আমার দেশপ্রেমের চারিত্রিক সনদপত্র

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

এস,এম, মোস্তফা আব্দুল্লাহ
  • ১৫
  • 0
  • ৬৩
১৯৭১ সাল।টগবগে যুবক আমি । নতুন বউকে ফেলে দেশের টানে চলে যাই ভারতে।এক মাস কঠোর পরিশ্রম করে যোগ দেই সম্মুখ যুদ্ধে।কি উত্তেজনার সেই সব দিন।বেঁচে থাকার জন্য নিজের সাথে,শত্রুর সাথে প্রতিক্ষণ লড়াই। কখনো কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে,কখনো রাতে,কখনোবা কড়া রোদে।হাতে একটা রাইফেল নিয়ে সদা প্রস্তুত। হয় মারো নয়ত মর।কখনো শত্রুকে ঘায়েল করে বিজয় উল্লাস,কখনো সহযোদ্ধার লাশ নিয়ে শোকের মাতম।
নিজের চোখে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধার লাশকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে ক্ষত বিক্ষত করতে । দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের উপর রাজাকারদের প্রসাব করতে।উদ্ধার করেছি কিশোরীকে যাকে রাজাকাররা তুলে দিয়েছিল পাকবাহিনির হাতে।সন্তানসম্ভবা মায়ের উলঙ্গ লাশের উপর শকুনের হুমড়ি খেয়ে পড়া দেখেছি।
নিজেকে সবসময় মৃতের মত মনে হত ।এত অন্যায় করছে পাকবাহিনী।আর তাদের কিনা সাহায্য করছে আমার দেশের লোকেরা। যারা নিজেদের রাজাকার,আলবদর,আল শামস বলে গর্বের সাথে পরিচয় দেয়।নিজের বন্ধুর কন্যাকে তুলে দেয় পাকিস্তানি অফিসারের মনোরঞ্জনের জন্য।সবাইকে বিপদে সাহায্য করত যে হিন্দু ধনী লোকটি,তাকে বাজারে উলঙ্গ করে প্রহার করে হত্যা করে এইসব জানোয়াররা।
মনে পড়ে যায় একটি মিশনের কথা।খুলনার ছোট একটি গ্রাম হোগলাডাঙ্গা।হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামের স্কুল ঘরে ক্যাম্প করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।তাদের সাহায্য করত এলাকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান শমসের খান।পাকিস্তানি অফিসারের জন্য প্রয়োজনে যে কোন কাজ করতে পারে সে।এলাকার হিন্দু তরুণীদের এর মধ্যেই সে নাজরানা হিসেবে পেশ করেছে তার প্রভুদের সামনে।প্রতিদিন একেকটি ঘরে শোকের মাতম ওঠে। কারো গরু,কার ছাগল নিয়ে এসে প্রভুদের উদরপূর্তি করে। এলাকার সব মুসলমানকে বাধ্য করেছে রাজাকার বাহিনিতে ভর্তি হতে।পাকিস্তানি অফিসার তাকে নাম দিয়েছে আনাস ই পাকিস্থান।মানে পাকিস্থানের সেরা বন্ধু।
আমরা ১০ জন ওই সেনাদলের হাত থেকে নিরীহ গ্রামবাসীদের বাঁচাতে মিশনে গেলাম।ক্যাপ্টেন রাকিব ব্রিফ করলেন প্ল্যান।
-দেখ,স্কুল ঘরের দক্ষিন দিক দিয়ে ২ জন ফাকা ফায়ার করতে থাকবে।পাকিস্তানী সেনারা তখন ওই দিকে মনোযোগ দিবে।বাকিরা তখন পিছন থেকে সাঁড়াশি অভিজান করে ওদের ধরাশায়ী করবে।
মিশন শুরু হল।২ জন ফাকা ফায়ার শুরু করতেই আমরা বাকিরা পিছন থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।মরণপণ লড়াই করে অবশেষে ওদের ধরাশায়ী করলাম।আমার বা পায়ে সেই মিশনের সৃতি রয়ে গেছে।স্কুল ঘর দখল করে তল্লাশি চালালাম কোন বেজন্মা বেঁচে আছে কিনা দেখতে।অন্ধকার একটি ঘরের ভিতর থেকে গুমরানো কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালাম।ভেতর থেকে উদ্ধার করলাম তিন রক্তাক্ত কিশোরী আর কিছু উলঙ্গ মহিলার লাশ।ঘরের ভেতরেই পেলাম সেই শমসের খাঁকে।আমার পা দিয়ে নয় তখন হৃদয় দিয়ে রক্ত ঝরছিল।ইচ্ছা করছিল জানোয়ারটাকে জবাই করে ওর রক্ত দিয়ে মেয়েগুলিকে গোছল করিয়ে দিতে।ক্যাপ্টেন আমাদেরকে ওই জানোয়ারটাকে বন্দি করে রাখার হুকুম দিলেন।এরকম নির্দয় হুকুম মানতে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পালন করলাম।কিছুদিন পরেই দেশ স্বাধীন হল।এইরকম কিছু জানোয়ার যারা আমাদের হাতে বন্দি ছিল তাদেরকে স্বাধীন দেশের সরকারের হাতে তুলে দিলাম । দেশের কল্যাণে সবাইকে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।এখন ভুলে যান ওদের কথা।সময়মত ওদের বিচার কড়া হবে।ক্ষত বিক্ষত দেশের সেবায় নিয়োজিত হলাম।যোগ দিলাম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।বাচ্চাদের পড়াই আর পড়ানোর ফাকে গল্প বলি আর সৃতিচারণ করি সেইসব দিনের। অরা খুব একটা চমকায় না কারণ যুদ্ধের স্বাদ ওরাও পেয়েছে। ওদেরকে বলি দেশপ্রেমের কথা।দেশ মায়ের কথা।বলি মায়ের জন্য যেমন বায়েযিদ তার মায়ের বিছানার পাশে গ্লাস হাতে দাড়িয়ে ছিল তেমনি তোমরাও দেশ মায়ের সেবায় সারাজিবন তার পাশে থাকবে। কিছুদিনপর জনৈক সরকারের আইনের ফাঁক গলে এসব জানোয়ার বেরিয়ে এল।ইচ্ছা হল আবার রাইফেল হাতে তুলে নেই।কিন্তু দেশের বিশিষ্ট জনেরা বললেন অরা ভুল করেছিল ওদের ক্ষমা করে দাও।কুকুর পায়ে কামড় দিলে কি তার পায়েও কামড় দিতে হবে।কিতু তাদের কিভাবে বুঝাই যে অরা কুকুরেরও অধম।
হাওয়া বদল হয়।আমার সন্তানেরা বড় হয়।কখন জানি গ্রামের পাশের নদীটা শুকিয়ে যায়। দেখি আমার বোনদের ধর্ষণকারীদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা। বিজয় দিবসে এইসব পশুদের পাশে আমাদের বসার বাবস্থা করা হয়। যে বিজয় আমরা জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছি সেই বিজয় উৎসবে যাওয়া বন্ধ করলাম। বারবার মুক্তিযোদ্ধার লিস্ট তৈরি করা হয়। যাকে আমি দেখেছি এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করতে,পাকিস্তানি প্রভুদের মনোরঞ্জন করতে তারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পায় সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে।আমি অথর্ব বৃদ্ধ হিসেবে রিটায়ার্ড করি।পেন্সিওন নামক কিছু ভাতার জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধার লিস্টে নিজেকে রাখার জন্য একটি চারিত্রিক সনদপত্রের প্রয়োজন পড়ল।গেলাম স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে।তিনি বললেন ওটা এমপি সাহেবের কাছে থেকে নিতে।বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অপশক্তির শরীক দলের সেই নেতার কাছে গেলাম।দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তার সাথে দেখা হল।চমকে উঠলাম তার পাশে সেই জানোয়ার শমসের খাঁকে দেখে।নিজেকে প্রশ্ন করলাম আমাকে এই শমসের খাঁর কাছ থেকে চারিত্রিক সনদপত্র নিতে হবে?
আমার সনদপত্র তো আমার পায়ের ক্ষত যা আমি আজ বয়ে বেড়াই।আমার সনদ পত্র তো দেশের মানচিত্র। আমার সনদপত্র তো লাল সবুজের ঐ পতাকা।
নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওই সনদপত্রের জন্য কোন আবেদন পত্র আমার গ্রহন করা হয় না। অভাবের সংসার, নিজের মেহেনতের ওই সামান্য টাকা পেলে হয়ত বাঁচতে পারতাম।কিন্তু ওই রাজাকারের কাছ থেকে আমি আমার চারিত্রিক সনদপত্র নিতে পারব না।সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।জানি,আত্মহত্যা মহাপাপ কিন্তু আমি নিরুপায়।এই অসহ্য যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছি না।আমার মৃত্যুর পর আমাকে ওই লাল সবুজ পতাকায় জড়িয়ে কবর দিয়ো। আর ওদের চখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ো যে ওটাই আমার চারিত্রিক সনদপত্র।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রোদের ছায়া খুব খুব ভালো লেখা বলতেই হচ্ছে/ এত কম বয়সে এরকম লেখা যে সম্ভব সেটাও ভাবনার বিষয় /
সালেহ মাহমুদ খুব ভালো লাগলো।
নিলাঞ্জনা নীল অসাধারণ!!!!! অনেক অনেক ভালো লাগলো.......
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি ভীষন ভীষন ভালো লাগলো আপনার গল্পটি পাঠ করে। লেখকের সাথে আমিও একমত। আমিও মুক্তি যুদ্ধ দেখেছি তাই মাঝে মাঝে আমার মাথায়ও ঐ একই চিন্তা কাজ করে ....।যাই হোক কমেন্ট লিখতে লিখতে চেয়ার থেকে উঠে আপনাকে একটা স্যালুট করলাম স্যার, আসা করি আপনি তা গ্রহন করবেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সন্মান করতে পেরে আমি ধন্য মনে করতে চাই।
আহমেদ সাবের অনেক কষ্টের গল্প। রাজাকারকে আমরা এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছি। এ’ লজ্জা আমরা রাখি কোথায়? বেশ চমৎকার সাবলীল লেখা। অনেক ভাল লাগল।
তানভীর আহমেদ এত বাস্তবতা থাকার পরেও সত্য কেন প্রকাশ হয় না, মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। যাক, খুব সুন্দর লেখা। শুভ কামনা।
M.A.HALIM চমৎকার গল্প। খুব ভালো লাগলো।
সাজিদ খান ছোট গল্প হিসেবে দারুন হয়েছে।খুব ভাল লাগলো ।শেষের লাইনগুলো খুব আবেগপ্রবন..
নিরব নিশাচর ছোট গল্প হিসেবে বেশ সুন্দর... tobe আরো কিছু যত্ন নেয়া যেত... শেষের লাইনগুলো চমত্কার... ভালো থাকবেন সবুজ পতাকা গায়ে জড়িয়ে...

০১ আগষ্ট - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪