আমার বন্ধু নবীন

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

Mohir
  • ১৭
  • 0
  • ৩৬
নবীন আর আমি ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। একই এলাকায় থাকার সুবাদে যতটুকু পরিচয় থাকে ততটুকুই পরিচিত আমরা। আলাদা স্কুলে পড়লেও ক্লাস এইটে উঠে আমি ওর স্কুলে ভর্তি হলাম।এর ফলে ওর সাথে পরিচয়ের পরিধি একটু বাড়লো।
আমি স্কুলে নতুন ভর্তি হওয়ায় নবীন আমাকে সব ব্যপারে হেল্প করতে চাইত, এটা আমার ভালোই লাগত। ও অনেক ভালো ছাত্র ছিল আর আমি তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম ভালো ছাত্র হওয়ায় ক্লাসে ওর একটা আলাদা মর্যদা আছে। ছাত্র এবং শিক্ষক সবার কাছেই ওর মূল্য একটু অন্যরকম এমনকি ওর মতামতের মূল্যও দেয় সবাই। আর নবীনের ভালো বন্ধু হওয়ায় ক্লাসের সব ছাত্র আমাকেও কিছুটা তোয়াজ করা শুরু করলো। যেমন - যেদিন নবীন স্কুলে এল না সেদিন ওর খবর নেওয়া, নবীন আর আমি মিলেমিশে নোট করে পড়ছি কিনা ইত্যাদি। কিন্তু ওরা তো জানেনা আমি লেখাপড়ায় একেবারে গোল্লা। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা কাছে চলে এলে আমি ভয় পেতে শুরু করলাম কারন পরীক্ষার পরেই তো সবাই বুঝতে পারবে যে আমি কত ভালো ছাত্র আর তখন তো সবাই এটাও জানবে যে ভালো বন্ধুত্ব থাকলেও এটার ভিত্তি লেখাপড়া না বরং পূর্বপরিচয়।
পরীক্ষা কাছে এসে গেলে নবীন আমাকে বেশ সাহায্য করতে থাকলো। অংক, ইংলিশে আমার বেশ উন্নতি হলো নবীনের সাহায্য পেয়ে যার ফলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় রেজাল্ট খুব ভালো না হলেও তুলনামূলক অনেক ভালো হলো। বেঁচে গেলাম। সবাই জানলো আমি লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো। ক্লাসে সবার সাথেই আস্তে আস্তে ভাব হলো। নবীন কোন মেয়ের সাথে মিশতো না কিন্তু কেউ কেউ ওর সাথে মিশতে চাইত। এসব ব্যপারে নবীনকে কখনো ততটা আগ্রহী দেখিনি। আমি নবীনের ভালো বন্ধু হওয়ায় ওরা আমার সাথেও কিছুটা মিশতে চাইলে আমার বেশ ভালোই লাগত। তাই আমিও একটু খাতির করতাম ওদের সাথে।
এভাবে বেশ ভালোই চলছিল কিন্তু ক্রমশ আমি বুঝতে পারছিলাম নবীনকে আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি সর্বদা ওর সাথে সাথে থাকলেও ওর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছি না। আমার মনে হতে থাকলো আমি নবীনের ছায়ায় বসবাস করছি প্রতিনিয়ত। নবীন লেখাপড়ায় ভালো, খেলাধুলায় ভালো এমনকি সাংস্কৃতি চচর্ায়ও সে পিছিয়ে নেই।
আস্তে আস্তে যেটা হলো তা হচ্ছে নবীনকে আমার শত্রু মনে হতে থাকলো। কেউ ওর কথা জানতে চাইলে আমি বিরক্ত হতাম, যে মেয়েগুলো নবীনের সাথে ভাব জমাতে চাইত তাদের কেমন যেন সহ্য হতো না। যেসব শিক্ষকরা নবীনকে নিয়ে বেশি প্রশংসা করতো বা ওর প্রতি বেশি সন্তুষ্ট ছিল সেইসব শিক্ষকদের ক্লাস করতে ইচ্ছা হতো না। এভাবে আমি নবীনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলাম যার ফলে আমার লেখাপড়ার দূরাবস্থা চরমে পৌছালো। যেসব ভালো বন্ধু জুটেছিলো তাদেরকে হারালাম। নবীনের ভক্ত মেয়েগুলোকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে লাগলাম। মাঝে মাঝে তাদেরকে বাজে কথা বলতেও ছাড়তাম না। মোটকথা বেশ ভালোই অবনতি হলো আমার।
লেখাপড়ার এমন উন্নতির (!) কারনে ঐ স্কুলে আর পড়া হলো না। এভাবেই চলতে থাকলো। এস এস সি পাস করলাম। নবীনের অনেক ভালো রেজাল্ট হলো আর আমি কোনরকমে পাশ করলাম। এর মাঝেও নবীনকে আমার আর কখনো বন্ধু বলে মনে হয়নি কিন্তু নবীন সর্বদা আমার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেয়েছে। আর আমি ঠিক তার উল্টো ব্যবহার করেছি। আসলে নবীন আগাগোড়া ভালো মনের অধিকারী ছিলো।
দুজনে একই কলেজে ভর্তি হলাম তবে আমি আর্টস আর নবীন সায়েন্সের স্টুডেন্ট হওয়ায় দুজনের ভবন আলাদা ছিলো ফলে ওর সাথে আমার মুখোমুখি হওয়া সুযোগ তেমন ছিল না।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নবীনের সাথে একটি মেয়েকে বেশ কথাবার্তা বলতে দেখতাম। মেয়েটা খুব বেশি সুন্দরী না হলেও দেখতে খারাপ ছিলো না। কোন এক অজানা কারনে এ মেয়েটিকেই আমার মনে ধরলো কিন্তু আমার সাথে তার কখনোই কথা হতো না। খবর পেলাম নবীনের সাথে মেয়েটির প্রেম চলছে। আর যায় কোথায় , এবার নবীনকে আমার চরম মত্রু মনে হলো। চিন্তা করলাম নবীনকে কলেজ ক্যম্পাসের বাইরে লোক দিয়ে মার দিতে হবে। লোক দিয়ে নবীনকে মার দিলাম কিন্তু তাতে মেয়েটির মানে রেখার সহানুভূতি আরো বেড়ে গেল নবীনের প্রতি। এরপর ফেসবুকে অন্য নামে একাউন্ট খুলে রেখাকে ফ্রেন্ড তালিকায় যোগ করলাম। নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করলাম। রেখা একটি সিটিসেল নাম্বার ব্যবহার করতো কিন্তু সেটা কিছুতেই সংগ্রহ করতে পারছিলাম না।
নবীনকে যে আমি ঠিক বন্ধু মনে করি না তা নবীন জানতো কিন্তু কিছু মনে করতো না কারন সে আমার বখাটেপনা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফেসবুকের বন্ধু সেজে রেখার মোবাইল নাম্বার নিতে চাইলেও সেটা রেখা দিলো না কারন অনলাইনের ফ্রেন্ডশিপকে অনলাইনেই কন্টিনিউ করতে চায় সে। কি আর করা।
বিভিন্ন সময়ে নবীন আর রেখাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখতাম। কখনো রেস্টুরেন্টে কখনো রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে চটপটি বা ফুসকা খেতে। এগুলো দেখে আমার মোটেও ভালো লাগতো না।
আমার অনেকগুলো ই-মেইল আইডি থাকায় সেগুলো থেকে নবীনের নামে বিভিন্ন খারাপ কথা টাইপ করে সেগুলো রেখাকে পাঠাতাম। তাতে কোনো কাজ হতো কিনা জানিনা তবে ওদের মধ্যে মাঝে মাঝে মনোমালিন্যর খবর পেলে আমার বেশ ভালো লাগতো। বেশ বলতে অনেক অনেক ভালো লাগতো।
সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার কিছুদিন পরে রেখার বিয়ে হয়ে গেল।শুনেছিলাম রেখার বাবা না থাকায় ওরা মানে রেখা, ওর মা এবং ছোট ভাই ওর ছোট চাচার বাসায় থাকতো। আমার মনে হলো রেখার বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত ওর আরো কিছুটা লেখাপড়া হতো। যা ই হোক একটা বিষয় খেয়াল করলাম যে রেখার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমার তেমন মন খারাপ বা দূ:খ হচ্ছে না। তারমানে হয়ত রেখার প্রতি আমার ভালোবাসাও নবীনের সাথে শত্রুতার কারনে প্রতিশোধমূলকভাবে তৈরী হয়েছিল। আসলে ব্যপারটা নিয়ে আমার আর ভাবতে ইচ্ছা করছিল না। সম্ভবত মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম রেখার বিয়ে হয়ে যাওয়ায়। আমার যা হয় হোক নবীনেরতো একটা শিক্ষা হলো।
এভাবে চলতে চলতে একসময় এইচ এস সি পরীক্ষাও চলে এলো। পরীক্ষা হলো। নবীন বরাবরের মতো ভালো রেজাল্ট করে বিবিএ অনুষদে ভর্তি হলো আর আমি একরকম পাশ করে ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম।
ইতিমধ্যে একদিন নবীন আমার কাছে এলো কিছু টাকার জন্য। আমি জানতাম টাকাটা আসলেই ওর খুব প্রয়োজন ছিল কিন্তু সামান্য এই কয়টা টাকা আমি দিলাম না। পরে শুনেছিলাম সাড়ে তিন হাজার টাকা যোগাড় হওয়ার পরেও মাত্র পাঁচশ টাকার জন্য নবীন বেশ ঝামেলায় পড়েছিল।
কোনভাবেই নবীনের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো হওয়ার কোন কারন তৈরী হচ্ছিল না বরং বলা ভালো আমি সে সুযোগ দিচ্ছিলাম না।
আরও বেশ কিছুদিন এভাবে যাবার পরে আমার বড় বোনের হার্নিয়ার অপারেশন হলো। অপারেশন হওয়ার আগেই ডাক্তার বলেছিল রক্ত লাগতে পারে। আমরা যেন এটার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে বাখি। শুধু আমার মা ছাড়া আর কারো সাথেই আমার বোনের রক্তের গ্রুপ মিললো না। কিন্তু মা অসুস্থ থাকায় তাঁর পক্ষে রক্ত দেয়া সমভব না। যা হোক ডাক্তার আমাদের অভয় দিলেন যে যদি রক্ত প্রয়োজন হয় তাহলে একটু টাকা খরচ করলে হসপিটালেই রক্ত দেয়ার লোক পাওয়া যাবে। আমরা এটা নিয়ে তেমন চিন্তা করছিলাম না কারন আমরা মনে করছিলাম হয়ত রক্ত লাগবে না। সাধারনত ডাক্তাররা সব অপারেশনের আগেই রক্তের ব্যবস্থা করে রাখতে বলে।
আমার বোনের অপারেশন হলো রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। আমরা সবাই সেখানে উপস্থিত। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর কিছু সময় পরে নার্স এসে জানালো রক্ত লাগবে। হসপিটালে ঠিক ঐ মুহূর্তে রক্ত দেয়ার লোক পাওয়া গেল না। আমাদের সবার রক্ত হিম হওয়ার মতো অবস্থা হলো। আমার বোনের রক্তের গ্রুপ ছিলো নেগেটিভ তাই রক্তের সন্ধান করে পাওয়াটা একটু কঠিনই ছিল।
আমাদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। আমি আমার সব বন্ধু-বান্ধবের কাছে মোবাইলে রক্তের সন্ধান করছি এবং খোঁজ খবর করতে বলছি কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রক্ত। আমার খালাতো ভাইয়ের সাথে রক্তের গ্রুপ মিললেও সামনে তার পরীক্ষা থাকায় সে রক্ত দিতে চাইলো না।
আমি হসপিটালের বারান্দায় পায়চারি করছিলাম এমন সময় দেখি নবীন আসছে। আমার কাছে এসে জানতে চাইলো রক্ত পাওয়া গেছে কিনা। পাওয়া যায়নি শুনেই ও বললো বোনকে রক্ত দেবে। আমার মনে তখন কোন হিংসা বা বিদ্বেষ কাজ করছিল না।ওকে ভেতরে নিয়ে গেলাম।
নবীন রক্ত দিলো। আমি ওকে আমার পরম বন্ধু নাকি ভাই ভাববো বুঝতে পারছিলাম না। কখনোই যার ভালো চাইনি সে কিনা আমাদের পুরো পরিবারকে এমন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করলো!
জানলাম এবং বুঝলাম বন্ধুত্ব লেখাপড়া, বংশ পরিচয় বা ধনদৌলতের যোগ্যতায় হয় না। এজন্য মানবীয় গুন থাকা লাগে। আর সে গুণের অধিকারী কোনভাবেই আমি নই, নবীন। কিন্তু চেষ্টা করলেতো এ গুনগুলো অর্জন করা যায়। আমি অবিরাম চেষ্টা করে চলেছি এ গুনগুলো অর্জন করার জন্য।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান সুন্দর সমাপ্তি টেনেছেন| বেশ ভালো লাগলো| ধন্যবাদ|
মিজানুর রহমান রানা মোটামুটি নির্ভুল শব্দের বানান। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা অতি উত্তম একটি গল্প। তবে উত্তম পুরুষে লেখলে পাঠকরা মনে করে এটা পুরোপুরি লেখকের নিজেরই গল্প। সেজন্যে সহমর্মিতা ও আগ্রহ বেশি থাকে। আমিও বেশিরভাগ উত্তম পুরুষে লিখি। গল্পটি ভালো লেগেছে আমার কাছে। আপনার অগ্রযাত্রা কামনা করছি।
বিন আরফান. অনেক শিক্ষনীয় গল্পটি. আমার বেশ ভালো লেগেছে. এরূপ গল্প আমি অসাধারণের চেয়ে বেশি চোখে দেখি. আর বেশি কিছু বলার নেই. শুভ কামনা . নিয়মিত হুন. বাংলা সাহিত্যে এক ধরনের ওই পোকা ঢুকেছে যারা সমাজে অশ্লীল কিছু গঠন তুলে ধরে খ্যাতি অর্জন করত সমাজে নানা অপকর্মের উদ্যোক্তা হচ্ছে. অবশ্য সাহিত্য ভালো জানে. তথাপিও আমি তাদের ওই রূপ লেখনীকে ঘৃনা করি. আপনি তাদের ব্যতিক্রম.
কথাকলি ভালো লাগলো আপনার গল্পটি।
sakil নতুন প্রজন্মের কাহীনি বেশ ভাল লাগল । সবার জীবনে নবীনের মত বন্ধুর অনেক প্রয়োজন । শুভকামনা রইল ।
সূর্য সংখ্যাটা যেহেতু "বন্ধু"র আর গল্পের প্রথম থেকেই নবীনের সাথে যে রকম দূরত্ব তৈরি করা হয়েছে তার পরিনতিতে এমনই হবার কথা ছিল। গল্পটা সাদামাটা হলেও ভাল লাগলো সাবলীলতার কারণে।
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) আমার বন্ধু নবীন ,bondhu chara jibon orthohin .
আহমেদ সাবের একটা সাধারন গল্প, সহজ ভাবেই লেখা। উপদেশটুকু মনে রাখার মত।
মোঃ ইকরামুজ্জামান (বাতেন) ভালো লাগলো ।। অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

১৪ জুন - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪