স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে উইপোকারা বাসা বেঁধেছে। সানন্দে দেয়ালের অনেকখানি খেয়েও ফেলেছে। প্লাস্টার খাওয়া গর্তটায় দল বেঁধে বসে আছে একঝাক সবুজ আর কালো ছোটছোট মশা। একটা টিকটিকি ক্ষয়ে যাওয়া জায়গাটায় খুব ধীরে ধীরে হেটে আসে। ঝুরঝুর করে কিছু বালি ঝরে পড়ে ফাটা মেঝেতে । হাতের উপর মাথা রেখে মেঝেতে শুয়ে জগলু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দেয়ালে । সুড়ুৎ করে জিভ বের করে টিকটিকিটা । নিজের ক্ষুধা মেটাতে খুবই সন্তর্পণে শিকার ধরে যায় সে। কিছু মশা উড়ে যেতে যেতে আবার বসে পড়ে দেয়ালে। যেন কোন রক্তমধু লেগে আছে অন্ধ উইপোকায় খাওয়া জায়গাটায়। কিছু মশা এসে কানের লতিতে কামড় দেয়, হাত নেড়ে তাড়া দেয় সে। মনে মনে বিরক্ত হয় জগলু-
-হালার পোলারা! গরীব মানসের টেহা নিয়া নিজেগোর খায়েশ পুরাণ হরে,ভুড়ী আকাশে উডায়। এইসব দেয়াল ঘর ঠিক কইরা কি হরব? সরকারী ঘর বইল্লা কোন যত্ন নাই! গরিব মানষে ট্যাক্স,খাজনা না দেলে হ্যাঁগো ভাঙা টেবিল, চেয়ার দিয়া কি হরব? তাই হেগো ঘর নিলামে উডে। আর ধনী মানষের ট্যাক্স, খাজনা না দিলে নোটিশও পায়না, ফাইল গায়েব হইয়া যায় ! হে হে কি চমেৎকার কাম ...আজ গরীব বইলাই..... দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাসকে গরম পরশ দেয়। জগলু অনুভব করে পিঠের নীচে ঘেমে পানি জমেছে। সে মুজিব চাচার কিছুই করেনি। ফেরেশতার মত মানুষ এই মুজিব চাচারে সে কেন কিছু করবে? সে যে দোষী না এটা বোরহান সাহেব এবং বেগম সাহেব দুজনেই জানে। তবুও আজ জগলু...এইখানে
প্রতিদিনের মতই সেদিনও বোরহান সাহেব বেগম সাহেবের সাথে দেখা করতে আসে। প্রথমে বেশ জোরেই ব্যবসা নিয়ে এবং পরে ফিসফিস করে দুজনে আলাপ করে। তারপর যথারীতি জগলুর ডাক পড়ে। -জ্যা বেগম সাহেব মোরে বুলাইছেন ? -হ্যাঁ একটু বাঁজারে যেতে হবে...। জগলুর হাতের ভীতরে একটা টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে দেয়। এখানে কত টাকা আছে তা সে জানে না তবে উপরে পাঁচশত টাকা দেখা যায়। সে চায়না তবুও ধমক দিয়ে জোর করে হাতে ধরিয়ে দেয়। এর অর্থ জগলু জানে। সে গত আঁট - নয় মাস ধরেই এমনটা দেখে আসছে। তবে আজ যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশী টাকা দিয়েছে। কেমন যেন একটা ভয় পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশির করে বেয়ে নামে। বাথ্রুম লাগে তার। মন সাঁয় দেয়না বাইরে যেতে আর তাই অনিচ্ছার সূরেই কথা বলে জগলু -বেগম সাব বাজারতো সবই আছে...হুদাই রৈদের মধ্যে ঘুরতে ভালা লাগে না । -আরে যা না আইসক্রিম খেয়ে আয়... মৃদ্যু ধমকে কথাটা বলে আড়চোখে তাকায় বোরহান সাহেবের দিকে । বোরহান সাহেব হাতে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে চুক চুক শব্দ করে চুমুক দেয় আর মিটিমিটি হাসে । -মেম সাবে যে কি কন না এই বুড়া কালে কেউ আইসক্রিম খায়নি কথাটা বলে মাথা চুলকায় আর লাজুকভাবে হাসে। কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে বেগম সাহেবের রক্তচক্ষু, যেন এখুনি খেয়ে ফেলবে।
সহজ মনের হলেও জগলু যে কিছু বোঝেনা তা নয়। আসলে সে সব বোঝে যদিও বেশ সময় লেগেছে বুঝতে। নুরীই তাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে আসল ঘটনা কি ! মাঝে মাঝে ভাবে সে মুজিব চাচার সাথেই বেঈমানি করছে ! সে কয়েকবার ভেবেছেও চাচাকে সব বলে দেবে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি । নুরী বলে -বড় মানষের বড় বড় গুপন কারবার থাকে । সেই গুলান দেইখাও না দেইখা চলতে হয় । কিছু দেখছো বালা কথা, তয় বুঝতে দিলেই নিজেরই বিপদ । জগলু তাই কোনদিন বেশী আগ্রহ দেখায়নি এদের এই গোপন অভিসারের ব্যাপারে । তার যত কষ্ট হয় মুজিব চাচার জন্য । লোকটা বউকে কত ভালোবাসে তবুও তার সেই অপার ভালোবাসা এই মহিলার মনের পালে সুখ দিতে পারেনি । আর তাই হয়ত বোরহান নামের মানুষটার বুকে মাথা রেখে চোখের পানিতে দুঃখকে ঢেকে কিছুটা সুখ খুঁজে নেয় সে। কিন্তু জগলুর মন বোঝে না এতো অঢেল ভালোবাসা, ধনদৌলত, প্রাচুর্য থাকা স্বত্বেও কি নেই মুজিব নামের মানুষটার যার জন্য ছুটে যেতে হবে বিবাহিত এক অন্যপুরুষের বাহুডোরে,তাও সবার অগোচরে ?
অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও সেদিন সোজা চলে যায় নুরীর কাছে । নুরী ছাঁদে কাপড় নাড়ে, জগলুও ওর সাথে হাত লাগায়। নুরী জগলুর চেয়ে ছোট হলে কি হবে সে অনেক বড়দের মত বুদ্ধি দিয়ে কথা বলে । জগলু নুরীর মত একটা বৌ চায় । আসলে সে নুরীকেই চায় । কথাও হয়েছে ওদের মাঝে । দুজনেই মানুষের বাসায় কাজ করা ছেড়ে দেবে । জগলু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করবে আর নুরী সংসার সামলাবে । একজনের টাকায় যে সুখ আসবে তাতেই তারা অনেক সুখী হবে । সেদিন দুজনে কত কথা বলে ছাঁদে বসে । কখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে কেউই টের পায়নি । নুরী জগলুকে ছাড়তে চায়না বলে আরো একটু গল্প করতে । আজ তার বাসার সবাই গেছে গ্রামে বেড়াতে কাল আসবে । কিন্তু জগলুর যে যেতে হবে । শেষে নুরীকে কথা দেয় বেগম সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আজ দুজনে নাইট শো মুভি দেখবে । জগলু মনে মনে ভাবে আজ নুরীকে একটা সালোয়ার কামিজ কিনে দেবে ।
বাসার গেইটের কাছে আসতেই জগলু অবাক হয়ে যায় পুলিশের গাড়ী দেখে। ছুটে যায় বাড়ীর ভিতরে...তাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বেগম সাহেব -ইনস্পেক্টর সাহেব এই সেই ছেলে যে আমার স্বামীকে খুন করেছ, ড্রয়ার থেকে টাকা চুরী করেছে ... সাথে সাথে জগলুর হাতে পড়ে হাতকড়ি। ঘটনার আকস্মিকতায় জগলু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে কাকে খুন করেছে ? মুজিব চাচাকে ? যে কিনা নিজের ছেলের মত ভাল জেনেছে? ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়াতে ভাল একজন ছাত্রকে গ্রাম থেকে তুলে এনে এই শহরে জায়গা দিয়েছে ? জগলুর মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়েছে ,বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তাকে ? যে মানুষটা চেয়েছে জগলু লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক কিন্তু স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই বলতে পারেনি সেই মানুষটাকে জগলু খুন করেছে ?
মেঝেতে রক্তাক্ত একজন মানুষ পড়ে আছে। সকালে যখন বেগম সাহেব ডাক দেয়, জগলু তখন ছুরিটা অনেক ধাঁর দিতে ছিল মুরগী জবাই করবে বলে। হাতে নিয়েই ছুটে এসেছিল । কথা বলতে বলতে ভুলে কখন যেন রেখেছিল টি’টেবিলে । ছুরিটা একেবারে বামপাশের বুকেই বসিয়েছে । কিন্তু এই ছুরিতে তো মানুষ মরার কথা না! তাহলে...? ঘরের কোথাও বোরহান সাহেবকে দেখতে পেল না জগলু .…! -না হুজুর আমি খুন হরি নাই …! -ঐ চুপ, কোন কথা বলবি না। যাকিছু বলার থানায় গিয়া বলিস । একজন কনেষ্টেবল খুব আস্তে করে বলে- 'রামধুলাই খাইলে তর না’ হ্যাঁ হইয়া যাবে।'
জগলু পুলিশের সাথে বের হতে যাবে দেখে বোরহান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে । তাকে দেখে বেগম সাহেবের কান্নার সুর আরো বেড়ে যায়। আর তাকে সান্ত্বনা দিতে বোরহান মাথাটা বুকে টেনে নিয়েছে। সুন্দরী বেগম সাহেব স্বামী হারানোর বেদনায় হু হু করে কেঁদে চলে । ‘হারামি বেডী স্বামীরে খাইবি খাঁ আমারে ফাঁসাইলি ক্যা?’ অবাক চোখে জগলু শুধু দেখে যায় ।
পরের দিন বোরহান সাহেব এসে জগলুকে বলে যায় তার ক্ষমতার জোরেই তাকে সে বের করে আনবে । শুধু যেন কোর্টে কোন কিছুই না বলে, শুধু মুখটা বন্ধ রাখতে হবে । জগলুকে নুরীকে নিয়ে ভাবতে একেবারেই নিষেধ করেছে ! সে এখন বোরহান সাহেবের হেফাজতে । জগলু জানে বোরহান সাহেবের ক্ষমতা কত আর তাই তাকে চুপ থাকতে হয় বা থাকতে বাধ্য হল। কখনো কখনো জীবন ভীষণ সরলরেখার মতো আচরণ করে। অন্ধের মতো কেবল উক্ত পথেই হেটে যেতে বাধ্য করে। কারন এই অসহায় জীবনে জগলুদের জন্য যে অন্যকোন পথ খোলা থাকে না! জেলখানা বা কোর্টে তার হয়ে কেউ আসেনি কোনদিন। ছুরীতে আঙুলের ছাপ আর টিনের বাক্সে টাকা এই টুকুই প্রমাণ। তবে নুরী...! নুরী মাঝে মাঝেই আসে । মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। দেখতে হয়েছে ঠিক যেন বেগম সাহেবের মত। কত দামী দামী গয়না আর শাড়ী পড়ে সে । বাতাসহীন এই বদ্ধ ঘরে ফুলের সুবাস নিয়ে এসে হাজির হয় নুরী । জগলু মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে তার স্বর্গের অপ্সরীর দিকে । কখনো কখনো জগলু দুহাতে সামনে মেলে ধরে ঐ সোনা চাঁদমুখ । ভালোবাসার ভেলায় করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক অনেক দূর নিঝুম এক দ্বীপে । কিন্তু নুরীর যে কি হয়েছে ?যেদিন থেকে জজ সাহেবের রায় শুনেছে সেদিনের পর থেকে আর আসেনা সে। কানামাছি খেলায় হেরে গেছে জগলু। আর তখন থেকেই এই দেয়াল ছবি তার সময় কাটাবার সঙ্গী । সমাজটা ধীরে ধীরে উইপোকায় খেয়ে যাচ্ছে ! মানুষের মনটাও ঠিক যেন ঐ পোকায় খাওয়া দেয়াল আর বোরহান এবং বেগম সাহেবের মত মানুষগুলো সব টিকটিকি। জগলু আর নুরীরা রক্তেভরা মশা। নিজেকে মশা ভেবে মলিন হাসে... হাত দিয়ে নিজের উরুতে মশা মারার মত করে চাপড় মারে ‘হালার পুত জন্মাইলি তো জন্মাইলি মশা হইয়াই জন্মাইলি’ খট খট বুটের শব্দে শোয়া অবস্থায়ই মাথা কাত করে দেখার চেষ্টা করে যে,কে আসছে ? কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না সে -কিরে জগলু, কিছু খেতে মন চায় ? - নাহ জেলার সাব মনে মনে ভাবে ‘ইস কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ দিয়া নুরীর হাতের এক লোকমা ভাত যদি সে খায়তে পারত।’ -কোন শেষ ইচ্ছা ? এবার মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয় - না জেলার সাব একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করে- -সাব ভুর হইতে কত বাকী? কথার কোন জবাব আসে না। পায়ের শব্দও বিলীন হয়ে গেছে । জগলু আবার তাকায় জেলখানার ভ্যাপসা ঘরের দেয়ালে। টিকটিকিটা জীভ বের করে করে এখনো খেয়ে যাচ্ছে মশা ! জগলুর পায়ের কাছে ঝুরঝুর করে খসে পড়ে আরো খানিকটা বালি...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।