অদৃশ্য

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

মামুন ম. আজিজ
  • ১২
  • ৩১
এক.
আজ ছুটির দিন। শুক্রবার। অথচ আমি সম্পূর্ণ একা। পুরো বাসাতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বেড়াতে গেছে। সবাই মানে আমার বউ, দুটো বাচ্চা, বৃদ্ধা মা, আর গৃহ সহায়িকা মেয়েটা। বউ আর বাচ্চারা গেছে আমার শ্বশুরের গৃহে, আমাকেও যেতে হবে সন্ধ্যায়, ওখানে একটা অনুষ্ঠান আছে। মা গেছে কাজের মেয়েটাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ী। ঢাকার খুব কাছেই। রবিবার ফিরে আসবেন। কিন্তু এমন একটা হালকা কুয়াশার সকালে কি আমার একা থাকার কথা! শীত শেষ বলাই যায়, কিছু বিচ্ছিন্ন কুয়াশা এখনও সেটা বুঝে উঠতে পারে নি বলে সকাল সকাল মাঝে সাঝে এসে হাজির হয়। আজও হাজির হয়েছে।

ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষা শেষ করে মুখমন্ডলে পানির ঝাপটা দেয়ার পর পানির বিন্দু বিন্দু ঘনত্ব ধারণ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যটাকে কুয়াশার সাথে যুদ্ধ করতে দেখছি। থমকে আছি সে যুদ্ধের দামামায়, হঠাৎ সূর্যের জয়ের আভাসে আনন্দ যেন আপনাতেই মনে ঠাঁই নিলো, যদিও আমি কুয়াশার ভক্ত তবুও সকালটাতে সুর্যের আলো চাইছি, আলোতে একটা সকালের একাকীত্ব ঘুচাতে চাইছি হঠাৎ, আমি দল পাল্টেছি এবং আমার দল জিতলো বলে, কুয়াশার হৃদয়ে আজ শক্তির প্রাচুর্য নেই, আজ সুর্য়ের রশ্মিতে তীক্ষè ধার। আজ সুর্যেও স্বাধীনতা এলো বলে। হঠাৎ নিজেকেও এই পুরো বাড়ীতে একা থাকার ভাবনা নতুন করে একবার ভেবে নেয়ার স্বাধীনতায় মনে মুহূর্তে শত পথ খুলে দিলাম। এইসব পথে ছুটতে হবে অনেকটা বেলা। তোয়ালেখানা ছোঁয়াতেই মুখের উপরের জল বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে সুর্যের তেজে মিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন কুয়াশাগুলোও আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে, একটা কাক সামনের আম গাছটাতে এসে বসেছে। আমি তাকিয়ে তার চোখে আর সে আমার। আমার চোখে স্বপ্নের শুরু আর তার চোখে বিস্ময় কিংবা ভীতি।

হঠাৎ কাল রাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য একটা গ্রন্থে দেখা সেই বিভৎস ছবিটার কথ মনে পড়ে-কোন এক শহীদ যুবক, হয়তো কোন হানাদার না হয় কোন স্বদেশী রাজাকার বা আল বদর সদস্যের হাতে নিহত হয়ে পড়ে ছিল পথের ধারে, দুটে কাক এসে লাশের ঠোঁটে ঠোকরাচ্ছে, সাদা কালো ছবি, তবুও কি বিভৎস। রঙিন হলে আমি হৃদয়ের দেয়ালে ঠিক মতো ছবিটা টানাতেই পরতাম না, দেয়াল বেঁকে যেত, সাদা কালো বলে তবুও লুকিয়ে রেখেছি মনের অন্ধকারে। আলো মনে আসবে কোথা থেকে, এ স্বাধীন দেশে এ স্বাধীনতায় এতগুলো বছর পরেও আলোর অভাব। সামনের কাকাটার উপর রাগ হয়, অথচ এ কাকের জন্ম হয়তো মাস কয়েক আগেই। তবুও কাকের বাচ্চা কাক। হায়! সে তো নিরীহ ইতর প্রাণিই কেবল। আর রাজাকার গুলো, বুড়ো হয়ে চুল দাড়ি সাদা করে ফেলেছে, তাদের দেখছি, সামনে দিয়ে বুক চিতিয়ে হেঁটে যাচেছ, সহ্য ঠিকই করছি। কাকটা উড়ে গেলো। রোদেও বুক চিরে কাকের ডানা সাঁতরে চলে গেলো।

হঠাৎ আমারও উড়তে মন চাইল, নখড় উঁচিয়ে উড়ব। নখড়ের খোঁচায় তুলে আনব কয়েক জোড়া রাজাকার বুড়ো...ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসব যেখানে তাদের মনিবের বাস। বুড়ো রাজাকার গুলো একপাল ছেলেমেয়েকে শিষ্য বানিয়েছে, অনলাইনে এদেরকে ছাগু নামে ডাকা হয়, ওখানে তাদের সংগবব্ধ হীন কর্ম বেড়েই চলেছে। বুড়ো রাজাকার গুলো বিদায় হলে ছাগুগুলোকে লতা পাতা খাইয়ে বড় করতে হবে, মানুষ করতে হবে, ভাত খাওয়ানো শেখাতে হবে, কোন এক রাষ্ট্রনায়ককে এই দায়িত্বটা নিতে হবে।

স্বাধীন দেশে দেশের বিরুদ্ধ কোন শক্তি থাকতে পারে না। তাহলে স্বাধীনতা কলুষিত হয়। কদাকার স্বাধীনতায় হয়তো দুমুঠো ভাত খাওযা যায়, ভাতে তরকারী জোটে না। এই আমার মত অতি দূর্বল একটা মানুষ এটা বুঝি অথচ জ্ঞানীরা কেনো বুঝবে না! তবে তরুণরা জেগেছে, কাদের মোল্লা নামের রাজাকারটার ফাঁসি হলো না বিচারে, এ কি মানা যায়, এ কি বেদনা দেয় না স্বাধীন বাংলার প্রতিটা স্বাধীন মনকে! অব্যশই দেয়। আমাকেও দিয়েছে। তরুণরা ক্ষেপেছে। তারা শাহবাগ চত্বর দখল করেছে আজ কয়েকদিন হলো। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সে গন জাগরণে যোগ দিচ্ছে। কী তীব্র শ্লোগান! অথচ আমি একদিনও যেতে পারলাম না। অফিসটা সেই ঢাকার অদূরে। সন্ধ্যার পরে ফিরে যাব যাব করে এখনও যাওয়া হলো না। অথচ আমার বউ ইতিমধ্যে দুদিন ঘুরে এসছে। তাও বাচ্চা দুটোকে নিয়ে । আমার ছোট মেয়েটা কোলের শিশু, বড়টাকে স্কুল থেকে আনার সময় ওদের নিয়েই গণজাগরণে শরীক হয়েছে।
আমি কিন্তু ভয় পেয়েছি। কখন কোথায় বোম টোম পড়ে, বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বউ কী জানি কি বিপদে পড়ে। তবুও প্রাণে আমার যেতে না পারার অপূর্নতা। তাই ভেবেছিলাম আজ যাব, আজ গণসমাবেশে, সকাল থেকেই থাকব। অথচ বাসা খালি করে সবাই চলে গেলো। তবুও আমি যাব। মনের মধ্যে একটা সংশয়, যদি কোন অপ শক্তি, বিরুদ্ধ শক্তি বোম টোম মারে...মারুক , এই জীবনে একবারও কী সাহসী হতে পারব না! বিকেলে শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার আগে শাহবাগ হয়েই যেতে হবে। যাবই।


দুই.
আমি দূর্বল, আমি সাধারণ আমি ভীতুও বটে। আমি তবুও হঠাৎ এনজয় করছি একাকীত্ব , অনেকদিন পর পুরা ঘরে একা। এটাকে কেনো শুধু শুধু নেতিবাচক ভাবনায় ঢুকিয়ে কষ্টের গুহায় প্রবেশ করছি। এটাতো ইতিবাচক। কত বছর চকলেট খাই না। হঠাৎ চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে। ফ্রিজে ছেলেটার জন্য চকলেট থাকে, ওর কান্না আর জিদ থামানোর একমাত্র উপাত্ত। ফ্রিজের দিকে হাঁটা ধরলাম।

ডাইনীং রুমটা খুব ছোট, ছোট চারকোনা একটা টেবিল আর একটা ফ্রিজ, দাঁড়ানোর জায়গা বলতে গেলে নেই, একটা জানালা এ মাথা থেকে ওমাথা..এক হাত ওপাশেই পাশের বাড়ীর বারান্দা, বেশ দীর্ঘ, কারুকাজ করা গ্রিল। সেদিকে অজান্তেই চোখ গেলো ঠিক তা বলবো না, বরং চোখ যেনো মনের ইশারা টের পেলো। এটা নষ্ট ইশারা। মানুষের মনতো!...মহিলা একা থাকেন, উনিই ও বাড়ী ওয়ালী, তিন তলা কমপ্লিট। স্বামী সৌদি থাকেন, সেখানে বড় ব্যবসা আছে। মহিলা দুই পুত্র নিয়ে এখানে থাকেন। অতুলনীয় সুন্দরী কাকে বলে জানি না, তবে অতুলনীয় আকর্ষন কাকে বলে এ মহিলাকে দেখলেই বোঝা যায়, ইলোরা গহর নামে একজন অভিনেত্রী আছেন, কিংবা হালের হিন্দী মুভিতে নায়িকা হয়েছেন মধ্য বয়সী চিত্রঙ্গদা, সেই ওমন মিষ্টি, গায়ের রং চাপা কিন্তু চিত্তাকর্ষক, উত্তেজনার আবেশ বলয় ঘোরে চারপাশে এই মধ্যবয়সী নারীর। কাছে যেতে ইচ্ছে হয়। অন্যদিন ছিঃ ছিঃ করলেও মন আজ ছিঃ ছিঃ শব্দটা শোনালো না। এ এক অদ্ভুত দুষ্টু স্বাধীনতা । মনকে তাই নিয়মে আবদ্ধ করতে হয়। তাহলেই সমাজের জন্য ভালো। স্ত্রী কন্যা পুত্র, মাতা এসবই সেই নিয়মের বৃহত্তম অংশ। অন্যদিনগুলোতে নিয়মে ঘেরা থাকায় এই নষ্ট জল¯্রােত পথ পায়নি। আজ পথ স্বাধীন, মহিলাকে আরেকটু বেশি দেখার সাধ হলো। ফ্রিজ খুলে একটা বড় লম্বাটে চকলেট বের করে হাতে নিতেই জানালায় চোখ গেলো, বারান্দা হতে মহিলা উল্টা ঘুরে ঘরে ঢুকছেন, ঝরঝরে চুলের ঢেউ মনটা উতলা করে দিলো। চকলেট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম, পর্দাকে কিঞ্চিৎ আড়াল করে মহিলার দৃষ্টিকে দৃষ্টিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে যাব, হঠাৎ দৃষ্টিকে কেড়ে নিলো দুটো ঘন কালো চোখ। মহিলার ঘরের ভেতর এই সাত সকালে একটা পুরুষ, আমার আড়াল করা পর্দটা হাত ফসকে ছুটে গেলো। আমি মুক্ত, প্রকাশিত। সেই পুরুষ এর দু বাহুর মাঝখানে এখন চুল খোলা এ মধ্যবয়সী নারী, ছুটতে থাকা রোদগুলোতেও এক আহাজারী। যুবা পুরষের চোখ দুটো মুহূর্তে ভীষণ ভালবাসা থেকে ভীষণ ক্রোধে পরিবর্তিত হচ্ছে, আমি টের পাচ্ছি। আমি যুবকটিকে চিনতে পেরেছি। সেও আমাকে চিনতে পেরেছে নিশ্চিত। আমি কম্পিত হচ্ছি। আমি পর্দা টেনে ছুটে টিভির ঘরে ভাঙা সোফাটার উপর গিয়ে বসে পড়লাম।

আমার ভয় আকাশ চুম্বি হলো। আমি যুবকটিকে কেনো চিনলাম? এই বুঝি সে চলে এলো। ওরা পরকীয়া, আপনকীয়া যা ইচ্ছে করুক, আমি কেনো দেখে ফেললাম। আমি কেনো পর্দার আড়াল ভেঙে দিলাম। না দিয়ে করবো কি, যুবকের চোখে প্রচন্ড এক অকুতোভয় সাড়া...আমি তাকে খুব ভালো করে চিনি। পাড়ার মোড়ে তার নাম পুঁজি করে আরও চার পাঁচটা গ্রুপ দাপট দেখায়। সে বড় ভাই, সে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট, সে একজন ক্যাডার। ইস এইতো তিন দিন আগেই আমি অফিস থেকে ফিরছিলাম, এক ছেলে কি মাইরটাই না দিচ্ছিল, কি তার তেজ...কি কারণ জানার সাধ হয়নি। তবে পরের দিন মার খাওযা ছেলেটার লাশ পাওযা গেছে জেনেছিলাম দূরের এক মহল্লায় এক ডোবায়। আর একদিন আমাকে একটা বাচ্চা ছেলে ডাকল, ঐ যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ভাই ভাই আপনাকে চা খেতে ডাকছেন। ভয়ে ভয়ে যুবকের কাছে গিয়ে টং দোকানে বসতে বাধ্য হলাম। একটা বেনসন এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি তো এই মহল্লায় থাকেন, কোন সমস্যা হলে আমাদের বলবেন, নেন ধরান। আমি ধরিয়েছিলাম। আমি মাঝে মাঝে সিগারেট ধরাই, খুব মাঝে মাঝে। তবে ভয় পাই নিয়মিতই নিয়মিত অনাচর দর্শনে।

আমি টিভি ছেড়ে শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের লাইভ অনুষ্ঠান দেখে মনে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করতে থাকি। বারবার চোখ চলে যায় দরজায়। এ বুঝি মাস্তান যুবক এলো। ঐ বুঝি আমার লাশটা ও পাড়ার কালো ঝিলে পড়ে রবে। আমি চোখ বুঝি। দরজা ধাক্কানোর শব্দ হয়। কুঁকড়ে যাই। তারপর চোখ মেলে দেখি ওটা আসলে অন কোন বাসায় অন্য কারও দরজা নক করা শব্দ। ভুল করলো কি?..কিন্তু যুবক তো আমাকে খুব ভালো করেই চেনে!

আবার চোখ বুজি, অদৃশ্য দৃষ্টির মাঝে নিজেকে লুকাতে চাই। আমি চোখ খুলবো না। আমি যুবকের হাত থেকে বাঁচতে চাই। আমি পরকীয়ার এই গোপন খবর ভুলতে চাই। চোখ চলে যায় ঐ জানালায়, পর্দার এক চিলতে ফাঁক গলে সূর্যের আলোর সাঁকো পেরিয়ে দেখলাম ওপাশের ঘন উজ্জ্বল পর্দা নেমে গেছে, সিনেমা শেষ হলে পর্দা নেমে যায়, নাকি সিনেমার শুরু হলো বলেই নেমে গেলো।

ঐ যুকবকে আমি বহু বছর ধরে দেখে আসছি। ও কিংবা ওদের মত যুবকরা সুযোগ খোঁজে, ওরা ঝগড়ার ওযুহাত খোঁজে , আমি জানি, আর এই গোপন অভিসার জেনে ফেলা..উহ! নো। আচ্ছা মহিলার বাচ্চা দুটো কোথায়?...দূর সে কথায় আমার কি , আমি লুকাব্,ো হে সৃষ্টিকর্তা , আমারে অদৃশ্য করে দাও। আমি পালিয়ে বাঁচতে চাই। আমাকে অদৃশ্য করে দাও।


তিন.
কতক্ষন চোখ বুজে ছিলাম জানি না। টিভিতে লাইভ শ্লোগান, ‘ক-তে কাদের মোল্লা তুই রাজকার, ন-তে নিজামি, তুই রাজাকার’... ভেসে আসছিল কানে। সব ছাপিয়ে হঠাৎ কেবল একটি ক্রমাগত শব্দ- দরজা ধাক্কানোর শব্দ-কানে আসছে।

না আমি খুলবো না, কিছুতেই না। আমি ধরা দেবো না। দরজায় ধাক্কা বাড়ছে তো বাড়ছেই। এবং দরজা ওরা খুলেও ফেললো। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকছে মাস্তান যুবক আর মধ্যবয়সী মহিলা।এগিয়ে আসছে। আমি দুহাত মুখের সামনে নিয়ে নিজেকে আড়াল করা চেষ্টা করলাম। পা দুটো সোফার নরম সিটের উপর উঠিয়ে জড়সড় হলাম। টিভির আওয়াজ এতক্ষন বন্ধ ছিলো, নাকি কোন এড হচ্ছিল, এডগুলো বড্ড বিটকেলে আজকাল, ভুল ইংরেজী শেখায়, বলে ফ্রিজিং মানে বেসম্ভব ঠান্ডা, এডের আওযাজ তাই কানে ঢুকাই না। হঠাৎ জাগরণ মঞ্চের লাইভ টেলিকাষ্ট আবার শুরু হয়েছে; স্লোগান কানে আসছে...‘আম পাতা জোড়া জোড়া, রাজাকাররা পড়ছে ধরা।’...

এখন তো আমিই ধরা পড়ে গেলাম। কি বলব ভাবছি। সম বয়সী কিংবা একটু বেশি হতে পারে বয়স মহিলার। পা চেপে ধরব। মাফ করে দেন। কাউকে বলব না। আমি নিরীহ বাংগালী। আমি যার যার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আপনাদের কাজ আপনারা করেছেন, আমার কী- আমি চেপে যাব...

কিন্তু একি আমার সামনে দিয়ে এরা চলে গেলো, এমন ভাব যেন আমি এখানে উপস্থিতই নেই। ভেতরের ঘরে খুঁজল, খুঁজল টেবিল চেয়ারের তলেও। এরা আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমি উঠে এবার বড় আয়নাটার সামনে গেলাম। যুবকের পাশ ঘেঁষেই গেলাম। আমি নিজেকেই খুঁজে পেলাম না। আমি নেই আয়নার ভেতর। আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি। আমি এখন অদৃশ্য মানব।

মুখের পাংশু ভাব কেটে গেছে। ভীতিবদ্ধ হৃদয়ের দুয়ারে হু হু বাতাস ঢুকছে। পরকীয়া নর নারী ঘরের দরজা জনালাবন্ধ করে আমারই বেড রুমে বিছানায় এগিয়ে গেলো। তাদেরই কেউ একজন যাবার পথে টেলিভিশনটাও বন্ধ করে দিলো।

আমি বেঁচেছি। ওরা যা পারে করুক, যেমনে যেখানে খুশি করুক। আমি স্বাধীন আমার অদৃশ্যে, ওরা স্বাধীন ওদের প্রেমে।

বাহ! কি সুন্দর,আমি বন্ধ দরজা ভেদ করেই ওপাশে চলে যেতে পারছি। একবার ভাবলাম বাইরে থেকে দুটোকে আটকে দিয়ে যাব নাকি। যা ভাবা সেই কাজ। দু জনে এখন গান গাক-’হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হে।’

কিন্তু মহিলার বাচ্চা দুটো কই?-যমজ বাচ্চা। বয়স দশ বারো। মহিলার ঘরে চলে গেলাম উড়ে উড়ে। আমি উড়তেও পারছি। অদৃশ্য মানুষের ভর নেই। পাখির মত পাখা ঝাপটানোর কোন বিষয় নেই, কেবল বাতাসে ভর করেই উড়ে চলে যাচ্ছি। মহিলার বেডরুমে মহিলার একটা সাদাকালো বিশাল ছবি টানানো। আরো পুরোনে বয়সের। আরো সুন্দর বলব না, কারন বর্তমান বয়সের আকর্ষণ ঠিকরে বেরোয়, ছবিরটা সৌন্দর্য কেবল ঠিক আকর্ষন নয়। দশ পনের বছর আগের হবে। ঘরে কেউ নেই। মহিলার ঘর থেকে বের হয়ে বাতাসে ভর করতেই কে যেন কানের কাছে বলে উঠল, বাচ্চা দুটো মামার বাড়ী বেড়াতে গেছো।

কে? কে?-চিৎকার করে উঠলাম।

কে জানি হাসল, বলল, আমিও তোমার মত অদৃশ্য। আরও আছে-আরও অনেক আছে এমন অদৃশ্য স্বাধীনতায়। এ এক ভিন্ন জগত। সচারাচর আমরা অদৃশ্য জগতের বাসিন্দারাও কারও সাথে কেউ কথা বলি না। পাছে গোমর ফাস হয়ে যায়! একাকী স্বাধীনতা, ইচ্ছে মত ঘোরার স্বাধীনতা। ইচ্ছে মত উড়তে পারার সুখ। ইচ্ছে মত লুকানোর সুখ, কিন্তু ...

কিন্তু কি...

সে থাক। তুমি শাহবাগের গনজোয়ার আর স্লোগান শুনছিলে টিভিতে দেখলাম, তাই ভাবলাম এক সাথে যাই চল ওদিকে।

কিন্তু ...আপনি কে? আপনি কত দিন ধরে...

আমি! আমি হচ্ছি বিবেক। মানে আমার নাম আর কি? অনেকে ‘জাতির বিবেক’ও বলে । সে অনেক বছর হলো আমি অদৃশ্য হয়েছি। দিন তারিখ মনে থাকে না আজকাল। শাহবাগে স্বাধীনতার পক্ষে একটা তারুণ্য শক্তি জেগেছে, চল ওখানে যাই।

কিন্তু আমার বাসা!

ও কী আর হবে। পরকীয়ায় মত্ত ওরা । ওদের বিবেক ই নেই, ওরা কী আর করবে?

ওসব ভুলে যাও, স্বাধীনতা উপভোগ কর।


চার.
বিবেক মশাইয়ের সাথে শুধু কথাই বলছি। তার কোন আকার দেখতে পারছি না। আমাকেও দেখেছে না তিনি। এ এক অদৃশ্য স্বাধীনতা।

শাহবাগে পৌঁছে দেখি সেখানে আকাশ বাতাস গনস্লোগানে প্রকম্পিত। ...এক সাথে হাজারো কণ্ঠ বলছে...‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই।’

আমিও বললাম। চিৎকার করে বললাম।

বিবেক হাসছে। বলল, দূর গলা ভাঙছ কেনো, তোমার আওয়াজ কেউ শুনতে পাচ্ছে না। তুমি আমার মত অদৃশ্য স্বাধীনতার ফান্দে আটকে গেছো। কেউ আর তোমাকে নিয়ে, তোমার কণ্ঠের ধ্বনি নিয়ে ভাবছে না। চল, একটু রাজাকারদেও কাছ থেকে ঘুরে আসি।

সত্যি,যাওয়া যাবে?

যেখানে খুশি যেতে পারবে।

আমরা দু’জন খুব কাছেই বড় রাজাকারটার মানে গো. আযমের রুমে চলে গেলাম। ব্যাটা এই থুড়থুড়ি বুড়ো বয়সে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসারত। লোকটাকে দেখে আমি বিবেককে বললাম, এক দলা থুথু দেই ওর গালে।

বিবেক বলল, কি লাভ, তোমার থুুথু লাগবে না। ওরা প্রচন্ড স্বাধীনতা ভোগ করেছে গত চল্লিশ বছর, ওদের অদৃশ্য শক্তিতে ভয় নেই। ওরা কেবল ভয় দেখায়। ওদের ভয় দেখাতে হলে জাতির বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। তোমার অদৃশ্য স্বাধীনতা পরিহার করতে হবে। বাস্তবতার মোকাবেলা করতে হবে। চল্লিশ বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সাহসী হতে হবে। জাগতে হবে। পারবে?

আমি হাঁ করে বিবেকের মুখেরদিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, আসলেই, এত বছর কিছু হয়নি। রাজাকাররা অপকর্মেও শাস্তি পায়নি বলেই হয়তো আজ আর তাদের প্রাণে সেই সংকা কাজ করে না। তারা ভেবেছে জাতির বিবেক তো মরেই গেছে...আমিও কি মরে গেছি!

না, তুমি আমি আমরা কেউ মরি নি। আমরা শুধু স্বার্থপর স্বাধীনতা উপভোগ করছি, অদৃশ্য স্বাধীনতা।

চল রাজাকারের ঘর থেকে বের হই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ...চল তোমার ঘরেই ফিরে যাই। এতক্ষণে ও দুটোর পরকীয়া শেষ হবার কথা।...

...চোখ খুলতেই দেখি সত্যি সত্যি দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। ডাইনিংয়ের পর্দটা বাতাসে সরে গেছে। জানালা আর পর্দার ফাঁক গলে দৃষ্টিতে ধরা পড়ল মহিলার চেহারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকেই তাকিয়ে সে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। দরজায় আবার কড়া নাড়ছে কেউ। এবার কথা শুনলাম, ‘ডিশের টাকা নিতে এসেছি’।

দরজা খুলে চোখ রগড়াতে রগড়াতে টাকাটা দিয়ে ডাইনিংয়ে ফিরে এলাম। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় বারোটা বাজে। পর্দাটা টেনে দেবো বলে এগিয়ে গেলাম। ওপাশে মহিলা বারান্দায় চুল ঝারছে। চুল ঝারতে ঝারতে সে নারী আমার দিকে তাকিয়েই আছে। মুচকি হাসি দিলো। আমি চোখ নামাতে যাব-বলল, কেমন আছেন? ভাবিকে নিয়ে একদিন বাসায় আসবেন, কথা হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায় গল্পটি অনেকটা আলাদা ধরনের লেগেছে।অদৃশ্য ভাবে থেকে নিরর্থক স্বাধীনতার মর্ম কথা প্রকাশ করেছেন—প্রকাশের ভাব ভঙ্গী সুন্দর লেগেছে।লেখককে জানাই অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ কবির হোসেন গল্পটি আমার কাছে চমত্কার লেগেছে. ধন্যবাদ.
নাইম ইসলাম বিবেক মশাইয়ের সাথে শুধু কথাই বলছি। তার কোন আকার দেখতে পারছি না। আমাকেও দেখেছে না তিনি। এ এক অদৃশ্য স্বাধীনতা। onek sundor!
মোঃ আক্তারুজ্জামান দৃশ্য, অদৃশ্যের মাঝে লেখক দারুণভাবে মূর্ত মান। খুব ভালো লিখেছেন।
এশরার লতিফ বেশ লাগলো গল্পটি। গল্পের প্রয়োজনে কল্পনা এবং বাস্তবের সীমারেখা বিলীন হয়ে গেছে।
অদিতি ভট্টাচার্য্য ভালো। বাংলা ভাষা সংখ্যার বিজয়ী হওয়ার জন্যে অভিনন্দন।
রনীল নির্দিষ্ট ফরম্যাটের বাইরে লিখেছেন। অদৃশ্য হয়ে যাবার ব্যাপারটার মাধ্যমে অদৃশ্য/ অর্থহীন স্বাধীনতার তুলনাটা চমৎকার ফুটিয়েছেন। স্বচ্ছন্দ, ঝরঝরে লেখনী গল্পকে উপভোগ্য করে তুলেছে। মো ইয়েনের একটা প্রভাব এসেছে কি?
Chesta ...provab tik naa,.,.examin ownself
মিলন বনিক দুর্বল ভীরু মনের সুন্দর ছবি একেছেন...বিবেকের সাহস আর স্বাধীনতা যেকানে অসহায়....গল্পের ধারাবাহিকতা...আর বর্ণনা খুব ভালো লেগেছে....সাধারণ মদ্যবিত্ত সমাজের বাস্তব চিত্র...যাদের শুধু দেখে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই...অনেক শুভ কামনা....
সুমন কিছু বিবেকহীন মানুষ রয়ে যায়, বাড়ে। তবে এদের সংখ্যা বিবেকবানদের ছাড়িয়ে যায় না। এবারও তাই হবে সত্য আর বিবেকের জয় হবেই।
এফ, আই , জুয়েল # সাবলীল বর্ননার অনেক চমৎকার একটি গল্প । চেতনা আর বিবেক জাগাবার ইঙ্গিতটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে । স্বাধীনদেশে স্বাধীনতা বিরোধী---এটা খুবই বেমানান । রাজাকার আর তাদের রাজকীয় কর্মকান্ডের অবসান হতে চলেছে---জাতির বিবেক জাগার কারনে । লেখককে ধন্যবাদ ।।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪