নিশ্বাসের সাথে সাথে সময় চলে যায়!সময়টা বড় নিষ্ঠুর!!কথা বল্লেও শুনে না।কিন্তু এই সময়টা যেন কিছুতেই শসির কাছ হতে যেতে চাচ্ছে না, যত দেরী হচ্ছে, শসির বুকের মধ্যে শূন্যতা ততই প্রকাশ পাচ্ছে।তাঁর শুধু মনে হচ্ছে,এই বুঝি বাবা-মা এসে,তাকেঁ আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।কিন্তু সে কিছুতেই আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই না।বদ্ধ ঘরে,আবদ্ধ হয়ে থাকার চেয়ে,মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ওড়ে বেড়ানোই তাঁর কাছে বেশী গ্রহনীয়।সে যতই কষ্টের হউক না কেন?
হাত ঘড়ির দিকে তাকাল শসি।সাতটা বাজে।সাতটা পঁচিশে ট্রেন ছাড়বে।এখনও পঁচিশ মিনিট বাকী।এই পঁচিশ মিনিট কী করে পার করবে, সেটা ঠিক করতে পারল না সে।বুকের মধ্যে একটা ভয় দানা বেঁধে উঠল,তার সব সময় মনে হতে থাকল,কেউ যেন তাঁকে বার বার দেখছে।দেখছে, তার চেহার নয়,দেখছে তার বুকটা।তাই সে বার বার বুকটা ঢাকার চেষ্টা করছে তবুও যেন ঢাকছে না।অস্থির মন তাঁকে আরও অস্থির করে তুলল।
মানুষের মধ্যে, সে অপরাধ বোধই হউক আর আনন্দ বোধই হউক-নিজ দৃষ্টিটা বারবার সেই দিকেই ধাবিত হয়।এ সব অনাকাংখিত আচরনের জন্যই অপরাধীকে ধরা সহজ হয়ে যায়।শসির মধ্যেও সে একই অনাকাংখিত আচরণ প্রকাশ ঘটতে থকল,যে কারনে বারবার সে নিজ বুকের দিকে তাকাচ্ছে।
কোন কাজ যদি শেষ না হয়, সে কাজ শেষ করার জন্য মস্তিস্ক আমাদের তাড়া দেয়.যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে।সে তাড়না থেকেই শসি আজ ঠিকানাহীন গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছে।কিন্তু ট্রেনেরে বিলম্ব শসিকে ধৈর্য্যহারা করে তুলল।একটু করে পুরানো স্মৃতিতে ফিরে যায়,আবার ফিরে আসে;বিচলিত মন তাকেঁ অস্থির করে তুলে............!
অনিলার সাথে যখন মাহাতব সাহেবের বিয়ে হল,মাহাতাব সাহেব বাসর রাতে অনিলাকে কতগুলো প্রশ্ন করেছিল।এই প্রশ্নগুলো বেশীর ভাগ স্বামীই তাঁর স্ত্রীকে করে থাকে।যেমন, তুমি কী খেতে ভালোবাস,তোমার প্রিয় রঙ কী,তুমি কী শাড়ি পরতে ভালোবাস ইত্যাদি ইত্যাদি।কথোপকথন হয়েছিল এ ভাবে-
- তোমার প্রিয় খাবার কী?
- পোলাও।আমাকে যদি তিন বেলা পোলাও দাও,আমি তিন বেলায় খাব।
- কিন্তু আমি ত পছন্দ করি সাদা ভাত।
- সেটা তোমার পছন্দ।আমার পোলাওই পছন্দ।
- আচ্ছা সেটা না হয় বোঝলাম।কিন্তু রং,কী রং পছন্দ?
- গোলাপী।
- আমার ত নীল রং।সে যায় হোক-এবার বল,তোমার কোন শাড়ী বেশী পছন্দ?
- সিল্ক।
- যা বাবা!এখানেও মিলল না।এবার বল,তুমি ছেলে নিবে না মেয়ে নিবে?
- আমি মেয়ে নিব এবং আমার মত সুন্দরী!যাকে সবাই দেখবে আর বলবে,দেখ,দেখ,অনিলার মেয়ে দেখ।
- আমি কিন্তু ছেলে চাই।মাহাতাব একটু চিৎকার করেই বলল।অনিলা মাহাতাবের চিৎকারে একটু থতমত হয়ে গেল।মাহাতব বিষয়টা বোঝতে পারল,সে নিজেকে সামলিয়ে,একটু হেসে বলল-তোমার সাথে দেখছি,আমার কিছুই মেলে না।সে যায় হোক,এখন বল,তোমার সব চাইতে প্রিয় কী?অনিলা বুদ্ধিমতী মেয়ে।সে একটুও দেরী করল না।চট করে বলে ফেলল,তুমি!
অনিলা ও মাহাতাবের সাথে দ্বৈতমতের সৃষ্টি হলেও,অনিলার প্রিয় মাহাতব তাতেই সে খুশি।সে আর কথা বাড়াল না।
অনিলার গর্ভে যখন সন্তান এল তখন মাহাতাবের বড় বিশ্বাস ছিল তাঁর ছেলে সন্তান হবে।কিন্তু অনিলার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর মেয়ে হবে।এ নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায় কথা-কাটি হত।কথা-কাটি থেকে ঝগড়া। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তুমি থেকে তুই এ চলে যেত।তার পরেও তাদেঁর মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল না,একে-অপরকে ভালোই ভালোবাসত।
সাধারণত,২৭০ দিন হতে ২৮৬ দিনের মধ্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে।কিন্তু অনিলার বেলায় তা হল না।তার কারণ,অনিলার ইউটেরাস সোজাভাবে ছিল না,ছিল আঁড়া-আঁড়ি ভাবে।বিধাই, সিজার করতে হয়েছিল ২৫০ দিনে।২৫০ দিনে অনিলা ছেলে সন্তানের জন্ম দিল।
ছেলের মুখ দেখে মাহাতাবের হৃদয় ভরে উঠল।অনিলা একটু দুঃখ পেল বটে,কিন্তু তাঁর ছেলে অবিকল তাঁর রুপ ধারণ করে এসেছে বিধায়,তাঁরও মন ভরে গেল।আনন্দে সে বলেই ফেলল,মাহাতাব দেখ,দেখ,ছেলে হলেও আমার মত দেখতে।আমি কিন্তু এর নাম দিলাম শসি।
শসি কেন? মাহাতব বলল
শসি শব্দের অর্থ চাঁদের আলো।আমার ছেলেও চাঁদের মত দেখতে,তাই নাম দিলাম শসি।তোমার আপত্তি আছে?
পছন্দ হল।
শসির জন্মের ফলে,অনিলা-মাহাতাবের মধ্যে যা এট্টু-আট্টু গরমিল ছিল তা দূর হয়ে গেল।আগের চেয়ে দু’জনের মধ্যে রোমান্সটা আরও গাঢ় হল।কিন্তু সমস্যা শুরু হল অনেক পরে.....
শসি যখন Puberty period এ পা দিল।শসির মধ্যে আচরণ ও দৈহিক পরিবর্তণ পুরষালী স্বভাব না দেখতে পেয়ে, অনিলার মধ্যে সন্দেহ হল।এমনিতেই তাঁর ছেলের মধ্যে মেয়েলি আচরণ।সবচাইতে বড় ভয় হল তাঁর,শসির বুকের প্রসরতা দেখে।ছেলে মানুষের বুকটা এমন হবে কেন?অনিলা মাহাতাবকে বিষয়টা জানাল।মাহাতব বিষয়টা গুরুত্বই দিল না।উপরন্ত অনিলাকে বকাঝকা করল।কী সব বাজে চিন্তা কর না।মেয়ে মানুষের এ একটা দোষ!সব কিছু আগাম ভাবে।
না গো,আমার কিন্তু ভয় করছে,তুমি একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না।
আমার অত সময় নেই।তা’ছাড়া,সন্দেহটা যখন তোমার.....তুমিই নিয়ে যেও।
আজ বার বছর হল,ছেলের প্রতি কোন কর্তব্যটা,তুমি পালন করেছ,বলতে পার?
ছেলের প্রতি আমার ভালোবাসা নেই;এটা তুমি বলতে পার না।সন্তান লালন-পালন বিষয়টা মেয়েদের।এ কাজের
জন্যই আল্লা মেয়েদের সৃষ্টি করেছে-এটা নতুন কিছু নয়।
ভালো বলেছ!সন্তান লালন-পালন যখন মেয়েদের,তখন আমাকেই নিয়ে যেতে হবে।
মাহাতাব আর কথা বাড়াল না।সে টিভি অন করে,একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাতে লাগল।হঠাৎ করেই তাঁর কী মনে হল-আচ্ছা কাল বিকেলে তুমি রেডি থেক,আমি চলে আসব।এর মধ্যে আমি একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ করে নিই।
পরের দিন বিকাল পাঁচটাই শসিকে ডাক্তার দেখানো হল।...........
মাহাতাবের ঘুম আসে না।সে বারান্দায় পায়চারী করতেই থাকে।অনিলা নিশ্চুপ।তাঁর কানে ডাক্তারের কথাগুলো, ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনি হতে থাকল।কোন ভাবেই সে মানতে পারছে না,তাঁর ছেলে একজন She male।চোখ দিয়ে তাঁর অবিরাম জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।........
শসিকে স্কুলের ছাত্ররা আগে হতেই যন্ত্রণা দিত।কেউ কেউ কখনও কখনও আপা বলে ডাকত,আবার কেউ বুবু বলত।তারপরেও তাঁর বন্ধুর অভাব ছিল না।তাঁর বন্ধুরা এ সব বিষয় নিয়ে আগে Protect করত।তাঁরাও এখন দূরে সরে যেতে লাগল।তাঁর জীবনটা দূর্বিষহ থেকে এমন চরম অবস্থায় পৌঁছাল যে,তাঁর আর স্কুলে থাকা সম্ভব হয়ে উঠল না।
শসির বয়স এখন পনের বছর।বাধ্য হয়ে মাহাতাব,শসিকে স্কুল থেকে টেনে নিয়েছে।তিন বছর হতে শসি নিজ গৃহে বন্দি।নিজ গৃহ বললেও ভুল হবে;নিজ ঘরে।বেশীর ভাগ সময়ই সে নিজের ঘরেই সময় কাটাই।এ’ভাবে জীবন চলাটা তাঁর কাছে যন্ত্রনার হয়ে উঠল।তাপরেও সে মেনে নিয়েছিল।মেনে নিয়েই তিন বছর যাবত একই ঘরে রয়েছে।কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর মা-বাবার প্রায়শই,কোলহ তাঁর পছন্দ হল না।বিধায় সে গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল।
ট্রেন ছেড়ে দিল।গন্তব্যহীণ ঠিকানায় রওনা দিল শসি।তাঁর ঠিকানা জানা নেই।কিন্তু যেতে হবে,এটাই সে জানে।হয়ত বা একদিন, সে একদল She male এর ঠিকানায় পৌঁছে যাবে!নতুন বন্ধু হবে.......যন্ত্রনাময় জীবন হতে মুক্তি পাবে!
(লেখাটা সোয়া ঘন্টায় লেখা।চিন্তার প্রতিফলন সঠিকভাবে ঘটাতে পারিনি)