‘বাবা,’ ঘর থেকে বারান্দায় নামল সানোয়ারা। তারপর ডান দিকে ঘুরে বারান্দার শেষ প্রান্তে বসে থাকা তার বাবার দিকে এগিয়ে গেল।
‘’
বারান্দাটা বিশাল, আর সেই অনুপাতে চওড়াও। ডান দিকের প্রান্তে লম্বা একটা কাঠের টেবিল, যেটার দুই পাশে ছয়টা হাতল বিহীন কাঠের চেয়ার, সেগুলো থেকে ভদ্রতাসূচক দুরত্ব বজায় রেখে দেওয়ালের গায়ে একটা কাঠের বেঞ্চি। বারান্দার অপর প্রান্তে মাঝারি আকারের একটা খাট, যার উপরে শুধু একটা শীতলপাটি। সামনেই বিশাল একটা উঠোন।
বাম দিকে উঠোনের মাঝ বরাবর চার-পাঁচ ফুট চওড়া একটা পথের ফালি ছাড়া উঠোনের বাকি তিন প্রান্তের পুরোটাকে ঘিরে রেখেছে গাছের সারি। গাছের সারি না বলে জংগলের প্রান্ত বলাই ভাল। কয়েকটা পরিচিত আম কাঁঠাল নারকেল গাছ মাঝে মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারলেও সমস্তটাই জংলা গাছে ঠাসা। বামপাশে কোনার দিকে একটা শ্যাওড়া গাছ, আর তার পাশে দুর্বল ফ্যাকাশে কলকে ফুলের গাছটা যেন নিজের দুর্বলতা ঢেকে ফেলার জন্য সাদা ফুল আর গোটা গোটা সবুজ ফলে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। গাছটার কাছেই, উঠোনের সেদিকের কোনায় একটা পাকা পায়খানা, সেটার সামনে একটা ঝকঝকে টিউবয়েল, যার গোঁড়াটা সিমেন্ট দিয়ে বাধিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে একটা সরু নালা বের হয়ে জংগলের ভিতরে হারিয়ে গেছে। পাশেই একটা মাটির উঁচু ভিটার দোচালা ঘর।
ইঁটের দেওয়াল আর টিনের চৌচালা বড়িটার দরজাটার সোজাসুজি উঠোনের বিপরীত দিকে আট দশ ফুট জংগল সাফ করে পথ বের করা হয়েছে। সেটা গজ বিশেক সোজা গিয়ে সামনের ইট বিছনো একটা রাস্তার সাথে মিশেছে। তারপরেই খাল, সেটা যেন রাস্তাটার প্রান্ত থেকে ঝপ করে পনের ফুটেরমত নেমে শুয়ে পড়েছে। খালটা যেন রাস্তাটাকে গ্রাস করে না নিতে পারে সেই জন্য মোটা গজারির খুঁটি গেঁড়ে রাস্তার এপাশটা বাধিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ত্রিশ গজেরমত চওড়া খালটার অপর পাড়টা কিন্তু সামান্য উঁচু। একফালি বাঁকা চাঁদেরমত খালটার সমান্তরালে পড়ে আছে ফসলের মাঠ। সেগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রাম- গাছপালা আর বাড়িঘর। ক্ষেতে এখনো কিছু বোনা হয়নি, তবে মানুষজন দেখে বোঝা যাচ্ছে তার প্রস্তুতি চলছে। আব্দুল করিম চেয়ারে একটু কাত হয়ে বসে আয়েশের সাথে পান চিবাতে চিবাতে সেদিকে তাকিয়েছিল- তাকে আর একটু পরেই সেখানে যেতে হবে। সে জানে, মালিক উপস্থিত থাকলে কর্মীরা কাজে অনুপ্রেরণা পায়। তাছাড়া তার নিজেরও এতে যেন নেশারমত লাগে, কোন কারণে যেতে না পারলে তার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতে থাকে। সে চাষির ছেলে, সামান্য কিছু লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও চাষাবাদের সব ধরণের কাজই তাকে করতে হয়েছে। তার বয়স এখন বাষট্টি, কিন্তু তার রোদে পোড়া সুঠাম দেহ দেখলে এটা সহজেই ধারণা করে নেওয়া যায়, সে এখনো কঠিন কাজ করারও ক্ষমতা রাখে। সে নিজের চেষ্টায় পৈতিক সম্পত্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, সে এমনকি, মধুগঞ্জের বাজারে একটা বড়সড় মুদির দোকানের মালিক। সেটার ভার প্রায় পুরাটাই কর্মচারীদের উপরে। সে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে গিয়ে থাকে। বাজারটা তার বাড়ি থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে।
সে সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে যতদুর পারা যায় তার দৃষ্টিকে খাল পার করিয়ে ক্ষেতের ভিতরে কাজ করতে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। তাদের খাওয়ার সময় হয়ে আসছে। তা ছাড়া গরুগুলোর একটু খোঁজ নিতে হবে, সেগুলোকে খালের এপারে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাখাল ছেলেটা এই কাজের ভরা মৌসুমে হঠাত অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেল, আর তার মাত্র দুদিন আগে বাড়ির কৃষাণ ছোড়াটাকে অসুস্থ মাকে দেখে আসার জন্য এক সপ্তাহের ছুটিতে পাঠানো হল! সকাল বিকাল গাই দোয়ানো তার জন্য খুব একটা কঠিন কাজ নয়, কিন্তু চাষাবাদের কাজের সময় গরুগুলোকে গোসল করানো, খেতে দেওয়া আর মাঠে নিয়ে যাওয়ার কাজগুলো তার পক্ষে কঠিন। এছাড়া আছে গোয়াল ঘর পরিষ্কার রাখা। সে কৃষাণদের কাউকে দিয়ে এর কোনটাই করাতে চায়না, কিন্তু তাকে বাধ্য হয়েই তাদের একজনকে দিয়ে সেটা পরিষ্কার করাতে হচ্ছে। বাকি কাজগুলো সে নিজেই করছে। আপাতত তার দোকান যাওয়া একরকম বন্ধ।
‘কী, মা?’ সে মুখ না ঘুরিয়েই জানতে চাইল।
‘তুমি তো আজ আর দোকানে যাবেনা,’ সানোয়ারা তার পাশে এসে টেবিলে একটা হাত রেখে বলল। তার পরণে বাইরে যাওয়ার পোশাক, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। কাঁধে ছোট একটা চামড়ার ব্যাগ, বাম হাতে একটা ফোল্ডিং ছাতা। তার গায়ের সাদা ওড়নার পিঠের কাছটা ভিজে চুলের পানিতে ভিজে আছে।
প্রায় পাঁচফুট লম্বা মেয়েটার দেহের পড়ন অনেকটা তার বাবার মতই, মুখের গঠনে মিল আরো বেশি। সে বাবারমত শ্যামলা নয়, তবে বাইরে ঘোরাঘূরির কারণে তার সাদা বর্ণ বাদামী হয়ে উঠেছে। আঠার বছর বয়সের সে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, মাস খানেক পরেই তার পরীক্ষা।
‘আমাকে বই আর কিছু কাগজ কিনতে হবে, শদুয়েক টাকা দিও.’
‘এই দুপুরে আবার কোথায় যাচ্ছিস?’ সে এবার মুখ ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘খেয়েছিস? ’
‘হ্যা, বাবা।’ সানু একটু ইতস্তত করে বলল। ‘আজ আমি কলেজে যাইনি। ভেবেছিলাম, ওগুলো তোমাকে দিয়ে আনাব। কিন্তু তুমিও যাবেনা। রুমা আর আমি যাব, ওরও কিছু কেনাকাটা আছে, আমাকে বলেছিল।’
‘তোর মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যা।’ ওর বাবা আবার ক্ষেতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল।
‘মা রান্নাঘরে,’ সানু জবাব দিল। ‘আমার দেরী হয়ে যাবে।’
আব্দুল করিম উঠে দাঁড়াল, সানোয়ারা সরে তাকে যাওয়ার পথ করে দিল। সে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল, মেয়ে তার পিছু নিল। কিন্তু কয়েক পা চলার পরেই তাদেরকে থেমে রাস্তার দিকে ফিরে তাকাতে হল।
‘আসসালামু আলাইকুম,’ জংলা গাছগুলোর পাশ দিয়ে উঠোনে পা দিয়ে তাদের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার বলে উঠল। তার সাথে তাদের অপরিচিত একটা ছেলে। বিশ পঁচিশ বছর বয়সের ছেলেটা সানোয়ারার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নিচে নামিয়ে নিল, কিন্তু সানোয়ারা ছেলেটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। একেবারে অপরিচিত একজন যুবক।
‘ওয়ালাই কুমাস সালাম। মাস্টার সাহেব যে,’ আব্দুল করিম বলল। মুখে হাসি। ‘আসেন, একটু বসেন, আমি এখনি আসছি।’ সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভিতরে ঢুকল।
‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার,’ তারা বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের কাছে আসতেই সানোয়ারা হাসি মুখে বলল। কিন্তু তার চোখে প্রশ্ন। মাস্টার সাহেব যে কারো বাড়িতেই নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আসেন না, স্কুলের কোন ব্যাপার ছাড়া তার ব্যাক্তিগত প্রয়োজন নেই বললেই চলে।
‘ওয়ালাই কুমাস সালাম। কেমন আছ, মা?’ সে পাঁচ ধাপের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে বলল। তারপর পিছন ফিরে হাতের ইশারায় সাথের ছেলেটাকে উপরে উঠে আসার ইংগিত করল।
‘জি, ভাল। আপনি ভাল আছেন তো?’
‘হ্যা, মা।’ তারা দুজনে বাইরের দিকের দুটো চেয়ারে বসল।
সানু মনে মনে কিছুটা খুশি হয়েছে। তার ধারণা, হেডস্যার তাদের জন্য একজন রাখাল নিয়ে এসেছে। ছেলেটা বা যুবকটা যাই হোক না কেন, পোশাক পরিচ্ছদে কৃষাণ জাতীয় কিছু একটা মনে হলেও তার বুদ্ধিদীপ্ত মুখে এমন একটা কিছু আছে, যাতে তাকে এত নিচু স্তরের বলে মেনে নিতে মন সায় দেয়না। কিন্তু সে বেশি কিছু ভাবার সময় পেলনা, পিছনে বাবার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দরজার কাছে গিয়ে বাবার হাত থেকে টাকা নিল। তারপর স্যারকে বিদায় জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নেমে গেল। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে, রুমা আবশ্য তার জন্য বাসায় সারা দিন অপেক্ষা করলেও কিছু মনে করবেনা, কিন্তু কলেজের গেটের কাছে শামিম মেজাজ খারাপ করতে শুরু করবে।
ছেলেটা উঠে দাড়াল।
‘বসো,’ নিজে চেয়ারে বসতে বসতে ছেলেটাকে বলল। ‘তারপর মাস্টার সাহেব, কী মনে করে?’ হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল। ‘স্কুল থেকে আপনাকে তো ঠেলা দিয়েও বের করা যায়না।’
‘জি,’ এদিক থেকেও হাসির মাধ্যমে জবাব এল। ‘আজ আপনার কাছে ঠেকায় পড়ে আসতে হল। একটা অনুরোধ আছে,’ সে একটু থামল, হাসি মুছে সেখানে কিছুটা গম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু আব্দুল করিম কিছু না বলে সেভাবেই তাকিয়ে থাকল। ‘এই ছেলেটাকে একটা কাজে লাগিয়ে দিতে হবে।’
‘আপনি আমার প্রয়োজনের সময়ে একজন কাজের মানুষ নিয়ে এসেছেন।’ তার মুখে কিছুটা উতসুক ভাব ফুটে উঠেছে। ‘আমার বাড়ির রাখাল আর কাজের লোক দুজনেই ছুটিতে গেছে, অথচ এখন ক্ষেতে কাজের সময়।’ সে একটু থামল। ‘বাড়ির কাজের লোক না হলেও চালিয়ে নেওয়া যাবে, কিন্তু একজন রাখাল না হলে আমার একেবারেই চলছে না।’
‘রাখাল!’ মাস্টার সাহেব এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিল। সে খুব আশা করে এসেছিল, আব্দুল করিম ছেলেটাকে তার দোকানের কোন একটা কাজে লাগিয়ে দেবে। কিন্তু রাখালের কাজে... ।
ছেলেটা মাথা নিচু করে মনযোগের সাথে শুনছিল। সে মুখ তুলে স্যারের মুখের দিকে তাকাল। সাথে সাথেই সে স্যারের হতাশা বুঝতে পারল। মুখ ঘুরিয়ে আব্দুল করিমের দিকে তাকাল। এই মানুষটার সমস্যাও সে বুঝে নিয়েছে।
‘জি, আমি যে কোন কাজ করতে রাজি আছি,’ স্যার তাকে বলতে শুলন। ‘কিন্তু আমি কখনো গরু রাখার কাজ করিনি। আমি কি পারব?’ স্যারের মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হল।
‘কঠিন কোন কাজ না,’ লোকটাকে কিছুটা ভারমুক্ত মনে হল। ‘আমার চারটে গরুই ঠান্ডা। তোমার কাজ হবে, সকালে সেগুলোকে গোয়াল থেকে বের করে ধুয়ে-মুছে দুধ দোয়ানোর জন্য প্রস্তুত করা, তারপর ওদের মাঠে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে একটু খেয়াল রাখ। বিকালে আবার গোসল করিয়ে নিয়ে আসা। তিনটে বাছুর আছে, তাদের একটু দেখাশুনা করা, জাবনা খেতে দেওয়া, আর গোয়ালঘর পরিষ্কার করা। তোমার নাম কী?’
‘আব্দুল মতিন।’ আতঙ্কে তার বুক হিম হয়ে গেছে। সে মৃদুস্বরে জবাব দিয়ে মাথা নিচু করল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল, একছুটে এখান থেকে বের হয়ে যেদিকে দু চোখ যায় পালিয়ে যায়। এ কাজ সে কখনই পারবেনা।
মানুষটা তার দিকে তাকিয়েছিল, তাকে কিছুটা হতাশ মনে হল। সে মুখ ফিরিয়ে স্যারের দিকে তাকাল। ‘খুব একটা কঠিন কাজ নয়।,’ সে বলল। ‘শুধু তোমার যদি করার ইচ্ছা থাকে। আমি তোমাকে সব দেখিয়ে দেব, আর তুমি যেটা পারবেনা, সেটা তোমাকে করতে হবে না।’ সে থেমে আবার আগ্রহের সাথে মতিনের তাকাল। মতিন কোন জবাব দিলনা। ‘ছোড়াটা না আসা পর্যন্ত আমার জন্য কয়েকটা দিন যদি একটু কষ্ট করতে।’ মানুষটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘জি, আমি করব,’ মতিন নিজেকে বলতে শুনল। কিন্তু সেটা তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছেনা।
...সকাল দশটার দিকে ট্রেনটা এমন একটা স্টেশনে এসে দাড়িয়েছে যেটাকে একটা স্টেশন হিসাবে মেনে নিতে ইচ্ছা করেনা। আর ট্রেনটা সেখানে এতটা বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে লাগল যে মতিন বিরক্ত হয়ে উঠল। রাত সাড়ে এগারটায় এটা কমলাপুর থেকে ছেড়েছে। সে ট্রেনযাত্রা খুব বেশি করেনি, হয়তো সেই কারণেই তখন থেকেই ঘুমিয়ে আর না ঘুমিয়ে রাতটা শেষ করেছ। এখন আবার তার ঝিমুনি আসছে।
সে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নিচে নামল। স্টেশনের টিউবয়েলে হাতমুখ ধুয়ে কিছু পানি খেল, তারপর খোঁজ নিতে লাগল। চট্টগ্রাম মাত্র চার ঘন্টার যাত্রা। সেদিক থেকে আসতে থাকা একটা মেইল ট্রেনকে পথ করে দেওয়ার জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কতক্ষণের জন্য? আধা ঘণ্টা হতে পারে, দুই ঘণ্টাও হতে পারে। ভাল। মতিন খোলা গেটের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে কোন টিকেট কালেক্টর নেই। তার খিদে লেগেছে, কিছু খেতে হবে।
ষ্টেশনের সমানে দিয়ে চলে যাওয়া পথটা বিশ্বরোড জাতীয় হলেও এলাকাটা একেবারে গ্রাম্য। ষ্টেশনের বিপরীত দিকে দোকান পাট নেই বললেই চলে, তবে একটু ডান দিকে এগিয়ে গেলে বাম দিকে একটা পথ চলে গেছে দেখা যায়, আর সেই কোনাটাতে বেশ আনেকগুলো দোকান, হোটেল আর সেলুন। সেই পথটার দুপাশেই গাছের সারি, যার প্রথম দিকে একটা বিশাল বটগাছের মাথা উঁচু হয়ে আছে।
ভাজি পরাটা আর চা খাওয়ার পরে সে বটগাছটার দিকে এগিয়ে গেল। গাছটার গোঁড়া সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। সেটার হাত পাঁচেক দুরেই একটা অতিব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া, কিন্তু এখনো পানি উগরে দিতে সক্ষম একটা টিউবয়েল। অজানা জায়গায় দিক ঠিক করতে যাওয়া তার পক্ষে সহজ নয়, কিন্তু এই পথটা বরাবর ফুরফুরে বাতাশ বয়ে আসতে দেখে তার মনে হল এটা উত্তর দক্ষিণ দিক বরাবর গেছে। সে গাছটার গোড়ায় হাতের জিনিসটা রেখে টিউবয়েলটার হাতল ধরে উঁচু করে নিচের দিকে চাপ দিল- ক্যাঁচ-ঘটাং প্রচন্ড শব্দে সেটা আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাল, কিন্তু সেই সাথে পানিও উগরে দিল। সেটার স্বাদ মন্দ না। পানি খেয়ে সে গাছটার গোঁডায় এসে বসল, তারপর কাঁত হয়ে শুয়ে পড়ল, এই অসময়ে তার দারুণ ঘুম পাচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই, দুদুটো রেল ইঞ্জিন এখান দিয়ে যাবে, প্রথমটার শব্দেই সে নিশ্চয় জেগে উঠবে আর দ্বিতীয়টা চলতে শুরু করার আগেই সে স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবে। সে চোখ বন্ধ করল, সবে তার ঘুম আসছে, এমন সময় তার মাথার দিক থেকে ক্যাঁচ-ঘটাং শুরু হল, সে চোখ খোলার ঝামেলায় গেলনা আর সেই শব্দের ভিতরেই ঘুমিয়ে পড়ল। কয়েকবার ক্যাঁচ-ঘটাং শব্দে তার ঘুম ভাংল, একবার তার মনেহল যেন সে ইঞ্জিনের বাঁশির শব্দও শুনল, কিন্তু ফুরফুরে বাতাশ তার সারা দেহে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল যে, তার পক্ষে চোখ খোলাও সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত টিউবওয়েলের একটানা শব্দে জেগে উঠল, তার কানে আজানের শব্দ এল। আজান! সে ধড়মড় করে উঠে বসল, তারপর সে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ষ্টেশনের দিকে ছুটল। সেখানে ট্রেন তো দূরের কথা, দুটো ছাগলের বাচ্চা আর কয়েকটা মুরগি ছাড়া একজন মানুষও নেই। তার আবার ক্ষিদে লেগেছে, সে আবার সেই হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল।
‘সন্ধ্যা সাতটা আটটার দিকে- নটাও হতে পারে- একটা লোকাল ট্রেন চট্টগ্রাম যাবে, তার আগে কোন ট্রেন নেই,’ হোটেলের ক্যাসিয়ার জানাল।
‘ভাল,’একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মতিন খেতে বসল। পড়ে থাকো এই অজ পাড়াগাঁয়ে রাত নটা পর্যন্ত।
আবার সেই বটগাছ। অনেকটা সময় তাকে এখানে কাটাতে হবে, সে মনে মনে ভাবল । সে আর ভুলেও ট্রেনে না ওঠা পর্যন্ত ঘুমাতে যাচ্ছে না। সে উঠে গ্রামের পথটা ধরে হাটতে শুরু করল। খামাখা আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়, তার চেয়ে বব্রং অচেনা জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখা যাক। পথের দুপাশেই ফাঁকা ফাঁকা করে লাগানো খেজুরগাছ, তারপরে চষা ক্ষেত। অনেক দূরেদুরে গাছপালার ঠাস বুনুনি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেখানে গ্রাম আছে। মাইল দুয়েক এগিয়ে পথটা বাম দিকে বেঁকে গেছে আর সেই সাথে পথটার সমান্তরালে একটা প্রায় দেড় মানুষ সমান উচু পাঁচিল। গজ বিশেক পরেই বড়সড় একটা কাঠের গেট, পুরোটাই খোলা, যার উপরে একটা পুরানো টিনের সাইন বোর্ড জানাচ্ছে, সেটা বাজেদপুর সরকারি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল।পাঁচিলের অপর পাশ থেকে ধুপধাপ শব্দ আর ছেলেদের চিতকারের শব্দে বোঝা যাচ্ছে, সেখানে ফুটবল খেলা চলছে।
গেটের কাছে এসে ভিতরে উঁকি দিল। মাঝারি আকারের মাঠটার অপর পাশে ছয় কামরার একটা সাদা বিল্ডিং। সেটার বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে একমাথা কাঁচাপাকা চুল আর মুখে সেই রকমের দাঁড়ি নিয়ে একজন বয়স্ক মানুষ খেলা উপভোগ করছেন। তার পরনে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবী। তার সামনে বারান্দার প্রান্তে বসে আট দশজন ছেলে খেলা দেখছে।
বিল্ডিংটার সমান্তরালে মাঠটার ডান কোনার দিকে একটা পাকা পায়খানা, আর সেটার সামনে একটা টিউবওয়েল। সেটা দেখে মতিনের পানির তেষ্টা পেল। সে একটু ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকল। সে প্যাকেটটা নিচে রেখে প্রথমে হাতমুখ ধুয়ে বেশ অনেকটা পানি খেল।বুড়ো মানুষটা তার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোন একজনও তার প্রতি কোন আগ্রহ দেখালনা।
সে ফিরে আসতে শুরু করেছে, এমন সময় বৃদ্ধ লোকটা হাত ইশারায় তাকে ডাকল। মতিন কিছুটা অস্বস্তির সাথে তার কাছাকাছি বারান্দার নিচে দাঁড়াল।
‘জি?’
‘কার বাড়ি যাবে?’ লোকটা প্রশ্ন করল।
‘কারো বাড়ি না,’ মতিন জবাব দিল। ‘ঢাকা থেকে আসছি, চট্টগ্রাম যাব।’
লোকটা ভ্রু কুঁচকে খাড়া হয়ে বসল। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। ‘একটা চেয়ার নিয়ে আয় তো মতি।’ সে সামনে বসে থাকা একটা ছেলেকে বলল, সাথে সাথেই ছেলেটা উঠে ভিতর থেকে একটা চেয়ার এনে তার পাশে রাখল। ‘একটু বসে যাও, ’ সে মতিনকে বলল। ‘এখান থেকে সেখানে হেটে যেতে আনেক সময় লাগবে।’ তার মুখ হাসি ফুটে উঠল। মতিনও হেসে ফেলল, কারণ লোকটার হাসিটা বিদ্রুপের নয়, কৌতুকের। ‘তা ছাড়া এটা উলটো পথও বটে।’
‘জি, জানি,’ মতিন বলল। ‘দুপুর বেলায় ফুটবল খেলা...।’ মতিন বদলা নিতে চাইল।
লোকটা এবার হোহো করে হেসে উঠল। ‘এদের শখ,’ সে বলল। ‘আসলে আজকে ফুটবলটা জোগাড় করতে করতেই এরা দুপুর করে ফেলেছে। স্কুলের ছুটির পরে নামাজ আর খাওয়া ছাড়া আমার আর কাজ নেই, কাজেই বসে বসে খেলা দেখেছি আর এদের প্রেরণা যোগাচ্ছি। আমার বাড়ি এখান থেকে মাইল ছয়েক দূরে, বউ ছেলেমেয়ে আর তাদের ছেলেমেয়ে সেখানে থাকে, কিন্তু হাটাহাটি করতে ভাল লাগেনা বলে সেখানে সপ্তাহে মাত্র একদিন যাই। আসলে আমি হচ্ছি এই স্কুলের হেড মাস্টার কাম দারোয়ান, কাজেই রাত্রে আমার এখানে থাকা উচিত...,’ সে কথা শেষ না করে হোহো করে হেসে উঠল।‘কিন্তু আর না- এই, তোরা সব থাম এবার। শুনছিস?’ হাসি থামিয়ে লোকটা হেঁকে বলল। বারান্দায় বসে থাকা দর্শকেরা এবার একটা কাজ পেল, তারা মাঠের ভিতরে ছুটে গিয়ে খেলয়ারদের খেলা লন্ডভন্ড করে দিল। তারা প্রথমে টিউবয়েলের কাছে জড়ো হল, হৈচৈ করতে করতে পানি খেল, আর কিছু নিজের আর পরের গায়ে মাথায় ঢালল, তারপর দুর থেকেই তাদের স্যারকে চিতকার করে সালাম জানিয়ে একে একে বিদায় নিতে শুরু করল।
দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া হাতে কাচা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবীতে আর পায়ের সাদামাটা চামড়ার স্যান্ডেলের কারণে মতিনকে নিচু শ্রেণির একজন শ্রমিকের উপরের পর্যায়ের বলে মনে হচ্ছিলনা। কিন্তু তার মুখের উজ্জ্বলতা আর বুদ্ধির ছাপ তাতে ভেটো দিয়ে যাচ্ছিল। বুদ্ধিমান মানুষটা তার পোশাকে প্রতারিত হয়নি। ‘বাড়ি ঢাকায়, না চট্টগ্রামে?’
‘ঢাকায়।’ লোকটা কোন কথা না বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মতিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘আসলে...,’ মতিন এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে শুরু করল।
‘...আমার বাড়ি ঢাকা শহরের একটু বাইরে। আমরা তিন ভাই একবোন, বোনটা সবার ছোট। বাবার পক্ষঘাত, মা মারা গেছে। বড় দুইভাই চাকরি করেন। তাদের প্রত্যেকেরই একটা করে সন্তান। বাবা যা পেন্সন পান, সেটা তিনি আমার বোনটার বিয়ের কথা ভেবেই হয়তো খরচ করছেন না। দুইভায়ের টাকায় আমাদের সংসার আর আমাদের দুজনের লেখাপড়া চলছে। এতে এখনো তাদের কোন অসম্মতি দেখা যায়নি, শুধু মেজভাবি কিছুটা অরাজি। সমস্যা বাবাকে নিয়ে, আর মেজভাবি সেটাকে বাড়িয়ে তুলছেন। বাবার কেমন যেন একটা ধরনা হয়ে গেছে, পড়াশুনা বাদ দিয়ে উপার্জনে লেগে গিয়ে সংসারে আর সবারমত আমারও অবদান রাখতে শুরু করা উচিত।’ মতিন চুপ করল, কিন্তু লোকটা এতটুকু শব্দ না করে অপেক্ষা করতে লাগল।
‘গতকাল আমার মেজভাবি আমার বোনের সহপাঠি, যে তার বাবা-মায়ের সম্মতিতে আমার কাছে পড়া বুঝে নিতে আসে, তাদের শুনিয়ে আমার বাবাকে এমন সমস্ত কথা বলেছে যেটা আমার অন্তরে বিধেছে। তার পরপরই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি।’ মতিন মাথা নিচু করে কিছক্ষণ চুপ করে থাকল। লোকটা কিছু বলার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু তখনি মতিন আবার মৃদুস্বরে বলতে শুরু করল ‘আমি ঝোঁকের মাথায় এটা করেছি সেটা ঠিক,’ মতিন বলল। ‘কিন্তু আমি ঠান্ডা মাথায় সমস্ত কিছু চিন্তা করে দেখতে চাই। কাজেই আমাকে কিছুদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হবে। আমার কাছে টাকা যা আছে তাতে দিন কয়েক চলে যাবে। চট্টগ্রামে আমি একটা কাজ গুছিয়ে নেব, ঝাড়ুদার মুটেগিরি যা কিছু হোক। তারপরে চিন্তা ভাবনা করে একটা কিছু ঠিক করব।’ সে লোকটার মুখের দিকে তাকাল। ‘আমি বি.কম পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্ট বের হবে কয়েক দিন পরে। কিন্তু আমি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা কাগজপত্রও সাথে আনতে পারিনি বা আনিনি।’
‘তোমার ব্যাপারে তোমাকে আমি কিছুই বলতে যাচ্ছিনা,’ লোকটা মতিনের মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল। ‘তবে তুমি নিরিবিলি থেকে যদি ভাবনার জন্য কয়েকটা দিন চাও, তাহলে এখানেই কিছুদিন থেকে যাওনা কেন।’ সে মতিনের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য থামল, কিন্তু মতিন কিছুই বললনা। ‘থাকা খাওয়া আর সামান্য বেতনের একটা কাজ হয়ত আমি তোমাকে যোগাড় করে দিতে পারব। তুমি কী বল?’
মতিন এক মুহূর্ত ভাবল। ‘তাতে আমার কোন আপত্তি থাকতে পারেনা। কিন্তু আমি যে কোন দিন চলে যেতে পারি, এটা জেনে কে আমাকে চাকরি দিতে যাবে?’
‘আমরা এখন সেটাই খুঁজতে বের হব,’ লোকটা উঠতে উঠতে বলল। মতিন উঠে দাঁড়াল। ‘ভাল কথা, তোমার তো বোধ হয় খাওয়া হয়নি?’ লোকটা একটা চেয়ার তুলে তার পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল, মতিন তাড়াতাড়ি অপর চেয়ারটা তুলে তার পিছুপিছু গেল।
‘ওখানকার হোটেলে আমি খেয়ে এসেছি।’
‘...তাহলে মাস্টার সাহেব, আপনারা খাওয়া দাওয়া করেন, আমি একটু মাঠে যাব।’
‘না, না,’ হেড মাস্টার ব্যস্ত হয়ে উঠে দাড়াল। ‘আমরা দুজনেই খেয়ে এসেছি।’
আব্দুল করিম স্যারের ব্যস্ততা দেখে হেসে ফেলল।‘আপনি বসেন, ব্যস্ত হবেনা। সানুর মায়ের অডার।’ তারপর মতিনের হাতের প্যাকেটটার দিকে তাকাল, ‘তুমি গিয়ে তোমার জিনিসপত্র নিয়ে এসো।’ স্বভাবতই সে ধরে নিয়েছে, মতিন স্যারের ওখানে উঠেছে।
‘ওর জিনিসপত্র ওর সাথেই আছে, ’ মতিনকে ইংগিত করে নিজে আবার বসতে বসতে বলল।
‘ভাল।’ লোকটা টিউবয়েলের পাশের ঘরটা দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে তুমি থাকবে।’ তারপর স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না, আমি ঘণ্টাখানেক পরে এসে একে সাথে করে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে দেব। দরকার হলে কাল সকালেও। আমার গরুগুলো খুব শান্ত, কোন সমস্যা হবেনা। আর আপনিও মাঝে মধ্যে একটু দেখে যাবেন।’
আব্দুল করিম দরজার কাছে শব্দ শুনে পিছন ফিরল। সেখানে একমাথা ঘোমটা দিয়ে সানুর মা বড় একটা বারকোস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেটার উপরে একগাদা আমের কাটা টুকরা, কিছু কাঁঠালের কোয়া আর দুই গ্লাস দুধ। আব্দুল করিম সেটা এনে স্যারের সামনে রাখল। তারপর এল কাঁচের একটা পানির জগ আর দুটো কাঁচের গ্লাস। তারা হাত ধুয়ে নিল।
‘কেমন আছেন, মাস্টার সাহেব?’ ঘোমটার কোন একটা ফাঁক দিয়ে শব্দগুলো বের হয়ে এল।
‘জি, ভাল আছি।’ আর কোন কথা হল না।
‘...না, চিন্তার কী আছে,’ সে মতিনকে খেতে শুরু করার ইংগিত করে নিজে একটুকরা আম তুলে নিয়ে বলল।
...গত কালকের বাকি দিনটা তার বেশ ভাল কেটেছে। বিকালে তাকে গরু আনতে যেতে হয়েছে। মাঠটা পনের বিশ মিনিটের পথ। করিম সাহেবের কথামত তার দেওয়া ছোট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে সে একটা লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে এসেছিল, আর হাত দেড়েক একটা লাঠি। চারটে গরুই বিশাল একটা আম গাছের নিচে শুয়ে জাবব্র কাটছিল। তাদের দেখেই তারা উঠে দাঁড়াল, তারপরে ধীরেসুস্থে খালের পাড়ে গিয়ে পানিতে মুখ দিল। তার চাকরিদাতার নির্দেশ মেনে সে এক এক করে সেগুলোকে পানিতে নামিয়ে খড় দিয়ে ডলে ডলে গোসল করিয়ে উপরে তুলল। তার আনাড়ি হাতের কাজ দেখে বারবারই তার মুখে হাসি ফুটে উঠছিল, কিন্তু সেটা বিরক্তির নয়, প্রশ্রয়ের হাসি। রেজাল্ট ভাল না হলেও সে প্রাক্টিকেলে পাশ করেছে।
গরুগুলো তাদের জন্য অপেক্ষা না করেই বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করল, মতিন তাড়াহুড়া করে পানি থেকে উঠতে গেল।
‘ওরা যাক,’ করিম সাহেব বলল। ‘আগে তুমি কাপড় বদলে নাও। আমি এখন একটু ক্ষেতে যাব, ওরা কী করছে দেখে তারপর ফিরব।’ সে হাত তুলে দূরে চাষাবাদের কাজে লেগে থাকা লোকগুলোকে দেখাল, তারপর ঘুরে হাটতে লাগল। তবুও মতিন তাড়াহুড়া করে গা মুছে পোশাক বদলে নিল, তারপর প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে গরুগুলোর পিছু নিল।
গোয়াল ঘরের সাথে বাড়ির যোগাযোগ সেই পাঁচফুটি রাস্তা দিয়ে। সেখানে বেশ অনেকটা জায়গা গাছ কেটে ফাঁকা করা হয়েছে। গোয়াল ঘরের পাশে বিশাল একটা খড়ের গাদা, সেটার পিছনে বড় একটা গর্ত, গোবর ফেলার জন্য। সেটার সামনে মাটির একটা বড় গামলা ছোটছোট কাঠের খুঁটি দিয়ে মাটির সাথে আটকে রাখা, এখানে তাদের খেতে দেওয়া হয়। তিনটে বাছুর আলাদা ছোট একটা খোয়াড়ে আটকা পড়ে আছে। এদের দুধ দোহানোর পরে তারা মুক্তি পাবে। মতিন গরুগুলোকে গামলাটার চারপাশে বেধে রেখে সেই পথ দিয়ে উঠানের টিউবয়েলের কাছে ফিরে এল। গরুগুলোর খাবার আগেই পাত্রটাতে রাখা হয়েছে। তার জন্য এখন কিছু খাবার বারান্দার টেবিলের উপরে অথবা খাটে রাখা হয়ে থাকে, আজকে সেটা টেবিলের মাঝামাঝি আছে।পানির জগ আর কাঁচের গ্লাসে দুধ। সে গামছা কাঁধে রেখে হাত মুখ ধোওয়ার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় সে বাড়ির পথে একটা পুরুষ কন্ঠের কথা শুনল। যদিও কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু সেই সাথে সানুর হাসি শুনে সে কিছুটা সচেতন হয়ে উঠল। সে একবার সেদিকে তাকিয়েই মাথা ঘুরিয়ে নিল। সানুর বাবা এখনই চলে আসবে, সে বাছুরগুলোকে বেশিক্ষণ অভুক্ত রাখতে চায়না।
সানু আর ছেলেটা পাশাপাশি অন্তরঙ্গ ভাবে হেটে আসছে। দুজনের পরনেই কলেজের পোশাক, কাঁধে ঝোলানো কলেজের ব্যাগ হাতে ছাতা। কিন্তু সানুর কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে আসার সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে এসব নিয়ে মতিনের মাথা ঘামানর কোন প্রয়োজন করেনা, সে তাদেরকে বারান্দায় উঠে যাওয়ার সময় করে দেওয়ার জন্য সেখানেই আরো বেশি সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল
‘ওটা তোমাদের নতুন রাখাল ছোড়াটা না?’ মতিনের সমরেখায় আসতেই ছেলেটা জানতে চাইল। মতিনের চাইতে দুএক বছর বয়সের বড় ছেলেটার পোশাক পরিপাটি, ঝকঝকে জুতা আর হাতে দামি ঘড়ি। ছয়ফুটের কাছাকাছি স্বাস্থ্যবান শ্যামলা ছেলেটার চৌকো মুখে আত্মরম্ভিতার ছাপ, যা তার পা ফেলার ভংগিতেও প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু মতিন ভেবে দেখল, এক মুহূর্তের দেখার উপরে ভিত্তি করে কোন মানুষ সম্মন্ধে কোন সিদ্ধান্তে আসতে যাওয়াটা একটা বোকামি। তবে এসবের কোন কিছুতেই তার কিছুই যায় আসেনা, সে এখানে একটা গরুর রাখাল।
‘হ্যা,’ সানু সংক্ষেপে জবাব দিল। ‘তোমাকে কিন্তু আমাকে দুটো অংক বুঝিয়ে দিতে হবে।’
‘রাখো তোমার অংক,’ তার উদ্ধত কন্ঠস্বর যেন মতিনের কানে ধাক্কা দিল। ‘এতটা পথ হাটিয়ে আনলে, এখন আবার আরো আধা মাইল হাটতে হবে। খিদেতে বাঁচিনা।’
‘তুমি একটু বস, আমি এখনই তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
তারা দুজন বারান্দায় উঠে গেল। চেয়ার সরানোর শব্দে মতিন বুঝল, ছেলেটা চেয়ারে বসেছে। তার এখন নিজের খাবারের খোঁজে বারান্দায় না যাওয়াই ভাল। সে উঠে নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরের বেড়াটার ভিতরে প্রচুর ফাঁকফোকর, তার একটার ভিতর দিয়ে সে দেখল, ছেলেটা টেবিলের উপরে ব্যাগ রেখে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে।একটু পরেই সানু এল। তার এক হাতে একটা দুধের গ্লাস আর আপর হাতে একটা একাউন্টিংএর বই, সাদা খাতা আর একটা বলপেন। সে ছেলেটাকে কিছু একটা বলতে বলতে গ্লাসটা হাতে দিল। তারপরে বই খাতা টেবিলে নামিয়ে বই খুলে কিছু একটা দেখিয়ে আবার ঘরে ফিরে গেল।
ছেলেটা বিরক্ত মুখে বাম হাতে গ্লাসটা তুলে ছোট ছোট চুমুকে দুধ খেতে খেতে বই দেখে খাতায় লিখতে শুরু করল। কিন্তু একটু পরেই তার লেখার আচরণ কেমন যেন বুনো হয়ে উঠল। তারপর সে হাতের কলমটা খাতার উপরে আছড়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল। ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলে বারান্দা থেকে নেমে সোজা বাড়িটা থেকে বের হয়ে গেল। মতিন এবার নিজের খাবারের জন্য সেখানে যেতে পারে।
তার খাবারের পাশেই বইখাতা পড়ে আছে। বইয়ের দুটো হিসাবে দাগ দেওয়া। তার একটা পুরোটা করে পুরোটাই কেটে দেওয়ার পরে সেটাই আবার কিছুটা করা হয়েছে। অপরটা ছুয়েই দেখা হয়নি। মতিন সেটুকু কেটে যতটা সম্ভব তাড়াহুড়া করে দুটো হিসাবই করে দিল। তারপরে কলমটা খোলা খাতার উপরে রেখে নিজের খাবার ভুলে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। গরুগুলো ডাকতে শুরু করেছে, ভাদের দোয়ানোর সময় বয়ে যাচ্ছে। আর প্রায় তখনই বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখল, আব্দুর করিম আসছে। মতিন খাবারের পাত্র ঘরের ভিতরে রেখেই বের হয়ে এল, গাই দোয়ানোর সময় তার প্রয়োজন পড়ে।
আব্দুর করিম তাকে দেখে হাসল, কিন্তু কিছু বলতে গিয়ে হাসি বন্ধ করে বারান্দার দিকে তাকাল। সানু হাতে একটা বারকোসে কিছু পিঠা, কাটা আমের টুকরা আর কাঁঠালের কোয়া নিয়ে দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে সে হতবুদ্ধিরমত তাকিয়ে থাকল।
‘কী হয়েছে, মা?’ আব্দুল করিম কোমল স্বরে জানতে চাইল।
‘শামিমভাই এসেছিল,’সে হাতের পাত্রটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল। ‘আমাকে না বলেই চলে গেল্?’
‘ওটা একটা পাগল,’ তার বাবা হাসতে হাসতে বলল। ‘তুই মা দুধের বালতিটা একটু এনে দে, গাইগুলো দুইয়ে নিই।’
সানু একবার মতিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর কিছু না বলে বইখাতা কলম তুলে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। বারকোশটা টেবিলের উপরে পড়ে থাকল।
পাঁচদিন পার হয়েগেছে। মতিনের এখন মনেই হয়না সে জীবনে রাখালী ছড়া অন্য কোন কাজ করেছে। গরুগুলের সাথে তার চমতকার ভাব, তার চেয়ে বেশি ভাব বাছুরগুলোর সাথে। গরুগুলোকে দিয়ে আসার পরে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে হাতে ঘণ্টা তিনেক সময় থাকে, হাটতে হাটতে সে প্রায়ই সেই স্কুলটাতে গিয়ে স্যারের সাথে গল্প করে আসে। অবশ্যই এতে আব্দুল করিমের অনুমতি আছে। তার অনুরোধে তার কাছে নিজের বাড়ির ঠিকান দিয়ে এসেছে, তবে শর্ত, সোমাকে ছাড়া কারো কাছে কোন খবর জানানো চলবেনা। আজকেও সে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু তার কপালে সেটা ছিলনা।
সে খাওয়া শেষ করে টিউবয়েলের পানিতে থালা বাটি আর গ্লাসটা ধুয়ে টেবিলের উপরে পানির জগের পাশে রেখে এসে নিজের ঘরে ঢুকল কাপড় বদলে নেওয়ার জন্য, আর ঠিক তখনই দুপদাপ পা ফেলে বাড়িতে ঢুকল সানু। মাথার উপরে ছাতা ধরা থাকলেও তার মুখচোখ লাল হয়ে আছে। মতিন বাধ্য হল বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকে লক্ষ করতে। কিন্তু একটু পরেই সে কলেজের পোশাকেই খালি হাতে বের হয়ে বারান্দার চেয়ারে এসে বসল। সে মাঝেমাঝেই এখানে এসে বসে, কিন্তু কখনই এমন সময়ে আর এই পোশাকে নয়। মতিন আর বের হল না, সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এবার টিউবয়েলের কাছে হালকা পায়ের শব্দে তাকে আবার বেড়ার ফুটোয় চোখ রাখতে হল। ততক্ষণে সানু কলকে ফুলের দুটো সবুজ গোটা ছিঁড়ে নিয়ে আবার বারান্দার দিকে যেতে শুরু করেছে। সে গোটা দুটো টেবিলে রেখে গ্লাসের গোড়া দিয়ে বাড়ি দিয়ে ভিতরের সাদা পিন্ডটা বের করে থেতো করতে লাগল। এতে শব্দ একাবারে কম হল না, কিন্তু মতিনের মনে হতে লাগল, তার হৃদপিন্ডের শব্দ যেন সেটার চাইতেও বেশি। মেয়েটা করছে কী?
‘কে বাবা এমন শব্দ করছে?’ বলতে বলতে সানুর মা দরজার কাছে এসে উঁকি দিল।
‘মা, আমি,’ সে তাড়াতাড়ি সাদা গুঁড়োগুলো গ্লাসে রেখে সেটাতে পানি ঢেলে দিল।
‘রান্না ঘরে একটু আয় তো মা, ভাতের হাড়িটা একটু ধরতে হবে, আমি একা পারবনা।’
‘চল,’ বলে সানু উঠে দাঁড়াল।
‘তুই এখনো কলেজের পোশাক ছড়িসনি, সানু? ’
‘কিছু হবেনা, মা, চল।’ সে তার মায়ের পিছুপিছু ভিতের গেল। মতিন কোন কিছু চিন্তা করতে পারার আগেই নিজেকে দেখল, সে সিঁড়ির আংশটা বাদ দিয়ে টেবিলের কাছে এসে লাফিয়ে বারান্দায় উঠছে। সে গ্লাসটা মুঠোয় ধরে সে ভাবেই ফিরে এসে নিজের ঘরের খাটের নিচে রেখে দিল। সে বিছনায় শুয়ে পড়ল, উত্তেজনায় তার বুকটা হাঁপরেরমত ওঠানামা করতে শুরু করেছ