকে একটু নীচে নেমে আবার ট্র্যাকে ফিরে চলতে শুরু করি। এরকম কয়েকপাক দিয়ে একবার ওভারটেক করার সময় কানে এল,
- চৌধুরী সাহেবের খবর শুনেছেন ?
’ কোন চৌধুরী ?
- আরে, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের আজিফাত হোসেন চৌধুরী ।
(আত্মিয়ের নামটা শুনে একটু থমকে গেলাম। আর কৌতুহলী হয়ে ধীর পদক্ষেপে পিছু হাটছিলাম। )
’ ও, আচ্ছা। কি হয়েছে ?
-হয়েছে বোধহয় বড় কিছু। কাল সিংগাপুর নিয়ে গেল। মনে হয় ব্রেইন ষ্ট্রোক করেছে।
’ তা হতেই পারে, বয়স তো আর কম হল না।
- কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, ছোট ছেলেতো টাকায় টাকায় লাল হয়ে গেছে। অন্য দুই ভাইয়ের তো মুখের খৈ ফুটানি বুলি ছাড়া আর কোন পুঁজি নেই। একটু আড়ি পেতে যা শুনলাম, তাতে মনে হল টাকার পাহাড় হলে হবে কি, ছোটটা ছাড় দেবার পাত্র নয়। উপরে উপরে ভাব দেখায় কত মিল ভায়ে ভায়ে ! অথচ কল সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বাবার পিছনে যত ব্যয় হবে তার সমান সমান ভাগ করে সবাইকে শেয়ার করতে হবে। বলছিল, লোন করে আমি চালিয়ে দিলাম , কিন্তু সবাইকে শেয়ার করতে হবে। তার মা অন্য দুই ছেলেকে সাপোর্ট করে বলল, ওরা এত টাকা কোথায় পাবে ? তুই যদি একলা না পারিশ তবে থাকনা, দরকার কি কোটি টাকা খরচ করে ? মরতে তো হবেই । এ বয়সে মরে গেলে আর আফসোসের কি আছে । বলতে গেলে মরা লাশই তো এখন। তা বাবা, এ লাশ নিয়ে এরকম কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার কোন মানে হয় না। তোরা ভাইয়ে ভাইয়ে এ নিয়ে গন্ডোগোল করিস না। উনাকে ঘরেই মরতে দে।
ছোট ছেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, চুপ ! এ কথা আর একবারও আর মুখে আনবে না। বাইরের ঘরে আমার ফ্রেন্ডরা বসে আছে । ওরা আমার কত মূল্যবান পার্টনার তা তােমাদের জানা আছে ? তাদের সামনে আমি খাট হতে পারব না। এতে আমার কত ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তা তোমরা বুঝবে না।
: তোর লাভ ক্ষতির হিসেবের মধ্যে কেন এ লাশ নিয়ে টানা টানি ? এটা কি অন্য কোন ভাবে ----
মাকে থামিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল, আর একটা কথা নয় । ঠিক আছে, তোমাদের কারো কিছুই করতে হবে না। যা করার আমিই করছি, তবে তোমরা কেউ আর এ নিয়ে একটা টু শব্দটি করবে না।
বাব্বা, এ পর্যন্ত শুনেই না, আমি একেবারে চমকে গেলাম। টাকার কি দাপট ! বেচারা বৃদ্ধ বয়সে একটু শান্তিতে ঘরে শুয়ে মরবে, সে উপায়ও নেই। কি জামানা এল গো আপা ! বাবা মায়ের লাশ নিয়েও ছেলে পেলেদের ব্যবসায়িক চিন্তা ! ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
’ কারো দরজায় আড়ি পাতা ঠিক নয়। তবু আপনি যা বললেন, তা থেকে আমাদের একটা শিক্ষনীয় বিষয় আছে ।
- কি বিষয় আপা ?
’ আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের নসিহত করে যেতে পারি, তারা যেন আমাদের মরণ কালে এরকম ব্যবসায়িক চিন্তা না করে । সাধ্য থাকলে চিকিৎসা করবে, না থাকলে দরকার নেই। মরতে তো হবেই । কিন্তু তাই বলে তাদের ষ্ট্যাটাচ, ঠাট, বাট বজায় রাখতে যেয়ে আমাদের মরণ কালে কষ্ট দেবে ? না, না, এ আমরা হতে দেব না । এটা তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে হলফ করিয়ে নিতে হবে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! বাবা, তোদের সামর্থ থাকলে চিকিৎসা কর , না থাকলে দরকার নেই। তাই বলে ব্যবসায়িক পার্টনারদের কাছে নিজেকে জাহির করতে হবে মরা লাশ নিয়ে ? ছি ! ছি !
- তাই তো হয়, দেখেন না, হাল ফ্যাশনের উঠতি বড় লোকদের কি সব হাল চাল শুরু হয়েছে আজ কাল। মা বাপ মরলে ক’ল খানি, মিলাদ , চল্লিশে পালন উপলক্ষে জিয়াফত , কত হাক ডাক করে লোক খাওয়ানো ! মনে হয় যেন বিয়ে বাড়ির আমোদ ফুর্তি করছে। এ সবই হচেছ ঐ লোক দেখানো। নিজেকে জাহির করার ব্যাপার স্যাপার । কেউ করে ভোটের জন্য, কেউবা নিজের অবৈধ আয় রোজগারের কারণে যাতে ধরা না খায় তার জন্য নানা কৌশলে বড় বড় ক্ষমতাধরদের দাওয়াতে সামীল করে তা জায়েজ করার জন্য ।
’ ঠিকই বলেছেন। এসব বাহানা দেখলে গা জ্বলে যায় ।
( পাশ কেটে চলে গেলাম সামনে)
আমার কিছুটা নিকট আত্মিয় আর তার পরিবার সম্পর্কে এ দুই ভদ্রমহিলার মূল্যায়ন একটু কষ্ট করে পিছু হেটে শুনছিলাম। যদিও কাজটা অন্যায় । কিন্তু বয়সটা কম তো ? তাই সে অন্যায়ের কাছে কৌতুহলের পরাজয় একটু হয়েই গেল। জানিনা এটা ক্ষমার অযোগ্য কি না ! তবে আলোচনা থেকে মানুষের বহুরূপ এবং সমাজের পচন ধরা রোগ সম্পর্কে জানলাম, শিখলাম ।
লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হল টানা এক মাস বাইশ দিন । একেই বলে জীবন বিলাস ! জানা গেছে জহরত চৌধুরীর সাথে এ্যঞ্জেলো হসপিটালস এর এম ডি সাহেবের সম্পর্কে চির ধরেছে। জীবন বিলাসের বিলাসিতার বিলটা সোয়া এক কোটি টাকার কম করা নাকি হসপিটাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব না।