সর্ব প্রথম জন্ম দাতা বাবার কথা শুনেছি। তার পর জীবনে অনেক বাবার নাম শুনেছি। পাগলা বাবা, নেংটা বাবা, দরবেশ বাবা, ফকির বাবা, সাইবাবা, পীর বাবা, লালবাবা, সাধু বাবা তবে ইয়াবাবার কথা কখনো শুনিনি। নেশার চমৎকার আধুনিকায়ন। কে ভেবে ছিল এমন জিনিস আসবে, বাবা দুনিয়া মাতাবে। যে বাবা হবে জন্ম দাতা বাবাদের আতংক !
কয়েক বছর আগেও গাঁজা কি চিনতাম না। মদ গাঁজা জোড়া শব্দ জানতাম। আমার পরিবেশে গাঁজার পরিচয় ছিল না। মনে উড়ু উড়ু ভাব নিয়ে হাটতে হাটতে ভার্সিটিতে প্রথম দিন গিয়েই সিগারেটের ধোঁয়ায় ঝাঝালো গন্ধ পাই। সিগারেট আমিও টেনেছি এমন কড়া গন্ধ কখনো বের হয় নি। উৎফুল্ল ভাব নিয়ে হাটছি তাই সে দিকে কোন পাত্তা দেই না। কয়েক দিনে আমাদের বিভাগের কয়েক জনের সাথে পরিচয় হওয়ায় এদিক সেদিক ঘুরাফেরা হয়। একদিন ঘুরতে ঘুরতে আসরের একটি সিগারেট টান দিয়ে অবচেতনের মধ্যে মাঝে মাঝে চেতন পেতে শুরু করি। আমার হাসি আর থামে না। সুন্দর একটি অনুভুতি আমাকে ছুঁয়ে যায়। কি হল বুঝতে পারি না। জুটে যায় কয়েক জন। এক সময় আমাকে ধরে ফেলে। আমিও নিয়মিত হয়ে যাই।
পার্কের গাছতলায় বসে আড্ডা জমাই। ভয়ের কোন কারণ নেই। কৈফিয়তের কোন বালাই নেই। আমরা স্বাধীন। চলছে আমাদের নিয়মিত আসর। একদিন আমি রিংকু আর ডলার বসে ছিলাম কড়ই গাছ তলায়। দুজন লোক আমার ডান পাশে কয়েক হাত দূরে গিয়ে বসে। সে দিকে আমাদের ভাবনা নেই। আমারা আমাদের কাজে ব্যস্ত । বিস্কিট বিস্কিট ঘ্রাণ পেয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে ডান পাশে ঘাড় ঘুরাতেই শুনি- ঐ দেখ ইয়াবা খাচ্ছে, রিংকুর কথা শেষ না হতেই ডলার বলে ইয়াবা ? ইয়াবা মানে ? ইয়াবা মানে ইয়াবা, অত্যাধুনিক নেশা- রিংকুর সাফ সাফ উত্তর। আমি একবার ডান দিকে তাকাই একবার রিংকুদের দিকে তাকাই। ভাই লাগবে ? কাথাটি শুনে আবারও ডান দিকে তাকিয়ে দেখি এক জনের বাম হাতের তালুতে একটি লাল বড়ি রেখে আমাদের দিকে হাত মেলে ধরে বলছে- লাগলে আছে। আমি আর ডলার সম্পূর্ণ নতুন। ডলারের আগ্রহে লোক দুটি আমাদের সাথে এসে বসে। তাদের হাতে বিস্কিটের সেই ধোঁয়া উড়ানো সরঞ্জাম, গ্যাসলাইট কাগজ কয়েন আর অর্ধ গলানো একটি বড়ি । রিংকু জানে কিন্তু এখনো ট্রাই করেনি। আমি আর ডলার এই প্রথম দেখলাম। আমাদের কৌতহলে লোক দুটি খুশি হয়েছে মনে হয়। জিনিসটা একে বারেই নতুন তাই দুশ্চপ্রাপ্য আপনারা চাইলে প্রতিদিন সাপ্লাই দিতে পারব- হাত নেড়ে মাথা ঝুলিয়ে দুজন বেশ জোড়ালো ভাবে আমাদেরকে আশ্বাস দেয়।
আমাদের মধ্যে সর্ব প্রথম ডলার এই বিস্কিটের ধোঁয়ার স্বাদ নেয়। আমার পরে রিংকু। নতুন অনুভুতিতে মন ভরে যায়। বেশ লাগে। মনের মধ্যে কেমনজানি উতাল পাতাল করে। হুম এই হল বর্তমান যুগের উৎকৃষ্ট নেশা। কোন বিশ্রী গন্ধনেই। কারো কাছে ধরা খাওয়ার ভয় নেই। আর পাওয়া যায় নব যৌবন। আহ্ কি দারূণ অনুভূতি। আজকাল ডাইল পাওয়া যায় না। দামও নেয় বেশী, আবার আনতেও রিক্স। তাই এই জিনিসটাই বেশী চলে। স্বগৌরবে বলে জগদীশ, ঐ দুই জনের একজনের নাম জগদীশ। পালা করে কয়েক রাউন্ড টেনে কয়েকটি বড়ি আগুনের তাপে ধোঁয়ায় রুপান্তরিত করে আকাশে মিলিয়ে দেই। কয়েক দিনের মধ্যেই আমার এক বছরের ব্রান্ড পরিবর্তন হয়ে যায়। স্টিকের পরিবর্তে এখন প্রতিদিন আসে ইয়াবা। সারাদিনের ক্লান্তি এখন আর রাতে জেকে বসে না। পৃথিবী ঘোরে আমি ঘুরি না, পৃথিবীর সূর্য অস্ত যায় আমার ভূবনে সূর্য অস্ত যায় না। আমি নিজেই সূর্যের মতো তাকিয়ে থাকি, সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে আমি ভেসে বেড়াই ক্লান্তিহীন সু-ঘ্রাণের সুখানুভূতিতে।
সময়ের সাথে তালমিলিয়ে দেখতে দেখতেই স্টিক আর ডাইলের আসর গুলো পরিবর্তন হয়ে অত্যাধুনিক হয়ে যায়। ইয়াবাবার বদৌলতে এখন আর বোরকাতে হয় না একশ পকেট। ডাবের ভিতর থাকে না সিরাপ। একে বারে হারিয়ে যাওয়ার পথে কাঁচের বোতল। এখনো চলে স্টিক, পকেট দুর্বল থাকলে এর কোন বিকল্প নেই। প্রথম প্রথম শহরের গুটিকয়েক জনের দখলে থাকলেও এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। গ্রামের অলিগলিতেও পাওয়া যায়। নির্ভয়ে নিয়ে যাওয়া যায় বাজারের ব্যাগে, মাছের ভিতরে, ফলের ভিতরে, আরো কত ভাবে। এখন এগুলি সবার জানা। রাস্তায় চেকিংএ ধরা খায় তাই কন্ডমের ভিতরে একশ দুশ ট্যাবলেট নিয়ে পায়ু দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। যেখানে পৌঁছাতে হবে সে খানে নির্ভয়ে পৌঁছে দেয় ক্যরি ম্যানরা। পৌঁছাতে পারলেই অনেক টাকা। সবনেশা খোররাই এই ট্যাবলেটের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। মুদি দোকানে রাখা সাবান সিগারেট আর চকলেটের মতো, রাখে ক্যাশ বাক্সের একটু আড়ালে - হাতের সাদা কাগজটা চিকন করে কেটে গোল করে বাঁশির মতো গুলিয়ে প্যাঁচানোর সময় একটানে কথা গুলো বলছিল প্রথম খোর, খোর থেকে ক্যরিম্যান, ক্যরিম্যান থেকে ঘুরে ঘুরে ফেরিকরে বিক্রি করা আজকের এই ডিলার জগদীশ। সব খোর সমান তালে টাকায় কুলাতে পারে না তাই এক সময় ব্যবসায়ী হয়ে যায়। জগদীশও খাওয়ার যোগান দিতে ব্যবসা করে ডিলার হয়েছে। এখন সে নিজে বিক্রি করে না। তার অনেক সেল্সম্যান আছে। এখন সে সারাদিন সারা রাত খায়। মাঝে মাঝে এসে মার্কেট যাচাই করে। সেই সুযোগে আমাদের সাথে আড্ডাদেয়। এর প্রকারভেদ নিয়ে যখন আলোচনা করে তখন আমার মনে হয় ভার্সিটির ক্লাসের চাইতে এই ক্লাস বেশী মজার। তিন প্রকার ইয়াবা বাংলাদেশে আসে। প্রথম প্রকার ট্যাবলেটের নাম আইস ক্লোল্ড মানে এটি খেলে চুপচাপ ঠান্ডা হয়ে থাকে। ডক খেলে লক্ষণ হয় কুকুরের আচরণের মতো। আরেক প্রকার ট্যাবলেট আছে যা আসল যদিও ঐটা কম পাওয়া যায়, এটা খেলে বাড়ে সেক্সসুয়াল অনুভুতি। আরো কত কি। তার কথা শুনে মনে হয় ইয়াবার উপরে গবেষণা করছে। এভাবেই তিনি আসর জাঁকান। হয়তো বাবা নামটিও তার দেওয়া।
আজ আসর থেকে উঠতে সন্ধা হয়ে যায়। পার্কের উত্তর পূর্ব পাশের কর্নারে পাবলিক টয়লেটের দিকে তিন জন মেয়ে এগিয়ে যেতে দেখে রিংকু বলে ঐ দেখ পাখিরাও ট্যাবলেট খুজছে মনে হয়। তার কথা শেষ না হতেই সবুজ ঘাসে বসে ব্যাগ থেকে জিনিস বের করে ধোঁয়া গেলা শুরু করে দেয় ওরা। ডলার বলে বাংলাদেশের ষাট ভাগ ছেলেরা ইয়াবার ভক্ত হয়ে গেছে। সাথে সাথে মেয়েরাও। আমি বলি আমরা পুরুষ মানুষ, তাই আমরা না হয় খাই। কিন্তু মেয়েরা খায় কেন ? ডলার উত্তর দেয় আরে বোঝ না শরীরের চর্বি কমায় স্লীম হয়, রাতে অধিক কাজ করার জন্য খায় বুঝলা- তার কথা শেষ হতেই তিন জন হাসতে থাকি। সন্ধা হতে হতে পাখিদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আসরের সংখ্যা।
দুপুরের কড়া রোদে ঢাকা কলেজের সামনে হাটতে হাটতে দেখি রাস্তার পাশে পুতে রাখা একটি রড ধরে টানছে এক পাগল। মুখ দেখেই চিনতে পারি তার কাছেই আমার হাতে-খড়ি। কি জগদীশ কি খবর ? আমার কথায় কোন পাত্তা দেয় না। আবারও জিজ্ঞেস করি। মাথা তুলে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রড নাড়াতে নাড়াতে বলে আঙ্কেল আপনার কাছে কি একটা একটাকার সাদা চকচকে কয়েন হবে আমার কাছে হাতুরি নাই, এই রডটা তুলব। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তার পর তার শরীরের দিকে তাকিয়ে বলি- আহারে জগদীশ আমার ওস্তাদ জদদীশ, এরি মধ্যে সব তার ছিঁড়ে গেল ? হয়তো একটা তার ভালো আছে তার বর্কতে এখনো কোমরে ঝুলছে দড়ি দিয়ে বাধা কয়েক বছরের পুরনো, ছেড়া ফাড়া ময়লা পেন্ট। গুরুর লাইনে আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। হয়তো আর ছ মাস কি এক বছর অপেক্ষা।
পাগলা বাবা নেংটা বাবা দরবেশ বাবা ফকির বাবা সাইবাবা পীর বাবা লাল বাবা সাধু বাবার পায়ে মাথা কুটে মরলেও টাকা ছাড়া চোখ তুলে তাকান না। টাকা ছাড়া কাউকে চিনেন না। জন্মদাতা বাবা একপলকের জন্যও সন্তানকে ভুলে থাকতে পারেন না। প্রতিনিয়ত তাদের খোঁজ খবর রাখেন। সন্তানের সুন্দর জীবন আর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শরীরের রক্ত পানি করেন। কিন্তু বাহিরে সন্তানেরা কি করে তার সব কিছুই জানা সম্ভব হয় না। যখন জানেন তখন হয়তো আর কিছুই করার থাকে না। তবু চেষ্টা করেযান বাবার কর্তব্যে। একটি পরিবারে একজন নেশাখোর থাকলে ঐ এলাকার শান্তি তাড়ানোর জন্য সেই যথেষ্টে।
ইয়াবার ক্ষমতার বলে যুবক যুবতীরা এমন ভাবে ধ্বংস হচ্ছে যে কোন চাকুরী অথবা ব্যবসা করে সংসার চালানো তো দূরের কথা নিজের দু পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী বিশ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার লোক পাওয়া যাবে না। পঙ্গু প্যারালাইস্ড চোর আর তার ছিড়া গোছের লোকের সংখ্যা হবে বাংলাদেশের মোট জন সংখ্যার অর্ধেক। ভাবতেও শরীর ঘেমেযায় । পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নেশা এসেছে তার মধ্যে ইয়াবার ছোঁয়াচে ক্ষমতা সবচাইতে বেশী। পৃথিবীর সব জন্ম দাতা বাবারা আজ সন্তানের ধ্বংস দেখে হতবাক। তারা ইয়াবার ধ্বংসের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছেন। দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হারাম হচ্ছে। যুব সামাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। বর্তমানে পৃথিবীতে ইয়াবার উপরে আর কোন বাবা নেই। সবচাইতে ক্ষমতাধর, নেশা জগতের বাবা। ইয়াবাবা। সন্তানের জীবনে ইয়াবাবার নেশার ছোবলে, ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন জন্মদাতা বাবা।
৩০ আগষ্ট - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪