শাড়ি চোর

শাড়ী (সেপ্টেম্বর ২০১২)

মাহমুদুল হাসান ফেরদৌস
  • ১৮
  • ১১
চেয়ারম্যান বাড়ির বাহিরের উঠান আজ লোকে লোকারণ্য। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকজন আরো বাড়ছে। এই গ্রাম ও এর আশেপাশের গ্রামের অনেকেই এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। অনেকের কাছে এটি ঈদের আনন্দের চেয়েও কম নয়। আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রতি বছরের মত কাপড় বিতরণ করা হবে, গতকালই তা মাইকে ঘোষণা করে সবাইকে জানানো হয়েছে । তাই গরীব ও অসহায় পরিবারগুলো প্রয়োজনীয় কাজ সকাল সকাল শেষ করে চেয়ারম্যান বাড়ির বাহিরে জড়ো হয়েছে। জড়ো হওয়া লোকজনের বেশিরভাগই মহিলা, অনেকে আবার সাথে করে তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে এসেছে যদিও বাচ্চাদের আনতে নিষেধ করা হয়েছিল। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা সারিতে কাপড় বিতরণ করা হবে। তাই পুরুষ ও মহিলা-গন আলাদা আলাদা সারিতে দাঁড়িয়েছে।

রতন সারিতে দাড়াতে দাড়াতে সারি ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান বাড়ির পুকুর-ঘাট পেরিয়ে গেছে। “এবারো কি খালি হাতেই ফিরতে হবে?” এই ভাবনা তাকে আছন্ন করে ফেলে। গত বছর যখন চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে সে প্রথম কাপড় নিতে লাইনে দাড়ায় কিন্তু তার সিরিয়াল আসতে আসতে কাপড় শেষ হয়ে যায় পরে খালি হাতেই ফিরতে হয়। তারপর চেয়ারম্যান সাব তাকে কাছে ডেকে হাতে ৫০টাকার একটি নোট ধরিয়ে দেয়।

সে তাড়াতাড়িই আসতে চেয়েছিল কিন্তু অসুস্থ মা’কে ঔষধ খাইয়ে পাশের বাসার আমেনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেল। আমেনা তাদের পাশের বাসায় থাকে একসময় গার্মেন্টসে চাকরি করত এখন সেলাই মেশিন কিনে নিজেই দর্জি দোকান দিয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে এসে রতনের মা’কে দেখে যায়।

তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে রতন সকালে কিছুই খায়নি। যদিও না খেয়ে থাকাটা তার কাছে এখন আর কষ্টের মনে হয় না। অভাবীর শরীরে সবই যেন তাড়াতাড়ি সয়ে যায়।

রতন অনেকক্ষণ ধরেই দাড়িয়ে আছে কিন্তু তার পেছনে আর কেউ দাড়াচ্ছেনা দেখে মনের ভেতর অস্থিরতা অনুভব করে। সে ভাবতে থাকে তার পিছনে আরো কেউ থাকলে কাপড় না পেলেও কষ্ট একটু কম হতো তখন বলা যেত তার মতো আরো অনেকে কাপড় পায়নি। কিছুক্ষণ পর তার পিছনে আরো কয়েকজন লোক দাঁড়ানোর পর তার মনে বল ফিরে আসে এবং মনে মনে বলে “যাক সঙ্গী পাওয়া গেল”।

ঘণ্টা দুয়েক দাড়িয়ে থেকেও সে দেখতে পায় এখনো কাপড় দেওয়া শুরু হয়নি। চেয়ারম্যান সাব এখনো আসেনি, তিনি আসলে সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার পর কাপড় বিতরণ শুরু করবেন। করিম বেপারীকে রতন বলে এসেছে দুপুরের মাঝেই সে কাজে ফিরে যাবে কাপড় পেতে পেতে দুপুর পার হয়ে যায় কিনা সে ভাবতে থাকে। রতন আর দাড়িয়ে থাকতে পারছেনা তাই লাইনের মাঝেই সে বসে পরে। বসে বসে সে ভাবতে থাকে তার বাবা থাকলে তাকে আজ এত কষ্ট করতে হতো না।
..............
রতনের বাবা ছিলো রিকশাচালক। খুব ভোরে রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পরতো আর ফিরতো সেই রাতে। রতনের সাথে কোন দিন দেখা হতো কোন দিন হতো না। রতনের বাবা ছিল সংসারের প্রতি অনেকটাই উদাসীন তবে রতনের জন্য প্রতিদিনই কিছু খাবার নিয়ে আসত। রতনের মা তখন অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। রতনকে ঘুম থেকে তুলে কিছু নাস্তা করিয়ে ঘরের ভেতর রেখে তালা দিয়ে চলে যেত এবং বিকেল হলে ফিরে এসে রতনকে নিয়ে খেলতে বসতো।

রতনের তখন আট বছর বয়স একদিন বিকালে সে আর তার মা ঘরের সামনে বসেছিল। তখন অনেক লোকজন তার বাবাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এলো। কিন্তু তারা তার পরিপূর্ণ বাবাকে আনতে পারেনি এনেছিল বাবার প্রাণহীন দেহ। তার বাবা নেশা করতো, অতিরিক্ত নেশা করার কারণেই তিনি মারা যান। কিছুদিন পর তার মায়ের শরীরে ভর করে প্যারালাইজড নামক ব্যথী। শরীরের ডান পাশ সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যায়। তারপর করিম বেপারী রতনকে তার ভাঙরির দোকানে মালামাল সরবরাহের জন্য নিয়োগ দেয়। তারপর থেকে রতন প্রতিদিন সকালে তার মা’কে ঔষধ খাইয়ে পাশের বাসার আমেনাকে নজর রাখতে বলে ভাঙরির মালামাল কুড়াতে যায়। দুপুরে ফিরে এসে তা মা’কে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আবার বেরিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় করিম বেপারীর দোকানে গিয়ে সারাদিন যোগাড় করা জিনিসপত্র বিক্রি করে। খুব বেশী টাকা পাওয়া যায়না তবুও যত টাকা হয় তা দিয়ে সে তার মায়ের ঔষধসহ প্রয়োজনীয় খাবার কিনে।
..............
মাথার উপর সূর্যের উত্তাপে রতন দর দর করে ঘামছে। বহুদিনের পুরোনো শার্টটি ঘামে লেপটে রয়েছে তার গায়ের সাথে। কিন্তু এখনো কাপড় বিতরণ শুরু হয়নি। রতনের ধৈর্য হার মানতে চাইছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে জোহরের আযানের ধ্বনি, অনেকেই অধৈর্য হয়ে জানতে চাইছেন কখন চেয়ারম্যান আসবে কখন শুরু হবে কাপড় বিতরণ?

চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে ঘোষণা এলো জোহরের নামাজের পরই শুরু হবে কাপড় বিতরণ। ঘোষণা আসার পর সবাই আবার শান্ত হলো। রতন যে লাইনে দাঁড়িয়েছে সে লাইনটি এখন পুকুরকে পাশ কাটিয়ে ছুঁয়ে ফেলেছে বড় রাস্তা। রতন ভেবে পায়না এত লোক আসে কোথা থেকে। কোন খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হলে কিংবা কিছু বিতরণ করা হবে শুনলেই হাজার হাজার মানুষ চলে আসে কিন্তু কারো প্রয়োজনের সময় খুব বেশী মানুষ এগিয়ে আসেনা। তার বাবা মারা যাওয়ার পর ও তার মা পঙ্গু হওয়ার পর করিম বেপারী ছাড়া আর কেউ তাদের পাশে এসে দাড়ায়নি। করিম বেপারীকে সে বলেছিল দুপুরের মাঝেই ফিরবে কিন্তু এখন দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কখন ফিরতে পারবে এখনো সে জানে না।

রতন যখন আনমনে এসব ভাবছে তখন চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে ঘোষণা এলো “এখন চেয়ারম্যান সাহেব আপনাদের মাঝে কিছু কথা বলবেন এবং কাপড় বিতরণ শুরু করবেন, সবাই এক এক করে সারিবদ্ধ ভাবে আসবেন। যারা পুরুষ সারিতে আছেন তাদের প্রত্যেককে একটি করে লুঙ্গি দেওয়া হবে এবং যারা মহিলা শাড়িতে আছেন তাদের একটি করে শাড়ি দেওয়া হবে”।

চেয়ারম্যান সাহেব সবার উদ্দেশ্যে কথা বলা শুরু করলেন কিন্তু রতনের মনোযোগ এখন আর চেয়ারম্যান সাহেবের কথার ভেতর নেই সে ডুবে আছে অন্য চিন্তায়। সে আশা করছিল একটি লুঙ্গি ও একটি শাড়ি পাবে। তাহলে সে লুঙ্গিটি বিক্রি করে তার মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে পারত আর শাড়িটি তার মা’কে পরতে দিত। এখন সে পুরুষদের লাইনে আছে তার মানে সে একটি লুঙ্গি পাবে। তার সামনে যত মানুষ আছে তাদের সবাইকে কাপড় দিতে দিতে তার জন্য কাপড় থাকবে কিনা সে চিন্তাও তাকে ভাবাচ্ছে ভীষণ।

চেয়ারম্যানের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর কাপড় দেওয়া শুরু হয়েছে। একদিকে দেওয়া হচ্ছে পুরুষদের লুঙ্গি ও অন্য দিকে দেওয়া হচ্ছে মহিলাদের শাড়ি। রতনদের লাইন আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। রতনও এগুচ্ছে আস্তে আস্তে সকাল থেকে অভুক্ত দেহে এখানে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে সে অনেকটাই ক্লান্ত। শরীর যেন আর চলতে চায় না।

অনেকক্ষণ এভাবে চলার পর সে তার কাক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে, চেয়ারম্যানের লোকেরা তার হাতে একটি লুঙ্গি তুলে দেয়। তারপর তার নজর চলে যায় শাড়ির দিকে। সে চেয়ারম্যানের লোকদের বলে একটি শাড়ি তাকে দেওয়া যাবে কিনা তার মায়ের জন্য, তার মা অসুস্থ তাই সে এখানে আসতে পারেনি। কিন্তু চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে জানিয়ে দেয় কোন শাড়ি দেওয়া হবেনা । সে আবার কাকুতি মিনতি করে বলে “লুঙ্গি রাইখ্যা দেন তবুও আমারে একটা শাড়ি দেন, শাড়ি পাইলে আমার মায় খুব খুশী হইব”। কিন্তু চেয়ারম্যানের লোকদের এককথা “নিয়ম ভাঙা যাবে না”। রতনের চোখ দিয়ে অজান্তেই নেমে আসে অশ্রুধারা। লুঙ্গী নিয়েই সে ফিরতে থাকে। বিতরণের জন্য জমিয়ে রাখা শাড়িগুলোর দিকে তার চোখ পরতেই সে যেন সেখানে তার মায়ের ছবি দেখতে পায়। তাই কোন কিছু না ভেবেই সে সেখান থেকে একটি শাড়ি নিয়ে দৌড় দেয়।
..............
অভুক্ত শরীরকে মনের জোরে আর কতটুকুই টেনে নেওয়া যায়। সেও তাই বেশিদূর যেতে পারেনি, বড় রাস্তায় ওঠার আগেই চেয়ারম্যানের লোকেরা তাকে ধরে ফেলে। তখন রতনের কানের ভেতর শুধু “মার”, “চোরের বাচ্চা”, “হাত পা ভাইঙ্গা দে”, “সাহস কত্ত”, “শেষ কইরা দে” নামক শব্দমালা প্রবেশ করতে থাকে। তার নিস্তেজ শরীর কিছুক্ষণের ভেতরই উত্তপ্ত মাটিতে এলিয়ে পরে। স্বজাতির কাছে সে ঘৃণিত হলেও মাটিই যেন তাকে আপন করে নেয়। হয়ত একটি শাড়ির মূল্য একটি জীবনের চেয়েও বেশী।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক সুন্দর করে লিখেছেন ...ধন্যবাদ জানাই আপনাকে ,,,
ভালো লাগেনি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১২
প্রিয়ম খুব দারুন লিখেছেন ভাই , অনেক অনেক কষ্ট পেলাম |
ভালো লাগেনি ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২
মিলন বনিক চোখে জল এলো..এটাই নিরেট বাস্তবতা...সমাজ একজন চোরকে দেখে....ভেতরেরটা কেউ দেখতে চায়না...খুব ভালো লাগলো....
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২
পারভেজ রূপক সুন্দর গল্প।
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১২
ছালেক আহমদ শায়েস্থা অভুক্ত শরীরকে মনের জোরে আর কতটুকুই টেনে নেওয়া যায়। সুন্দর লাগল। ধন্যবাদ কবি।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
ইমরান আলম বেশ ভালই লাগলো ভাই
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২
বশির আহমেদ এ গল্পে আসর চোর কে রতন না চেয়ারম্যান এটা ভাবার বিষয । রতনরা চিরদিনই মার খায় । রতনদেরই স্বগোত্রীয় একদল চামচা ব্যক্তিস্বার্থে রতনদের রক্ত ঝরায় । সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ । আপনার গল্প আর আমার গল্প প্রায় সমগোত্রিয় ।
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২
জাকিয়া জেসমিন যূথী কিছু কিছু প্রয়োজনের কাছে নিয়ম ভাঙ্গা হলে ক্ষতি কি? আর এটাতো যাকাতই দেওয়া হচ্ছে। যে যেটা পেয়ে খুশি হবে সেটাতেই তো সওয়াব হবে। আমরা সেটাই বুঝি না। ভালো গল্প।
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২
আহমেদ সাবের একটু আগে জাকাতের শাড়ী নিয়ে আরেকটা গল্প পড়লাম। আমাদের আর কতদিন অর্থনৈতিক বৈষম্যের নগ্ন এসব চিত্র দেখতে হবে। গল্প হিসেবে সাদামাটা লেখাটা ভাল লেগেছে।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২
হিমেল চৌধুরী করুণ গল্প। কঠিন বাস্তব।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

১৮ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪