বিশাল বাড়িটা সামাদ সাহেবের কাছে আজ অচেনা মনে হচ্ছে। বাড়িটা খুব সখের ছিল তার। তিনিও খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। কলমের আম গাছ, লিচু গাছ, বিভিন্ন পাতাবাহার ও ফুল গাছ দিয়ে বাড়িটাকে সাজিয়েছেন তিনি। গ্রামে এটা বাগানবাড়ি নামে পরিচিত। একসময় খুব জাকজমক ছিল বাড়িটা। তার অনেক সমবয়সী বন্ধুরা আসতো। তার সাথে গল্প করতো, হুকো খেতো, পান খেতো। রাত্রি বেলায় গল্প ও পুঁথির আসর বসতো। কিন্তু এখন আর তার বাড়িতে কেউ আসেনা। তাকেও কারো বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়না। কারণ সে এখন অদ্ভূত এক মানুষ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কোন কথা বলেনা। কাউকে চিনেনা। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলে উঠে, ওইরে" আর দুই হাত সামনে নাড়িয়ে বারণ করতে থাকে। মনে হয় কে যেন তাকে মারতে আসছে আর সে হাত দিয়ে বারণ করছে। তাকে নিয়ে এখন একেক জনের একেক কথা। কেউ বলছে তাকে জ্বীনে ধরছে। ফকির আইন্যা বৈঠক দিলেই জ্বীনে হাজির অইয়্যা কইয়্যা দিব। কন থিকা ওডা আইছে । কেউ বলে পাগল হয়ে গেছে। এভাবে নানাজনের নানা কথায় সারা গ্রামে গুনজন পড়ে গেছে। তার একমাত্র ভাতিজী মিতুরা। ছোটবেলা থেকেউ বাবা মাকে হারিয়ে চাচার কাছে বড় হয়েছে। চাচার এই অবস্থা দেখে একধম নিঃচুপ হয়ে গেছে। সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। চাচা তাকে অনেক ভালবাসতো। বাবা মারা যাবার পর মা যখন অন্যত্র চলে যায়। তখন সামাদ সাহেবই তাকে বাবা মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে। প্রথমত মিতুরা বিশ্বাস করতে পারেনি। চাচাতো এমন মাঝে মাঝেই করতো। মিতুরার মনে পরে। একবার সে তার বড় ফুফুর নাকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। তার একটা লেদারের ব্যাগ ছিল। ঢাকা থেকে ছয়শত টাকা দিয়ে কিনে এনেছে। ব্যাগটা খুব শখেরছিল তার। কালো ব্যাগের উপরে দুইটি পকেট চেন দিয়ে আটকানো। অধিক সাবধানতার জন্য তালার সিসটেম করা আছে। ব্যাগটা এনেই তার বড় বোন মরণাকে ডেকে বললো। মরণ দেখ কি আনছি ইড্যা! মরণ ঘরের মধ্যে কি যেন খুজতে ছিল। আসতে দেড়ি হলে সে নিজেই মরণার ঘরে যায়। বু তোর কী আরায়ছে? নাকের নৎটা কনে যানি ছুইট্যা পরলো, ওডাতো আর পাইন্যা। মরণার বয়স হয়েছে চোখের জ্যোতি কমে গেছে। সামাদ সাবেহ নৎটা খুঁজে দিলেন। মরণ নৎ পেয়ে খুব খুশি হলেন। হাজার হোক স্বামীর দেয়া নৎ। ক্ষণিকের জন্যও সে নাক থেকে সরায়না। নৎটা পেয়ে মরণা নেড়ে- নেড়ে দেখতেছিল। এক হাতে নৎ আর আরেক হাতে নাকের ছিদ্রটা ধরে ধরে সামাদকে বলতেছিল, সামেরে,আমার নাকের ফাশাটা অনেক বড় অইয়্যা গেছে। কনে বড় অইছে! বেশি বড় অয়নাই। না, অয়নায় এইযে দেখ কতো বড় অইছে। দেহি বু, বলে সামাদ নাকের দিকে তাকিয়ে বলল নাহ্ তাই বুইজ্যা এই টিপতালা তুর নাকে লাগবনা? মরণ বলল আমার মনে অয় এইড্যাও আমার নাকের ফাশায় লেগে যাইব। নারে ব,ু লাগবনা। এই বলে সে তার নাকের মধ্যে তালা দিয়ে আটকে দিল। তালার ভারে মরণার নাক ঝুলে ঠুটের দিকে পরে আসে। হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ করে বলতে লাগলো, দেখছে শয়তানডা আমার নাকে ইড্যা কি দিল। তারাতাড়ি খোল ইড্যা ওরেহ্ আমার নাক মইলো। সে বু কে আরো রাগানোর জন্য বলতো। এল্লা বু ইড্যার চাবিতো আরাই হালাইছি। খারা খুইজ্যা দেহি পাই নিহি। তার পর মরণের অনেক কান্নাকাটির পর সেটা খুলে দেয়। শুধু তাই নয় এরুপ অনেক আশ্চর্য ঘটনা সে ঘটিয়েছে। শুনেছি ছোট বেলায় সে ফতের মার প্রেমে পরেছিল। ফতের মা ইরানা বেগম ছিল তখনকার টপ সুন্দরী। বন্ধু হায়েত আলীকে নিয়ে প্রায়ই তার বাড়িতে যেতো। যাবার সময় মুন্তার দুকানের গজা, সন্দেশ, গনেশের হাতের মিষ্টি, ইয়া একবুঝা নিয়ে যেতো। তখন সে কোন কাজ করতোনা শুধু মাথায় তেল দিয়ে শিথি কেটে, পান খেয়ে ঠুট লাল করে ঘুরে বেড়াতো। আর দিনের শেষে বাবার ব্যবসার তফিল গণে কিছু উপরি পেতো। তা দিয়ে ইরানা বেগমের মন জয় করা কঠিন। তাই তার কিছু একটা করা উচিৎ। বন্ধু হায়েত আলীকে নিয়ে পুইন্ড্যার দুকানে বোন মরণার হাতের চুরী দুটা বিক্রি করে দিল। হায়েত আলী বললো শেষ ম্যাষ বোনের চুরী... আরে নাহ্! ওতো আমার বইন, এইড্যা কি আর চুরি অইল নিহি? কিযে কওনা। মুখে তখন এক ঝলক হসি। নও যাই আহি ইটু দেহা কইর্যা...
মরনা হাতের চুরী জায়গা মতো না পেয়ে এদিক সেদিক খোজা খোজি করল, কিন্তু পেলনা। না পেয়ে ইচ্ছে মতো ষাপাপিটা করল। এর বিচ্যার আল্লার কছে দিল্যাম। আল্লা তুই তার বিচ্যার করিছ। তার বংশ থাকপনা। নাই অইয়্যা যাইব। শ্যাষ অইয়্যা যাইব সব। আল্লা তুই দেইখ্যা রাখিছ। ইত্যাদি ইত্যাদি কতো কথা। সামে বুর সামনে দিয়া যায় আর বলে, ইস! আযীব যাই, কেরা ইরহম কাম করলে। থাইক বু,ষাপাপিট্যা কইর্যা লাভকি! হ আমার এতো সখের জীনিস আরায়ছে আর আমি চুপ কইর্যা বয়্যা থাকুম। মরণা রোজ সকাল বিকাল এরুপ ষাপাপিটা করতে থাকে। সামে একটি বুদ্ধি পাকালো। একদিন হঠাৎ করে সে কোন কথা বলেনা। সারা শরীর কাঁপিয়ে দাপিয়ে মেঝেতে শুয়ে পরলো। মরণা হাউমাউ করে মানুষ ডেকে আনল। মসজিদের হুজুর ডেকে আনল। হুজুর সাহেব ঝার ফুক দিয়ে বলল সম্ভবত তাকে জ্বীনে পাইছে। মরণা তখন তার বাজানকে ডেকে বলল ও বাজান দেহছে হুজুরে কয় সামেরে নিহি জ্বীনে ধরছে। এইনে আয়া দেহছে বাবায় হাজির অয় নিহি। সামের বাবা কাছে এসে বলল, কওছে বাজান তুমি কনে থিক্যা আইছ। এই তগো বাড়ির পিছে গাবগাছে আমি থাকি। ভোগ দেছনা তাই আইছি। বাবা আমাগো মরণের চুরী আরায়ছে, ওডা কনে আছে ইটু কওন যাইবনা ? খুব আদবের সহিত মরণের বাজান তার জ্বীনের সাথে কথা বলে। অনেক দুরে আছে ইন্দুরে নিছে উডা, অযথা ষাপাপিটি করছ মানুষরে। পাবিনা। ওডার আশা ছাইরা দে। এমন সময় হায়েত আলী পাশ দিয়া যায় আর জ্বীনের কথা শুনে হাসে। মরণাকে কাছে ডেকে বলল, ওসব কিচ্ছুনা। এই এই ঘটনা।ভান ধরছে। কিছু কইয়না বু ভাইয়েই তো নিছে। ওন থিক্যা অগো আইব্যার কও।
এসব ঘটনা মনে করে মিতুরা ভাবছে চাচা বুঝি এবারো ভান ধরছে তাই আশায় থাকে চাচা হয়তো আবার ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু এবার আর চাচা ভাল হয়না। মিতা বুঝুতে পারে চাচা চিকিৎসা ছাড়া আর ভাল হবেনা। এক সময় সে মানুষকে আনন্দে রাখতো। তার সুখের সীমা ছিলনা। কিন্তু এখন তার দুঃখেরও বাঁধন নেই। জীবন যাদের অনেক সুখের তারা দুঃখকে খুব কমই সহ্য করতে পারে। দুঃখ সহ্য না করতে পেরেই হয়তো চাচার সেন্সলেস হয়ে গেছে। সামাদ সাহেবের দুইটি ছেলে, মেয়ে নেই। ভালবাসার বউটা ষাপের কামড়ে মারা গেছে। অনেক চেষ্টা করেছিল বাঁচাবার জন্য পারেনি। ওঁঝা বলেছিল ষাপটা না মারলে নাকি সে বেচে যেতো। সেই শোকে আর বিবাহ করেনি। দুই ছেলেকে বুকে ধরে জীবনের দীর্ঘ একটা দিন কেটে যায় তার। একাত্তুরে দেশে যখন যোদ্ধ শুরু হয়, তার ছোটবেলার বন্ধু আয়েত আলী তাকে যোদ্ধে নিয়ে যায়। প্রথমত যেতে চায়না। আয়েত আলী বলল, হানাদাররা নাকি নিরিহ মা বোনদের উপর জুমুম অত্যাচার করতেছে। আর যাই করুক ইড্যাতো মিয়্যা মানা যায়না। সামের মনে পরে যায় তার স্ত্রীর কথা। বুঝতে পারে বউ হারা, মা হারার বেদনা কতো বিরহের। তাই ক্ষিপ্ত হস্তে অস্ত্র ধরে সেদিন যোদ্ধে গিয়েছিল। মন ভরা আশা ছিল। দেশটা সোনার দেশে পরিনত হবে। দেশ হতে সকল জুলুম অত্যাচার দূর হয়ে শান্তি ফিরে আসবে। সেই শান্তি আজো তার অর্জন হয়নি। একটু শান্তির আশায় সে আজ পাগল হয়ে গেছে। যে মানুষকে সব সময় হাসিয়ে রাখতো, তার দুঃখে মানুষের চোখে আজ জল আসে। অনেক আশা ছিল ছেলেদুটো লেখা পড়া শিখে বড় হবে। বাপ দাদার নাম রাখবে। হয়নি। বাবার বর্তমানেই বাবার সুন্দর বাড়িটির মালিক কে হবে এই নিয়ে দু ভাইয়ের সে কি ঝগড়া। সে দিন সারা গায়ের মানুষ জড় হয়েছিল। তারা বলাবলি করছে সামের পুলারা এরকম অইব মনদেও না। বাপেতো অহনো মরে নাই। মরলে না হয় নিস। এগুল্যাতো তগই থাকপ। বড় অন্য কেড্ডই নিব্যার আইবনা। সেদিনই ঝগড়া করে দু ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। সামাদ সাহেবও তাদের কোনদিন খুজতে যাইনি। এর প্রয়োজনও তিনি মনে করেনা। আর করতেও পারবেনা...।
২৫ অক্টোবর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪