শিশু বিশেষজ্ঞ ডক্টর শামসুজ্জামান এর চেম্বারে প্রচন্ড ভিড়। সপ্তাহে চার দিন চেম্বারে বসেন বিকাল ৫ টা থেকে রাত ৯ টা অব্দি। বেশ সুনাম কামিয়েছেন ইতমধ্যেই তাই রোগীর কমতি থাকে না । প্রতদিন গড়ে ১২ থেকে ১৫ টি বাচ্চা আসে নানা রকম সমস্যা নিয়ে । আর সোমবার যেন ডাঃ শামসুজ্জামানের জন্য খুবই শুভ দিন। কোন এক অজ্ঞাত কারনে প্রতি সোম বার প্রচুর রোগী আসে ।
প্রায় ঘন্টা খানেক হলো মিনু-রফিক তাদের বাচ্চাকে নিয়ে অপেক্ষা করছে কোনের দিকের একটা লম্বা মতন বেঞ্চে ।খুবই অপ্রসস্থ জায়গায় আর আট দশ জন রোগীর উপস্থিতিতে চ্যাম্বারটি তে রীতিমত দম বন্ধ হয়ে আসছে মিনুর ।
তিন মাসের ছেলেকে নিয়ে এসেছে ওরা , চোখে একটা অসহায় চাহনি দুজনেরই ......।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক .......একটা বাচ্চার জন্য কত সাধনা , কতো কান্নাকাটি ,কতো কষ্টই না করেছে মিনু। তারপর যখন বাচ্চাটা এলো ওদের জীবনে, ঠিক নিশ্চিন্তে থাকতে পারে নি একদিন ও । দুই মাসের মধ্যে বেশির ভাগ সময় ছেলেটা কান্নাকাটি করে কাটিয়েছে। বাচ্চাটা দিন রাত কেঁদেই যাচ্ছে , থামার কোনো লক্ষণ নাই, মিনু কত রকম কৌশলেই না ছেলেটাকে থামাতে চেষ্টা করছে। রফিক মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় আবার নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলের কাছে যায়, কোলে নেয়, বাইরে নিয়ে যায় , তাতে কিছুটা শান্ত হয় বটে কিন্তু সেটা খুব কম সময়ের জন্য ।
মিনু অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকায় , বলে কিছু একটা করো দয়া করে , আর তো ছেলের কান্না সহ্য করা যায় না । রফিকই বা কি করবে , তিন মাসের বাচ্চাকে তো আর বাইরের খাবার খাওয়ানো যায় না , তবু কয়েক রকম বাচ্চাদের উপযোগী দুধের কৌটা কিনে এনেছে । মিনু ও নানা ভাবে চেষ্টা করছে খাওয়াতে কিন্তু ছেলে কিছুতেই খাবে না ।
গত সাত দিন থেকে বাচ্চাটা কিছু খায়নি বললেই চলে, ফিডারে করে খুব অল্প পরিমান দুধ খায় কি খায় না , আর সামান্য পানি , এই খেয়ে কি থাকতে পারে ছেলে ?
রাজা বলেই ডাকে ওরা কিন্তু বাচ্চাটির এখনো ভালো কোনো নাম রাখা হয় নি, কিছু টাকা পাবার কথা আছে আগামী মাসে। সেই টাকাতেই ছেলের আকিকা দিবে ভেবে রেখেছে , একটা নাম ও ভেবে রেখেছে দুজন মিলে ...। টানাটানির সংসার, ছোট একটা কোম্পানিতে নিতান্তই ছোট একটা চাকরি করে রফিক । কিন্তু ছেলের অবস্থা দেখে আকিকার চিন্তা বাদ দিয়ে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে এলো শেষ পর্যন্ত।
বিয়ের ৫ বছর হতে চলল ওদের , আগে দুজনের সংসার কোনো রকমে চলে যেত কিন্তু গত মাস দুয়েক হলো ছেলেটার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে, মাসের অর্ধেকেই রফিকের হাত খালি হয়ে যায় । মিনুও জানে সেটা তাই তো মুখ ফুটে কিছু বলে না , কোনো কিছু চায় ও না নিজের জন্য , চাইতে হয়তো জানেইনা । আমাদের সমাজে মেয়েদের শুধু দিতেই শেখানো হয় , নিতে বিশেষ করে চেয়ে নিতে খুব কম মেয়েই পারে ।
প্রায় দুই ঘন্টা পর ডাক এলো ওদের, এলোমেলো ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলো রফিক। মিনু আর ছেলে সহ ডাক্তারের চ্যাম্বারে ঢুকে সালাম দিল, ডাক্তার সাহেব সালামের উত্তর দেবার তেমন প্রয়োজন বোধ করলেন না । সরাসরি সমস্যার কথা জানতে চাইলেন '' বাচ্চার কি সমস্যা বলেন , সব কিছু খুলে বলবেন।''
রাজা কেঁদেই যাচ্ছে , ওকে সামলাতে সামলাতে দুজন পরস্পরের মুখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো । সব কথা খুলে বলা ঠিক হবে কিনা তাই হয়তো ভাবছে ওরা ।
একটু পরে মিনু খুব নিচু গলায় জানালো ..... ডাক্তার সাহেব বাচ্চা কিছু খেতে চায় না , ক্ষুধার জ্বালায় সারাদিন কান্নাকাটি করে ।
ডাক্তার জানতে চাইলেন '' বয়স কত বাচ্চার? বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন না?''
মিনু কি বলবে ভেবে পেলনা , মুখ নিচু করে থাকলো /
ডাক্তার আবারও প্রশ্ন করলেন বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন?
মিনু লিজ্জিত ভাবে মাথা নেড়ে না করলো ।
'' এই হল আপনাদের সমস্যা , বাচ্চাকে ব্রেস্টফিডিং করবেন না আর একটু কাঁদলেই ডাক্তার দেখাতে ছুটে আসবেন । "
এরপর ডাক্তার সাহেব রাজাকে নিয়ে পাশের খাটে শুইয়ে দিলেন, নানা ভাবে পেট চোখ ঘাড়ের পিছন দিক পরীক্ষা করে জানালেন .....'' তেমন কোনো সমস্যা তো দেখছি না , এক কাজ করুন বাচ্চাকে ব্রেস্টফিডিং করানোর চেষ্টা করুন, আর আগেই করানো প্রয়োজন ছিল। যাই হোক প্রথম দিকে দুধ না আসলেও চেষ্টা করে যাবেন দিন সাতেক, তারপর যদি দুধ না পায় তাহলে নাহয় আর একবার আমাকে দেখিয়ে নিবেন ।''
ডাক্তারের ফি ৫০০ টাকা দিতে দিতে রফিক একটা ছোট্ট করে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল .....'' যাক বাবা বেশি টাকা খরচ হয় নি, ওষুধ পত্র কিছু কিনা লাগলো না , কোনো টেস্ট করতে দেয়নি ...বড় একটা খরচ বেঁচে গেল ''। কিন্তু ডাক্তার সাহেব যা বলল তাতে কি কাজ হবে? এই প্রশ্ন মিনু রফিক দুজনার মনেই ।
বাড়ি ফিরে দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে মিনু তাদের শোবার ঘরে রাজাকে নিয়ে গেল , তারপর কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা সংকোচ আর সবচেয়ে বেশি কিছু একটা হারানোর ভয় নিয়ে জীবনে প্রথমবার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। প্রথমে রাজা কিছুতেই বুকে মুখ দিতে চাচ্ছিল না , বেশ খানিকটা সময় পর টানতে শুরু করলো , কিন্তু দুধ না থাকায় বেশিক্ষণ আর সামলানো গেল না , আবার কাঁদতে শুরু করলো । ব্যর্থ চেষ্টা শেষে মিনু কেনা দুধই কিছুটা খাইয়ে রাজাকে ঘুম পাড়ালো ।
দিন চারেক পরের কথা । সকালে মিনুর নিজেকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে , বুকটা বেশ ভারী আর ব্যথাও আছে সাথে , তবে কি ওর বুকে দুধ আসবে ? বিশ্বাস হতে চায় না মিনুর । ডাক্তার সাহেব দিন সাতেক চেষ্টা করতে বলেছেন , মিনু মনে মনে ঠিক করে সে দিন দশেক চেষ্টা করবে তারপর কিছু না হলে আবার ডাক্তার দেখাবে । তবে একটি ব্যাপার খেয়াল করছে মিনু , আজকাল রাজার কান্নাকাটি অনেক কমে গেছে । মিনু নিজের মনে এখন বিশ্বাস করা শুরু করেছে যে ডাক্তারের কথা ঠিক হবে , হবেই ।
বেপারটা রফিক ও খেয়াল করেছে যে ছেলে আজকাল কম কাঁদে , মিনুকে একবার জিজ্ঞাসাও করেছে যে রাজার কান্নাকাটি কম শোনা যায় দুদিন থেকে , ঘটনা কি ? মিনু লজ্জায় কিছু বলেনি কিন্তু রফিকের কাছে তো ঘটনাটি লুকানো যাবে না , বলতেই হবে , আজ রাতেই এক ফাঁকে বলবে বলে ভাবছে ...।
রাতে রাজা ঘুমানোর পর মিনু কাছাকাছি হয়ে খুব আস্তে আস্তে রফিক কে জানালো তার বুকের ব্যাথার কথা । কিন্তু রফিক তাতে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না বরং মিনুকে আরও কাছে পাবার ইচ্ছাটি আবার নতুন করে ওকে জাগিয়ে তুলল । কিছুদিন থেকেই মিনু কেমন যেন দূরে দূরে থাকছে , আজ কাছে চাইই চাই । মিনু বেশি কিছু বলার আর সুযোগ পেল না তার আগেই রফিকের দুই হাতের মাঝে নিজেকে আবিস্কার করলো । তারপরের কিছুটা সময় সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে দুজন শুধু দুজনের ।একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমের কোলে আশ্রয় নিল এই যুগল। জীবন যুদ্ধে অনবরত সংগ্রাম করতে থাকা মানুষদুটি আজ রাতের মত জয় করে নিয় জীবনের খানিকটা ।
গায়ে জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে ঘুম ভাঙ্গার পর মিনুর কেমন অচেনা লাগে নিজেকে । গা মেজমেজ বুকে ব্যাথার পাশাপাশি বুক ভীষণ ভারিও লাগছে আজকে ...এমন হয় নাকি তাহলে? কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবে তেমন লোকও নেই আশেপাশে। রাজার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় কেটে যায় কিছুটা সময় । ছেলের ঘুম ভাঙ্গা কান্নার শব্দে দৌড়ে যায় মিনু , ছেলে কোলে নিয়ে আল্লাহর দরবারে মনে মনে দোয়া করে '' হে আল্লাহ , আমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করো , তোমার অপার করুনা যেন আমি পাই '' । তারপর মিনু জীবনের এক অভিনব পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নেয় , নিজের কাছে নিজের চূড়ান্ত পরীক্ষা ।
অফিসে যাবার জন্য তৈরি হতে রুমে ঢুকে রফিক মিনুর কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায় ......হল কি ওর, চোখে পানি কেন? পাশে গিয়ে বসে , তারপর আলতো হাতে মিনুর কাঁধে হাত রেখে জানতে চায় কি হয়েছে । মিনুর চোখে পানি থাকলে ও মুখে ছড়িয়ে আছে একটা পরিতৃপ্তির হাসি '' জানো আমি আজ সত্যি সত্যি মা হতে পেয়েছি ......... পেটে না ধরেও আজ আমি রাজার মা হতে পেরেছি ।'' রফিক অবাক হয়ে তাকায় মিনুর কোলে শুয়ে দুধ খেতে থাকা রাজার দিকে ।রফিকের বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁয়েছে । কথা হারিয়ে ফেলে ও ...শুধু একটা শব্দই বের হয় বিস্মিত রফিকের মুখ থেকে '' সত্যি''!