অ্যাগালম্যাটোফিলিয়া

পূর্ণতা (আগষ্ট ২০১৩)

মামুন ম. আজিজ
  • ২১
  • ৫১
এক.
একজন নাকি একটা কংকাল নিয়ে এসেছে, সম্পূর্ন মানব কংকাল।

আমরা যখন রেজিষ্টার অফিসের দিকে এগোচ্ছিলাম তখনই শুনলাম ষ্টাফরা নিজেদের মধ্যে কংকাল বিষয়ে কানাঘুষা করছিল। আমি আর আমার স্ত্রী নাফিয়া সহজেই বুঝলাম গেইট দিয়ে ঢোকার সময় যে হট্টগোল চলছিল তাহলে তা এই কারণেই। কংকালটা আমাদের চোখে পড়েনি অথবা আমরা একটু তাড়ার মধ্যে ছিলাম, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে কয়েকটা পরিবহণ বদলে তবে পৌঁছেলিাম এই শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনিষ্টিটিউট এ। অত খেয়াল করা সময় তখন কোথায়। তবে লোকটি সম্ভবত আমাদের দৃষ্টিতে মুহূর্তের জন্য হলেও ধরা পড়েছিল। আমাদের রিকশা ঢুকতে পারছিল না, দাড়োয়ান আর সেই লোকটিরর কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, লোকটির গায়ে ছিল উজ্জ্বল রক্ত বর্ণের পাঞ্জাবি, ষ্ট্রেইট চুল একটু কাঁধের নিচে ঝুলে ছিল, বাতাসে উড়ছিল। একজন এগিয়ে এসে আমাদের দু’জনের চিঠিটা দেখেই ঢুকতে দিয়েছিল। তারপর আমরা লাল পাঞ্জাবী ওয়ালাকে আর গুরুত্ব না দিয়ে ঢুকেই পড়েছিলাম।

আমি আর আমার স্ত্রী একসাথে ট্রেনিংটা করা জন্য গত দুবছর ধরে অপেক্ষা করেছি। অবশেষে তদবীর কাজে লেগেছে। তবে তার জন্য আমাদের এই নির্জন মফস্বলে আসতে হলো। আমি যদিও গত বছর একা একা ট্রেনিংটা করার সুযোগ পেয়েছিলাম রাজধানীতেই। কিন্তু ঐ যে একসাথে করব ঠিক করেছি। আমাদের এখনও ভালবাসার আবেশ কমেনি। ক’বছর আর হলো বিয়ে হলো। মাত্র বছর চার। বাচ্চা কাচ্চা এখনও নেয়নি। এই ট্রেনিংটার জন্যই সেটাও থেমে আছে। নির্জন মফস্বল হলেও এলাকাটা বেশ সুন্দর। ইনিষ্টিটিউটের পেছনে বেশ পাহাড়ের সারি। নয়ন জুড়িয়ে যায়। আমাদের মত শিক্ষক দম্পতির জন্য আদর্শ প্রশিক্ষণ স্থান। কিন্তু ট্রেনিংয়ের চিঠি হাতে পাবার পর জানলাম এখানে দু’জন কে আলাদা আলাদা থাকতে হবে। নারী আর পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হোষ্টেল। সেটাই স্বাভাবিক আমাদের দেশে। কিন্তু আমরা তো তা মানব না। শিক্ষা অফিসে উচ্চ পর্যায়ে একটু তদবিরের সুযোগ ছিল। সেটা কাজে লাগিয়ে হাজার দুয়েক টাকা গোপনে উপরি খরচে ব্যয় করে এই ইনিষ্টিটিউটটের শিক্ষকদের জন্য থাকার গেষ্ট হাউসে আমরা একটা রুম বরাদ্দ পেয়েছি বিশেষ বিবেচনায়। এখন তাড়াহুড়া সে কারনেই, অনিয়েমের এই পাওয়াটা যত তাড়াতাড়ি হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু রেজিষ্টার অফিসের লোকটা আমাদের বসতে বলেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ল।

নাফিয়া আর আমি ভাবছি আমাদের গেষ্ট হাইসে রুম পাওয়া নিয়ে আবার কোন সমস্যা হলো কিনা! নাফিয়া অবশ্য সান্তনা দিলো। নাফিয়ার এই গুনটা আছে। সে আমার মত এত সহজে উতলা হয় না। এটা আমার খুব পছন্দ। অবশ্য যখন হয় তখন আবার বেশিই হয়। পছন্দের গুনটি আবার আমার মধ্যে একটুও নেই। অথচ থাকা উচিৎ ছিল, আমি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান পড়াই , পদার্থ বিজ্ঞানে অস্থিরতার কোন জায়গা নেই। সব কিছু নিয়মতান্ত্রিক, সুস্থির, এমনকি একটি সরল গোলকও যে শুণ্য মাধ্যমে অন্তকাল দুলতে থাকে তাও একটা নিয়মতান্ত্রিক, আসলে সৃষ্টির সব রহস্য মাঝে এই সুস্থিরতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার বন্ধন, যা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় সৃষ্টিকর্তার নিয়মতান্ত্রিকতার পরাকাষ্ঠা। নাফিয়া জানাল তার ধারণা গেটে ঐ লাল পাঞ্জাবী ওয়ালার কংকাল সমস্যা সমাধান করতেই লোকটা উঠে গেছে। নাফিয়া আরও জানাল সে রুম নিয়ে ভাবছে না, এই নির্জন মফস্বলে ট্রেনি আর ট্রেনিরারের সংখ্যা আর কতই বা হবে, রুম এখানে কোন সমস্যাই না, টাকা না দিলেও নাকি পাওয়া যেত। এই নিয়ে তার সাথে আমি তর্কে গেলাম না, সে জানে না এই দেশে শিক্ষকদের কত পদে কত ধরণের ঘুষ দিতে হয়। সব কাজতো তার আমিই করে নিয়ে আসি সে বুঝবে কি করে। তবে সে জানাল তার মাথায় কংকাল বিষযটা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি অবাক হলাম না, দর্শনের শিক্ষিকার মাথায় এমন বিষয় একটু ঢেউ তুলবে সে আর অবাক হবার কি। বললাম, ভয় পেলে নাকি? সে উত্তর না দিয়ে বরং বলল, শোনোনি ওরা বলছিল কংকালটার গায়ে নাকি সেলোয়ার কামিজ পড়ানো। আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায় কি শুনলে, কংকাল কেউ পড়াশোনার জন্য নিয়ে আসতে পারে মানা যায়, কিন্তু পোষাক পড়ানো কংকাল! দূর ও চিন্তা বাদ দাও, ভুল শুনেছ। চল একটু উঠোনে গিযে চারদিকে চোখ ফেরাই। দেখেছোতো জায়গাটা কি সুন্দর। কেনো যে এখানে কেউ আসতে চায়না!

নাফিয়া উঠলো না। আমার এদিকে অস্তির লাগছে। দূর কখন যে রুমটা বরাদ্দ পাব? একবার উঠে যেতে পারলে হয়।

অপেক্ষার পালা শেষ হলো। প্রায় মিনিট বিশেক পার হয়েছে। লোকটা এসে তার সিটে বসতে বসতেই মাত্র একবার সরি বলেই অনর্গল ঘটনা বলতে লাগলো যা আমি না হলেও নাফিয়া অন্তত শোনার জন্য অধীর আগ্রহে ছিল।

লোকটির কথায় জানা গেলো লাল পাঞ্জাবীর আড়ালে লোকটির নাম আনন্দ চৌধুরী। গেটে দারোয়ানরা তাকে না চিনেই ভুল করে ট্রেইনি ভেবে কংকাল দেখে আটকেছে। তাও আবার কংকালের গায়ে কাপড় পড়ানো। আসলে দারোয়ান তো আর তার ঘটনা জানে না। তারা চিঠিও ভাল করে দেখে না। তার হাতের চিঠিটা যে পোষ্টিং অর্ডার কোন ট্রেনিং অর্ডার না তা তারা পড়ে দেখবে কেনো। কংকাল নিয়ে তারা তর্কে ব্যস্ত। লাল পাঞ্জাবীও গোয়াড় লোক। তার এক কথা দারোয়ানরা বেয়াদবী করেছে, এখুনি ডিরেক্টরকে ডাকতে হবে। রেজিষ্টার অফিসের লোকটা কংকালের কথা শুনেই নাকি বুঝেছে ওটা আনন্দ স্যার। উনি প্রশিক্ষনার্থী নয় বরং প্রশিক্ষক। বায়োলজির পাঠ পড়ান শিক্ষকদের। মাথায় তার কিছুটা গোলযোগ আছে বলে শোনা যায়। কিন্তু প্রশিক্ষক হিসেবে অতুলনীয়। খুবই পন্ডিত ব্যক্তি। সে কারনেই বিভাগীয় শহরে সবচেয় বড় ট্রেনিং ইনিষ্টিউটেই তার পোষ্টিং হয়েছিল। কিন্তু ঐ যে কংকালটা তার চির সঙ্গী। বিয়ে থা করেনি। এক কংকাল নিয়েই তার বসবাস। সেদিন ঐ ইনিষ্টিটিউটে একটা পার্টি ছিল। শহরের মেয়র, সরকারী বেসরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকতা, শিক্ষা অফিসের উর্ধ্বতন লোকজন অনেকেই আমন্ত্রিত ছিলেন। সেই অনুষ্টানে গোল গোল খাওয়ার টেবিল। সেখানে হঠাৎ আনন্দ স্যার উপস্থিত হলেন তার প্রিয় কংকালটাকে কোলে নিয়ে। তাও আবার বেশ সুন্দর একটা শাড়ি পড়িয়ে। বসালেন পাশের চেয়ারে। আর জায়গায় কোথায়। মেয়রকে কে বোঝাবে ও ব্যাটা কংকালটা নিয়েই কাটায় রাত-দিন। সচারচর এসব অনুষ্ঠানে সে আসে না ঠিকই। সেদিন কি মনে কনে যেন চলে এসেছিল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এক অফিসারের স্ত্রী তো কংকাল দেখে সেই যে মূর্ছা গেলেন, তার জ্ঞান ফিরেচিল পরদিন সকালে। লোকটা বলল, বোঝেন কত ভয়াবহ বিষয়। ওমন একটা লোকের জন্য অবশেষে এই নির্জন ইনিষ্টিটিউট হলো নতুন পোষ্টিং স্থান। কপাল ভাল চাকুরীটা হারান নি। অবশ্য যোগ্য্য শিক্ষক, খুবই যোগ্য।

রেজিষ্টার অফিসারটি তাই শোনা মাত্র ছুটে গিয়েছেন আমাদের বসিয়ে রেখে, আনন্দ স্যারকে গেইট থেকে উদ্ধার করে, তার কংকাল আর বাক্স পেটরা সহ গেষ্ট হাউসে উঠিয়ে দিয়ে তবে এসেছেন।

নাফিয়া আমার কানে কানে বলল, ঐ গেষ্ট হাউসে আমরা থাকব, একটা কংকাল ওখানে, কি ভয়াবহ।

লোকটা বলল, কিছু বললেন।

বললাম, না ঠিক আছে। আমাদের বিষয়টা তো জানেন।

জি জি মিঃ নুহুল হাসান। জানি। এই নেন আপনাদের গেষ্ট হাউসের চাবি। আসলে আপনারা স্বামী স্ত্রী একসাথে এসেছেন, এক সাথেই তো থাকবেন। একদম চিন্তা করবেন না। তা আপনি তো বিজ্ঞানের শিক্ষক, আর ম্যাডাম ...

নাফিয়া আসলে কি নিয়ে যেন ভাবছে। আমিই উত্তর দিলাম-দর্শন শাস্ত্র।


দুই.
একাডেমি ভবন আর মূল হোষ্টেলের দুটো ভবন পেরিয়ে আরেকটু ডানে উল্টো পাশে একটা পাহাড়ের গোড়ায় রেষ্ট হাউসটা অবস্থিত। পাঁচতলা বিল্ডিং। আমাদের চাবির গায়ে ২০৩ লেখা দেখে বুঝলাম ওটা দুতলাতেই হবে। ঠিক তাই। প্রশিক্ষকদের রেষ্ট হাউসে থাকব এটা ভেবে একটু পুলকিত হচ্ছিলাম আর ভাবচিলাম এই নিয়ে আসলে আবার কোন সমস্যা হয় কিনা। এই আমার স্বভাব অসাধারণ জিনিস নিয়ে ভাবি না, তবে সামান্য বিচ্যুতি নিয়ে অস্তির হই। নাফিয়া জিজ্ঞেস করল, তুমিও কি কংকাল নিয়ে ভাবছ।

বললাম, কংকাল! না, দূর ও নিয়ে ভাবার কী আছে। ও ব্যাটা পাগল, কংকাল নিয়ে থাকুক থাক। আমাদের কী?

আমাদের কী মানে? তুমি বুঝতে পারছ এই বিল্ডিংয়ে কোন রুমে একটা কংকাল। তাও কাপড় পড়া। কী আজব! তুমি জান মাঝে মাঝে আমাবশ্য রাতে নাকি অতৃপ্ত আত্মা তার সুরক্ষিত কংকালের উপর এসে ভর করে। কংকাল তখন হাঁটে, কথা বলে...

তাই নাকি, দর্শন এইসব বিশ্বাস করে নাকি...

দর্শন ছাড়া কি আর কিছু নেই দুনিয়ায়। আধ্যাত্মবাদ বলে কিছু একটা তো আছে। আসলে একটা বিদেশি বইযে পড়েছিলাম কংকালের উপর আত্মা ভর করার...

তুমি আসলে এত পড়তে পড়তে ঐ আনন্দ স্যারের মত পাগল হয়ে যাবে। অদ্ভুত! একটা কংকাল নিয়ে এত ভাবার কী আছে?

আছে, আত্মা ভর করে- মানলাম ওটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। কিন্তু আমি অন্য একটা বিষয় ভাবছি, সেটা হলে বিষয়টা বেশ ইন্টারেষ্টিংও বটে।

সে আবার কী...
...আমার প্রশ্ন নাফিয়া শুনল কিনা জনি না। সে তখন বারন্দার দরজাটা খুলে খোলা বাতাসের মাঝে তার দীঘল চুলটা মেলে ধরেছে। আমি এদিকে ব্যাগ খুলে কাপড় বদালোনোর আয়োজন করছি, হঠাৎ নাফিযা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। সে এটুকু ছুটেই হাপাচ্ছে। আমি অবাক তাকালাম। জিজ্ঞেস করা আগেই নাফিয়া বলে উঠল, উফ! এস নুহুল, এদিকে এস, এই বরান্দায়, দেখ ...লুঙ্গি কোমরে গুজতে গুজতেই নাফিয়ার পিছে পিছে বারন্দায় গিয়ে পৌঁছালাম। পাশের লাগোয়া বারান্দায় সেই লাল পঞ্জাবীটা ঝুলছে। নাফিয়া বলল, কেবল লাল পাঞ্জাবীই না দেখো সেলোযার কামিজও ঝুলছে। মনে হচ্ছে যেন আনন্দ স্যারের সাথে সাথে কংকালটাও গোসল করে কাপড় রোদ দিয়েছে।

কপাল!- ব্যাটা উঠেছে আবার পাশের রুমেই। আমি এবার কংকাল নিয়েও অস্থির হতে লাগলাম। মনে ভয় ভয় ভাব। নাফিয়া যা বরল, তা আবার সত্যি না হয়। নিয়মতান্ত্রিক এই পৃথিবীতে নিয়মের বাইরেও কত কিছু তো ঘটে, ঘটে নাকি? নিজের মনে নিজেই সন্দেহের অকারণ বাতাবারণ চলছে।

নাফিয়ার হাতের গুতোয় সম্বিত ফিরে পেলাম। সে আমাকে দেখালো, ঐ দেখে আনন্দ স্যারকে দেখা যাচ্ছে। খালি গায়। সামনেই একটা কাঠের হ্যাঙ্গারে কংকালটা ঝুলছে, তার গায়ে একটা শাড়ি জড়াচ্ছে লোকটা। কি কটূ দৃশ্য। না নুহুল, যা ভাবছিলাম তাই...

কি ভাবছিলে, কী?

আরে এ লোকটা একটা মারাত্মক মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আমি পড়েছি এ বিষয়ে। ওটাকে বলে অ্যাগালম্যাটোফিলিয়া। একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। একটা মুভি আছে এর উপর। পুরোপুরি দেখেনি। বোরংি লেগেছিল, ঐ যে আমার এক ছাত্রী আমেরিকাতে মনোবিজ্ঞানে পড়ে, ঐ যে সানা, ও ইন্টারনেটে পাঠিয়েছিল। একাকীত্বে ভোগা একজন লোক লারস; সে একটা সুন্দরী ডল কিনে নিয়ে আসে। তারপর তার সাথে প্রেম হয়, রাত কাটে দিন কাটে, এমনকি চার্চে রবিবারে বাইবেল পাঠের সময়ও সে পুতুল নারীকে পাশে বসিয়ে তার হাতেও একটা বাইবেল ধরিয়ে দেয়। পুতুলের মাঝে সে একাকীত্ব হারানোর চেষ্টা করে। সে যেন পূর্ণতা পায় জীবনে। সে শেযয়ার করে তার সুখ দুঃখ পুতুলের সাথে। অবিকল সুন্দরী এক রমনীর মত দেখতে পুতুল। বিদেশে নাকি এমন পুতুল এভেলএবল, মার্কেটে পাওয়া যায়, সেক্স ডলও বলে অনেকে। মুভিটার নাম সম্ভবত ‘লারস এন্ড দ্যা রিয়েল গার্ল’। আনন্দ মিয়াতো আরও এক ধাপা আগে, কংকালের সাথে ...

আমি আর নাফিয়া একটু ভয় পাই। কেমন একটা উৎকণ্ঠা জাগে আমাদের মাঝে। আমরা ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু বারবার আমরা বারান্দায় ফিরে যাই, উঁকি দেই। লোকটার কার্যকলাপ খুব টানছে। পর্দার ফাঁক দিয়েই আমরা দেখতে থাকি কংকালটার সাথে কি সুন্দর গুটুর গুটুর কথা বলছে। কী কুৎসিৎ একটা মুখ। চোখ নেই, বড় বড় ফুটো, গায় আবার একটা সুতির শাড়ি জড়ানো। কী বিভিৎস!

কংকালের চোখের কোটরে একবার আমার চোখ পড়তেই মনে হলো ওটা আমাকে নিষেধ করছে। আমি ভয় পেলাম সত্যি। আমি নিজেকে বারান্দায় যাওয়া থেকে সংবরণ করলাম। নাফিয়া পারছে না। সে বারবার উঁকি মারছে। ইতিমধ্যে অবশ্য আমি একবার রেজিষ্টার অফিসের লোকটার সাথ আলাপ করে এসেছি। কিন্তু সে বলেছে, এই মুহূর্তে রুম বদলানো যাবে না। ডিরেক্টও স্যার নাকি এমনেতেই আমাদের গেষ্ট হাউসে থাকা নিয়ে অসন্তুষ্ট । উপরের ফোন থাকায় কিছু বলতে পারছেন না। তারউপর আনন্দ স্যার এর কংকাল কাহিনী তিনি আজই জেনেছেন। সেটা নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে তিনি ডিরেক্টরকে আর উদ্বিগ্ন করতে চাইছেন না। আমি বিফল হয়ে ফেরত এলাম ।

নাফিয়া আমাকে বলছিল, দুপুরে খাবার ক্যাফেটেরিয়ায় আবার কংকালে নিয়ে না ব্যাটা হাজির হয়। কিন্তু তেমন কাজটি সে করেনি। খুবই স্বাভাবিক ভাবে আর সবার মত একা একা খাবার নিয়ে টিচারদের লাউঞ্জে বসেই তাকে খেতে দেখেছি আমরা।


তিন.
একদিন কেটে গেছে। রাতে বারান্দায় যাবার সাহস আমি বা নাফিয়া কেউ করিনি। আনন্দ স্যারের বারান্দায় পর্দাটা ঠিক ঐ এক চিলতে সরানোই ছিল। সম্ভবত খেয়াল করেনি। নাফিয়া বলছিল, একজন অ্যাগালম্যটোফিলিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মত সব আচরণ ই ঐ লোকটার মধ্যে আছে মনে হচ্ছে। সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন, কথা বলা, শেয়রা করা, সাজগোজ করানো...নাফিয়া ভয় পাচ্ছে কংকালের সাথে তার আদর ভালবাসার সম্পর্ক আরও গভীর কিনা! কেনো জানি পাশের রুমে এক স্যার আর এক কংকাল আমাদের সব কিছু ভুলিয়ে মন দুটো আচ্ছন্ন করে রেখেছে গত চব্বিশ ঘণ্টা।

আমরা যখন সকালে খেতে বসেছিলাম তখন হাউস কিপার রা রুম পরিষ্কার করতে ঢুকেছিল। সেই সময় আনন্দ স্যারের রুমে ঢুকে এক হাউস কিপিং মহিলা চিৎকার করে পুরো গেষ্ট হাউস মাথায় উঠিয়ে ফেলেছে। আমরা নাস্তা শেষে ফিরে গিয়ে দেখি ডিরেক্টর দোতালায় এসে সে বিষয়ে খবরদারী করছেন। আনন্দ স্যার ডিরেক্টরকে বোঝাচ্ছে-একটা কংকাল, একটা মানুষই তো, তাও এটা একটা মেয়ে মানুষ, ভয় পাওয়ার কি আছে। তিনি বুঝতেই চাইছেন না। ডিরেক্টর স্যার বললেন, আনন্দ স্যারের রুমে কারও ঢোকার প্রয়োজন নেই। আনন্দ স্যার তাতেই খুশি হলো মনে হলো বরং। আমরা ডিরেক্টর স্যারকে সালাম দিয়ে কোনমতে রুমে ঢুকে পড়লাম।

বিকেলে সেদিনই আমরা ক্লাব রুমে খেয়াল করলাম সবার মুখ মুখে এই কংকাল কাহিনীর চর্চাই হচ্ছে। প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের কেউ কেউ তাকে আগে থেকেই চেনে বলে মনে হলো। আমার এক কলিগকে দেখলাম, সে যে আসবে জানতামই না। ওর নাম হাসনাত। রসায়নের শিক্ষক। আমার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, স্বামী স্ত্রী ভালো দাও মেরেছো গেষ্ট হাউসে, এসি রুমে উঠেস।

তাকে বললাম, আরে না আমাদের রুমটা এসি রুম না। তবে টিভি আছে।

সে হাসল আর বলল, হুম পাশের রুমে শুনলাম একজন কংকাল গৃহীনিও আছে।

যে সব রিউমার চলছিল তার মধ্যে হাসনাতের কাছে যেটা শুনলাম সেটাই গ্রহনযোগ্য মনে হলো। আনন্দ স্যার মেডিক্যালে ভর্তি হযেছিলেন। সেখানেই এক সহপাঠীর সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। মেডিক্যালে বছর খানেক পড়ার পর হঠাৎ তিনি একদিন আবিষ্কার করলেন তার সেই প্রেমিকা সহপাঠীনিটি শুধু তার সাথেই নয় , বরং এক সাথে তিন চারজনের সাথে প্রেম লীলা চালিয়ে যাচ্ছে, সিনিয়রদের সাথেও। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। অথচ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করার পর সে নাকি বলেছিল, সবাই ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে সে গ্যারান্টি কোথায় , তাই নো রিস্ক, প্রেম সবার সাথেই চলবে, শেষে যে টিকবে সেই হবে পাকা পোক্ত বর। কারও সাথে এই দুঃখ শেয়ার করতে পারছিলেন না। হোষ্টেলে রুমে তার নিজের টিউশনির পয়সায় কেনা একটা কংকাল ছিলো। কংকাল টা যে মেয়ে কংকাল সে সে আগেই নির্ণয় করেছিল। সে রাতে কংকালই হলো তার সেই বিরহ কষ্ট শোনার সাথী। ওর পর আর পড়াশুনা হচ্ছিল না তার । প্রথম প্রোবেশনারিরই উৎরাতে পারল না। মেডিক্যাল ছেড়ে ভর্তি হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালেয়ের অধীন বায়োলজিতে, তারপর মনোযোগ দিলেন। তারপর আজ এই অবস্থানে এসেছেন। বায়োলজি বিষয়ে তার জ্ঞান সুপ্রসিদ্ধ কিন্তু। অনেক কিছু করতে পারতেন, কিন্তু কংকাল যেন সব টেনে রেখেছে।

এমনও শোনা গেলো- যে মেয়েকে ভালবাসত সে মারা যাবার পর তার কংকালটা তিনি যোগাড় করেছেন মেডিক্যাল থেকে। মেয়েটা লাশ দান করেগিয়েছিল। এটা আমাদের বিশ্বাস হলো না। হাসনাতের মুখে শোনা রিউমারটাই গ্রহন করলাম। অবশ্য আমাদের গ্রহণ করা না করা দিেেয় কি যায় আসে!

ক্লাব থেকে রুমে ফেরার সময় দেখলাম, লাল পাঞ্জাবীটা পরে কেউ যেন বসে আছে গেষ্ট হাউসের পেছনে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা নান্দনিক লেকটার ধারে। সাথে বসে একটা সরু নারী অবয়ব। শাড়ী পড়া। মাথায় কাপড়। কংকাল যে তা আমরা বুঝে নিলাম। আসলেই দূর থেকে নর নারীর মতই লাগছিল।

পরিশিষ্ট
...সে সন্ধ্যায় আমরা আরও কুণ্ঠিত হচ্ছিলাম। আমরা কেউই মন থেকে আনন্দ স্যার আর তার কংকালকে সরাতে পারছিলাম না। এমনকি আরেকটু রাত গভীর হতেই এই নির্জনে আমরা স্বামী স্ত্রী দোঁহে যখন দুজন খুব কাছাকাছি, নিবিড় আলিঙ্গনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছিলাম বিছনার উপর, তখনও হঠাৎ আশ্চর্য দু’জন এক সাথে বলে উঠলাম, লোকটা কংকালটার সাথে কিভাবে এতটা সময় কাটায়?
আমরা নিজেদের আলিঙ্গন আর প্রেম ভেঙে সত্যি সত্যি বারান্দায় চলে গেলাম। পর্দার সেই এক চিলতে ফাঁকটা এখনও আছে। সে ঘরে একটা লাল ডিম লাইট জ্বলছে। আমি তাকাতে চাচ্ছিলাম না। নাফিয়া অবশ্য না তাকিয়ে পারল না।
নাফিয়া তাকিয়ে একটু চোখটা রগড়ে ভালো করে আবার দেখলো তারপর আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, কংকালের সাথে আনন্দ স্যারের সম্পর্ক অনেক গভীর। কংকালের মাঝেই আনন্দ স্যার তার জীবনের সব পূর্ণতা যেন খুঁজে ফিরছেন। ঐ দেখো কংকালকে জড়িয়ে সে শুয়ে আছে, মাঝে মাঝে চুমুও খাচ্ছে কংকালের অসম্পূর্ণ শক্ত মুখে...আমি আর নাফিয়া এর বেশি আর দেখার বা জানার ইচ্ছেকে দমন করলাম...

দ্রুত আমরা ঘরে ফিরে আসলাম। ট্রেনিংয়ের যে ক’টা দিন থাকতে হবে আমরা বারন্দাটা আর খুলবোই না ভেবে নিলাম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Lutful Bari Panna ব্যতিক্রমী একটা গল্প। দারুণ লাগল।
মাহমুদুল হাসান ফেরদৌস চমৎকার লাগল গল্প ও উপস্হাপন।
সূর্য গল্প ভালো হয়েছে মামুন। তোমার এ ধারাটাও পছন্দ হয়েছে। এর আগেও সম্ভবত দুটা গল্প মানসিক সমস্যার দুটো আলাদা সিনড্রোম নিয়ে লিখেছিলে।
মিলন বনিক ভিন্ন ধারার একটি টান টান উত্তেজনাকর গল্প মামুন ভাইয়ের সুন্দর লেখনীতে উপভোগ করলাম...অসাধারণ গল্প...মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ আর মানুষের জাগতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও খুব সুন্দর ভাবে ফুঠে উঠেছে...খুব খুব ভালো লাগলো....
শাহনাজ নাসরিন মল্লিকা ধন্যবাদ চমতকার ভিন্ন স্বাদের গল্পটির জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা
রনীল গল্পের এই স্টাইলটি নতুন মনে হল। ভিন্নতা/স্বকীয়তার জন্য এই গল্পটি দীর্ঘদিন মনে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখলেও গল্পের কোথাও খুব বড়সড় বিচ্যুতি দেখিনি। তবে উৎসুক পাঠক হিসেবে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আনন্দ স্যারের সাথে (ইন ফ্যাক্ট মেয়ে কংকালটার সাথে স্যারের) মেয়ে কংকালটার প্রণয়ের পূর্ব ইতিহাস। এই জায়গাটায় একটা অতৃপ্তি অনুভব করেছি।
তানি হক গল্পের শুরুতে গেটের সামনে দারোয়ান আর আনন্দ স্যারের ঝগড়ার সময় কল্পনাও করিনাই যে আনন্দ স্যারের সাথের সেই কংকাল টি গল্পের ভেতরের এমন টান টান ভয় ভয় ভাব আর রহস্যর জন্ম দেবে । শেষের দিকে এসে তো খুব ভয় লাগছিলো ... আসলে এমন এমন মানুষ আছেন আমাদের মাঝে ... যারা মনের ভেতরেও অদ্ভুত আর বাইরেও অদ্ভুত ...আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা মামুন ভাই ... খুব খুব ভালো লাগলো ... অন্য রকম এই গল্প টি ।। ধন্যবাদ
রফিক আল জায়েদ 'ঈদ মোবারক' কত দারুন উপস্থাপনা করেছেন।
জায়েদ রশীদ অদ্ভুত রোগটা আর তাকে ঘিরে গল্পের বিস্তৃতি - ভাল লেগেছে।
জাবের খান লেখা আপনার সাধনা আপনার নিয়েগেলাম অমূল্য শিখন আমার

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪