এক,
রোদে পুড়ে আজ তার গায়ের রং বদলে গিয়েছে। চোখের নীচে বেশ কালি ও পড়েছে। কিন্তু একদিন তার রূপের খ্যাতি ছিল। বাবা মায়ের দেওয়া সুন্দর একটা নামও ছিল, "রানু", আজ কাল দিনের বেলা- আসাদগেট, কল্যাণপুরের ফিলিং ষ্টেশনে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি আসে তেল নিতে। তিনি এগিয়ে যান গাড়িতে বসে থাকা ভদ্র, শিক্ষিত মানুষের কাছে। সালাম দিয়ে ভিক্ষা চান। বুকের কাপড়টা সরে গেলে অনাবৃত স্তন চোখে পড়ে। সভ্য সমাজের কাছে তাঁর পরিচয়-তিনি আজ ভাসমান পতিতা। রাতে তার ঠিকানা-ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্ক, সংসদ ভবনের ফুটপাত, কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানের আশে পাশের এলাকা। তবে, জীবিকার প্রয়োজনে রাতের অন্ধকারে এখন আর খদ্দেরের খোঁজ করেন না তিনি। রাত গভীর হতে না হতেই-চোখে ঘুম আসে; গভীর ঘুম। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগেই চোখে ভাসে-বন্দুক হাতে এগিয়ে আসা খাকি পোশাক পড়া সেনাদল। আগুনের লেলিহান শিখা; রক্তাক্ত লাশ। কানে আসে দপদপ করা বুটের শব্দ; গুলির আওয়াজ; বুক ফাটা আর্তনাদ, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে খান সেনাদের অট্টহাসি যেন বাতাসে বাতাসে প্রতিফলিত হয়ে বার বার তার কাছেই ফিরে আসতে থাকে।
দুই,
দেশ জুড়ে চলছে বিক্ষোভ, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঢাকায় বৈঠক, ইয়াহিয়ার নির্বাচন। এরই মাঝে হাতে মেহেদী দিয়ে। লাল বেনারসি পড়ে শফিকের ঘরে আসে রানু। তখন শীতকাল। মেঘের উপর জমে থাকা শিশির বিন্দুতে সূর্যের আলো এসে পড়ে। উত্তরের হাওয়া বয়ে যায়। গাছের শুকনো হলুদ পাতা ঝড়ে পড়ে মাটিতে। গড়াই নদীর পাড় ধরে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলে যায় গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। শফিক শুধু স্কুলে শিক্ষকতাই করে না, রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে, দেশের কথা ভাবে। রানুকে বলে,
"দেখো, দেশের এই অবস্থা বেশীদিন থাকবে না। একদিন আমরা স্বাধীন হব। আর আমাদের সন্তান সেই স্বাধীন দেশে জন্ম নেবে।" গভীর রাতে পূর্ণিমার আলোতে উঠোন ভরে যায়। জানালার ফাঁক গলিয়ে সেই আলো ঘরে এসে পড়ে। গাছের পাতা চুইয়ে চুইয়ে-টুপ টুপ শব্দ করে বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়ে টিনের চালে। শফিকের বুকে মাথা রেখে, রানু স্বপ্ন দেখে তার ছোট্ট ছেলেকে বুকে নিয়ে সে দুধ দিচ্ছে। চুক চুক শব্দ করে ছেলেটা তার স্তন চুষে দুধ খাচ্ছে। ছেলে হলে রানু নাম দেবে রনি, আর মেয়ে হলে শফিক নাম দেবে-শমী।
গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। হলুদ হয়ে যাওয়া সর্ষে ক্ষেতে প্রজাপতি উড়ে। মৌমাছি মধু খায়। আসে ৭ই মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন। "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।" স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সব বন্ধ হয়ে যায়। তবে, শফিকের কাছে অনেকেই আসে। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ওরা সবাই আলোচনা করে। সেদিন শুক্রবার। মাগরিবের নামাজের পর এক প্রতিবেশী আসে শফিকের কাছে। মাথায় টুপি। হাতে তজবী। টুপিতে একফলি সবুজ চাঁদ। তীক্ষ্নগলায় হারুন বলে,
"শুনতাছি, তুমি নাকি দ্যাশ স্বাধীন করবার চাও। আরে দ্যাশ ত একটাই, তার দুইটা ভাগ। ওরা হইতাছে গিয়া আমাগো বড় ভাই। ভাইয়ের লগে ভাই এর আবার যুদ্ধ কিসের? শালার বাচ্চা। স্বাধীনতার কথা বইলা দ্যাশটারে ভাঙ্গতাছে ভারত। ঐ মালাউনগুলোই ত আমাগো শত্রু।"
মাথায় রক্ত উঠে যায় শফিকের, চিৎকার করে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে তাকে। হারুন মণ্ডল তবুও উঠে না। বলে,-
"ভাবীর এত সুরত। একবার দ্যাখলেও পরানটা জুড়ায়। তবে তার হাতে এক গ্লাস শরবত না খাইয়া উঠি ক্যমনে?"
২৫শে মার্চ। পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে হত্যা করে এদেশের লাখ লাখ মানুষকে। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। ২৫ তারিখেই গভীর রাতে পাকিস্তানী সেনা প্রবেশ করে শহরে। ২৬ তারিখ থেকে শুরু হয় ৩০ ঘণ্টার কারফিউ। হুড খোলা জীপে করে তারা টহল দিতে শুরু করে। পুলিশ লাইন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন দখলে নেয়। শহরের জেলা স্কুল, চাঁদ সুলতানা, দিনমণি স্কুল সহ বিভিন্ন স্কুলে ও জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে ওরা। আর তাদের প্রধান থাকে-মেজর শোয়েব, ক্যাপ্টেন শাকিল, সামাদ। ৩০ তারিখের ভোর চারটায় মোহিনী মিল ও ওয়ারলেস ষ্টেশনের উপর আক্রমণ চালায় শফিক। ওর সাথে থাকে অরুণ, রাজ্জাক, সোবহান ও কমল। ঐ অপারেশনের পর কুষ্টিয়া ছেড়ে যাবার আগে রানুর সাথে দেখা করতে অনেক রাতে বাড়ীতে আসে শফিক। চলে যাবার সময় রানুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, "তোমার রনি আর শমীর জন্য আমি ঠিকই ফিরে আসব একদিন।" পরদিন ভোরবেলা শৈলকূপার কাছে পুলের গোঁড়ায় গর্ত করে তারপেলিন দিয়ে সেই গর্ত ঢেকে শফিকরা হত্যা করে শোয়েবকে।
শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকেও শত শত লোক আসছে এখানে। এরপর তালবাড়িয়া ঘাট হয়ে চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। লাখ লাখ মানুষ গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ও দেশের শরণার্থী শিবিরে। ভারত সরকার খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে এদেশের মানুষকে। একদিন, দুই দিন করে মাস পার হয়ে যায়। শফিকের কোন খবর আসে না বাড়ীতে। দিন দশেক আগে গভীর রাতে, আলমডাঙ্গা থানার অপারেশন শেষে মুক্তি বাহিনীর চারজন ছেলে এসেছিল বাড়ীতে রানু আর ওর শাশুড়ি উঠে ভিতরের ঘরে বসে গরম ভাত রান্না করে খাইয়েছিল ওদের। ওদের কাছেও শফিকের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ছেলে গুলে চলে যাওয়ার সময় ওদের সাথে মুড়ি, খই, চিড়া দিয়ে দিয়েছিল রানু। ওর ভাসুর রফিক, সে যুদ্ধে যায়নি। বড় বাজারে কাপড়ের দোকান আছে তার। দুই মেয়ে তার বৌকে বহু আগেই শ্বশুর বাড়ী রেখে এসেছে সে।
একটানা বৃষ্টি চলে কয়েকদিন। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ নতুন সুর তোলে। একই ঘরে পাশের খাটে শ্বশুর ঘুমায়। রানুর পাশে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকে প্রৌড়া শাশুড়ি। রাত গভীর হয়। রানুর চোখে ঘুম আসে না। শফিকের মুখটা মনে পড়ে। কতদিন হয়ে গেল শফিকের দেখে না সে। রানু ঠিক করে রনি আর শমী নয়। ওর ছেলে হলে নাম দেবে-স্বাধীন, আর মেয়ে হলে নাম দেবে মুক্তি। লেখাপড়া শিখে স্বাধীন আর মুক্তি-একদিন অনেক বড় হবে। শফিক স্কুলে পড়ায়, ওরা কলেজে পড়াবে। দেশ স্বাধীন হবার কথা শুনলেই সে উঠোনের উপর পতাকা উড়াবে। স্বাধীন দেশের মাটিতে সেই পতাকা উড়বে। যুদ্ধ শেষে শফিক বাড়ী ফিরবে। দৌড়ে গিয়ে তার বুকের মাঝে শফিককে জড়িয়ে ধরবে সে। আর কোন দিন সে শফিক কে কাছ ছাড়া করবে না, .......................................... কোনদিন না।
তিন,
টগবগ করে বড় হাড়িতে ভাত ফুটছে। ঘরের মোরগটা জবাই করা হয়েছে। ক্ষেত থেকে পুঁই এর ডগা কেটে নিয়ে এসেছে রানু। জ্বাল কমে এসেছিল, মসলা বাটতে বাটতে ব্যস্ত হয়ে খড়ি দিয়ে উনুনের জ্বাল বাড়িয়ে দেয় সে। নদীর ঐ পড়ে হরিপুর গ্রামে বাড়ী রানুদের। সেই সাত বছর বয়সে মা মারা গিয়েছে, বাবা, বড় ভাই রায়হান আর ভাবীকে নিয়ে সংসার। শফিক যুদ্ধে গিয়েছে, খবর পেয়ে রায়হান এসেছে রানুকে নিয়ে যেতে। মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল ওরা। রানুর শ্বশুরের সাথে রায়হান ও পুকুর পাড়ে গিয়েছে ওজু করতে। অনেক দিন পর ভাসুরও আজ দোকানে গিয়েছে। এমন সময় শুরু হয়-চিৎকার, ছোটাছুটি। বড় রাস্তার মোড়ের উপর পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই দুটো জীপ এসে থামে। জীপ থেকে নেমেই সেনারা ছড়িয়ে পড়ে। গর্জে উঠে তাদের হাতে রাইফেল আর মেশিনগান। পাখির মত গুলি করে মারতে থাকে সবাইকে। গায়ের স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। তারপর আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউদাউ করে পুড়তে থাকে সবকিছু। দু/তিন জন সেনাকে নিয়ে, হারুন এসে দাঁড়ায় রানুদের উঠোনে। একজন লাথি মেরে উল্টিয়ে দেয় ভাতের হাড়ি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে শুধু ভাত আর ভাত। খোঁটা থেকে দুধেল গাই দুটোকে ছাড়িয়ে নিয়ে, হারুন ওর ভাইকে গরুগুলো বাড়ী নিয়ে যেতে বলে। একজন রানুর শ্বশুর-শাশুড়িকে লাথি মারতে মারতে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। তারপর তোষক দিয়ে পেঁচিয়ে উঠোনের জ্বলন্ত উনুন থেকে আগুন নিয়ে, আগুন ধরিয়ে দেয় ওদের গায়ে। হারুন এগিয়ে আসে রানুর দিকে, এরপর রানুর মুখটা তুলে ধরে বলে,-"দ্যাখেন হজুর,ক্যামন মাল যোগাড় করছি আপনাগো লাইগ্যা।"
রায়হানের সাথে পাড়ার রাজ্জাক, নিতাই, বিশু, জব্বার, হারান সহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে আসে নদীর পাড়ে। তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে অল্প করে গলা কেটে ছেড়ে দেয় ওদের। ঘোড়ার ঘাট থেকে শ্বশান ঘাট পর্যন্ত প্রতিদিন শত শত মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করে ওরা। কখনো সারি বেঁধে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। ছুড়ি দিয়ে একে একে সবার নখ আর চোখ তুলে নেয়। জল খেতে চাইলে সামনে প্রসব এনে জোড় করে খাইয়ে দেয়। মুখের উপর ইট ছুঁড়ে মারে। নদীর জলে শুধুই রক্ত ভাসে। তারপর সেই জল বইতে বইতে সাগরে গিয়ে মেশে। বাতাসে রক্তের গন্ধ। গড়াই এর চরে শুধুই লাশ আর লাশ। সন্ধ্যা নামলে শেয়াল কুকুরে সেই লাশ নিয়ে টানাটানি করে।
চার,
একই ভাবে আরো কয়েকটা মাস কেটে যায়। আসে ১৬ ডিসেম্বর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়াজী আত্নসমর্পন করে জেনারেল অরোরার কাছে। স্বাধীন হয় মাতৃভূমি। চারিদিকে পতাকা উড়ে। সুবজের মাঝে লাল বৃত্ত। সেই বৃত্তে হলুদ রং এর বাংলাদেশের মানচিত্র। স্বাধীনতা মুক্তির আনন্দ বয়ে আনে ঠিকই, কিন্তু ঘরে ঘরে সন্তান হারা মায়ের আর্তনাদ আর স্বামী হারানো স্ত্রীর কান্নায় যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠে। লাঞ্ছনা, অসম্মান আর অপমান নিয়ে দিন কাটতে শুরু করে ধর্ষিতা মেয়েদের। সেদিন মিলপাড়া থেকে রানুর সাথে লক্ষীদি, রত্না, কাকলিদি, সীমাভাবী আর ঝর্ণাকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা। ঘরে দেড় বছরের ছেলে রেখে গিয়েছিল সীমাভাবী। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফিরে এলো সে। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল সীমা ভাবীকে। কুষ্টিয়া কলেজে আই.এ পড়ত লক্ষীদি। বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলে বিয়ে করবে না শোনার পর আত্মহত্যা করল। দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ঝর্ণা, ময়নার মাকে দিয়ে গর্ভপাত ঘটানোর সময় মারা গেল। কে নাকি বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল ঔষধের সাথে, বাড়ী বাড়ী ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালাত কাকলিদি। এখনো বাড়ী ফেরেনি সে। ছেলেকে হারিয়ে ঘরে বসে অপেক্ষা করছে তার বিধবা মা। হয়ত কোন একদিন ঘরে ফিরে আসবে তার মেয়ে, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা রত্না চলে গিয়েছে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। যশোরের সেনানিবাস হাসপাতাল থেকেও অনেকেই চলে যাচ্ছিল পূর্নবাস কেন্দ্রে। ওদের সাথে রানুও চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শফিক তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে বাড়ীতে। শহীদ, বীরাঙ্গনা আর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন হিসাবে কত উৎসাহ আজ রফিকের। অথচ, যুদ্ধের সময় পাক সেনারা মিল পাড়া আক্রমণ করেছে জেনেও সেদিন সে বাড়ীতে আসেনি। কোথায় পালিয়ে ছিল, তারপর রাতের অন্ধকারে চলে গিয়েছিল শ্বশুর বাড়ীতে। সেই রফিক আজ ঢাকা থেকে অনেক অনেক টাকা অনুদান নিয়ে আসে। আগে দোচালা ঘর ছিল, এখন ইটের গাঁথুনি দিয়ে চার চালা ঘর তোলে। বাড়ীতে টিউবওয়েল বসায়। তার কাপড়ের দোকান বড় করে। রাতের অন্ধকারে তার লোক বর্ডারে গিয়ে কাপড় নিয়ে আসে। বাতাসে কাঁচা টাকা উড়ে।
সময় গড়াতে থাকে। শুকনো গাছ আবার হলুদ হয়। গাছে গাছে আমের বোল আসে। সেই গন্ধ ছড়িয়ে থাকে চার পাশে। রাত গভীর হয়। বিছানায় শুয়ে নিঘুম রাত কাটে রানু আর শফিকের। ঘরের চালে ডাহুক ডাকে। বাঁশ ঝাঁড়ে বাতাসের দোলা লাগে। পাতায় পাতায় খসখস শব্দ হয়।এস সব দিনের স্মৃতি রানু সম্পূর্ণ রূপে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। সেদিন আর সব মেয়েদের সাথে রানুও উঠল মিলিটারি জীপে। জীপে উঠার সময় এক পাকসেনা ওদের প্রত্যেকের পেটে সজোরে লাথি মারছিল। সেই থেকে শুরু। জীপ এসে থামল থানায়। আরো কত মেয়ে এখানে, সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই কাটল। তারপর রাত নামলেই মেয়েদের হাত, মুখ, চোখ বেঁধে আবার জীপে তোলা হল। কাউকে নিয়ে যাচ্ছে বাঙ্কারে, কাউকে ব্যারাকে আবার কাউকে সেনা নিবাসে। অনেক রাতে জীব এসে থামল যশোর সেনানিবাসে। এরপর মেয়ে গুলোকে এক একেক রুমে পৌঁছে দেওয়া হল। হেড কোয়ার্টারের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় দুপাশের ঘর থেকে শুধু মেয়েদের চিৎকার শোনা যায়। ঘরে ঢুকিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল রানুর। তারপর লাথি মেরে মাটিতে শুইয়ে শুরু হল পাশবিক অত্যাচার। একজন শেষে আরেক জন আসে। সারারাত চলে। সকাল হয়। বেলা বাড়লে প্রস্রাব করার জন্য ঘরের বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না রানু। একি দেখছে সে! একটু দূরের বারান্দায় সারি সারি বিবস্ত্র মেয়ে শূন্যে ঝুলছে। মোটা লোহার তারে চুলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের। কাউকে গরুর মত লাথি মারা হচ্ছে, কাউকে পশুর মত পেটানো হচ্ছে, কাউকে বেটন দিয়ে উন্মত্তভাবে আঘাত করা হচ্ছে। কেউ হাসতে হাসতে ধারালো ছুড়ি দিয়ে কোন কোন মেয়ের স্তন কেটে দিচ্ছে, আর কেউবা মেয়েদের যৌন পথে ছুড়ি বা লোহার দণ্ড ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে, আবার অনেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে। রক্ত! শুধু রক্ত ঝড়ছে মেয়েদের শরীর দিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠে রানু। কয়েকজন এসে বারান্দার উপর আছড়ে ফেল তাকে। তারপর আবারও সেখানেই শুরু হল পাশবিক অত্যাচার। রানুর বুকে, পিঠে, গলায়, গালে কামড়ের দাগ গুলোতে হাত বুলিয়ে দেয় শফিক। বলে, "আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি ঠিকই, কিন্তু তোমরা আমাদের চাইতেও বড় মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সন্তান একদিন তোমাকে সেই মর্যাদা দেবে, দেখে নিও।" রানুর চোখে জল আসে। শফিককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।
পাঁচ,
সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করে সবকিছু। কিন্তু কেন যেন রানুর বুকের ভিতরটা শুধুই হাহাকার করে। সংসারের বাঁধনটা কেমন যেন আলগা আলগা লাগে তার কাছে। মনে হয় স্বাধীন কিংবা মুক্তি এলেই তার বুকটা ভরে যাবে। মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে থাকে শফিক আর রানু। কত জায়গায় মানত করে। কিন্তু কোন আনন্দের খবর আসে না ওদের ঘরে। রানুকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় শফিক। অল্প কিছু পরীক্ষা করেই ডাক্তার জানিয়ে দেয়-সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে, শুধু রানু নয়, রানুর মত আরো অনেকেই আর কোন দিনই মা হতে পারবে না। মূহুর্তের মধ্যেই রানুর আকাশ টা ক্যকাসে হয়ে যায়। ঘরে ফিরে শফিক বলে, "আমার জন্য তুমি আর তোমার জন্য আমি আছি। দুজন দুজনকে নিয়ে বাকীটা জীবন আমরা কাটাতে পারব না রানু?"
পদ্মার জল গড়াই এ এসে পড়ে। বড় বড় ঢেউ গুলো পাড়ে এসে আঘাত করে। পাড় ভাঙে। দু'কূল উপচে জল আসে। এক সময় জল নামে। রেখে যায় পলি মাটি। ফসলের পর ফসল জন্মে। একটা কথা আসে রানুর কানে।
"বংশ যখন রক্ষা হইব না তখন, শেয়াল কুকুরের খাওয়া একটা মেয়ে ছেলেরে নিয়া সংসার কইরা কি লাভ? তালাক দিয়া আরেকটা বিয়া করলেই ত হয়।?
ভাসুরের কথার পিঠে কথার কোন উত্তর দেয় না রানু। বেঁচে থাকার সব আনন্দই একে একে হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ছাত্র পড়ায় শফিক। পড়া শেষে শেখ মুজিবের কথা বলে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কথা তুলে ধরে ওদের সামনে। তার ছাত্র রাসেল, মানিক, শুভ, অপু'র মাঝে খুঁজে পেতে চায় তার-স্বাধীন আর মুক্তিকে। যে চেতনা নিয়ে শফিক যুদ্ধে গিয়েছিল। সেই চেতনা সে খুঁজে পেতে চায়-ওদের চোখে। ওরা একদিন বড় হয়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে; বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা জানাবে।
ছয়,
১৫ই আগস্ট। ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িতে রাতে হত্যা করা হয় জাতির জনককে। এর কিছু দিন পর ৩রা নভেম্বর জেলখায় হত্যা করা হয় আরো চার নেতাকে। খুব তাড়াতাড়িই বদলে যেতে শুরু করে সব কিছু। ক্ষমতায় আসে নতুন সরকার। ক্রিকেট খেলার সময় পাকিস্তান প্রেমীরা ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকা উড়ায় উল্লাস করতে বাজি পোড়ায়, মিষ্টি খায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানের দোসররা সংসদ সদস্য হয়। আলিশান বাড়ী-গাড়ী করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের বীর বিক্রম, বীর উত্তম, বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয় অথচ, বীরাঙ্গনাদের কথা কেউ বুঝতেও চায়না। কেউই তাদের অনুভূতি দিয়ে বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের পরিমাণ অনুভব করতে পারে না। সবাই ভুলে যেতে চায় ওদের কথা যেন ৭১'এ পাকিস্তানী সেনাদের এদেশের একটি নারী ও ধর্ষিত হয়নি।
কয়েকব মাস পরে ঘটনা। সকাল থেকেই আকাশে মেঘ। তবে বৃষ্টি নেই। গুমোট ধরে আছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আরো মেঘ জমতে থাকে আকাশে। সূর্য ডোবার আগেই সন্ধ্যা নামে। রানুকে নিয়ে হরিপুর থেকে ফিরছিল শফিক রায়হানের মৃত্যু আর রানুর ঘটনা শুনে স্ট্রোকে প্যরালাইসিস হয়ে আজ পাঁচ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন রানুর বাবা। ঘোড়ার ঘাট পার হওয়ার আগেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামে। ৭১'এর সেই হারুন আজে শফিকের স্কুলের সেক্রেটারি। মোটা অঙ্কের টাকা সে দান করেছে স্কুলের ফান্ডে। এক সপ্তাহ আগে সে শফিককে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তার কক্ষে।
"শোন মাষ্টার, ক্লাসের পড়া বাদ দিয়া তুমি নাকি ছাত্রগো যুদ্ধের গল্প শোনাও। পাকিস্তানী সেনা ও আমাগোর নামে গিবত গাও। এক সপ্তাহের মধ্যে হয় তুমি স্কুলের চাকরি ছাড়। না হইলে সকালের অ্যাসেমবি্লতে সকল ছাত্রের নামনে তুমি হাত জোড় কইরা কইবা তুমি যা বলছ, তার সবই মিথ্যা।"
হারুনকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে শফিক। এ যেন আরেক যুদ্ধ বলে মনে হয় তার কাছে। নিজের বিবেক, নিজের স্বত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এত বড় অন্যায়, সে কখনো, কোনদিন করতে পারবে না। ঘাট পার হয়ে আসে ওরা। অন্ধকার আর বৃষ্টি এক সাথে। জন শূন্য রাস্তা। বাতাসে বৃষ্টির জল মুখে এসে পড়ে। বড় রাস্তায় উঠে এসে রিক্সার জন্য সামনে এগিয়ে যায় ওরা। হঠাৎ সামনে থেকে মোটর সাইকেল এসে থামে ওদের সামনে। তিন জন লোক নামে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই দুজন শফিককে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় পিস্তল ঠেকায়। অন্যজন পিছন থেকে রানুর মুখ চেপে ধরে। পর পর দুটো গুলির শব্দ কানে আসে রানুর। তারপর............................ তারপর, সব কিছুই শুধু কালো অন্ধকার।
সাত,
গোয়ালন্দ ঘাট। সব ট্রেন এসে থামে। তারপর, আবার ফিরে যায়। নিস্তব্ধ ষ্টেশনটা যেন হাহাকার করে। গোয়ালন্দ ঘাটের পাশেই নিষিদ্ধ পল্লী। আর সেই নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা আজ রানু। টিনের চালের সারি সারি ঘর। বেড়া দিয়ে ঘর গুলো আরো ছোট ছোট করা। সরু সরু গলি পথ দিয়ে সেই ঘরে ঢোকার রাস্তা। যেখানে, সেখানে নানা বয়সী মেয়েরা বসে বসে কেউ আড্ডা দেয়, কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ আগের রাতের কথা বলে, আবার কেউ মদ খেয়ে মাতলামি করে। এই ছয় মাসে রানুর বেশ নাম ডাক হয়েছে। রাতের মানুষ গুলো এখানে এসে অনেকেই রানুর খোঁজ করে। কোন কোন দিন বিকেল হলে নিজের খুপরি ঘর ছেড়ে বাইরে আসে রানু। বাঁশের সাঁকো পাড় হয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে বসে সে। সামনে পদ্মা, প্রমত্ত পদ্মা। নদীর ওপারের সীমানা চোখে পড়ে না। যতদূর চোখ যায়-শুধুই জল, আর জল। বাতাসে শাড়ীর আঁচল উড়ে। চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়ে। ছোট ছোট ঢেউগুলো মাটি ছুঁয়ে আবার ফিরে যায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায় রানু। কিন্তু পারে না। অসহ্য এক কষ্ট। চোখ উপচে জল আসে। স্বাধীন আর মুক্তি ত কবেই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে। শফিক-যে দুই হাত দিয়ে তার বুকের মধ্যে রানুকে আগলে রেখেছিল, সেও আজ নেই। মরতে ত সেও গিয়েছিল, কিন্তু পারল না কেন? কিসের টানে এই মায়া কার জন্য? উত্তর খোঁজ রানু, কিন্তু কোন উত্তরই পায় না সে।
সেদিন কিছুটা অবচেতন আর কিছুটা চেতনার মধ্যে রানুর মনে হয়েছিল, কেউ যেন প্রচণ্ড শক্তি বলে তাকে পিষে ফেলতে চাইছে। তার মুখে, স্তনে কেউ যেন কামড় দিচ্ছে। তবে কি যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি? ঐ পাকিস্তানী শিবিরে কি সে এখনও বন্দী! এরপর আর কত জন আসবে? এক,............ দশ,............ আট............ সাত, দুই................... ঘোরের মধ্যেই রানুর কানে একটা কথা এলো, "শালা! মাগীর অহনও জ্ঞান ফেরে নায়।" আবার ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল সে। গভীর সেই ঘুম। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেল বুঝতে পারে না রানু। হয়ত ২/৩ ঘণ্টা হয়ত তার বেশী অথবা কম। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন তার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকাল সে, অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। খুব জোড়ে শব্দ হচ্ছে। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। ব্লাউজটা ছেঁড়া, অবিন্যস্ত শাড়ী, বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় সে বুঝতে পারল একটা পড়ো বাড়িতে সে শুয়ে আছে। এটা ত সেই সেনানিবাস নয়। যুদ্ধ ত কবেই শেষ হয়েছে। যুদ্ধ শেষে শফিক ও ত ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। এক একে তার মনে পড়তে লাগল সবকিছু। মুহূর্তের মধ্যেই বুকটা যেন শূন্য হয়ে গেল রানুর। অবশ হয়ে এলো তার শরীর........... তারপর, শরীরের সমস্ত শক্তি দেিয় সে উচ্চারণ করল .............. শ............ফি..............ক। বাইরে তখনও বৃষ্টি আর উত্তাল বাতাসের মাতামাতি। বৃষ্টি মধ্যে রানুর সেই কণ্ঠস্বর, বাতাসে ভাসতে ভাসতে দূরে হারিয়ে না, গিয়ে ঘরে মধ্যেই বার বার পাক খেতে লাগল চির দিনের মত শফিক তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল; তার কোলও খালি, বাকীটা জীবন সে এখন কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবে? এত বড় সর্বনাশ তার কে করল? এমন কেন হল! কিছুক্ষণ আসে মেঘ চমকানোর আলোয় একটা ব্যাঙ দেখেছিল ঘরের কোনে। সেই ব্যাঙটাই বোধ হয় পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। তবুও স্থাণুর মত বসে রইল রানু। শফিক, তার প্রেম, তার ভালবাসা, বিয়ের পর ৩/৪ মাসই শফিককে, সে যা কাছে পেয়েছিল তাই। তারপর যুদ্ধ শেষে দুজনেই বাড়ী ফিরে এলো ঠিকই, কিন্তু পেল ভাঙ্গা সংসার। আর সেই ভাঙ্গা সংসার টাও আজ সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে গেল। অনেক দূর থেকে ফজরের আযানের সুর ভেসে এলো। হয়ত ৪টা বাজে। রাত শেষ হতে চলেছে তাহলে। উঠে দাঁড়াবার সময় নিজের শরীরে কষ্ট পেল রানু। এই প্রথম তার অনুভূতিতে এলো যে-গত রাতে সে আবার ধর্ষিত হয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে শফিকের লাশটা কি ওখানেই পড়ে আছে, কেউ বাড়ীতে পেঁৗছে দিয়েছে, না শেয়াল কুকুরে খাচ্ছে? শফিকের মৃত্যুর খরব এতক্ষণে নিশ্চয় বাড়ীর মানুষ জেনে গিয়েছে। আর না জানলে তাকে বাড়ী গিয়ে জানাতে হবে। পড়ো বাড়ীর বড় ঘর থেকে থেকে বাইরে বের হয়ে এলো রানু। জায়গাটাকে চেনার চেষ্টা করল সে। তারপর গলি ধরে হাঁটা শুরু করল। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাতাসে বাতাসে মেঘ ভেসে চলেছে। মেঘ এসে চাঁদ ঢেকে দিচ্ছে, আবার মেঘ সরে যেতেই চাঁদ দেখা যাচ্ছে। গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় এলো রানু। তার পরিচিত রাস্তা। এই রাস্তা ধরে মাইল খানেক হাঁটলেই সে বাড়ী পেঁৗছে যাবে। মাঝে মাঝে বাতাসের দোলা লেগে পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল ঝড়ে পড়ছে। ডান পায়ে জুতা ছিল, সেই জুতা খুলে ফেলে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল রানু। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, যুদ্ধের সময় এদেশের লাখ লাখ মেয়ের উপর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদের একটা পরিচয় ছিল-তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। কিন্তু আজ যারা তাদের নির্যাতন করছে, তাদের পরিচয় কি? তারাও এদেশেরই সন্তান। যুদ্ধ শেষে; যখন সে ঘরে ফিরে এসে ছিল, তখন মাঝে মাঝেই পুরুষ, ঝি সবাই উঠোনে এসে আসা একজন অত্যাচারিত নারীকে দেখতে আসত। আর আজ সকাল হলেই সবাই আবার আঙ্গুল তুলে একজন ধর্ষিতাকে সমাজের বাকী সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে। সতীত্ব কি শুধুই গায়ের চামড়ায় থাকে? পুরুষেরা তাদের পাশবিক শক্তি দিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন নারীকে ভোগ করলেই সেই সতীত্ব হারিয়ে যায়। এতই সস্তা! মিলের পিছন দিয়ে বায়ের দুটো গলি পার হয়ে ডানের গলিতে উঠতেই, দূর থেকে বাড়ী দেখতে পেল রানু। মরা বাড়ি! অথচ শোকের মাতম নেই, বুক চাপড়ানো হাহাকার নেই। উঠোনে শফিকের লাশও নেই। রাতের অন্ধকার কেবল মাত্র কাটতে শুরু করেছে। সেই আবছা আলোতে টুপি মাথায় দেওয়া দুজন কে বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে দেখল রানু। ভোরের আলোয় কিচির মিচির শব্দ করতে করতে এক ঝাঁক পাখি আকাশে উড়ে গেল। বাড়ীর সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকলে এরকম বহু জনের সম্মুখে পড়তে হবে, তাই পিছনের আম আর বাঁশ বাগানের ভিতর দিয়ে ঘরের পাশে দাঁড়াল সে। বৃষ্টিতে জল কাদায় মাখামাখি। ঘরের কাছে আসতেই জায়ের গলা শোনা গেল- "রানু ত অহন ও ফিইরা আইল না। বেলা বাড়লে থানায় গিয়া একবার খোঁজ নাও।"
"আল্লাহর কাছে শোকর জানাও। ছোট যেন আর ফিইরা না আসে। শফিক মাইরা গেছে। ছোট সারারাত বাড়ী ফেরে নায়, ঐ নষ্ট বিধবা মেয়ে ছেলেকে আশ্রয় দিলে সমাজে আমরা মুখ দেখাইতে পারবা? না মাইয়্যাদের কোন দিন বিয়া হইব? আমার সাফ কথা ছোট যদি কোন দিন ফিইরা আসে, এবাড়ী তে ওর জায়গা নাই। সে যেন তার বাপের কাছে চইলা যায়।"
কথাটা শোনার পরও বাঁশ ঝাড়ে দাঁড়িয়ে রইল রানু। মিল থেকে সকালের প্রথম সাইরেন ভেসে এলো। অর্থাৎ সাড়ে পাঁচটা বাজে। একটি কাক উড়ে গেল। রানুর গায়ের উপর পায়খানা এস পড়ল। তবুও নির্বাক সে। নতুন কয়েকজন ঘরে এলো। গলার স্বর শুনে মানুষ চেনার চেষ্টা করল রানু। কয়েক জন পথচারী মিলে শফিককে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই সে মারা যায়। হাসপাতাল থেকে শফিকের লাশ এখনো ছাড়েনি।
ডাক্তার এসে পোস্টমর্টেম করার পর লাশ বাড়ীতে আসবে। বাড়ীতেই কবর দেওয়া হবে শফিককে। মিল থেকে ছটার সাইরেন ভেসে এলো। বেল বাড়ার সাথে সাথে এই পিছন দিক দিয়েও লোক ভেঙ্গে পড়বে মরা বাড়ীতে। আবার হাঁটতে শুরু করল রানু। কোথায় যাবে সে এখন? কে আশ্রয় দেবে তাকে? ছেঁওরিয়ার দিকে হাঁটতে লাগল সে। রাস্তার দুপাশ জলে ডোবা। বৃষ্টির জলে গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ধুয়ে গিয়েছে। কি সবুজ দেখাচ্ছে সেগুলো। গাছের পাতায়, সাদা মেঘে মেঘে দিনের প্রথম সূর্যের আলো। গাঢ়ো নীল আকাশ। কি সুন্দর! কি পবিত্র সব কিছু! যেন গত রাতের বৃষ্টি পৃথিবীর সব পাপ ধুয়ে নিয়ে গেছে।
আরো কিছুদূর হাঁটার পর, অসমাপ্ত একটা বাড়ী দেখতে পেল রানু। ছাদ ঢালাই এর পর ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঘর গুলো আলাদা করা হয়েছে মাত্র। রানুর কি মনে হল, সেই বাড়ীতে ঢুকল সে। সামনে ধানের ক্ষেত। ক্ষেতের ওপার দিয়ে রেল লাইন। একটা লম্বা মালগাড়ি চলে গেল। অনেক ক্ষণ ধরে মাল গাড়িটার যাওয়া দেখল সে। তাপর, কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে মেঝেতে শুয়ে থাকল রানু। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরে গুঞ্জন শোনা গেল- শফিক মাষ্টার খুন হইছে, আর অর বৌ এর যার লগে পীরিত ছিল, তার লগে পালায়ছে। সারাদিন পাখির কিচির মিচির ডাক আর ট্রেনের হুইসেলের শব্দ কানে এলো রানুর। তারপর, মাগরিবের আযান শেষে, যথন রাতের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে আকাশে তারা উঠতে শুরু করল, তখন ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে লাগল সে। ভিজা মাটিতে বার বার পা পিছলে যেতে লাগল তার। ভিজা মাটি আর লাঙল দেওয়া ক্ষেতের গন্ধ; রানুর মনে হল- যেন কত বছর পর সে এই মাটির গন্ধ পাচ্ছে। রেল লাইনের ধারে এসে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না রানুকে। দূর থেকে আসা ট্রেনের হেড লাইটের আলোর সাথে সাথে শব্দও খুব তাড়াতাড়ি কাছে আসতে লাগল। রেল লাইনের পাশ দিয়ে সমান্তরাল ভাবে চলে যাওয়া তারটাকে পার হয়ে লাইনের আরো কাছে এসে দাঁড়াল সে। মরবে সে। মরতে তাকে হবেই। প্রতি ক্ষণে রানুর মনে হতে লাগল-এই মূহুর্তে সে রেল লাইনের উপর গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু পারল না। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তার পা দুটোকে আটকে রইল। তারপর, বাতাস উড়িয়ে, প্রচণ্ড শব্দ করে রানুকে পাশ কাটিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। হত বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানু। কেন এমন করল সে! কোথায় কার কাছে ফিরে যাবে সে এখন? রেল লাইনের উপর দিয়ে একটা শেয়াল আরেকটা শেয়াল কে তাড়া করে দৌড়ে গেল। ঝি ঝি পোকার ডাক কানে বাজতে লাগল। ট্রেনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিল রানু। হঠাৎ ট্রেনটা থেমে গেল। হয়ত সিগনাল পায়নি। কয়েকজন লোক উঠা নামা শুরু করল। রেল লাইনের ভিতরে ছড়ানো পাথরে হাঁটতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছিল রানুর। তবুও খালি পায়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। এরপর সিঁড়ি দিয়ে ট্রেনের এক কামড়ায় উঠে দরজার কাছে বসে পড়ল।
হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়ল।সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তার নিজের সাজানো ছোট্ট ঘর, সংসার, শফিক বাবা সবাইকে ছেড়ে এ কোন অজানা গন্তব্যে চলল সে, নদীর ব্রিজের উপর ট্রেন উঠল। গড়াই নদীটা দেখার চেষ্টা করল রানু। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না সে। হু হু করে বাতাস আসতে লাল। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে দূর লোকালয়ের মিট করা আলো চোখে পড়ে। হাঁটুতে মাথা রেখে বসে থাকলে রানু। একে একে চড়াই খোল, কুমারখালি, খোকসা, মাছপাড়া, পাংশা পাড় হয়ে ট্রেন চলতে লাগল। রাত ও বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। গত কাল রাত থেকে নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা কোন কিছুর চাহিদাই রানুর অনুভূতিতে আসেনি। অবশ্য এ অভিজ্ঞতা তার নতুন নয়। যশোরের সেনানিবাসে যখন সে ছিল, তখনও একটানা তিন দিন না খেয়ে ছিল সে। তখন মনে হত না খেতে পায়েই সে মরে যাবে। কিন্তু মরেনি, আজও মরতে পাল না সে। মৃত্যু কি এতই কঠিন। রাজবাড়ী ষ্টেশনে এসে ট্রেন অনেক ফাকা হয়ে গেল। অনেক ক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকল এখানে। দরজার কাছ থেকে উঠে গিয়ে রানু সিটে এস বসল। এক ছেলে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে যাচ্ছিল, তার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গ্লাস পানি খেল সে। ট্রেন চলতে শুরু করলে জানালার কাছে বসা লোকটি এগিয়ে রানুর মুখোমুখি এসে বসল। নাম বলল সুরত আলী। বয়স ৩০/৩২। স্বাস্থ্যবান। ইচ্ছে করে কথা বলতে শুরু করল রানুর সাথে রানু কোথায় যাবে? কোথায় বাড়ী? আকাশে আবার মেঘ চমকানো দেখে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল রানুর। আবারও বৃষ্টি। আর দুটো ষ্টেশন পড়েই দৌলতদিয়া ঘাট। ট্রেনের যাত্রা শেষ। ট্রেন থামবে। তারপর আজ ভোর রাতে যাত্রী নিয়ে আবার চলতে শুরু করবে তার গন্তব্যে। কিন্তু তার গন্তব্য কোথায়? ষ্টেশনে বসেই বাকী রাতটা কাটাবে সে। রাত শেষে পদ্মায় গিয়ে যুবে মরতে চাইলে সে পারবে কি? সে ত সাঁতার জানে। পাঁচুরিয়া ষ্টেশনে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি নামল। রানুর কাছ তেকে কোন উত্তর না পেয়ে সুরত আলী এবার বলল-
"বইন, তর কষ্ট দেইখা আমার চোখে পানি আসতাছে। তা না হইলে এত রাতে কোন মাইয়া একা একা পথে বাহির হয়।" এবারও কিছুই বলল না রানু, তবে একটা সহানুভূতির কথা শোনায় চোখ দুটো জলে ভরে উঠল তার। বৃষ্টি ছাঁট আসছিল, সুরত আলী উঠে পাশাপাশি জানালা দুটো বন্ধ করে দিল। তারপর রানুর মাথায় হাত রেখে বলল-
"কাঁদিস না বইন। আল্লা যে কার কপালে কি লিখছে!" শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে রানু এবার হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। গোয়ালন্দ বাজার ষ্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছল, তখন বৃষ্টি নেই। সুরত আলীর সাথে রানুও নামল ট্রেন থেকে। বাড়ীতে তার বৌ অসুস্থ। ঘরে দেড় বছরের ছেলে। ছেলেকে দেখার কেউ নেই। ছেলেকে রাখার জন্যই রানুকে নিয়ে যাচ্ছে তার বাড়ীতে। মানুষ নয়, সুরত আলীকে ফেরেশতা বলে মনে হচ্ছিল-রানুর।
ছোট্ট ষ্টেশন। হাতে হ্যাজাক বাতি নিয়ে ষ্টেশন মাষ্টার ঘোরাঘুরি করছেন। ষ্টেশন থেকে বের হতেই হ্যাজাকের আলো মিলিয়ে গেল। মাথার উপরে চাঁদ। অনেক রাত বলে মনে হল রানুর। দুটো রিক্সা দাঁড়িয়ে ছিল। কোন কিছু না বলেই সুরত আলী তার একটাতে উঠে বসে রানুর জন্য জায়গা করে দিল। হারিকেনের আলোয় রিক্সা চলতে লাগল অন্ধকার। চারিদিকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ। সম্মুখের কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল রানু। হঠাৎ সুরত আলীর হাত এসে পড়ল তার বুকের উপর। সিগারেটের গন্ধ ভর্তি মুখটাও এগিয়ে এলো রানুর মুখের কাছে। কিছুক্ষণ পর রানু বুঝতে পারল তার ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। তারপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই সুরত আলী আগে রানুর ঘরে। শুধু রানু নয়, কাজল, ফাতেমা, রেখা, ছবি ওদের সবাইকেই এই পতিতা লয়ে এনে তুলেছে সুরত আলী। মেয়ে বিক্রি করাই তার কাজ।
আট,
১৯৮৪ সাল। কয়েকদিন হল বাতাসে বাতাসে একটা কথা ভাসতে থাকে। পতিতালয় উচ্ছেদ হবে। পতিতালয়ের ঐ অপবিত্র, পাপী মেয়ে গুলো সমাজকে কলুষিত করে। তাই এই সমাজকে পবিত্র করতে হাতে লাঠি নিয়ে অনেকেই জমায়েত হয় এখানে। এরপর, একসময় লাঠি উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর। ঘরের বিছানা লেপ, বাসন সব ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাইরে। ঘরের চাল আর বেড়ার উপর বৃষ্টির মত লাঠি এসে পড়ে। এরপর ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে যায় ওরা। ৭১'এর কথা মনে পড়ে রানুর। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানী সেনারা এই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের দোসররা ত এদেশে রয়েছে আর চিরকাল থাকবে। তাদের হাত থেকে এদেশকে বাঁচাবে কারা? সেই দিন শেষে খোলা আকাশের নীচে বসে রাইল তারা সবাই। মাঘের কনকনে শীতে দুধের শিশুগুলো সারারাত কাঁদতে থাকল। কি দীর্ঘ সে রাত। মায়ের বুকের উষ্ণতা সে রাতে সন্তানকে উত্তপ্ত করতে পারেনি। তাই ত পরদিন সকালে নীলিমার দুমাসের ছেলেটা তার বুকের মধ্যে মারা যায়।
গোয়ালন্দ থেকে কিছুটা দূরে দৌলতদিয়া ঘাটে গিয়ে রানুরা আবার বসতি গড়ে। রাতের অন্ধকারে যারা রানুদের কাছে আসে, দিনের আলোতে তারাই উচ্ছেদের কথা বলে; রানু, সুফিয়া, শাবানাদের গালি দেয় বেশ্যা মাগী বলে। রাতের অতিথিরা সমাজের মানী, গুণী মানুষ আর রত্নরা অচ্ছুত, অস্পৃশ্য। জীবনের অন্ধকারচ্ছন্নতা এখানে রাতের অন্ধকারাচ্ছন্নটার চাইতেও কালো। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলেই মেয়েরা সাজতে শুরু করে। কপালে টিচপ পড়ে, গালে রং মাখে ঠোঁটে লিপিষ্টিক দেয়। তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। খদ্দের দের কেউ কেউ মদ নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের দরজা গুলো বন্ধ হয়ে যায়।, অবুঝ সন্তান গুলো দরজার বাইরে বসে কাঁদতে থাকে। এর নামই কি জীবন! বাবার কোন পরিচয় থাকে না। তবুও সন্তানের সকল দায়িত্ব নিয়ে এখানে মেয়েরা সন্তান গর্ভে ধারণ করে। সন্তানের জন্ম দেয়। মাতৃত্বের কি আকাঙ্ক্ষা। শফিকের কথা মনে পড়ে রানুর। বীড়ান্বনা বলে, কোনদিন সামান্যত সম্মান টুকুও পায়নি সে। তার আজ! আজ তার স্বাধীন এর বয়সী ছেলেরা আসে তার কাছে। রানু বুঝতে পারে না ঐ ১৬/১৭বছরের ছেলে এসে কি তাদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করে, না বিকৃত লালসা মেটায় কোনটা? সময়ের সাথে সাথে পতিতালয়েও মেয়েদের ভিড় বাড়তে থাকে। কারো স্বামী এসে বিক্রি করে যায়, কেউ ধর্ষিত হয়ে আসে। আবার কেই কেউ বৃদ্ধ বাবা মা কিংবা সন্তানের মুখে দুটো ভাত দিতে স্বেচ্ছায় এই পথে আসে।
নয়,
আজকাল রানুর শরীরটা ভাল লাগে না। দিনের বেলা ঘুমের সময়ে ও তার চোখে ঘুম আসে না। প্রায় সময়ই মাথায় ব্যথা হয়। ভারী হয়ে থাকে মাথাটা। হাতুড়ী পেটানোর মত দপদপ করতে থাকে। কেমন ঘোলা ঘোলা লাগে চার পাশটা। একাই নদীর পাড়ে এসে বসে সে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। শুক্ল পক্ষের আধা খাওয়া চাঁদ উঠে আকাশে। জলে চাঁদের ছায়া ভাসতে থাকে। অনেক দূরে পদ্মার বুকে জেলে নৌকার কুপির আলো মিট মিট করে জ্বলতে থাকে। অনেক রাতে ফেরে রানু। কিন্তু ফিরে এসেও কাউকে ঘরে ঢুকতে দেয় না সে। কিছু দিন কেটে যায় এভাবে। একদিন রাতে সুরত আলী আসে ঘরে। অন্য সবার মত সেও দেরী করে না। ঘরে ঢুকেই দরজা আটকিয়ে দেয় সে। অথচ, কোন পরিবর্তন ই ঘটেনা রানু। খাটে হেলান দিয়ে সে বসে ছিল, তেমনি ই বসে রইল সে। কিছুক্ষণ পর সুরত আলী আরো এগিয়ে এলো, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষিপ্ত কুকুরের মত তাকে কামড়াতে লাগল রানু। এরপর, রানুর ঘরে আসতে আর কেউ সাহস করেনি। ১০/১৫ দিন এভাবেই কাটার পর দীপালী নামের একজন তার ঘরের দখল নিলো।
দৌলতদিয়া লঞ্চ ঘাটের হোটেলে এসে কাজ নেয় রানু। বাসন ধুয়ে দেয়, মসলা বাটে, বিনিময়ে দুবেলা খেতে পায় সে। রাতে লঞ্চ ঘাটের এক কোনে শুয়ে থাকে রানু। কখনো কোনদিন হয়ত চোখে ঘুম নামে আবার কখনো হয়ত সারারাত নির্ঘুম কাটায় সে। সকাল হয়। সারি সারি লঞ্চ বাধা থাকে ঘাটে। একদিন, সকাল আটটার সময় রাজশাহী থেকে ট্রেন আসার পর ট্রেনের যাত্রীরা লঞ্চে এসে উঠতে লাগল। রানুর কি মনে হল সেও যাত্রীদের সাথে লঞ্চের ডেকে এসে উঠল। ঘণ্টা বাজার পর লঞ্চ ছাড়ল। ঘাট ছেড়ে লঞ্চ সরে এলো। সবুজ হয়ে থাকা ছোট ছোট চারা ধানের ক্ষেত গুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। নীল আকাশে সাদা মেঘ। বাতাসে নদীর জলের গন্ধ। সোনালী রোদ। দূর আকাশে ডানা মেলে ভাসতে থাকা এক ঝাঁক সাদা বক। সাদা ফেনাওয়ালা জলের ঢেউ রানু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল সব কিছু। ভেপুবাজিয়ে ভটভট শব্দ করে লঞ্চ চলতে লাগল তার গন্তব্যে। ওপারে আরিচা ঘাট।
দশ,
সাড়ে চার বছর পরের ঘটনা। ১৯৯৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। কুয়াশা ভেজা সকাল। একবার, দুইবার, তিনবার করে ৩১ বার তোপ ধ্বনি বাতাসে শব্দ তোলে। দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তি। চারিদিকে লাল সবুজের পতাকা। মাইকে মাইকে বেজে চলে "সালাম সালাম হাজার সালাম" অথবা "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি" আবার কখনো কখনো শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, একারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।" .................................................................. ..................... ............................................ আর যদি একটা গুলি চলে......................" খবরের কাগজের পাতায় পাতায় যুদ্ধের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। টিভিতে মুক্তিযুদ্ধের নাটক, স্মৃতিচারণ, আলোচনা। ২৬শে মার্চ কিংবা ১৬ই ডিসেম্বর মানে অন্য রকম ছুটি। দুপুরে খাবার টেবিলে ভালো খাবার। বিকালে স্বাধীনতা বিরোধীর ছেলেকে সাথে নিয়ে স্মৃতি সৌধে গিয়ে ফুল দিয়ে আসা। রাতে আদম ব্যবসায়ী আর ফেনসিডিল পাচারকারীর কবির ও সোহেলের সাথে বসে জম্পেশ আড্ডা, সাথে মদ, ভি.সি.আর-এ শিল্পা শেঠীর উদ্দাম নাচ। আরো পরে কোন কাজল কিংবা পারুলের ঘরে গিয়ে রাত কাটানো। এই ত স্বাধীনতার মূল্য। হায়রে দেশ! ৩০ লক্ষ শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তৈরি হয়েছে স্মৃতিসৌধ। অথচ সেখানে বীরঙ্গানা শব্দটি উচ্চারিত পর্যন্ত হয়নি। এতই ঘৃণিত, অস্পৃশ্য তারা। ৭১'এর লাখ, লাখ ধর্ষিত, অত্যাচারিত নারীরা আজ কোথায়? এদেশের মাটিতে, এদেশের পতাকায়, এদেশের জাতীয় সঙ্গীতে যাদের অবদান, যাদের অগ্রাধিকার, এদেশ তাদের বানিয়েছে বেশ্যা, বহু ভোগ্যা, পতিতা।
শীতের সকালে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট উলঙ্গ, অভুক্ত শিশুরা শীতে, ক্ষুধায় কান্না করে। স্বাধীনতা এদের জীবনে ক্ষুধা মেটাতে পারে না। সন্তানের ক্ষুধার অন্ন যোগাড় করতে ক্লান্ত মায়েরা জানে না কোন এই বিজয় দিবস? জীবনের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ছোট্ট একটি ছেলে রাস্তায় পতাকা বিক্রি করে চলে। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা বাসের কন্ট্রাক্টর গুলো চেঁচাতে থাকে এই ............... নবীনগর ......... নবীনগর। স্মৃতিসৌধ, ............ স্মৃতিসৌধ। হাতে ফুল নিয়ে বহু মানুষ স্মৃতিসৌধে যায় শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। মাথাটা ব্যথায় টন টন করতে থাকে রানুর। দিনের এত আলোর মাঝেও চাপাশটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগে তার কাছে। এই নিয়ে ছেঁড়া কাপড়ে শরীর ঢেকে বাসের যাত্রীদের কাছে গিয়ে ভিক্ষার হাত বাড়ায় সে। বাতাসে বাতাসে ভাসতে থাকে, "তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না। না.................. না ................................ না, শোধ হবে না।
তথ্য সংগ্রহ:
০১। আমি বীরঙ্গনা বলছি। (নীলিমা ইব্রাহীম)
০২। একাত্তরের নারী নির্যাতন এবং নির্যাতিত দের সামাজিক অবস্থান। (শাহরিয়ার কবির)
০৩। মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশ (রশীদ আহমদ)
০৪। বাংলা পিডিয়া