এক দুই বছর নয় বরং অনেক অনেক বছর আগের কথা। তখন ছিল না মানুষের মধ্যে কোন হানাহানি না কোন রেষারেষি। মাটির মানুষের মনটাও ছিল কাদা মাটির মতোই নরম। শৈশব কালে মানুষ যেমন থাকে সহজ সরল তখনও ঠিক তাই ছিল। মনুষ্য বসতির তখন ছিল শৈশব কাল। তো তেমনই এক দিনের কথা বলছি এখন।
এক দেশে ছিল এক কামার এক কুমোর। কামার ছুরি, দা,বটি তৈরি করে আর কুমোর তৈরি করে মাটির হাঁড়ি। দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব। কিন্তু হলে কি হবে দু’জনের কাজ কিন্তু দু’জনের থেকে আলাদা। বলা চলে তারা একে অপরের শত্রু। কেননা কুমোরের তৈরি মাটির জিনিস পত্রে যদি লোহার তৈরি ছুরি দা বটির ঘা লাগে তো দফা রফা হতে মোটেও সময় লাগবে না। কিন্তু দুই মালিকের বন্ধুত্ব থাকার কারণে মাটির হাঁড়ি পাতিল আর দা ছুরি বটি বেশ মিলেমিশেই থাকতে লাগল। তবে মজার কথা হল তাদের মিলমিশের কথা দুই মালিকের কেউই কিন্তু মোটেও জানে না। কেননা তারা তো আর দুই মালিককে দেখিয়ে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাব করেনি। বরং মালিকরা যখন দোকান বন্ধ করে নিজের নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় তখনই শুরু হয় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব। আর তা চলে সারা রাত পার হয়ে পরদিন সকালে দোকান খোলার আগে পর্যন্ত। এভাবে চলতে চলতে একদিন এক মাটির হাঁড়ির সাথে একদম পুচকে এক ছুরির ভীষণ ঝগড়া বেধে গেল। কুমোরের ঘরে যে সব পুরনো হাঁড়ি ছিল, বিক্রি হয় হয় করে পড়ে আছে দীর্ঘ দিন। তারা তাদের মালিকের তৈরি নূতন ঐ হাঁড়ির কর্মকাণ্ডÊ দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। তারা তাকে ডেকে গোপনে বলল, ‘দেখ আমাদের বয়সটাতো মোটেও কম হয়নি। বিক্রি হয়না বলেই মালিকের ঘরে পড়ে আছি আজও। নতুবা আমাদের সাথে তৈরি হওয়া হাঁড়িদের একটাও বোধহয় অক্ষত নেই আজ অবধি। কেউ আধাভাঙা হয়ে কারও হেঁসেলে পঁচছে। কেউবা ফুটো হয়ে কৃষকের ফসলের জমিতে কাক তাড়ুয়ার মাথা হয়ে রোদে জলে ভিজছে। আমরা যদি বিক্রি হয়ে যেতাম তাহলে আমাদের অবস্থাও বোধকরি তাদের মতোই হতো।’ তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল আবার, ‘সে যাই হোক, আমরা আমাদের বয়সে কোন মাটির হাঁড়িকে দা ছুরির সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখিনি; ঝগড়া করা দূরে থাক।’
কিন্তু কথায় আছে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। এমনিতে মালিকের নিপুণ হাতে সদ্য তৈরি হওয়া হাঁড়ি। তাতে আবার বয়সটাও একেবারেই অল্প। লাল গোলাপি রঙের মিশেলে ভারি চমৎকার মানিয়েছে তাকে। যেন সদ্য ফোটা আর শিশিরে নেয়ে ওঠা পদ্ম ফুল। অপরদিকে কালো রঙের লক লকে ছুরিটা কে দেখলে বিশ্বাসই করতে চাইবে না কেউ তাদের বন্ধুত্বের কথা। যে কেউই নাক সিটকে বলতে বাধ্য হবে, ‘অমন সুন্দর হাঁড়িটার পছন্দের বলিহারি। দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন যাত পাতের ও একটা বিষয় আছে, নাকি তাও থাকতে নেই। নিজেকে যখন অমন সুন্দর করে গড়িয়েছে তার মালিক। তখন উচিত ছিল তারই হাতের তৈরি কোন মাটির হাঁড়ি কিংবা নিদেন পক্ষে কোন বাটির সাথে বন্ধুত্ব করা, হোক সে কুৎসিত কিংবা মর্যাদাহীন। তা না করে সে করল কোথায় লোহার ছুরির সাথে বন্ধুত্ব। তাও অমন কুৎসিত দেখতে। এখন নেও ঠ্যালা। ’
এ তো গেল সাধারণ মানুষের কথা। কিন্তু বয়সে প্রবীণ বিক্রি না হওয়া হাঁড়িরা মনে মনে বেশ বুঝল বিষয়টা মোটেও মামুলি না। যদিও পুচকে একটা ছুরির সাথে নিতান্ত নিরীহ সরল সোজা এক অবলা হাঁড়ির বন্ধুত্ব ও ঝগড়া। কিন্তু লোহার তৈরি ওসব ছুরি কাঁচি কে মোটেও বিশ্বাস করতে নেই। কখন কী হয় বলা যায় না।
প্রবীণ গুণীজনের কথা যে ফেলনা নয় তা হাতে হাতে প্রমাণ মিলল দু’দিনের মাথায়। দুই দোকানের মালিক বন্ধু হওয়ায় তাদের দুই দোকানের মাঝে একটা মাত্র বাঁশের তৈরি বেড়া। তাতে আবার বড় বড় ফাঁক। একটা ছোটখাটো ছুরি খুব সহজেই ঐ ফাঁকগুলো দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। এতদিন ছুরি দা এর সাথে মাটির হাঁড়ির যতই বন্ধুত্ব থাক তারা কেউ পরস্পর বিনা অনুমতিতে একে অপরের দোকানে নাক গলায়নি। কিন্তু পুচকে হাঁড়ির সাথে গোলমালের মাত্র দু’দিনে মাথায় একটা মাঝারি আকারের ছুরি বেশ অনায়াসে মাটির হাঁড়ির দোকানে ঢুকে পড়ল। মোটেও অনুমতি নেয়া দূরে থাক বরং তার চলাফেরাও উদ্ধত প্রকৃতির। এক পুরানো হাঁড়ি সাহস করে তাকে বলল, ‘বাবা, তোমরা লোহার ছুরি আমরা হোলাম গিয়ে মাটির হাঁড়ি। এভাবে না বলে কয়ে হঠাৎ এখানে ঢুকে পড়লে আমাদের যে বড় ভয় করে। ’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। গলা ছেড়ে দিয়ে ছুরিটা তাকে বলল, ‘কী বললে ভয় করে, কেন? আমরা চোর না ডাকাত?’
তার কথা শুনে তখন মাটির হাঁড়ি বলল, ‘বাবা তোমরা চোরও না ডাকাতও না কিন্তু তোমরা লোহার তৈরি আর আমরা কোথায় মাটির তৈরি। ভয় তো করবেই। তোমাদের গা’ এর একটা টোকা লাগলেও আমরা ফুটো হয়ে যেতে পারি। একটু জোরে লাগলে তো কথাই নেই, ভেঙে দু’টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ব ঘরময়। একবার ভেবে দেখেছ আমাদের মালিকের কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। তোমাদের খেলাধুলা আর আমাদের বিপদ।’
বুড়ো হাঁড়ির কথা শুনে ছুরিটার একটুও মন গলল না। বরং সে ভেংচি কেটে বলল, ‘অতই যখন জান বোঝ তখন বন্ধুত্ব করতে কে বলেছিল তোমাদের?’
তার কথা শুনে পিছন থেকে এক নান্দা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হায়, হায়! কী অলুক্ষুণে কথা গো; অমন করে কথা এক দস্যি ছাড়া কেউ বলে না। তুমি একটা পুচকে ছুরি, আমাদের চাইতে বয়সেও কম; আকারেও অনেক ছোট, শুধু লোহার তৈরি বলেই দেমাগ বেশি। কিন্তু এও জেনে রাখ অতটা দেমাগ থাকা মোটেও ভাল না।’
ছুরিটা তখন তাচ্ছিল্য করে বলল তাকে, ‘তোমাদের উপদেশ শুনে কাজ নেই আমাদের। জন্মই যার মারা মারি কাটা কাটি করার জন্য, তাকে উপদেশ দেয়া আর উলু বনে মুক্তা ছড়ান সমান। এখন ভালই ভালই ভাল লোকের হাতে পড়লে তো ভালই; কিন্তু খারাপ লোকের হাতে পড়লে কত লোকের যে সর্বনাশ হবে আমাকে দিয়ে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কেননা মালিকের গোলামি করাই আমাদের কাজ। ’
বয়স্ক এক মাটির হাঁড়ি তখন ভেংচি কেটে বলল, ‘সবই যখন বোঝ তখন অত আদিখ্যেতা দেখান কেন হেঁ; যতদিন কারো গোলাম না হও ততদিন নিজেও ভাল থাক আমাদেরও ভাল থাকতে দাও।’
কথায় আছে মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজে না। তাই যা হওয়ার তাই হল। ছুরিটা খুক্ খুক করে একটু কেশে নিয়ে বলল, ‘আমাদের লোহার তৈরি শরীর, এ দেহে অত মায়া দয়া নেই। তার চে’ বরং তোমরাই একটু সাবধানে থেক।’ তার কথা শুনে রি রি পড়ে গেল পুরো দোকানের মাটির জিনিস পত্রের মধ্যে। শেষে এক বুড়ো মাটির হাঁড়ি সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘দেখ বাবা আমরা মাটির তৈরি গরিব মাটির হাঁড়ি, বাটি, কলস। আর তোমরা লোহার তৈরি ছুরি, দা, বটি। তোমাদের সাথে আমাদের তুলনা চলে না। তারপরও বলছি বেশি দেমাগ থাকা ভাল না। তাতে অহংকার হয়। অহংকারই পতনের মুল তাও জেনে রাখ।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পুচকে ছুরিটা ত্রীং করে এক লাফ দিয়ে বলল, ‘ভাল কথা আমাদের কানে ঢোকে না। তোমাদের ইচ্ছা হলে আরও উপদেশ দিতে পার কিন্তু তাতে মনে হয় না কোন লাভ হবে। ’ বলতে বলতেই সে দিল আরও এক লাফ। এবার সে তাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে পড়ল এক মাটির হাঁড়ির পিঠের উপর। ফলে যা হওয়ার তাই হল। মাটির হাঁড়িটা ফুটো হয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ছুরিটা। তার কার্যকলাপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মাটির তৈরি সব জিনিস পত্র। কিন্তু তাদের হতভম্ব আর অবাক হওয়ায় বিশেষ ক্ষতি বৃদ্ধি হল না ছুরিটার। সে মোক্ষম মতো আর এক লাফে সেখান থেকে বের হতে গিয়ে বাধাল আর এক বিপত্তি। হাঁড়িটা ভেঙে এবার চৌচির হল।
মাটির হাঁড়ি-বটিরা মনে মনে বুঝল ঝগড়ার ঝাল মেটাতেই এমনটা করছে সে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন প্রবল প্রতাপশালী হয় তখন তার বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকে না। মুখ বুজে অপমান আর ¶তি সহ্য করা ছাড়া মাটির হাঁড়িদের তখন আর কিছুই করার নেই।
পরদিন আবার একই কান্ড ঘটাল পুচকে ছুরিটা। আজ আর একটা হাঁড়ির দফারফা হল। এভাবে চলতে থাকলে তাদের এতদিনের সুখের বাস যে উঠে যাবে তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না। কিন্তু মাটির হাঁড়িরা তাদের মনের দুঃখের কথা কিছুই তাদের মালিক কে জানাতে পারল না।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। প্রতিদিন সকালে এসে ভাঙা হাঁড়ি দেখতে পেয়ে মালিকের মনে সন্দেহ জেগে উঠল। সে ভাবতে শুরু করল অশুভ কোন অপশক্তি তার দোকানের উপর ভর করেছে। যেই ভাবা সেই কাজ।
একদিন দোকানের মালিক বড় একটা লাঠি নিয়ে দোকানে ঢুকল। তারপর তার তৈরি করা হাঁড়িগুলোর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোরা সব অপয়া। তোদের বদলে আমি নূতন হাঁড়ি তৈরি করব। কিন্তু তোদের আর একদিনও চোখের সামনে দেখতে চাইনে ... ’ এই না বলে সে একে একে সব গুলো হাঁড়ি লাঠির এক এক বাড়িতে ভেঙে টুকরো করতে লাগল। আর এ ভাবেই অসম বন্ধুত্ব তাদের সর্বনাশ ডেকে আনল। তবে কিনা বয়সে প্রবীণ হাঁড়িরা যদি পূর্বেই তাদের নবীন হাঁড়িদের সর্তক করত তাহলে হয়তো বা এমন পরিণতি ভোগ করতে হতো না।
আর সেই দা, ছুরি, বটিদের কি হয়েছিল তা যদি কেউ শুনতে চাও তাহলে এতটুকুই বলব। বন্ধুকে তার তৈরি জিনিস গুলো ভাঙতে দেখে বন্ধুর মন আর ভাল থাকে কি করে। সে তখন করল কি জান? তার দোকানের তৈরি করে রাখা সব অস্ত্রপাতি অল্প দামে বিক্রি করে দিল একই দিনে। আর এই খবর গোপনে না পেয়ে এক বড় মোচ অলা ডাকাত সব ছোরা, দা আর বটি নিলামে কিনে নিয়ে আত্মগোপন করল।
আর এভাবেই শেষ হল মাটির হাঁড়ি আর দা,ছুরি, বটির মধ্যে বন্ধুত্ব।
২৫ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪