জলপাই রঙের টোয়েটা কারটাকে তাদের পথ থেকে মেইন রোডে উঠে বাম দিকে কয়েক গজ এগিয়েই ঝপ করে থামাতে হল । একটা মোটাতাজা মটর সাইকেল আড়াআড়ি ভাবে এটার গজ দুয়েক সামনে সাৎকরে এসে দাঁড়িয়েছে। গগলস আর হেলমেট পরা চালক মাথা নিচু করে মটর সাইকেলের ইঞ্জিনের কাছে কিছু একটা দেখতে শুরু করল। সকালের রোদের হাল্কা আলো তার কাল চামড়ার জ্যাকেটের পিঠের কাছটা চকচকে করে তুলতে লাগল।
মনে মনে খুব খারাপ ধরণের একটা গালি আউড়ে মিজান সেটার পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আশায় স্টিয়ারিং হুইল ডানে ঘুরিয়ে গাড়িটাকে চালাতে গেল। অবশ্য তার ইচ্ছা হচ্ছিল সে সেটার উপর দিয়েই চালিয়ে দেয়। কিন্তু আবার তাকে থামতে হল।
তার ডান দিকের জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখল, হাত খানেক দূরে আর একটা মটর সাইকেল এসে দাঁড়িয়েছে। এতে চালকের পিছনে আর একজন। মিজানের কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিছনের জন বাঁ হাতের একটা ছোট হাতুড়ির বাড়িতে জানালাটার কাঁচ ভেঙ্গে ডান হাতের একটা পিস্তল দিয়ে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে মিজানের ডান হাতের বাইসেপে গুলি করল। শব্দের বেশির ভাগ অংশই গড়ি তার নিজের ভিতরে জমা করে রাখল। গুলিটা মাংস পিন্ডটাকে ছিন্নভিন্ন করে গাড়ির ছাদে আশ্রয় নিল। মিজান যন্ত্রণায় চিৎকার করে বাঁ হাত দিয়ে ক্ষতস্থানটাকে চেপে ধরে স্টিয়ারিঙের উপরে কপাল ঠেকাল। তার এটা দেখার সময় হল না যে, আর একটা মটর সাইকেল গাড়িটার বাম পাশে এসে থেমেছে। সেটাতেও দুজন। পিছনের মানুষটা নেমে গাড়ির পিছনের দরজা খুলল। দরজাটা লক করা নয়। তাতে অবশ্য কাঁচট রক্ষা পেল।
পিছনের সিটে স্কুল ড্রেস পরা ছোট করে ছাঁটা চুলের বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে। তার ডান দিকে স্কুল ব্যাগ, তার উপরে একটা সচ্ছ প্লাষ্টিকের প্যাকেটে এক সেট সুইমিংকাষ্টুম। তার ডানে দরজা ঘেষে একজন বয়স্ক মহিলা- সম্ভবত আয়া, দৃষ্টিতে আতঙ্ক। দুজনেই খোলা দরজার দিকে তাকাল।
মেয়েটা দুই হাত দিয়ে একটা প্লাষ্টিকের ওয়াটার বটল ধরে রেখেছে। তার চোখে বিস্ময়, কিন্তু সে ভ্য় পায়নি। লোমশ দুটো হাত তার দিকে এগিয়ে এলো, মহিলা চিৎকার করে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু একটা প্রকান্ড ঘুষি তার কানের গোড়াঁয় আছড়ে পড়তেই সে জ্ঞান হারিয়ে দরজার উপরে ঢলে পড়ল।
মেয়েটাকে নিজের আর মটর সাইকেল চালকের মাঝখানে বসানোর আগেই সামনের মটর সাইকেলটা সরে সেটার যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। এটা আগে যাওয়ার পরে বাকি দুটো সেটার পিছুপিছু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
দেশের এই ধরণের অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা হয়তো নিজেদের ঘড়ির সময় জিএমটির সাথে মিলিয়ে রাখতে পছন্দ করে, তাই হয়তো তাদের ভোর হয় বিএসটির মান অনুযায়ী সকাল দশটার পরে। তা ছাড়া রোজার দিনগুলোতে উঠতে সবার একটু দেরীই হয়। কাজেই পথে মানুষজন নেই আর কোন দোকানপাট এখনো খোলেনি।
পিছনে ডান দিকের ফুটপাথের কাছে যে ছেলেটা একটা বেঞ্চে খবরের কাগজের পশরা বিক্রির জন্য সাজিয়ে বসে আছে, সে নাটকের পুরোটা মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। শুধু গাড়িটার পিছনের সবগুলো জানালার কাঁচ কাল, আর মেয়েটাকে তুলে নেওয়ার কাজ বিপরীত দিকে ঘটেছে বলে এটা দেখেনি। আর গত কয়েক দিন ধরে যে সুন্দর পোশাকের সুদর্শন যুবকটা এই সময় তার পাশে উঁবু হয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ত কিন্তু আজকে অনুপস্থিত, তার সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে সেটাও ধারণায় আনতে পারেনি।
আরো দু'জন দর্শক অবশ্য ছিল। অনেকটা সামনে ডান দিকের গলির মুখে যে কাল কাভারড ভ্যানটা নাক বের করেছিল, সেটার ড্রাইভার আর তার পাশের মাঝ বয়সী মানুষটা। সে খুব আগ্রহের সাথে তাকিয়েছিল। বাহনগুলো রওয়ানা হতেই তার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। 'চলো, যাওয়া যাক,' সে বলল।
সাদা ধপধপে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাংলো টাইপের একটা বাড়ি। তিন দিকেই মৌসুমি ফুলের বাগান। হাট করে খোলা গেটের কাছে পাহারাদারের মত দুটো ইউক্যালিপটাসের গাছ। ভিতরের দিকের একটা ঘরে বিশাল একটা খাটে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। সেই একই পোশাক, জুতো জোড়াও খোলেনি।
ঘর জুড়ে ঝাড়বাতির হালকা আলো। কোনার দিকে জানালার পাশে ছোট একটা টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে সালোয়ার কামিজ পরা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের একজন মহিলা একটা ম্যাগাজিন পড়ার চেষ্টা করছে।
ঢং করে দেওয়াল ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজল।
পাশের ঘরটা একটা অফিসের মত করে সাজানো। গ্লাসটপ বিশাল টেবিলের ওপাশে চামড়ার আরাম চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আছে ড্রাইভারের পাশের সেই মানুষটা। হাতের কাছে একটা টেলিফোন। তার বিপরীত দিকের চেয়ারগুলোর একটাতে আর একজন মানুষ টেবিলে হাত ভাঁজ করে রেখে তার উপরে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে।
ফোনটা বেজে উঠল।
'হ্যা?'
'টাকা রেডি করেছে। কিন্তু বস, র্যাবকে খবর দিয়েছে। সময় নিতে চায়।'
'শুওরের বাচ্চা!' দাঁতে দাঁত চেপে বলল বস। 'আচ্ছা ঠিক আছে। নযর রাখিস।' সে ঠক করে ক্রাডলে রিসিভারটা আছড়ে রাখল। আর প্রায় সাথে সাথেই তার প্যান্টের পকেটে সেল ফোনটা বেজে উঠল। সেটা বের করে নম্বরটা দেখল।
'হ।'
'টাকা রেডি,' অপর দিক থেকে জবাব এলো। 'কোথায় নিতে হবে?' একটু থেমে আবার বলল, 'আমার মেয়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই। সে ভাল আছে তো?'
'ভালা আছে। ঘুমাইতাছে, অহন কথা হইব না। কিন্তু অই হারামির বাচ্চা, তুই তর বাপেগো খবর দিছস ক্যা? অহন ডবল...।'
'কোন সমস্যা হবে না। তারা কোন একশন নেবে না। ড্রাইভারের গুলির ক্ষতটার জন্য হাসপাতাল থেকে...।'
'একশন না নিলেই ভালা। তয় অহন ডবল দিবি, এক কুটি। আজ রাইতে...।'
'আজ রাতে এত টাকা কোথায় পাব?' কন্ঠে হতাশা ফুটে উঠল।
'কোথায় পাবি জানিনা। না পারিস, যা গোছাইছস হেইডা তর বাবাগো দিয়া দে। তর মাইয়ার কবরের খরচ আমরাই দিয়া দিমু নে।'
'আর কয়েকটা দিন সময় দাও...। অন্তত তিন দিনের আগে আর বাকি টাকা যোগাড় করা...।'
'এক কুটি...। কাইল এই সময় ফোন করিস। কিন্তু এক কুটির কম না।...।' ফোনটা আফ করে পকেটে রাখতে রাখতে সামনের জনকে ডাকল, 'মোমিন'।
'বস?' লোকটা মাথা তুলে তাকাল।
'সকাল ছ'টার সময় মাল চন্দনার বাড়িতে নিয়ে যাবে। এখানে রাখা ঠিক হবে না। শালার ঝামেলা হয়ে গেল। পঞ্চাশ নিয়ে আজ রাতেই মিটিয়ে ফেললেই ভাল ছিল। কিন্তু র্যাব...। খোঁজ খবর না নিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। মনে হয় না কালকে টাকা দিতে চাইবে। মনে হয় সময় দিতেই হবে। তবে ঈদ...মেয়েটাকে কি বাইরে রাখতে চাইবে?'
'বস, রাতেই সরিয়ে ফেলি?'
'না, ওদের নিজেদের লোকও আছে। রাতে কড়া নজরদারি থাকবে। দিনে, বিশেষ করে সকালের দিকে ততটা না।'
'কভারড, নাকি প্রাইভেট?'
'মটর সাইকেলে।'
'কও কী বস? দুনিয়ার মানুষে দেখবে।'
'শোরুমের একটা লাল হোন্ডায় নম্বর লাগিয়ে নেবে। রতন চালাবে। পিছনে পারুল। মাঝে মাল রাখবে। পারুল আর মাল এক বোরখায়। ...তাড়া খেলে ঝোঁপ জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যেতে পারবে, কিন্তু গাড়ি নিয়ে তা সম্ভব নয়।'
'বস, দুই ঘণ্টারমত লাগবে। পথে যদি চিল্লামিল্লি শুরু করে?'
'পারুল গলা টিপে ধরবে। কোন শালা জানবে মরেছে না বেঁচে আছে? মরলে টাকা পাওয়ার পরে লাশ পাঠালেই হবে। আর না পাঠালেই বা কী, টাকা পাওয়া নিয়ে কথা।'
'আর কে যাবে, বস?'
'তুমি আর জিতু। নতুন সবুজটা। সকালে রাস্তা ফাঁকা থাকবে। তোমরা পিছনে দশ পনের গজের মধ্যে থাকবা। দু'জনেই পিস্তল রাখবা। আমি ঘাটিতে গাড়ি নিয়ে রেডি থাকব, সমস্যা দেখলেই সাথে সাথে ফোন দিবা।'
'কাল বাদে পরশ্বু ঈদ, বস। জ্যাম থাকবে...।'
'আরে না। ঈদের আগের দিন ঐ পথে সকলে একটাও গাড়ি পাবে কিনা সন্দেহ। শহরের এদিকটায় একটু সামলে চললেই হবে।'
কিছুটা দূরে মোটামুটি সমান্তরালে নতুন বিশ্ব রোড হওয়ায় এই পথটা এখন গুরুত্ব হারিয়েছে। পাশে পঁচা পানির নালা, চার পাঁচ ফুট চওড়া হতে পারে, তার দু'পাশে হালকা পাৎলা ঝোঁপঝাঁড়। মাত্র কয়েকটা লোকাল বাস আর টেম্পু এপথে চলে, কিন্তু রোজার সময় এই সাত সকালে পথ একেবারে বলতে গেলে ফাঁকা। দুটো একটা মাটি ভরা ট্রাক হয়তো শহরের দিকে যাচ্ছে বা খালি হয়ে আসছে। আর এদের একটাই সমস্ত কিছুর নিয়ামক হয়ে দাঁড়াল...।
ছোটখাটো গর্ত থাকলেও ভাল একটা গতিতে ছুটে যেতে তাদের সমস্যা হচ্ছিলনা। মেয়েটাকে বয়ে নিতে থাকা বাহনটা রাস্তার বাম দিক ঘেষে আর তার পিছনেরটা প্রায় মাঝ বরাবর আসছিল। গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা পথ প্রথম বাহনটার কিছুটা সামনে থাকতেই হঠাত করে পথটাতে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একটা মাটি ভর্তি ট্রাক নাক বাড়িয়ে দিল। ফাঁকা পথে হর্ন হাজানোর কথা কেউ ভাবেনি।
গজ পাঁচেক পিছনের সবুজটা গতি বাড়িয়ে ট্রাকটার সামনে দিয়ে বের হয়ে যেতে পারল। প্রথম মটর সাইকেলটার হয়তো যাত্রিদের গুরুত্বের কথা ভেবেই কোন ঝুঁকি নিতে গেলনা, থামানোর চেষ্টা করতে গেল, কিন্তু সেটার সামনের চাকা ছোট একটা গর্তে পড়ে ক্যাঁৎ হয়ে একটা তেজি রাগি ঘোড়ার ভংগিতে পিছন দিকটাকে উপরে ছুড়ে দিল। পারুল চিত হয়ে বাতাসে ভাসলো। বাতাসে বোরখা সরে যেতেই তার পেটের কাছে মেয়েটাকে দেখা গেল। সেভাবেই সে চিত হয়ে ঝোঁপের উপরে পড়ল, অষ্ফুট একটা শব্দ করে সে জ্ঞান হারালো আর তার শরীর থেকে খসে মেয়েটা পানিতে পড়ে একটা পাথরেরমত টুপ করে ডুবেগেল।
ট্রাকের উপরে লেবার চারজন চিৎকার করে উঠল, কিন্তু ট্রাকটা গতি বাড়িয়ে দিয়ে রাস্তায় উঠে প্রাণপণে শহরের দিকে ছুটতে শুরু করল।
দেখা গেল এই রাগি ঘোড়াটাকে বশ করার ক্ষমতা রতনের আছে। সে ঝাঁকি খেতেখেতে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সেটাকে থামাতে পারল। সবুজ গাড়িটাও ফিরে আসতে শুরু করেছে।
পারুলকে তুলে মাটিতে একটা মটর সাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জ্ঞান ফিরেছে। কাপড়ে রক্তের দাগ কিন্তু হাড়গোড় কিছু ভাঙ্গেনি।
তারা তিনজন পথের কিনারায় দাঁড়িয়ে নালাটার পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যেখানে পড়েছে সেখানে পানির নিচে বহুদিন ধরে পড়েথাকা পঁচা লতাপাতার নিচে জমা গ্যাস মুক্তি পেয়ে নালার পুরো প্রস্থটাকে বৃত্তের আকারে বুদবুদে ভরে ফেলেছে। মেয়েটার কোন চিহ্ন নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোমিন পকেট থেকে সেলফোন বের করল।
'বলো।'
'বস, ঘটনা খারাপ।'
'মানে?'
'মাল পানিতে ডুবে গেছে...।' সে সব কিছু খুলে বলল। '...তুলে আনবো?'
'বাঁচানো যাবে?'
'মনে হয়না, বস।' আসলে এই পঁচা পানিতে কারো নামার ইচ্ছা নেই।
'ঝামেলার দরকার নাই, তোমরা ফিরে এসো। পারুলের জন্য গাড়ি পাঠাতে হবে?'
'দেখি।' মোমিন হেঁটে পারুলের কাছে গেল। তাকে হাত ধরে তুলে কয়েক পা হাঁটালো। প্রথমে টলমল করলেও ঠিকমত হাটতে পারল। 'না, বস।'
'ঠিক আছে...সমস্যা হলে জানিও।'
অষুধের প্রভাবে চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সুদক্ষ ট্রেনারের কাছে ট্রেনিং পাওয়া হাত-পাগুলো রিফ্লেক্স একশনে তাকে পানির নিচে দিয়ে অপর পারের ঝোঁপের গোঁড়ায় নিয়ে তুলল। তারপর তার অবচেতন ম্নন তাকে একটা চারপেয়ে জন্তুরমত ঝোঁপের ভিতর দিয়ে অপর পারের ফাঁকা মাঠে টেনে আনল। সে শুয়ে পড়ল। রতন তখনো তার বাহন সামলাতে ব্যস্ত।
সামনে দিগন্ত জোড়া মাঠ। ফসল নেই। মাঝে মাঝেই মাটি কেটে নেওয়ার গর্ত। ডান দিকে কয়েক গজ দূরে একটা মাটির পথ। আধা মাইল দূরের কয়েকটা বাড়ির দিকে এগিয়েছে সেটা।
সকাল আটটার কয়েক মিনিট আগে বাড়ি থেকে বের হল সালেহ। মোট প্রায় মাইল খানেক হেঁটে বাসষ্টান্ড, তারপর বাসে আধাঘন্টা, তারপরে তার কাজের জায়গা। বাস ঠিকমত পাওয়া যায়না বলেই তাকে অন্তত আধাঘন্টা আগে বের হতে হয়।
তবে আজকে তার বের হওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। আজ থেকে ঈদের ছুটি। গতকাল তাদের বোনাস দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাস শেষ হয়নি বলে বেতন দেয়নি। বলেছে, আজকে সম্ভব হলে বেতন দেবে। যাদের বিশেষ প্রয়োজন তারা যেন দেখা করে। সালেহ জানে, এটা শান্তনার কথা। তবু যদি কিছু পাওয়া যায়, অন্তত ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের কিছু কেনা যাবে। বোনাসের টাকাটা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আর মিষ্টি সেমাই কিনতেই শেষ।
সে মাথা নিচু করে আপন মনে হাঁটছিল। সড়কের কাছে এসে মাঠের কোনায় পড়ে থাকা মেয়েটা তার চোখে পড়ল। সে আঁৎকে উঠে থেমে দাঁড়াল। বোঝাই যাচ্ছে নালার পানি থেকে উঠে এসেছে। কেউ মারার জন্য পানিতে ফেলেছে নাকি গাড়ি এক্সিডেন্টের ফল? কিন্তু পড়ে আছে কেন? 'ছেলেটা' কি মরে গেছে?
সে তাড়াতাড়ি সড়কে উঠল। একটা গাড়িঘোড়া বা জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। সে আবার ফিরে এসে মেয়েটার কাঁধে হাত দিল। মেয়েটা চোখ মেলে তাকিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শুয়ে চোখ বন্ধ করল।
ছিপছিপে পাৎলা মেয়েটা তার ছোট মেয়ের বয়সী হবে। কাদা আর পঁচা লতাপাতা জড়ানো পোশাকটা নিশ্চয় এমন কোন স্কুলের ইউনিফর্ম, যেখানে ঢোকার সাহস সালেহদেমত কারো হবে না। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। কিন্তু পিতা মাতার সেই 'অবস্থা' এখন এর কোন উপকারে আসছে?মেয়েকে ফিরে পেতে তাদের সম্পদ এখন কোন কাজে লাগছে? খোদা এর ভার এখন এমন একজনের উপরে ন্যাস্ত করেছেন, যার নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের কিছু কেনাটা কঠিন। এর জন্য কিছু করতে গেলে নিজের ছেলেমেয়েদের অন্নে টান পড়তে পারে। কিন্তু সে একজন পিতা- একে এভাবে ফেলে রেখে সে চলে যেতে পারে না। তার নিজের ছেলে বা মেয়ে যদি এভাবে পড়ে থাকতো আর কোন একজন উপেক্ষা করে চলে গেলে সালেহর কেমন লাগতো? সে হাতের খালি ব্যাগটা নিচে রেখে নোংরা মাখা মেয়েটাকে বুকে তুলে নিল। মাথাটা নিজের কাঁধে গুঁজে দিল। দু'ঘন্টা পরে গেলেও চলবে।
ক্ষোভে অভীমানে চোখে পানি এসে গেল রিজিয়ার। তিন ছেলেমেয়ের খাবারই বলতে গেলে ঠিকমত জোটাতে পারেনা, তার উপরে আরো একটা মুখ এনে হাজির করেছে। পড়েছিল বলে তুলে এনেছে, এটা কেমন কথা? নিজেদের অবস্থার কথা একটু ভাবতে হবে না? কিন্তু এটাও তো ঠিক, যেখানে কোন জন মানুষ নেই সেখানে একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে থেকে মরে যাবে, সেটাও তো হতে দেওয়া যায় না। তার দিলু, মিলু বা শান্তদের কোন একজন যদি হোত? সে শিউরে উঠল।
সালেহ গেল একটু দুধ কিনে আনা যায় কিনা দেখতে।
ইট বিছানো বাথরুমে একটা কাঠের জল চৌকি পেতে তার উপরে বসানো হয়েছে মেয়েটাকে। বড় মেয়ে তার দুই কাঁধ ধরে রেখেছে।
বালতির পানিতে সামান্য গরম পানি মিশিয়ে নিল। পুরো পোশাক খুলে নিল। মেয়েটা একবার চোখ মেলে আবার বন্ধ করল। সেই অল্প আলোতেই তার বুকের উপরে সরু একটা সেনার চেন ঝিকমিক করে উঠল। সাথে একটা ছোট কিন্তু পুরু নক্সা কাটা লকেট। সে সেটা হাতে তুলে নিল। সেটার উপরে জলছপেরমত করে লেখা- মিতু। তার মেয়ে ঝুঁকে পড়ল। 'মা, কী সুন্দর!' সে বলল। তার মায়ের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল শুধু।
লকেটটার নিচের দিকে মানানসই নয় এমন একটা হুক। সেটাকে সে বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিতে চাপ দিতেই লকেটের উপরের অংশটা একটা ঢাকনার মত খুলেগেল। ভিতরে ছোট একটা ভাঁজ করা কাগজ। সে তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা আবার বন্ধ করে দিল। তার আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল- আহ! তার মেয়েদের যদি এমন গহনা থাকত!
সে সেটা খুলে নিল না। গা ধোয়াতে একটু অসুবিধা হলে হোক, কিন্তু খুলে নিলে যদি আর ফিরিয়ে দিকে ইচ্ছা না করে?
গায়ে পানি পড়তেই মেয়েটার শরীর যেন কিছুটা শিথিল হয়ে গেল। ভাল লাগছে। যত্ন করে গোসল করিয়ে মুছিয়ে মিলুর পোশাক পরিয়ে দিল। একটু ঢিলা হল, কিন্তু কিছু করার নেই। তারপর তাকে তুলে তার ঘুমন্ত দুই সন্তানের পাশে শুইয়ে দিল।
কাগজটা একটা ফোন নম্বার আর তাদের ঘরে একটা সেলফোন আছে। ভাগ্য ভাল, সামান্য কিছু ব্যাল্যান্সও আছে।
'হ্যালো, কে বলছেন?' ভেঙ্গে পড়তে থাকা একটা পুরুষ কন্ঠ জানতে চাইল।
'আমি সালেহ।'
'সালেহ কে?' এবার কন্ঠটা কিছুটা কড়া আর রাগী।
'আমি...মানে...মিতুর গলার লকেটে...।'
'মিতু...কোথায়? ওর কোন ক্ষতি করবেন না। আমি টাকা নিয়ে আসছি।'
'টাকা...না, কিসের টাকা? আপনি কে?'
'আমি মিতুর বাবা। কিন্তু টাকা না কেন? টাকার জন্যই তাকে হাইজ্যাক করেন নি?'
'না না, আমি হাইজ্যাকার না।' সে আৎকে উঠল। 'তাকে মাঠের কোনায় পড়ে থাকতে দেখে...বেঁচে আছে দেখে...।'
'এক মিনিট।' মুহূর্তেই কন্ঠস্বরটা কোমল আর ভেজা হয়ে উঠল। সালেহকে হতভম্ব করে দিয়ে লাইনটা কেটে গেল। কিন্তু প্রায় সাথে সাথে বেজে উঠল। 'আপনার ঠিকানাটা বলেন।' সালেহ বুঝিয়ে বলল। 'আর দয়া করে অন্তত পনের মিনিট আপনার ফোনটা বন্ধ করবেন না বা লাইনটা কাটবেন না। আমি আসছি...।'
‘তুমি যেওনা,’ মিনু স্বামীর কনুই খামছে ধরল। ‘এটা একটা ফাঁদ হতে পারে।’
‘আমাকে মেরে ফেলবে? সেটা সে করবে না। আর করলেই বা। তুমি জান কে। আমার কিছু হলে দরকার হলে সব সম্পত্তি বিক্রি করে টাকাটা তাকে খুন করার কাজে লাগাবা। পারবা না?’ মিনু কোন জবাব না দিয়ে হাত ছেড়ে দিল। ঠিক পাঁচ
মিনিট পরেই ল্যান্ড ক্রুজারটা পথে বের করল।
গাড়ি ছুটে চলেছে। পিছনের সিটে মিতুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে তার বাবা। চোখ দুটো করমচারমত লাল। মিতুর পরণে এখনো মিলুর সাদামাটা পোশাক, তাতে সাবানের গন্ধ। চোখ দুটো বন্ধ। তার ইউনিফর্ম আর জুতাদুটো দুটো পলিথিনে ভরে ফেলে রাখা হয়েছে। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। মিনুকে বলে দিয়েছে সারমিতায় চলে যেতে।
মিতুর বাবা ভাবছে । পায়ের কাছে ব্রিফকেসে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। কিন্তু মানুষটাকে এমন কি পোশাকটার বা যে দুধটা এনে খাইয়েছে তার দাম হিসাবে একটা টাকাও নিতে রাজি করাতে পারেনি। তার নিজের মেয়ের ব্যাপারে কী যেন বলছিল।
কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী?
কয়েকটা জায়গায় ফোন করে মেয়ের বিছানার পাশে এসে বসল। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। স্যালাইন চলছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। মিনুর দিকে তাকাল। সে ডেস্কে বসে হাসপাতালের প্যাডে কিছু লিখছিল, এখন সেটা পড়ে দেখছে। মিতু কোথায় কীভাবে ছিল আর সেখানকার পরিস্থিতি কী সেটা সে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে।
‘কাছেই তো মার্কেট, এগুলো কিনে আনতে পারবে না?’ সে কাগজটা সামনে বাড়িয়ে দিল।
চাল ডাল তেল, শুকনো খাবার, জুতো পোশাক, গহনা...। মানুষটা হেসে ফেলল। ‘বাব্বা! এ যে দেখছি বিয়ের লিষ্ট!’
‘কালকে ঈদ না?’ মিনু এই প্রথম হাসল।
‘আমি এখনই বলে দিচ্ছি, সব কিনে রেডি করে রাখবে।’ তারপর একটু থেমে বলল,’কিন্তু পোশাক আর জুতোগুলো তারা এসে পছন্দ করে নিয়ে গেলে ভাল হয় না? পছন্দ আর মাপের একটা ব্যাপার আছে।’
‘তাহলে তুমি...।’
‘হ্যা, কালকে ঈদ না?’ তার দু’জনে জোরে হেসে উঠল। পর মুহূর্তেই ভয়েভয়ে মিতুর দিকে তাকাল। মনে হল সেও যেন মুখটিপে হাসছে...।
-এই গল্পের স্থান কাল পাত্র সব কিছু কাল্পনিক, বাস্তব কিছুর সাথে মিলে গেলে সেটা কাকতালীয়- ওয়াহিদ।