প্রতিবাদী রুমা

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

তানি হক
  • ৩২
  • 0
  • ৯২
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই সব কিছু দেরি হয়ে যাচ্ছে রুমার ।এই দেরি শুরু ফজরের নামায থেকে । এবং তার পর কুরআন শরিফ তেলাওয়াত ,হাল্কা ব্যায়াম। নাস্তা খাওয়া, সব কিছুতেই হতচ্ছাড়া ‘দেরিটা’কিছুতেই আর পিছু ছাড়ছেনা, দ্রুত খাটের পাসে টেবিল থেকে মোবাইল টা হাতে তুলে নিলো ।৮;১০ ,সময় চোখে পরতেই আঁতকে উঠল ও ।আজ কপালে দুর্গতি আছে। সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন নিচে নামছিল তখন ওদের বিল্ডিঙের ৪তলায় ভাড়া থাকেন ।এক ভাড়াটিয়া মহিলার সাথে দেখা হয়ে গেল।মহিলার হাতে বাজারের ব্যাগ।মর্নিং ওয়ার্ক সেরে বাজার করে এসেছেন তিনি ।রুমাকে দেখেই তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পরল। রুমা মহিলাকে সালাম দিয়ে বলল;কেমন আছেন আনটি?
‘ভালো আছি আম্মু!তুমি কেমন আছ?’
‘আলহামদু লিল্লাহ’।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
ম্যাডামের বাসায়;
ঝটপট উত্তর দিল রুমা। বুঝতে পারছে দেরি হয়ে যাচ্ছে । তারপর ও মুরব্বি মানুষের সামনে অভদ্রতা ঠিক নয়।
‘আনটি আমি আসি, দোয়া করবেন;
বলে সিঁড়ির পরের ধাপে পা রাখল ও।
‘ঠিক আছে! বাসায় এসো সময় করে, ক্যামন?
‘জী ,আনটি ;
রুমা আর দেরি করলনা ।তারা তারি নিচে নেমে এলো। গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো ও।মাথাটা নিচু করে পরনের বোরখা দেখে নিলো ।যে তাড়াহুড়োতে বের হয়েছে বাসা থেকে তাতে। সব ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নেয়া দরকার।হাত দিয়ে মাথার স্কার্ফ ঠিক মত বসিয়ে নিল। তার পর কাঁধে ঝোলানো বই খাতার ব্যাগের বেল্টটা নড়িয়ে চরিয়ে ঠিক করে হাটা শুরু করল। রুমা ঢাকার শহরের এক স্বনামধন্য এলাকাতে বাস করে ;এখানের প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বিলাসিতার ছোঁয়া,বিল্ডিং এর সামনে নানা রকমের ফুল গাছ । রুমার নাকে সুন্দর একটা ফুলের ঘ্রাণ লাগল।কিন্তু এই মুহূর্তে ঘ্রাণটা কোন ফুলের ঠিক মনে করতে পারলনা। আজ সোম বার তাই রুমা ম্যাডামের কাছে পড়তে যাবে, ম্যাডাম সপ্তাহে ৩ দিন পড়ান। এর মধ্যে সোম বার ও আছে। যে ব্লকে ওর বাসা ঠিক তার ২ ব্লক পরেই ওর খালাতো বোন হিমুর বাসা। ও এখন হিমু দের বাসার দিকেই যাচ্ছে। তার পর হিমু আর ও এক সাথে যাবে ম্যডামের বাসায় পড়তে। রুমা হিমুর চেয়ে মাত্র ২মাসের বড়। একি কলেজে পড়ে দুইজন তাই সব কিছু হয় একি সাথে । সকাল বেলা ঝাড়ুদার রা রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছে।তাতে একদম পরিষ্কার লাগছে চারপাশ।রুমার মন টা খুশি হয়ে উঠলো।সব সময় যদি রাস্তা টা এমন পরিস্কার থাকতো! কিন্তু ম্যাডামের বাসা থেকে যখন পড়া শেষ করে আসবে ততক্ষণে এই পরিচ্ছন্নতার ছিটে ফোটাও আর থাকবেনা। সিগারেটের টুকরো জুস চিপসের খালি প্যাকেট সহ নানা রকমের ময়লার কুৎসিত দাগে বুঝার উপায় থাকবেনা যে মাত্র ২।৩ ঘনটা আগে পরিষ্কারের পবিত্রতা ছিল এখানে। রুমার খুশি হয়ে উঠা মন দপ করে নিভে গেল।
‘কবে যে আমরা বদলাব; বির বির করল ও।অথচ নিজের ধোয়া মোছা ঘরে ময়লা দেখলে কলিজায় কামর মারে। কিন্তু ধোয়া মোছা রাস্তায় ময়লা ফেলার সময় মনেই থাকেনা । সকালে ঝাড়ু দেয়া হয়েছিল কিনা, ‘হুহ! শালার স্বার্থপর দেশ প্রেম, নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হল রুমার। সেই ময়লা ভরা রাস্তায় ও তো হেটে ফিরবে কিন্তু ওইবা কি করবে? বুকের ভেতরে কেমন ব্যথা লাগছিল রুমার। ‘আমি কি কিছুই করতে পারি না? নিজেকে জিজ্ঞেস করলো মনে মনে।
হিমুদের বাসার সামনে এসে অবাক হয়ে গেল ও ,হিমু এখনো নিচে নামেনি! রুমা হাফ ছেরে বাঁচল।হিমু খুবি টাইম সচেতন একটা মেয়ে। কাটায় কাটায় টাইম মেনে চলা ওর বাতিক। রুমা ও টাইম মেনে চলার ব্যাপারে সচেতন কিন্তু হিমুর ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। এমনিতে সে শান্ত স্বভাবের হলেও টাইম মেনটেনের ব্যাপারে হের ফের হলে শান্ততার খোলস ছেড়ে রীতিমত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। ও বলে যে কোন কাজ টাইম মতো শুরু না করে দেরি তে শুরু করা মানে সেই কাজ টি প্রথমেই উলট পালট করে ফেলা ।আর প্রথমেই যে কাজে গরিমল, সেই কাজে সাফল্যতেও গরমিল। রুমার এই কথাতে সমর্থন থাকলেও। মাঝে মাঝে হিমুর বাড়া বাড়ি ওকে কষ্ট দেয় ।রুমা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতে যাচ্ছিল,এমন সময় হিমু বের হল। হলুদ রঙের বোরখা আর হলুদ রঙের স্কার্ফ পড়েছে ও।
‘কিরে !রাতে হিমুকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে স্বপ্ন দেখেছিস নাকি? হিমু ওর মুখোমুখি হতেই বলল রুমা। চোখ নামিয়ে নিজের বোরখা দেখল হিমু।
‘জখন বুঝতেই পারছিস তখন জিজ্ঞেস করিস ক্যান ? মিনমিন করে বলল ও ।রুমা ওর বলার ঢঙ্গে হেসে ফেলল।
‘তো ম্যাডামের আজ দেরি হল মনে হয়?; এমন সুযোগ সামনে আসবে কিনা ভেবে কথাটা বলেই ফেলল রুমা ।
‘নেকাব টা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ওর কথায় রাগ এবং বিরক্তি ঝরে পড়ল।
‘দেখ!এমনটা মাঝে মাঝে হতেই পারে ।এই কিছু খুঁজে না পাওয়া ,একটু আধটু লেট হওয়া।
‘হয়েছে হয়েছে এবার চল!এমনি তে দেরি হয়েছে!
রুমা হাত বারিয়ে হিমুর কাঁধে চিমটি কাটল। বেচারি হিমু আজ নিজেই নিজের উপর রাগ হয়েছে। ‘আল্লাহ ভরসা চল! বলল ও। সামনে আরও ৫ ব্লক পর ম্যাডামের বাসা, সবসময় ওরা হেঁটেই যায় কিন্তু কিছুদূর যাবার পর হিমু বলে উঠল- ‘চল রিক্সা নেই!মেজাজ ভাল নেই’ হাঁটতে ভাললাগছেনা;
রুমা মাথা ঝাঁকাল। রিক্সার খোঁজে ডানে বাঁয়ে তাকাতেই একটা খালি রিক্সা চোখে পরল । হিমুও রিক্সাটা দেখতে পেয়েছে।রুমার হাত ধরে টানল ।ওঁরা দুজন সামনে এগোল। ঠিক এমন সময় হঠাৎ পেছনে কয়েক জন পুরুষ কণ্ঠের চিৎকার টেরপেয়ে থমকে পেছনে তাকাল। এবং দেখতে পেল ওই দিক থেকে একটা ছেলে দৌড়ে আসছে। তার পেছনে আরও দুই টা ছেলে,সামনের ছেলেটার গায় পাঞ্জাবী। কিন্তু পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নিয়ে পুরো সামনের সাইড ছিরে ঝুলে গেছে,মাথার বড় বড় চুল এলো মেলো। ছেলেটার চেহারা তে আতংক উপচে পরছে ,প্রাণ পণ দৌড়ে এগিয়ে আসছে সামনে।মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত তাকে তাড়া করেছে ।রুমা হিমু দুই জনই জায়গায় জমে গেল।মুখ নেকাবে ঢাকা তাই মুখের অবস্থা বোঝা না গেলেও ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে , হঠাৎ ওদের দুজনের একটু পাসে একটি অর্ধ ভাঙ্গা ইটের টুকরা উড়ে এসে পড়লো।
হিমুর মুখ থেকে চাপা চিৎকার বেরিয়ে এলো। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে ওরা দুজন দ্রুত রাস্তার সাইডে সরে এলো। ওরা দুই জনই তাকিয়ে আছে পেছনে দৌড়ে আসা ছেলে দুই জনের দিকে।সামনের ছেলে টাকে ধরার জন্য সমান তালে এগয়ে আসছে। এক জনের হাতে বড় এক খণ্ড ইট। সে মুহূর্তে ইটটা ছুঁড়ে মারল। রুমা দেখল ইটের টুকরো টা পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার পায়ে গিয়ে আঘাত হানল। ছেলেটা ব্যথায় চিৎকার দিল ,এবং ঠিক ওদের কাছা কাছি এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মাটিতে পড়েই সে তার হাত দিয়ে পায়ের গোড়ালির কিছুটা উপরে চেপে ধরল। ব্যথায় ওর মুখ নীল হয়ে গেছে।যে ভাবে ইটের আঘাত লেগেছে তাতে হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। আসে পাসে আরও লোকজন ছিল, সবাই থমকে ,মাটিতে লুটিয়ে থাকা ছেলেটাকে দিকে তাকিয়ে আছে। রুমা দেখল দুই জন মহিলা দ্রুত সরে পরল ,তাদের মুখে আতংক।ততোক্ষণে আহত ছেলেটার কাছে পৌঁছে গেছে, পেছনের ছেলে দুইজন ,একজন পা তুলে ভীষণ ভাবে লাথি দিল ওর বুকে।
‘মা! গো’ ছেলেটার বুকের ভেতর থেকে চিৎকার বেরিয়ে এলো।পা ছেড়ে বুক চেপে ধরল এবার। প্রচণ্ড ব্যথায় দেহটা কুঁচকে গেছে।
‘আল্লহু আকবার! রুমার ও মুখথেকে চিৎকার বেরিয়ে এলো,ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে লাথিটা রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া ছেলেটার নয় ওর বুকে পড়েছে।
‘চল! চল!’ রুমার হাত ধরে টেনে রুমাকে পেছনে সরিয়ে আনল হিমু।রুমা হাত ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো,তার পর আতংকিত কণ্ঠে বলল ‘আরে দাড়া না;
‘তুই পাগল হয়ে গেছিস!এখানে দাঁড়াব মরতে! চেঁচিয়ে উঠল হিমু। রুমার আচরণে ক্ষুব্ধ ,আবারো রুমার হাত ধরে টেনে জোর করে সামনে হাটা শুরু করল। এখুনি এখান থেকে সরে পরা দরকার।উঠতি বয়সী বখাটে ছেলে ওরা,ওদের কাছে পিস্তল থাকাটা মটেই অস্বাভাবিক নয়, আর ওরা দুজন ফায়ার রেঞ্জের ভিতরে দারিয়ে আছে। কিন্তু রুমার মনোযোগ তখন পুরোপুরি ছেলে গুলর দিকে। ও দেখল দ্বিতীয় বারের মত প্রচণ্ড গতিতে পা চালাল ছেলেটা ,এবার নাক বরাবর লাগল লাথিটা,আহত ছেলেটা ককিয়ে উঠল।নাক থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে রাস্তায় মিশল। দুহাতে মুখ চেপে দুর্বল ভাবে উঠে বসার চেষ্টা করল সে কিন্তু আবারো লাথির আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল ।
রুমার কাছে পুরো ব্যাপারটা ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নর মত লাগছিল,আর লাগাটাই স্বাভাবিক মাত্র ১৭ বৎসরের তরুণী সে,বাবা মায়ের আদর আর সাবধানতার বেড়াজালে গড়ে উঠা গোলাপ কলির মতই নিষ্পাপ ও এবং ওর হৃদয়।মনের অজান্তেই হিমুর হাত থেকে আবারো ঝাঁকি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো । রাস্তায়ে সন্ত্রাসীরা কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলল অথবা পেট্রোল ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল,এমন দৃশ্য সিনেমাতে হাজার বার দেখেছে রুমা।কিন্তু এমন ভাবে কাউকে মারতে বা মার খেতে জীবনের প্রথম বার দেখছে তাই নিজেকে ইলেকট্রিক শট খাওয়া মানুষের মত লাগছে । আহত ছেলেটার পুরো মুখ রক্তে ভেসে গেছে,লাথির আঘাত ওর নাক আর ঠোঁট থেঁতলে দিয়েছে, রক্ত ছেলেটার চিবুক ছাড়িয়ে পাঞ্জাবীর বুক অবধি ছড়ানো ।এর মধ্যে এক জন ঘাতক ইকটু সরে গিয়ে আসে পাসে কি যেন খুঁজল। রাস্তার পাসে দেয়াল ঘেঁসে সাজিয়ে রাখা ইট দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল দ্রুত। রুমা আঁতকে উঠল! দেখল ছেলেটা আস্ত একটা ইট হাতে নিয়ে ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে ব্যথায় কাতরাতে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে এলো। কি ঘোটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রুমার ভেতরে একটা ঝাঁকি লাগল , ও দুই পা সামনে এগোল কিন্তু পেছন থেকে হিমু আবারো টেনে পেছনে নিয়ে এলো ।
‘রুমা!কোথায় যাচ্ছিস তুই? চল এখান থেকে! আতংক যেন চেপে ধরেছে হিমু গলা।
‘হিমু ওরা ছেলেটাকে মেরে ফেলছে! রুমা কান্না জোরানো কণ্ঠে বলল।
রুমা দেখল সেই আস্ত ইট দিয়ে কোনোমতে উঠে বসা ছেলেটার মাথায় আঘাত করল,সন্ত্রাসী টা ।কিন্তু এবার ওর গলা থেকে কোন শব্দ বের হলো না,শুধু মাথার হাড় আর ইটের সংঘর্ষের বিচ্ছিরি একটা শব্দ হল ।গোরা কেটে দেয়া কলা গাছের মত ধীর ভঙ্গিতে কাত হয়ে পরে গেল সরিল টা।রুমার মনে হল ছেলেটা হয়তো মরেই গেছে ,কিন্তু রাস্তায় সুয়ে পড়েই ছেলেটা ব্যথাতুর ক্লান্ত কণ্ঠে বলে উঠল ‘ভাই গো! আমারে বাঁচান ;ভাই গো! আমারে মেরে ফেলল!
এরই মধ্যে আসে পাশের বিল্ডিং এর দারোয়ান সহ আরও লোকজন জড় হয়ে গেছে,আতংকিত ভাবে ঘটনাটা দেখছিল সবাই। কিন্তু সবাই সবার নিজ যায়গাতে অনড়,কেউ কোন শব্দ করছেনা।এমনকি জখন ছেলেটা প্রাণ বাঁচানোর আত্মচিৎকার করছিলো,তখনও একজন লোক বাজারের ব্যাগ হাতে ওর কাছ ঘেঁসে চলে যাচ্ছিল ,তার চেহারা দেখে মনে হল যেন এখানে কোন বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেয়া হয়েছে,যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পরা যায় ততই ভাল। ‘ভাইয়ারা আপনারা আগান না সবাই; ওকে তো মেরে ফেলছে!’ হটাৎ উচ্চস্বরে চিৎকার দিল রুমা। একজন মানুষ কে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে ,আর সবাই চুপ চাপ ঘটনাটা দেখছে এটা সহ্য করার মত হৃদয় রুমার হয়নি এখনো ,রুমা আর দেরি করলনা ।হিমুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে আগালো, ওর বুকের ভেতর যেন হাতুড়ির বারি পড়ছে,কান দিয়ে গরম ভাপ বেরোচ্ছে মাথার বোধশক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
‘যা মর তুই!’ পেছনে হিমুর রাগান্বিত হিংস্র গলা সুনতে পেল, রুমা মাথা ফিরিয়ে রাস্তার ওপারে দোকানের সামনে তাকাল ,দেখল সেখানের মানুষ এখনো অনড় হয়ে দাড়িয়ে আছে,কেউই মারামারি টা থামানর বা সাহায্য করার জন্য ছুটে আসেনি ,রুমা ওর বুকের ভেতর ঘৃণার অগ্নিগিরির অস্তিত্ব অনুভব করলো,ওর হটাৎ মনে হল সামনের সন্ত্রাসীদের কাছে যাবার আগে ঐ মুখোশে ঢাকা ঠাণ্ডা মাথার সন্ত্রাসী গুলর কাছে আগে যায়। কারণ এই দুই গ্রুপের মধ্যে তো পার্থক্য খুবই কম একদল মারছে একদল দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে! রুমার অবুঝ আবেগি হৃদয় কষ্টে অভিমানে থর থর করে কাঁপছে, বুঝতে পারছেনা কি করবে। রুমা দাড়িয়ে পড়েছে দেখে হিমু ভাবল রাগের মাথাতে সামনে গিয়ে এখন হুশ হয়েছে!ব্যাপার টা যে কি ভয়ানক!এতক্ষণে কানে পানি গেছে।‘ফিরে আয় রুমা আর সামনে আগানোর দরকার নেই ;আকুল হয়ে আহ্বান করল ও।রুমার কানে এই কথা পৌঁছানোর আগেই সে সামনে পা বাড়িয়েছে।হিমু ঢোক গিলল,ওর ধারনা ভুল!রুমা দৃঢ় পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
‘আল্লাহ আমায়ে হিফাজত করো!; রুমা বিড়বিড় করল । ও রাস্তা পাড়ি দিয়ে ,ওই পাশে চলে এসেছে ,কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের বেল্ট টা শক্ত করে ধরে আছে। এক জন অনবরত লাথি দিয়েই চলছে,আর অন্ন জন আবারো হাতের ইট উপরে তুলছে ।
‘ভাইয়া আপনারা তো ওকে খুন করে ফেলছেন!’ কান্না জড়ানো কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল ও ।
জার হাতে ইট ছিল সে রুমার উল্টো দিকে মুখ করে দারিয়ে আছে । হটাৎ পেছনের নারী কণ্ঠ ওকে চমকে দিল, আঘাত করতে উদ্যত অবস্থায় থমকে পেছনে তাকাল। রুমা দেখল ছেলেটার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তে ভর্তি জঘন্য চেহারা । চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি,ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে।মুখ থেকে আগুন বের হওয়া ডাইনোসরের মত কুৎসিত আর ভয়ংকর লাগলো ওকে।
‘দেখেন বোন আপনি সরেন এখান থেকে!’ রুক্ষ স্বরে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ছেলেটা ।কিছুটা অবাক দৃষ্টি তে রুমাকে ভালো দেখে নিলো ।যেন আঁচ করতে চাইছে ও ঠিক কোন বয়সী মহিলা ।
‘আমাকে বোন বললেন!আর চলে যেতে বলছেন?; রুমা ঘাবড়ে গিয়ে বলল ।ছেলেটা ওকে বোন বলাতে একটু সাহস পেল।যদিও সন্ত্রাসী টার চোখে তাকাতেই ওর ভয় লাগছে, রাগে ছেলেটা ছেলেটা হাতের ইট পাশে ছুড়ে ফেলল।
‘আপনি এর মধ্যে নাক গলাতে এসেছেন কেন? আপনাকে যেতে বলেছি! যান এখান থেকে! রাগে চিৎকার দিল ছেলেটা,রুমার সাহস দেখে রক্ত উঠে গেছে মাথায়। রুমা ভয়ে কেঁপে উঠল ওর চিৎকারে , কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখল ।তার পর গলার স্বরে যথাসম্ভব কোমলতা এবং দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল, ‘ভাইয়া মাত্র আমায় বোন বললেন,আর বোন হয়ে,ভাই কাউকে মেরে ফেলছে এটা কি দেখা যায়?; আপনি ই বলুন।;
ছেলেটা ভীষণ রাগি ভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু হটাৎ যেন ওর মুখে কে লাগাম টেনে ধরল, রুমার বলা কোথাটা হৃদয়য়ের গভীরে বারি লেগেছে। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছেনা । রুমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, নেকাবের আড়ালে ঢাকা মুখ,কিছুই দেখা যাচ্ছেনা চোখ ছাড়া। অসম্ভব মায়াময় নিষ্পাপ দুটো চোখ,বড় বড় পাপড়ি অশ্রু তে ভেজা।মুখের ছবি না দেখলেও রুমার চোখে ভয়, উৎকণ্ঠা,আর ঘৃণার ছায়া দেখতে পেল ও ।
রুমা দেখল ,সন্ত্রাসী টার চোখের রঙ বদলে যাচ্ছে। মুখের টান টান চামড়া শিথিল হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করছে। ছেলেটা ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তায় পড়েথাকা রক্তাক্ত মানুষ টার দিকে তাকাল ,নাক মুখের পর এবার ওর মাথা থেকেও রক্ত ঝরছে, নির্জীব ভাবে পরে আছে দেহটা, উঠে বসার চেষ্টা টুকো করার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে।ও আবারো রুমার দিকে তাকাল ,চোখের হিংস্র ভাবটা আর নেই,বড় করে শ্বাস ছাড়ল একবার তারপর মাথা ঘুরিয়ে তার অপর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল
‘হয়েছে! এবার চল!
কিন্তু তার সঙ্গী এই কোথাতে একদমই অসন্তুষ্ট হল,সে মুখ বিকৃত করে তুমুল প্রতীবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিল। রুমা দেখল সঙ্গীর আচরণে ঘাতক টা তার চেহারায় সেই হিংস্র ভাব মুহূর্তে ফিরিয়ে আনল এবং দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল ‘ চল! ওর বাজখাঁই গলায় রুমা আর একবার কেঁপে উঠল ।
যদিও মার থামিয়ে ছেলে গুলো চলে যাচ্ছে দেখে ,মাথাটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে ওর। ছেলে দুই জন হাল্কা দৌড়ে স্থান ত্যাগ করল ।রুমা চোখ বন্ধ করে ঢোঁক গেলার বার্থ চেষ্টা করল। নিজের গলাটাকে শিরিষ কাগজের মত লাগছে ,নিজেকে একটু সময় দিল, অবশেষে চোখ খুলে তাকাল ।এই দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা দরকার। বিশ্বাস হচ্ছেনা ব্যাপারটা এত দ্রুত শেষ হয়ে গেছে ,ভেবেছিল শেষ অবধি ও নিজেও না মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে যায়!কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহের বানী যে ছেলে টাকে মাত্র দুলাইন কথাতেই প্রতিহত করতে পেরেছে। ছেলেটাকে কি বলেছিল মনে করার চেষ্টা করল।চরম উত্তেজনার মধ্যে কি এমন কথা বলল যে ….
‘রুমা তুই ঠিক আছিস?; হিমুর উৎকণ্ঠা ভরা কথার আওয়াজ ওকে বাস্তবে নিয়ে এলো । চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখল শুধু হিমু নয় আরও চার পাঁচ জন এগিয়ে আসছে ওর দিকে ।সবার নাকে মুখে চরম উত্তেজনা ।এমন সময় রুমার পাস ঘেঁসে একটা রিক্সা থামল।সেই রিক্সাটা যাকে তখন দেখেছিল,মাঝ বয়সী চালক রিক্সা থেকে নেমেই আহত ছেলেটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। এরই মধ্যে রিক্সাওয়ালার সাথে আরও দুই জন এসে তাড়াতাড়ি আহত ছেলেটাকে রিক্সায় উঠালো।রুমা তাদের তৎপরতা দেখে তাদের প্রতি বুকের ভেতর শ্রদ্ধায়ে ভরে গেল। মারামারির সময় এরা কি ছিল নাকি ছিলনা মনে পড়ছে না ।ছেলেটার সারা মুখে রক্ত,মাথা থেকে রক্ত ওর কপাল গড়িয়ে নামছে,কি জানি হয়ত আর দু তিনটা ইটের বারি মাথায় লাগলে,ওর প্রাণহীন নিথর দেহ টাই তুলতে হতো রিক্সায়! রুমা চোখ বন্ধ করে ফেলল এমন দৃশ্য ওর সহ্য ক্ষমতার বাইরে,মনে মনে মহান রব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া জানালো সময় মতো সামনে পা বারিয়ে ছিল তাই নাহয় এতক্ষণে.........।মানুষ জন কথা বলতে শুরু করেছে। ‘ছেলে দুই টা কোন এলাকার? ‘নিশ্চয়ই কাওসারের গ্রুপের পোলাপান;।
‘মেয়েটার সাহস দেখছ?’।
এমন টুকরো টুকরো কথা রুমার কানে ঢুকছে ।
‘রুমা এখুনি বাসায়ে চল; হিমু রুমার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল।রুমার মুখে কথা নেই নিশ্চুপ দারিয়ে আছে।
‘ভাইজান ফার্মেসী কোনদিকে?’ রিক্সাওয়ালা বলল।
‘সোজা আগাও’ আহত ছেলেটাকে যে ধরে রেখেছে সে উত্তর দিল। তার পরনের কাপড়ে মনে হচ্ছে আসে পাশের কোন বাড়ির দারোয়ান হবে সে।
‘দেহেন তো লগে মোবাইল আছে নাকি।; রিক্সার প্যাডেলে পা রেখে বলল রিক্সাওয়ালা ।
‘আরে ফোন পরে’!আগে নিয়ে যাও ফার্মেসিতে কেউ চিনলে চিনতেও পারে; রাস্তায় দাঁড়ানো একজন বলে উঠলো। ‘আরে মিয়া ! টান দাও রিক্সাটা!’ অপর আর একজন বলল ।
রুমা দেখল বেশ কয়েক জন লোক ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে,সবার চোখে জিজ্ঞাসা । রুমার কাছে কয়েক জন কে পরিচিত লাগল। ওরা দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছিল। ওদের দিকে তাকিয়েই রুমা চিৎকার করে সাহায্য চেয়ে ছিল । মাথার ভেতর একটি বিদ্যুৎ ওয়েভ বয়ে গেল ওর, রুমা সবার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল । ভালই হয়েছে লোক গুল নিজ থেকেই ওর কাছে এসেছে ।
‘আপা আপনার সাহস তো কমনা’! আপনি জানেন ওরা কারা ?যদি একটা ক্ষতি করে ফেলত আপনার? এক জন বলে উঠল।
রুমা ধীরে সুস্থে লোকটার দিকে তাকাল । মনে হচ্ছিল সিনেমার নায়কদের মত এক ঘুসি মেরে লোকটার মুখের দাঁত গুলো উপড়ে ফেলে।একজন মানুষ কে চোখের সামনে মেরে ফেলছে দেখেও,এগোয়নি যারা,তারা আবার বলে যদি ক্ষতি করে ফেলত! রুমা ভেবে পেলনা এর আসলে ঠিক কোন রূপের মানুষ ।না, না, মানুষ নয়! কোন রূপের অমানুষ।
ও মনে মনে খুশি হয়ে উঠল! সিনেমার নায়কের মত এক ঘুসি বসিয়ে দিলো লোকটার ঠোঁটে ,আর তার দাঁত গুল ভেঙ্গে ঝুর ঝুর করে ওর পায়ের কাছে পরল । তার পর তার মাথার চুল খামচে ধরে টেনে মুখের কাছে এনে শাপের মত ফিসফিস করে বলল ; ‘এই হল তোর শাস্তি! সারা জীবন তুই দাঁত ছাড়া খাবি!দাঁত ছাড়া চাবাবি! আর দাঁত ছাড়া হাসবি! তোর ভাই বিপদে পড়েছে আর তুই তাকে সাহায্য করতে আগাসনি! এই হল তোর শাস্তি!
হটাৎ রুমার ধ্যান ভাঙল ওর অবচেতন মন এইসব কি ভাবছে! রাগে ও পাগল হয়ে গেল নাকি?কারণ ও টের পাচ্ছে এক ভয়ংকর রাগ আর ক্ষোভের ছোবল বার বার ওকে অবশ করছে। না ও দিবা স্বপ্ন দেখছে? সব কিছুই স্বপ্ন?একজনের আর্তনাদ! কিছু লোকের পৈশাচিকটা!কিছু লোকের স্বার্থপরতা! একজনের বাধা দেয়া! সব?
‘কি আপু!কথা বলছেন না কেন? লোকটা অদ্ভুত ভাবে আবারো বলে উঠল।তার ভ্রু কুচকে উঠেছে। রুমা তার দিকে তাকিয়ে আছে।অথচ মনে হচ্ছে আসলে তার দিকে তাকিয়ে নেই!
রুমা নিজে কে সামলে নিলো। নিজের ভেতর সাহস যোগাল, দিবা স্বপ্ন দেখে সময় কাটাবার মেয়ে সে নয়, মাথার ভেতরের আবোল তাবোল ভাবনা সরিয়ে চরম তিরস্কারের স্বরে বলল;
‘ক্ষতি!ক্ষতি ত করেই ফেলেছে’! কেন?’ দেখেননি আপানরা?ইট দিয়ে এমন ভাবে বারি দিয়েছে মাথায় যে,হয় তো মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে আমার ভাইয়ের! আর কি ক্ষতি করবে ওরা?
রুমার জবাব সুনে সবাই থ হয়ে গেল। একজন অন্য জনের দিকে তাকাল।
‘ছেলেটা আপনার ভাই? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অল্প বয়সী একটা ছেলে।
‘হ্যাঁ! আমার ভাই!’ হৃদয়ের গভীর থেকে বলল রুমা।
‘না, না ,ওকে আমরা চিনি না’ কিন্তু প্রবল আপত্তিতে মাথা নাড়ল হিমু । রুমার কাণ্ড কারখানা কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।
‘আমার আপন ভাই সে!’ রুমা গলা চড়িয়ে বলল। ‘তাই তো আমি ছুটে এসেছি তাকে বাঁচাতে। আপনারা সবাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলেন,কারণ সে আপনাদের ভাই নয়! আপনারা আসবেন কেন? সে যদি আপনাদের আপন ভাই হতো আর বলত ‘ভাই গো!আমাকে বাঁচাও আমাকে মেরে ফেলল’ তা হলে ছুটে আসতেন ভাইকে বাঁচাতে, হাজার বার ছুটে আসতেন। তখন মনেই থাকতনা তাকে কে মারতেছে সন্ত্রাসী!না দুধের বাচ্চা! তখন মনেই থাকত না যে সন্ত্রাসীর সামনে গেলে আমাকে গুলি করতে পারে,আমাকে চিনে ফেলবে,পরে রাস্তা ঘাটে মারবে ঘর ভাংচুর করবে! কি এই সব মনে থাকতো বলুন? ইশ… কি দিল দরিয়া মানুষ আমরা!তাইনা! নিজের ভাইয়ের জন্য জান দিয়ে দিব কিন্ত অন্যের ভাইয়ের বেলায় গলার আওয়াজ টুকু না’। রুমা বুঝতে পারছে রাস্তায় দড়িয়ে এভাবে ওর কথা বলা একদম ঠিক হচ্ছেনা ।আশেপাশের মানুষরা তাকাচ্ছে।কিন্তু ও নিরুপায়! এই লোকগুলোকে যা বোঝাতে চাচ্ছে তা বলতে গিয়ে।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সত্যিই কঠিন ।
‘কিন্তু ভাইয়া একটা কথা মনে রাখবেন’ অন্নের ভাইকে বাঁচাতে না এগিয়ে আসলে,আপনার প্রিয় ভাই টিকে বাঁচাতে ও কেও এগিয়ে আসবেনা, সেইদিন আপনার ভাই বাঁচাও বলে চিৎকার দেবে।আর তার আসে পাসে থাকবে আপনার মত কিছু বুদ্ধিমান ভাইরা আর বোন রা!’ এতোটুকু বলে রুমা একবার অর্থপূর্ন দৃষ্টিতে হিমুর দিকে তাকাল । ‘যারা নিজের পরিচয় প্রকাশেই ভীতু হয়ে থাকে ,আর বাঁচাবে জীবন? আপনার ভাই রাস্তায় এভাবেই মার খাবে কিন্তু কারো সাহায্য আর পাবেনা। হাহ!’ এক টানে কথা গুল বলে রুমা থামল। নিঃশ্বাস নেয়ার ফাঁকে দেখল।সামনে মানুষ গুলর চেহারা কালো হয়ে গেছে। সত্যি তো! নিজের ভাইয়ের মাথায় কেউ ইটের বারি দিলে তার মাথাকি ঠিক থাকতো! কল্পনায় রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া প্রিয় ভাইয়ের রক্তাক্ত মুখ ভেসে উঠল !ভাই কে বাঁচাতে খুদার্থ্য বাঘের সামনে ও যেতে আপত্তি নাই। সবার মুখে অনুশোচনার গভীর ছায়া পরতে দেখে রুমার খুব ভাল লাগল । কিন্তু তারপরও রুমার হৃদয়গ্রাহী কথার মর্ম বোঝার হৃদয় তো আর সবার নেই! একজন ঠিকি বলে উঠল; ‘তার পর ও বোন! নিজে বেঁচে বাপের নাম!’ সে এমন ভাবে মাথা দোলাল যেন মানুষের জীবন নিয়ে ৫০ বছর গবেষণা করেছে। আর তার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে । রুমা তার কোথাতে থমকে গেল। তার পর এমন একটা ভঙ্গি করল যেন এই কথাতে ওর একশ ভাগ সম্মতি আছে। ‘হ্যাঁ!ভাইয়া আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন!নিজে বেঁচেই তো বাপের নাম। খাঁটি কথা ।তবে মনে রাখবেন সবার বেলায় সব খাঁটি কথাই সমান ভাবে ফলে!এই যেমন আপনি বললেন নিজে বেঁচে বাপের নাম! দেখবেন! এমন একদিন আসবে যেদিন সবার উদ্দেশে আপনি কাতর হয়ে বলবেন ‘ভাই গো! আমারে বাঁচাও! আর সেই দিন আপনি নিজের কানেই শুনবেন সবাই বলছে ‘নিজে বেঁচে বাপের নাম’ ঠিক ই তো!নিজে বেঁচেই তো বাপের নাম তাইনা? রুমা লোকটার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁর সমর্থন চাইল। কিন্তু সে বোবা বনে গেছে কিছু আর বলতে পারলোনা শুধু হাবার মত তাকিয়ে রইল। রুমা আর এক মুহূর্ত এখনে দাড়াতে মন চাইলোনা। ও ক্ষিপ্ত ভাবে মাথা ঘুরিয়ে হাঁটা শুরু করল এই লোকগুলোকে এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করতে পারছেনা। বুকটার ভেতর অভিমানে ,অপমানে,আর দুঃখের আঘাতে ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছে । অভিমান এই জন্য যে মানুষ কেন এমন স্বার্থপর! নিজের সব আপন আর পরের সব পর ভাবে! নিজের ব্যাথা নিজের আর পরের ব্যাথা পরের এমন ভাবে! কিন্তু এটা কেন ভাবেনা নিজের কষ্ট আর পরের কষ্ট তো একি !এর মধ্যে যে বিন্দু মাত্র তফাৎ নাই! তবে কেন মানুষ পরের ব্যথা নিজের ব্যথা মনে করেনা! রুমার চোখ দিয়ে কষ্টে ঝর ঝর করে পানি নামতে থকল নিজের ১৭ বছরের সুখী জীবনটা হটাৎ ভীষণ কুৎসিত আর নিরানন্দ মনে হল। ‘কেন আমরা এমন? নিজেকেই প্রশ্ন করল ও।পেছনে হিমুর পায়ের আওয়াজ টের পেল ও ।কিন্তু মটেই পরোয়া না করে আরও দ্রুত হাটা শুরু করল ।এই মুহূর্তে ও একা থকতে চায় ,হিমুর কাছে কোন রকম জবাব বা কৈফিয়ত দেয়ার ইচ্ছে একদমই নেই। বেশিক্ষণ রুমা এগিয়ে থাকতে পারলোনা।কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমু রুমা কে ধরে ফেলল।তবে কনো কথা বল্লনা চুপ চাপ শুধু হাঁটতে লাগল। রুমার দৃষ্টি নিচে ।ভুলেও হিমুর দিকে তাকাচ্ছে না । কিছুক্ষণ পরে দেখল ওরা দুজনই ম্যাডামের বাসা নয়!উল্টো হিমুদের বাসায় ফিরে এসেছে! এবং এটা দুজনের অজান্তেই হয়েছে। ব্যাপার টা বুঝতে পেরে থমকে, দুজনই দুজনের চোখে চোখ রাখল। রুমা কিছু বল্লনা চোখ সরিয়ে ওর বাসার দিকে শরীর ঘুরিয়ে ফেলল । কিন্তু হিমু খপ করে রুমার হাত ধরে অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠল; ‘রুমা প্লিজ! আমার কথা শোণ!’ রুমা দাড়িয়ে পরল।হিমুর অপরাধী কণ্ঠ ওকে দাড়াতে বাধ্য করেছে। ‘আমায় ক্ষমা কর! আ..আমি এতদিন অন্ধ ছিলাম!এতদিন একটা বিশ্বাস ঘাতক ছিলাম! নিজের বিশ্বাসের বিশ্বাস ঘাতক ছিলাম!নিজের আত্মার বিশ্বাস ঘাতক ছিলাম! নিজের দেশের বিশ্বাস ঘাতক ছিলাম!’ ও রুমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল ।আবেগে গলা কাঁপছে। ‘সেই ছোট বেলা থেকেই তুই আমায় বলতি!আমায় বোঝাতি কিন্তু আমি বুঝিনি!উপলব্ধি করিনি যে দেশপ্রেম কাকে বলে!ভালবাসা কাকে বলে।কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছি তুই আমায় সব সময় কি বোঝাতে চেষ্টা করিস! মানুষ হলেই যে মনুষ্যত্ত অর্জন হয়না,মানুষ হলেই যে সত্যি কারে মানুষ হওয়া যায়না। আজ আমার সব ভুল ভেঙ্গে গেছে! বিশ্বাস কর !ওই লোক গুলকে যখন তুই বলছিলি যে আপনার ভাই যদি রাস্তায় সুয়ে এভাবে বাঁচাও বলে….আমি সত্যি ওখানে রাসেল[হিমুর ছোট ভাই]কে দেখেছি !আমি দেখেছি ও চিৎকার করছে বাঁচাও বাঁচাও বলে কিন্তু কেউ আসছেনা সাহায্য করতে! আর সন্ত্রাসীরা ওকে পিটিয়েই যাচ্ছে,পিটিয়েই যাচ্ছে,বিশ্বাস কর!’ হিমুর গলা আঁটকে গেল ,আর কথা বলতে পারছেনা ,আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেছে গলার স্বর। রুমা দেখল হিমুর চোখ দিয়ে অশ্রু নামছে। ওবুঝতে পারল হিমুর বুকে কি ঝড় হচ্ছে।রুমা বড় করে শ্বাস ছড়ল!হাত রাখল হিমুর কাঁধে! নরম কণ্ঠে বলল। ‘চল!ভেতরে চল! এইতো সত্যি কারে মানুষ হয়ে উঠলি এবার!নিজের সাথে সকল মানুষের তুলনা এক করলি যে!সেই জন্যই তো মসজিদে সবার সমান অধিকার দেখিস না!সবার কাতার এক!কারো জন্য আলাদা কিছু নেই! কারণ যখন আমরা সবাই সবাই কে সমান ভাবে দেখব!তখন নিজের ভাই আর পরের ভাইয়ের মাঝে কোনই পার্থক্য খুঁজে পাবনা!’ হঠাৎ ওর স্বর ভারী হয়ে উঠল ‘যেমন পার্থক্য ছিলনা মহান মুক্তিযুদ্ধ র সময়। আমাদের সেই সব মুক্তি সেনারা তাদের ভাইবোন দের নিয়ে মাটির নিচে সিন্দুক খুঁচে বসে ছিলেন না তারা আমার তোর মত হাজারো ভাইবোন দের রক্ষার জন্য শত্রুদের মোকাবেলায় আশ্রয় ছেরে বেরিয়ে এসেছিলেন! আর দেখ আজ আমরা স্বাধীন! আমাদের পরের বলতে কিছুই নেই !সব আমাদের নিজের!এই মাটি ,এই আকাশ বাতাস। মানুষ জন। সব । তারা তাদের জীবন বাজী রেখে আমাদের এই দেশ,আমাদের জন্য!আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ করেছে । আজ আমরা খুব স্বার্থ বাদী হয়ে উঠেছি,নিজের স্বার্থের চিন্তায় অপরের জীবন দাম টাও আমাদের কাছে বড় সামান্য হয়ে গেছে। তাই তো দেশ গোল্লায় যাক! দেশের মানুষ গোল্লায় যাক! তাতে আমাদের কিছুই আসে যায়না। কিন্তু না...এমন করে খুব বেশি দূর আগানো যায়না! যতই তুমি নিজেকে নিরাপদ ভাবনা কেন, যদি তোমার ভাই বোন বিপদে থাকে তাহলে,একদিন না একদিন তুমি নিজেও বিপদে পড়বে! হিমু রুমার কোথায় মাথা ঝাঁকাল । তার পর বলল ; ‘আমি খুব ভয় পেয়েছি যখন তুই ওদের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলি’’ ‘কিন্তু দেখ! আমার কোন ক্ষতি হয়নি!কারণ আমি জানতাম নিয়ত গুনে বরকত।আমি ভাল কাজে এগিয়েছি! আমার সঙ্গে ভালই হবে! এই বিশ্বাস ছিল,নিজের ঈমানের উপর আস্থা আছে আমার! একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে যদি আমার জীবন চলেও যায় তাহলে আমার পুরস্কার জান্নাত! তাহলে কিসের ভয় আমার? এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু থাকতে পারে? এই ছোট্ট জীবনে । আর আমার মত হাজারো বোনদের বাঁচাতে গিয়ে কত ভাই অঘরে প্রাণ হারিয়েছে সে হিসেব কি আমরা জানি না?তাহলে আমার মত রুমা যদি কোন ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসী দের গুলি খেয়ে মরে তাহলে আফসোস কিসের ? আমার অন্তত কোন আফসোস থাকবেনা! চোখের সামনে আমারই মত কোন রক্ত মাংসের মানুষ বিনা বাধায় নির্মম ভাবে খুন হচ্ছে !এটা দেখার পরে সারা জীবন সেই দুর্বিষহ বেদনা বুকে বয়ে চলার চেয়ে প্রতিবাদ করে মরে যাওয়া অনেক ভাল! এটা আমার মনের বিচার ! বুঝলি ? হিমু রুমাকে হাল্কা ধাক্কা দিল। তার পর সামনে টানল। ‘হয়েছে! হয়েছে! এবার চল বাসায় !এত তাড়াতাড়ি তোর মনের আদালতে আমার এই দেশপ্রেমিকা বোনের মৃত্যু দণ্ড চাইনা!’ বলল ও ।রুমাও হেসে ফেলল ওর কথায়। হাসতে হাসতে উল্টো হিমুকেও ধাক্কা দিল বলল; ‘চল’।………..
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিরব নিশাচর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অসাধারণ একটি প্রতিবাদী গল্প... রুমার মত প্রতিবাদীরা ছাড়া এই দেশ পাল্টাবে না... দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরুক এমন প্রতিবাদীরা... এমন একটা লেখা জন্ম দিতে নিজেকে যথেষ্ট প্রতিবাদী মনোভাব রাখতে হয় বলে আমি মনে করি, তাই আজ থেকে তুমিও আমার দৃষ্টিতে একজন প্রতিবাদী তানি... বানানে আরেকটু সচেতন হতে পারো... সময়মত পড়তে না আশায় আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ...
আনিসুর রহমান মানিক আজ পুরোটা শেষ করে বলতে হলো ভালো লিখেছেন /
সূর্য একটা সময় বোরকা পরিহিত রুমার আবেগ আচরণে মনের ভেতরে কেমন যেন একটা নিনজা নিনজা টাইপের চরিত্র ভেসে উঠেছিল। "প্রতিবাদী রুমা" নামটাই এমন মনে হবার কারন। ভেবেছিলাম রুমা বোধ হয় দু-চার ঘা লাগিয়ে দেবে ঐ সন্ত্রাসীদের যা পরোক্ষভাবে আঘাত করবে সুপ্রিয় দর্শক বৃন্দকে। তবে গল্প তার স্বাভাবিক গতিতেই চলেছে। সুন্দর একটা (অনেক বড়) গল্প।
পাঁচ হাজার নামকরণ স্বার্থক। গল্পটাও সুন্দর হয়েছে। তবে প্যারা ছোট ছোট করে ভাগ করে দিলে পড়তে চোখের আরাম হয়।
মোঃ আক্তারুজ্জামান এরকম ঘটনা প্রায়ই চোখের সামনে ঘটে, শুধু দেখা যায় না প্রতিবাদ করার মত কোনো মানুষ| আমরা বড় স্বার্থপর, ভীতু| খুব ভালো লিখেছেন| বুঝতে পারছি- তাড়াহুড়া করাতেই শেষের দিকে প্যারা থাকেনি, থাকলে আরো দৃষ্টি নন্দন হত | তাড়াহুড়া পরিহার করবেন, বারবার রিভিশন দিবেন| প্রতিবারের রিভিশন আপনার লেখার মনকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে| অনেক অনেক ভালো থাকুন এই শুভ কামনা|
মোহাম্মদ শামসুল আলম খুব ভালো লাগলো আপনার গল্পটি এক সময় ব ড় লেখক হবেন
প্রজাপতি মন আমি জানতাম নিয়ত গুনে বরকত।আমি ভাল কাজে এগিয়েছি! আমার সঙ্গে ভালই হবে! এই বিশ্বাস ছিল,নিজের ঈমানের উপর আস্থা আছে আমার! একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে যদি আমার জীবন চলেও যায় তাহলে আমার পুরস্কার জান্নাত! তাহলে কিসের ভয় আমার? এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু থাকতে পারে? এই ছোট্ট জীবনে । আর আমার মত হাজারো বোনদের বাঁচাতে গিয়ে কত ভাই অঘরে প্রাণ হারিয়েছে সে হিসেব কি আমরা জানি না?তাহলে আমার মত রুমা যদি কোন ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসী দের গুলি খেয়ে মরে তাহলে আফসোস কিসের ? অনেক ভালো লাগলো তোমার সাহসী লিখা ......... :) সত্যিই মন ভরে গেল রুমার সাহসিকতা দেখে. ৫/৫ দিয়েও মন ভরবেনা, দিয়ে গেলাম আশির্বাদ তোমায়, ভালো থেকো, শুভকামনা রইলো.
M.A.HALIM খুব সুন্দর হয়েছে ভালো লাগলো। বন্ধুর জন্য শুভ কামনা রইলো।
মোঃ শামছুল আরেফিন ৪০৫৬ শব্দের গল্প। অনেক সময় নিয়ে পড়তে হবে। আপাতত তাই পিডিএফ ফাইলে সেইভ করে রাখলাম। পরে পড়ে কমেন্ট করব।

০৯ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪