মুক্ত আলোর দিকে

মুক্তির চেতনা (মার্চ ২০১২)

মোহাম্মদ শামসুল আলম
  • ১৪
  • 0
  • ৫০
একদিন গভীর রাতে দরজায় খটখট আওয়াজে অাঁৎকে উঠেন শরীফা বেগম । দরজার আওয়াজ শুনে তিনি দ্রুত ছেলের ঘরে চলে গেলেন। ছেলেকে ঘুম থেকে উঠালেন। চাপা স্বরে বললেন, বাবা ! এখন কথা বলার সময় নেই। তুই পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তোর মামাদের বাড়িতে চলে যাবি। তারপর তোর মামাতো ভাই ইমতাজের সাথে কাজ করবি। আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমার জন্য চিন্তা করিসনে।
আমজাদ ঘুমের আবেশে বলল, এতো রাতে যেতে হবে কেন ?
এবার মা বলেন, মনে হয় আর্মিরা দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। তুই জলদী বেরিয়ে পড়।
আমজাদ ভেবে কুল কিনারা পায় না। এতোকাল মায়ের মানা ছিল যেন কোন দিন ইমতাজের সাথে চলাফেরা না করে। ইমতাজ বখাটে হয়ে গেছে। এখন মা বলছেন ইমতাজের সাথে কাজ করতে ! ইমতাজতো যুদ্ধ করছে। তবে কি মা মুক্তিযুদ্ধে যেতে বলছেন। আমজাদ কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইতেই মা তাকে জোর করে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তারপর দরজা বন্ধ করে ফিরে আসেন নিজের ঘরে।
আমজাদ সবসময় মায়ের কঠোর শাসনের মাঝে গভীর ভালবাসা অনুভব করে। মায়ের আদেশ অমান্য করে এমন সাহস আমজাদের নেই। মায়ের ত্যাগ তার প্রেরণার উৎস। তাঁর কঠোর সংগ্রামী জীবন আমজাদকে অনুপ্রাণিত করে।
যুদ্ধ শুরু হলে আমজাদ ঢাকা থেকে পালিয়ে ব্র্াহ্মণবাড়ীয়ায় চলে আসে। সেখানেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ আর্মিরা টহল দিচ্ছে। শহরের রাস্তার পাশেই শরীফা বেগমের বাসা। কখন হানাদাররা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এতোসব ভাবনায় মায়ের টেনশনের শেষ নেই। রাতে চোখ বন্ধ করলেই দেখেন, আর্মিরা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। ছেলেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। শরীফা বেগম আর্মি অফিসারকে মিনতি করছে, ছেলেকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। অমনি অফিসারটি সজোরে লাথি মারে। লাথির আঘাতে তিনি ছটফট করতে করতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে যান। এতক্ষণ দম বন্ধ ছিল। তাই ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে ফুসফুসের ক্ষতিপূরণ করতে গিয়ে হাঁপাতে থাকেন। এবার এক গ্লাস পানি খেয়ে ছেলের রুমে যান। ঘুমন্ত ছেলেটির মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকেন। মনে মনে শিশু আমজাদকে আদর করেন। তারপর বর্তমান আমজাদকে সোহাগ করেন। পরে ভবিষ্যত আমজাদকে ভেবে হতাশ হন। এভাবে অনেকক্ষণ ছেলের পাশে থেকে দোয়া কালাম পড়ে দূর থেকে ফুঁ দেন। আবার বিছানায় যান। চোখ বন্ধ হতেই একটা হালকা আওয়াজে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেন। পরক্ষণে মনে হলো, গাছের শুকনা ডাল ভেঙ্গে পড়েছে।
আবার ভাবনা এসে যায়, যদি ছেলেকে ধরে নিয়েই যায়। তখন না জানি কতভাবে টর্চার করে। কোনদিন যে ছেলের গায়ে একটা টোকা দেন নি, সেই শরীর এত আঘাত সইবে কিভাবে ! যদি টর্চার করে মেরেই ফেলে, তার চেয়ে যুদ্ধের ময়দানে মরাই ভাল। এইতো গত মাসে ওই পাড়ার জোয়ান ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে আর ফিরে নি। তার মা প্রতিদিন ছেলের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক সপ্তাহ আগে পাশের বাসার ইব্রাহিমকে না পেয়ে তার বাবাকে নিয়ে গেছে। উত্তর পাড়ার আকবরকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে গেছে। যাদের ধরে নিয়ে গেছে তাদেরকে কি নির্যাতন করছে না কি মেরেই ফেলেছে ! কত খবর বাতাসে ভেসে আসছে। এসব ভাবতে ভাবতে শরীফা বেগম আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
একটু পরেই দূর থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দে আবার জেগে ওঠেন। আবার পানি খান। বাথরুম সেরে অজু করে আবার ছেলের রুমে কিছুক্ষণ দোয়া দরূদ পড়ে দূর থেকে ফুঁ দেন। আবার ঘুম। হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজে সমস্ত ঘর কাঁপতে থাকে। শরীফা বেগেমের কলিজার ধপ থপ কম্পন শুরু হয়। একের পর এক ভারি যানবাহন রাস্তা কাঁপিয়ে এগিয়ে চলছে। হয়তো বড় কোন অপারেশনে যাচ্ছে।
আমজাদের চোখেও ঘুম নেই। মা প্রতি রাতে যতবার তার রুমে আসেন তত বারই সে টের পায়। কিন্তু মাকে দু:শ্চিন্তামুক্ত করতে ব্যর্থ চেষ্টায় সে ঘুমের ভান করে থাকে। এভাবেই দিন কেটে যায়।
আজ ছেলেকে অন্ধকারে বের করে দিয়ে মায়ের বুক ফেটে কান্না বের হচ্ছিল। যত কঠিন হোক ছেলেকে এভাবে অজানা পথে ছেড়ে দিয়ে তিনি কিছুতেই নিজেকে সামাল দিতে পারছিলেন না। তিনি আর বাঁচতে চান না। কপালে যাই থাকুক তিনি দরজা খুলবেন না। তাই বসেই রইলেন মূর্তির মতো। অনেকক্ষণ পর মনে হলো যদি আর্মিরাই দরজা ধাক্কা দিয়ে থাকে, তবে এতোক্ষণেতো দরজা ভেঙ্গে ঢুকে যেতো। একটু দম নিয়ে আবার দরজা নক করছে কারা! এবার তিনি দরজা খুললেন। দরজা খুলে হতবাগ!
একি ! ইমতাজ তুই ! তোর সাথে এরা কারা ?
মুক্তিযোদ্ধা। আমরা ক্ষুধার্ত। দু'দিন থেকে না খেয়ে আছি। ইমতাজ বলল।
শরীফা বেগম বলেন, তোরা ভিতরে ঢোক আমি আসি।
বলেই শরীফা বেগম পেছনের দরজা খুলে চলে গেলেন বাগানের ভিতর। তিনি ছেলেকে খুঁজলেন। কিন্তু ততক্ষণে ছেলে এলাকা অতিক্রম করে গেছে। শরীফা বেগম অঝোরে নিঃশব্দে কাঁদেেত কাঁদতে ঘরে ফিরলেন।
ইমতাজকে সব কিছু খুলে বলেন।
ইমতাজ ঘটনা শুনে অাঁৎকে উঠল ! সে ফুফু আম্মাকে বলল, ফুফু আমরা আজ খাব না। এক্ষণি বের হতে হবে। অপারেশনের সময় হয়ে গেছে।
শরীফা বেগম বলেন, বাবা তোরা কি বলিস ! দু'দিন থেকে খেতে পাস নি। এখন না খেয়ে চলে যাবি। আমি তোদের খাবারের ব্যবস্থা করছি, খেয়ে যা। তোরা না খেয়ে গেলে মায়ের কলিজা ফেটে যাবে বাবা !
ইমতাজ জানে তাদের এলাকা মিলিটারীরা ঘিরে রেখেছে। এ জন্যেইতো সে সাথীদের নিয়ে এখানে এসেছে। আমজাদকে না ঠেকাতে পারলে সে মারা যাবে। এ কথা ফুফুকে বলা যাবে না। আমজাদের কিছু হলে ফুফু বাঁচবেন না। তাই সে সাথী এগারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ফুফুর কোন বাঁধই মানল না।
তার ফুফু এই ছেলেটির জন্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমজাদের জন্মের আগেই বাবা-মা সেপারেশন হয়ে যায়। বাবা আবার বিয়ে করেছে। ফুফু তখন ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্রী। তিনি শিশু আমজাদকে নিয়ে বোনের বাসা ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যান। আমজাদ খালার বাসায় বড় হতে থাকে। ফুফু হোস্টেল থেকে এসে ছেলেকে দেখে যেতেন। এভাবে এমএ পাস করেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় চলে আসেন। উইমেন কলেজে চাকরি নেন। ছেলের কষ্ট হতে পারে ভেবে মা আর বিয়ে করেন নি। নিজের জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন। এসব ভাবতে ভাবতে ইমতাজ দলবল নিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
ইমতাজ সাথীদেরকে বলল, আমার ফুফাতো ভাইকে বাঁচাতে হবে। সেও আমাদের সাথী।
ইমতাজের দল এগুতে পারছে না। রাস্তায় আর্মিরা টহল দিচ্ছে। টের পেলেই গুলি ছুঁড়বে। আর এ পথ দিয়ে পালানো সহজ নয়। শহরের রাস্তা। তা ছাড়া তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে বেশিক্ষণ লড়া যাবে না। কিন্তু তাকে তো থেমে থাকলে চলবে না। ফুফাতো ভাই তাদের বাড়ির কাছাকাছি হলেই ধরা পড়বে। তাদের গ্রাম ঘিরে রেখেছে পাকিস্তানী আর্মিরা। ইমতাজ ভাবছে সাথীদের নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলে তারাও মারা পড়বে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল সে একাই দৌড় দিয়ে এগিয়ে যাবে। ইমতাজ এ গ্রুপের কমান্ডার। কমান্ডারের কাজ নিজের জীবন দিয়ে সাথীদের রক্ষা করা। এ শপথ সে নিয়েছে, প্রশিক্ষণের সময়।
সে নির্দেশ দিল, তোমরা এই বাগানে লুকিয়ে থাকবে। ইমতাজ তার ফুফাতো ভাইয়ের চেহারার বর্ণনা দিল। এও বলল, আমি ফিরে আসি আর নাই-বা আসি তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। যদি আমার ফুফাতো ভাইকে পাও তাকে নিয়ে সকাল হবার আগেই নিরাপদ জায়গায় সরে পড়বে।
বলেই ইমতাজ অস্ত্র হাতে দৌড় দিল। ইমতাজ জানে তার এমন অসাবধানতার জন্য ধরা পড়তে পারে। কিনত্ত সে কিছুতেই থামতে পারে না। তার মেধাবী ভাইটি এ দেশের ভবিষ্যত। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এমন ভাল ছেলে এ তল্লাটে নেই। নিজেতো লেখাপড়া করে নি। তারপর লোকে বলে বখাটে হয়ে গেছে। কি মূল্যইবা আছে তার জীবনের। কিন্তু আমজাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে। ইমতাজ রাস্তা পেরিয়েই ধান ক্ষেতের আইলে আমজাদকে পেয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে একটি গুলি তার বুকের ভিতরে সীমানা পেরিয়ে ওপার দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ইমতাজ আমজাদকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমজাদ আমি ইমতাজ, তোর খোঁজে এসেছি। আমার সময় নেই। এক্ষুণি আর্মিরা এসে যাবে। তুই সরে পর। হালিমা দিঘীর পাড়ের বাগানে এগারোজন মুক্তিযোদ্ধা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তুই সেখানে চলে যাবি। আমাদের গ্রাম আর্মিরা ঘিরে রেখেছে। সে দিকে যাবি না। আর্মিরা চলে আসছে এদিকে। তুই ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাক।
কিন্তু আমজাদ কিছুতেই আহত ইমতাজকে ছেড়ে যেতে পারে না ।
এবার ইমতাজ বলল, আমার কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে পারছি না। তোকে বেঁচে থাকতে হবে। দেশকে মুক্ত করতে হবে। তুই লুকিয়ে যা- ভাই।
এদিকে গাড়ির হেডলাইটের আলো এগিয়ে আসতে লাগলো। আমজাদ একটু সরে ধান ক্ষেতের আড়ালে শুয়ে পড়ে। আর্মিরা যে শিকারীকে এই মাত্র গুলি করল তাকে খুঁজতে লাগলো। তারা এতো রাত্রিতে ধান ক্ষেতের ভিতরে ঢুকতে সাহস করল না। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

আমজাদ আড়াল থেকে ফিরে দেখে ইমতাজ নেই। আশেপাশের ধান ক্ষেতের পানি লালে লাল হয়ে গেছে। ইমতাজ নিজেকে কোরবান করে দিল এ দেশের জন্য। ধান ক্ষেতের ঘোলাটে পানি লাল রং ধারণ করে স্বাক্ষী হয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
এদিকে গুলির আওয়াজ শুনে ইমতাজের সাথী এগারোজন মুক্তিযোদ্ধা পণ করলো তারা ফিরে যাবে না। এসেছে যুদ্ধ করতে তাই ভয় পেলে চলবে না। সাথী কমান্ডারকে বিপদে ফেলে যাওয়া যাবে না। হয়তো ওই গুলিটি কমান্ডারকেই টার্গেট করেছে। না জানি কি হয়েছে ! এতোক্ষণে তাদের বুঝতে বাকি রইল না যে, কেন কমান্ডার তাদেরকে নিরাপদে রেখে একাই এগিয়ে গেছেন। তাই তারা এগুতে লাগল। এক সময় তারা কমান্ডারের লাশের সাথে আমজাদকে পেল। কমান্ডারকে হারিয়ে সাথী মুক্তিযোদ্ধারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
ভোর হয়ে আসছে। শোকে তারা ভুলে গেল গ্রামটি আর্মিরা ঘিরে রেখেছে। ভোরের সূর্যের রক্তে রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়ছে দেখে তাদের চৈতন্য ফিরে এলো। এখনতো পালানো যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে। তারা দ্রুত ক্ষেতের পাশ্বর্ের বাড়িতে উঠল।
বাড়ির কর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে ভয় পেয়ে যান। একটু পরেই হয়তো বাড়িটি জ্বালিয়ে দেবে। ছেলেমেয়ে শুদ্ধ সবাইকে গুলি করবে। তার উপর এ ছেলেদের দেখলে কারোই রক্ষে নেই।
বাড়ির কর্তা বললেন, বাবারা তোমরা কোথায় লুকাবে। এ বিপদের সময় এখানে এলে কেন। তোমরা জান না মিলিটারীরা সারা রাত ঘিরে রেখেছে গ্রাম। আমাদের তো পালাবার জায়গা নেই। আমরা সারা রাত ঘুমাই নি। পালাবারও উপায় ছিল না। তোমাদের সাথের মুখ ঢাকা ছেলেটি কি মরে গেছে!
আমজাদ বলল, চাচা আমি মহিলা কলেজের শিক্ষিকা শরীফা বেগমের ছেলে।
চাচা আশ্চর্য হয়ে বললেন, তা হলেতো তুমি আমার চাচাতো বোনের ছেলে ? সেই ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছি।
চাচা আরো বললেন, বাবারা কথা বলার সময় নেই। আমার ছেলেমেয়েরা এখনো ঘুমিয়ে আছে। তোমাদের চাচী কোরআন শরীফ পড়ছেন। কেউ দেখার আগে তোমরা ওই নারার স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে পড়। লুকাবার জন্য এর চেয়ে ভাল জায়গা নেই। তা ছাড়া মিলিটারীরা এ বাড়িতেও চলে আসতে পারে। তারা মুক্তিযোদ্ধারে খোঁজে এ গ্রাম ঘিরে রেখেছে।
আমজাদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ইমতাজের লাশটিসহ নারার স্তুপে লুকিয়ে গেল।
নারার ভিতরে অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা গোলাগুলির বিকট শব্দ শুনতে পেল। মনে হলো গুলির আওয়াজ এগিয়ে আসছে। তারা পরস্পরকে বলতে লাগলো এবার আর রক্ষে নেই। হয় গুলিতে না হয় নারার আগুনে পুঁড়ে মরতে হবে। কেননা তারা যদি ঘর বাড়ি পোড়ায় তখন নাড়ার স্তুপেও আগুন দেবে।
ধীরে ধীরে মেশিনগানের আওয়াজ আরো স্পষ্ট হতে লাগল। নারার মধ্যে কয়েকটি গুলি এসে পড়ল। মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিল মরতে যখন হবেই তখন লড়েই মরবে।
আমজাদ বলল, তোমরা যদি গুলি কর সাথে সাথে ওরা মেশিনগানের গুলিতে নারার স্তুপ উড়িয়ে দেবে। আমরা শেষ হয়ে যাব। কিন্তু আমাদের কারণে গ্রামের সব মানুষকে ওরা শেষ করে দেবে। তাই এ অবস্থায় তোমাদের গুলি করা ঠিক হবে না। আমাদের কারণে গ্রামের একটি মানুষও যেন মারা না যায়।
আমজাদের কথায় মুক্তিযোদ্ধারা যুক্তি খুঁজে পায়। তাই তারা গ্রামের মানুষদের বিপদে ফেলতে চায় না।
হঠাৎ এক ঝাঁক গুলি এসে নারার মধ্যে পড়ল। আশেপাশে কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। নারার মধ্যে ইমরানের দেহটি ঝাক্কি মেরে উঠলো।
একি! ইমরানের বুকে গুলি লেগেছে। তরতর করে রক্ত পড়ছে।
ইমরান মুখে হাত দিয়ে সাথী ইকবালকে বলল, চুপ থাক। ওই দেখ আর্মিরা এদিকে আসছে। এক দম কাছে এসে গেছে।
ইমরানের বুকে গুলি লেগেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে পারছে না। দাঁতে দাঁত কামড়ে থাকে। সে জানে তার সময় শেষ ! একটু নড়াচড়া করলে মুক্তিযোদ্ধা সবাই মারা পড়বে। জীবনের শেষ সময়েও সাথীদের কথা ভাবতে হচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানে সহযোদ্ধারা একে অন্যের জন্য জীবন দিতে পারে ! ইমরানও শেষ সময়ে সাথীদের নিরাপত্তার কথা ভুলে যায়নি ! তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে যন্ত্রণার প্রকাশ না করেই চলে গেল !
এক সময় মিলিটারীরা চলে গেল। যাবার সময় অনেক ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধারা দু'দুটি লাশ নিয়ে গ্রাম ছাড়ল।
এ ঘটনার পর আমজাদ ভারতের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ শিবিরে চলে যান। সেখানে ২১ দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে ২৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে প্রথম অপারেশন শুরু করেন চাটখিলে। গাইড বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানী বাহিনীকে পূর্বেই জানিয়ে দেয়। ফলে প্রথম অপারেশনে সাথী ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমজাদ বন্দি হয়। সেনা ক্যাম্পে বন্দি আমজাদ ভাবছিল, কখন কিভাবে তাকে হত্যা করা হবে। তার মায়ের কি হবে। দেশের কি হবে। মৃতু্যর পর কি হবে। এতোসব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে। মাথা কাজ করছে না।
সন্ধ্যার পর বন্দি শিবিরের ৪২ জনের সকলকে ডাকা হলো। আমজাদ জীবনের শেষ দু'রাকাত নামাজ পড়ে নিল। গভীর ধ্যানে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল। অঝোরে কান্না কাটি করল। নামাজ শেষে সকলের সাথে খোলা ছোট্ট মাঠে লাইন ধরে দাঁড়াল আমজাদ। হঠাৎ গুলির শব্দ হলো। আমজাদের সামনে-পেছনের সকল বন্দির সাথে মাটিতে পড়ে গেল। গভীর রাতে আমজাদের জ্ঞান ফিরে এলে দেখে খোলা মাঠে পড়ে আছে, অনেক লাশের মাঝখানে।
মনে পড়ে যায়, পাকিস্তানী সেনারা অনেকের সাথে তাকেও গুলি করেছিল। সম্ভবত তখন সে লাইন থেকে একটু সরে গিয়েছিল। গুলি তার গা ঘেঁষে চলে গেছে। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
মাঠের এক প্রান্তে গাড়িতে লাশ উঠানো হচ্ছে। আমজাদ গড়িয়ে গড়িয়ে জঙ্গলের দিকে এগুতে লাগল। গাড়ির লাইট তার চোখে পড়ছে। আমজাদ বারবার আল্ল্ল্লাহর সাহায্য চাইছে, আর গড়িয়ে গড়িয়ে সরে পড়ছে। পাকসেনারা টর্চ লাইট মেরে এগুচ্ছে। মাঠের এক প্রান্তে অনেক মানুষ। তারা লাশ গাড়িতে তুলছে। আমজাদের মনে হচ্ছিল এবার রক্ষে নেই। তাকেও লাশের গাড়িতে লাশের স্তুপে ছুঁড়ে ফেলবে। তারপর মাটি চাপা দেবে। আর যদি তারা বুঝতে পারে এখনো জীবিত আছে তবে আরেকটা বুলেট খরচ করবে। তবু শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমজাদ সূরা ইয়াসীন পড়তে লাগল। হঠাৎ তার চোখে টর্চ লাইট জ্বলে উঠল।
একজন বাঙ্গালী বলে উঠল, তুমি বেঁচে আছ!
আমজাদ অাঁৎকে উঠল! এবার বুঝি সব শেষ।
বাঙ্গালী নিম্নস্বরে বলল, তুমি দ্রুত সরে পড়। সেনারা এ দিকে আসছে। আমি ওদেরকে একটু ঠেকিয়ে রাখি।
বলেই বাঙ্গালীটি সামনে এগিয়ে গেল। এ ফাঁকে আমজাদ ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেল। ঝোঁপ-জঙ্গল পার হয়ে অন্ধকার চিরে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে আমজাদ মুক্ত আলোর দিকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক খুবই সুন্দর ভাবে ..যুদ্ধের টান টান উত্তেজনা ফুটিয়ে তুলেছেন ..খুব ভালো লেগেছে ..ভাইয়াকে ধন্যবাদ ..
রফিকুজ্জামান রণি আশির্বাদ রইলো ভাই ! ভালো লাগলো আপনার লেখা / দন্যবাদ
মামুন ম. আজিজ মুক্তিযুদ্ধের এক তর তাজা কাহিনী। গঠন ভালো লেগেছে।
মিলন বনিক গল্পের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সুন্দর একটি বর্ণনা..ফুটে উঠেছে.. খুব ভালো লাগলো...ধন্যবাদ....
আহমেদ সাবের এ ধরনের লক্ষ লক্ষ ত্যাগে নির্মিত আমাদের প্রিয় দেশ। আপনার সাবলীল বর্ণনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে তাদের অমর কীর্তি। বেশ ভাল লাগল গল্প।
পাঁচ হাজার চমৎকার একটা মুক্তিযুদ্ধের উপর খন্ড নাটক দেখলাম যেন। মুক্তিযুদ্ধের লেখাগুলো সব সময়ই আবেগের। ভাল লাগল খুব।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি Khub Valo Laglo Alom Vai Mukti judhdher kahiniti...R likhechheno darun.........dhonnobad apnake........5
মাহবুব খান পড়ে মনে হলো সত্য কাহিনী /ভালো লাগলো
Abu Umar Saifullah অনেক ভালো লাগলো
মোঃ আক্তারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের উপর সুন্দর বর্ণনায় লেখা গল্প- মনে হয় যেন চোখের সামনেই সব কিছু ঘটছে| শুভ কামনা থাকলো লেখকের প্রতি অনেক অনেক|

১২ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪