পরী হিনা ও আজব দেশে আকমল ( সপ্তম পর্ব )

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

হোসেন মোশাররফ
  • ১০
দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল আকমলের। বদ্ধ পঁচা পানির এই অন্ধকার কুয়াই তার জীবনের শেষ ঠিকানা। এখন তার সামনে আর মাত্র একটি পথই খোলা রইল; তা হল মৃত্যু। মনে মনে তারই প্রহর গুণতে লাগল আকমল।
মৃত্যুর আগে মানুষের যা যা মনে পড়ে তা সবই এক একে মনে পড়তে লাগল আকমলের। একবার মনে মনে খোদার কাছে ক্ষমা চাইল আকমল। তারপর সে কায়মনো বাক্যে বলল, ‘হে খোদা, জীবনের এই শেষ সময়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় রইল না। কেননা তুমি ইচ্ছা না করলে কোন কৌশলই কারো কোন কাজে আসে না। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে যেমন তোমার সাহায্য দরকার তেমনি মৃত্যুর সময়ও তোমার সাহায্য দরকার। আমি এখন মনে মনে তাই কমনা করছি খোদা।’
আকমলের মনের এই আকুতি অন্ধকার কুয়ার শেওলা পড়া দেয়ালে বার বার ধাক্কা খেয়ে ধ্বণিত প্রতিধ্বণিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল। এক সময় দিনের ক্ষীণ আলোটুকুও মুছে গেল। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার আর পঁচা পানির গন্ধে আকমল এক সময় নেতিয়ে পড়ল কুয়ার মধ্যে। শুরু হল তার উপর বিষাক্ত পোকা মাকড়ের অত্যাচার। এই বারই বুঝি জীবন প্রদীপ নিভে যায় আকমলের। তারপর একসময় আর কোন সাড়া শব্দ রইল না তার........।

হঠাৎ কোথায় যেন একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোটা তীব্র না অথচ মিষ্টি। চোখে লাগে না কিন্তু দেখা যায়। ধরা যায় না অথচ ছোঁয়া যায়। ধীরে ধীরে আলোটা উজ্জল হল। আকমল চোখ খুলল, না এই মুহূর্তে সে বদ্ধ কুয়ার মধ্যে বন্দি নেই। তার চারদিকে বিষাক্ত পোকা মাকড়ের পরিবর্তে সুগন্ধি ফুলের পাপড়ির সমারোহ। কিন্তু এসব কোথা থেকে এল? ভেবে পেল না আকমল। তার কাছে মনে হল অনেকটা সময় সে ঘুমিয়েছে এখানটায়। একটু সংবিৎ ফিরে পেতে তার মনে পড়ে গেল পঁচা কুয়ার কথা। কিন্তু সেখান থেকে এখানে এল কী করে .... ভেবে পেল না আকমল।

হঠাৎ গুরু গম্ভীর শব্দ হতে লাগল। যেন আকাশ থেকে খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেঙে পড়তে লাগল তার মাথার উপর। ভয়ে উঠে পড়ল সে ফুলের বিছানা ছেড়ে। এবার চারদিকে ভাল করে লক্ষ্য করতেই সে বুঝতে পারল এতক্ষণ সে একটা বিশাল ঘরের মধ্যে ছিল। কিন্তু এত উঁচু আর এত বড় ঘরে তো মানুষ থাকার কথা না। তাহলে কে থাকে এখানে? কিন্তু অত ভাবা ভাবির সময় এখন তার হাতে নেই। কেননা মাত্র কিছুক্ষণ আগে শোনা সেই গুরু গম্ভীর শব্দটা আবার শোনা গেল। বোধহয় ভয়ঙ্কর কিছু একটা তাকে আক্রমণ করতে এদিকেই আসছে। আর একটুও দেরি করল না আকমল। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। বাঁচতে হলে পালাতে হবে নতুবা মরতে হবে। কিন্তু এখানে পালাবে কোথায়? চেনা নেই জানা নেই। তার উপরে রয়েছে গত দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার এক রাশ ক্লান্তি। বিপদে মানুষের বুদ্ধি খোলে। আকমলেরও খুলল। খুব সহজেই বিশাল দরজার পিছনে নিজেকে আত্মগোপন করে ফেলল সে।
আর একটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল আকমল।
শেষ মেশ কপাল জোরে এ যাত্রা রক্ষা পেল। দরজার চৌকাঠের ফুটোয় চোখ লাগিয়ে যা দেখতে পেল আকমল তাতে তার চোখ মাথায় উঠল। বিশাল আকৃতির এক দৈত্য ঢুকল বিশাল ঐ দরজার ফোকর গলিয়ে। মনে মনে প্রমাদ গুণল আকমল। এ যাত্রা বুঝি আর মামার বাড়ি ফেরা হবে না আকমলের... তা মামা যত কৌশল-ই করুক না কেন। মামা মামাই-তো, নাই মামা থেকে কানা মামাও যে ভাল।
আকমল ভেবে পেল না এত সুন্দর আর বিশাল এই বাড়িটাতে থাকে এই কুৎসিত দৈত্যটা! দৈত্যটা ঘরের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর আকমল এবার দরজার ফুটো দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল পুরো বাড়িটা। এটাকে বাড়ি না বলে বলা যায় রাজ প্রাসাদ। সুন্দর কারুকার্য করা দরজার কপাটে লাগান সোনা আর হীরা-জহরতের তৈরি করা ফুল। ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল সব ঝাড়বাতি। আর তা থেকে বিচ্ছুরিত রঙিন আলো ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে। নিচে ফোয়ারা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে রঙিন পানি। অথচ সেই পানি থেকে ভিজে যাচ্ছে না ঘরের কোন আসবাব। সব কিছুই যেন ¯^প্নের মতো। কে বলবে এমন সুন্দর করে সাজানো এই ঘরে বাস করে কালো মুখো ধুমসো পনা এক কুৎসিত দৈত্য।
আকমল দরজার পিছনে লুকিয়ে বসে রইল। দৈত্যটা ঘর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই বাইরে বের হওয়া তার উচিত হবে না। কেননা ভীষণ আকৃতির ঐ দৈত্যটা যে কোন সময় হামলে পড়তে পারে তার উপর। সাবধানের মার নেই। সুতরাং সাবধান থাকাই ভাল। এদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে তার। কিন্তু কোন উপায় নেই আপাতত। একই বিপদে বার বার পড়া যাবে না। বিপদে পড়ার চেয়ে ধৈর্য ধরা অনেক ভাল। তাতে লাভ না হোক কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
অপেক্ষায় কাজ হল আকমলের। একটু পর যে এল সে সেই দৈত্যটা না। অপূর্ব দেখতে এক কিশোরী মেয়ে। কিন্তু তার কিশোরী বয়সটা চেহারায় ধরা পড়ল শুধু। শারীরিক গঠনটা মোটেও তার পরিচয় দেয় না। দেখতে বিশাল আকৃতির, উচ্চতায় দৈত্যের প্রায় কাছাকাছি। তবে ছিপছিপে গড়ন তার। অঙ্গ সৌষ্ঠব যেন গোলাপি আভায় গলানো মোমের তৈরি। একটু তাপ দিলেই যেন গলে পড়বে এখনি। এমন কুৎসিত দৈত্যের ঘরে এমন সুন্দরী মেয়েটি এল কোথা থেকে?
ভেবে পেল না আকমল। আর অত ভাবা -ভাবির সময়ও নেই তার হাতে। পালিয়ে থাকার মত মোক্ষম একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে তাকে। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে মোটেই নিরাপদ মনে হল না তার কাছে। মনে হল মেয়েটা এ ঘরে এসে কিছু একটা খুঁজছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অকস্মাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেল। মেয়েটা হঠাৎ এদিকে এসেই হেঁচকা টানে দরজার কপাট সরিয়ে একবার দেখে নিল পিছনটা। নেহাত কপাল জোরেই বেঁচে গেল আকমল ধরা পড়ার হাত থেকে। সম্ভবত অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকার কারণেই এ যাত্রা রক্ষা পেল সে। মেয়েটা এবার অন্য ঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল এ ঘর ছেড়ে।
‘যাক, এখান থেকে সরে পড়ার একটা মওকা মিলেছে এবার।’ মনে মনে বলল আকমল। তারপর আর দেরি করল না সে। দরজার পিছন থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে যেয়ে ঢুকল। এই ঘরেও লুকানোর মতো তেমন মোক্ষম জায়গা নেই। জনশূন্য এই ঘরটা ছেড়ে পাশের ঘরেও উঁকি দিয়ে দেখল। তারপর পেল একটা ছোট খাট ঘর। প্রথম গুলোর চেয়ে আকারে ছোট এই ঘরটা। তা হলেও একেবারে ছোট বলা যায় না কিছুতেই। বেশি বেশি জিনিস-পত্র থাকায় ছোট দেখাচ্ছে ঘরটা। ঘরের এক কোনে মুখ কষে বেঁধে রাখা বেশ কয়েকটি বস্তা। বস্তা গুলোর উচ্চতা কয়েক মানুষ পর্যন্ত উঁচু। সম্ভবত এটা রান্নাঘর কিংবা খাদ্য-শস্য রাখার ঘর। তবে এখানে লুকিয়ে থাকা যায় অনায়াসে। কেননা বস্তা গুলোর আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকলে কেউ দেখতে পাবে না তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার বাইরে খুট খাট পায়ের শব্দ পাওয়া যেতে লাগল। বোধাহয় কেউ এদিকেই আসছে। আর দেরি করল না আকমল। দ্রুত একটা বস্তার পিছনে নিজেকে আড়াল করে ফেলল। আর একটু হলে ধরা পড়ে গিয়েছিল প্রায়। সামান্যর জন্য বেঁচে গেল আবারও।
আগে দেখা সেই কিশোরী মেয়েটিই আবার ঢুকেছে ঘরে। তার হাতে একটা বাড়ন। সম্ভবত ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্য বাড়ন খুঁজতেই এর আগে দরজার পিছনে উঁকি দিয়েছিল ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল আকমলের ধারণাই ঠিক। মেয়েটা বাড়ন নিয়ে ঘর ঝাঁট দেয়া শুরু করল। এবার শুরু হল লঙ্কাকাণ্ড। প্রচণ্ড গতির ঝাড়ু চালনার ফলে বাতাসে ধুলো মিশে চারদিকে একাকার হয়ে গেল। বস্তার পিছনে দম আটকানোর মতো হাঁসফাস অবস্থা হল আকমলের। বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকেই আসে। এমনিতে দম আটকানোর মতো অবস্থা তার। ইতোমধ্যে কোথা থেকে একটা ইঁদুর এসে হাজির হল সেখানটায়। ইঁদুর দেখে আকমলের ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। যদি সেটা ¯^াভাবিক আকৃতির ইঁদুর হতো। দেখতে ইঁদুরের মতোই তবে আকৃতিতে সে আকমলের চাইতে বড়। ইঁদুরটা তেড়ে আসলে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আকমলের সামনে আর কোন পথ খোলা থাকবে না।
তবে এ যাত্রা আবার প্রাণে রক্ষা পেল আকমল। ইঁদুরটা কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে নিজের পথে পা বাড়াল। সম্ভবত সে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে তাই আকমলের সাথে ঝামেলা না করেই বিদায় নিল।
আকমল মনে মনে বুঝল জায়গাটা তার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। সময় থাকতে এখান থেকে সরে পড়াই ভাল। তবে মেয়েটা ঘর ছেড়ে বের না হওয়া পর্যন্ত বস্তার পিছন থেকে বের হওয়াটা বোকামু হবে ভেবে আকমল সেখানেই বসে রইল। কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। একটু পর একটা তেলাপোকার আবির্ভাব হল সেখানে। বিশাল বিশাল শুঁড় উঁচু করে পোকাটা যেন তার দিকেই ধেয়ে আসছে।
‘আর একটুও দেরি করা চলে না।’মনে মনে বলল আকমল। কারন এ তেলাপোকা টি সাধারণ কোন তেলাপোকা নয়। দেখতে যদিও আর দশটা তেলা পোকার মতোই। কিন্তু গঠনটা মোটেও তাদের মত নয়। বিশাল আকৃতির দু’টি পায়ের মধ্যিখানে পেটটা যেন একটা ছোটখাট গুদাম ঘর। সেখানে আকমলের মতো দু’তিনটে আকমল চালান হয়ে গেলেও বাইরে থেকে কোন কিছুই বোঝার উপায় থাকবে না। সুতরাং দেরি করলেই মরণ।
উপস্থিত বুদ্ধির জোরে অনেক সময় মানুষ বড় বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে যায়। আকমল ছুটতে শুরু করল। আকমলের জন্য সামনেও বিপদ পিছনেও বিপদ। সামনে বের হলে মেয়েটার হাতে ধরা পড়ার সমুহ সম্ভাবনা। পিছনে.... বস্তার পিছন দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। রাস্তাটা অন্ধকার। কিছুক্ষণ আগেই এই রাস্তা দিয়েই ইঁদুর টা গেছে। অন্ধকারে ইঁদুর টা যদি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলেই বিপদ। এর উপর দেখতে না পেয়ে আকমলের সাথে তার গায়ে গায়ে টক্কর লাগলে তো ষোল আনা বিপদ। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তেলাপোকার হাতে বেঘোরে প্রাণ হারানোর চাইতে ঝুঁকি নেওয়া বরং অনেক ভাল। আকমল আগপাছ না ভেবে রওনা হয়ে পড়ল। অন্ধকার রাস্তা, ভিষণ অন্ধকার। রাস্তার দু’পাশে কিংবা আশে পাশে কোথাও কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে পথ হাতড়ে রাস্তা মাপতে লাগল আকমল। দু’একবার ছোট খাট হোঁচটও খেতে হল তাকে। একবার উল্টে পড়তে পড়তে অল্পের বেঁচে জন্য গেল। বস্তার নিচ দিয়ে রাস্তা। কোথাও সরু কোথাও চওড়া। দম আটকানোর মতো গুমট গন্ধ। পিছনে তেলাপোকার পায়ের খস্ খসানি শব্দ। যে কোন সময় হামলে পড়তে পারে ওটা ওর উপর। ইঁদুরটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কিনা জানেনা আকমল। যত বিপদই আসুক খোদাকে স্মরণ করে আকমল সামনে এগিয়ে যেতে লাগল।
এক সময় সুড়ঙ্গ রাস্তার শেষ প্রান্তে দিনের আলো দেখতে পাওয়া গেল। মনে মনে ¯^স্তির নিশ্বাস ফেলল আকমল। পথ ওখানটায় যেয়ে বস্তার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়েছে। ওখানে যেয়ে বস্তার এলাকা শেষ। এখন মুক্ত এলাকায় বের হওয়াটাও নিরাপদ না তার জন্য। কেননা যে কেউ দেখে ফেললেই সাড়ে সর্বনাশ হবে তার। কিন্তু অত ভাবা ভাবির সময় নেই এখন। পিছনেই তেলেপোকা; আর একটু হলেই তার কাছে পৌঁছে যাবে প্রায়। সুতরাং রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে পড়ল আকমল বস্তার নিচ থেকে। একটু সামনে এগিয়েই পড়ল একটা গর্ত। সম্ভবত এটাই সেই ইঁদুরের গর্ত। এখন বাঁচতে হলে ইঁদুরের গর্তে ঢোকা ছাড়া কোন পথ খোলা নেই আকমলের সামনে। গর্তে ঢোকার মুখে বেশ খানিকটা গড়ানো ঢালু পথ। আকমল চোখ বন্ধ করে লাফ দিল ওটাতে।
চোখ খুলে দেখতে পেল একটা মানুষের ফেলে যাওয়া মরা দাঁতের উপর এসে পড়েছে সে। অনেকের বিশ্বাস ইঁদুরের গর্তে দাঁত ফেললে মানুষের দাঁতও ইঁদুরের দাঁতের মতো শক্ত হয়; তাই হয়তো দাঁতগুলো এখানে কেউ ফেলে গেছে। কিন্তু একেক টা দাঁতের আয়তন প্রায় আকমলের সমান। আকমল অনায়াসে একটা দাঁতের পিছনে যেয়ে আত্মগোপন করল। তেলাপোকা বেচারি গর্তে নামতে সাহস করল না। উপর থেকে শুঁড় নামিয়ে কিছুক্ষণ খোঁজ করে সেখান থেকে উধাও হল ওটা।
আরও একটা বিপদ কাটল। কিন্তু বড় বিপদ যে সামনেই আছে তা অনুমান করতে অসুবিধা হল না আকমলের। কেননা এই গর্তটা যে ইঁদুরের তা তার গায়ের বিকট গন্ধ থেকেই নিশ্চিত হল আকমল। এ যেন শেয়ালের ভয়ে বাঘের গুহায় আশ্রয় নেয়া। এখন এখান থেকে যত দ্রুত সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল আকমলের জন্য। পথ সামনে তার একটাই খোলা; আর তা হল ইঁদুরের এই গর্ত থেকে বের হয়ে পড়া। কিন্তু উপর থেকে লাফ দিয়ে ঢোকা যত সহজ ছিল এখান থেকে বের হওয়া ঠিক ততটাই কঠিন। কেননা অনেকটা খাড়া ভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে গলি মুখের এই রাস্তাটা। এখানে লাফ দিয়ে কোন কাজ হবে না। বরং পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙার সমুহ সম্ভাবনা আছে।
তারপরও আকমল বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল। শেষ মেশ রণে ভঙ্গ দিয়ে বসে রইল। আবার একটা বিপদের আশঙ্কা জেগে উঠল তার মনে। এখান থেকে বের হতে না পারলে নির্ঘাত মৃত্যু। কেননা ইঁদুরের গর্তে বসে সে। আর ইঁদুর গুলো আকারে তার চাইতে বড় হবে তো ছোট না। সুতরাং সামনা সামনি হলে যে কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
এমন সময় হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। উপর থেকে কেউ যেন একটা মোটা দড়ি নামিয়ে দিতে লাগল নিচে। দড়ির প্রান্তটা কাছা কাছি এসে পৌঁছুতেই আকমল ওটা ধরে পরীক্ষা করে দেখল। দড়ি ধরে উপরে ওঠা যায় অনায়াসেই। কেননা অপর প্রান্ত উপরে বেশ শক্ত করে আঁটা। আগপাছ না ভেবেই আকমল ওটা ধরে উপরে উঠতে শুরু করল। কিন্তু কথায় আছে যেখানে ভূতের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
হলোও তাই। গর্তের মুখ বরাবর ওঠা মাত্রই অঘঠন টা ঘটে গেল। পড়বি তো পড় বিশাল এক বেড়ালের মুখেই পড়ল আকমল। উপরে দাঁড়িয়ে সে এতক্ষণ ধরে দড়িটা শক্ত করে তার এক পা দিয়ে ধরে রেখেছিল। উপওে ওঠা মাত্রই পাঁজাকোলা করে তাকে মুখে নিয়ে ফেলল বেড়ালটা। তারপর ঊর্দ্ধশ্বাসে দে ছুটৃ..।
কপাল মন্দ থাকলে এমনই হয়। আকমল এবার মনে মনে ধরেই নিল খোদার যদি অন্য কোন রকম ইচ্ছা না থাকে তাহলে এবারই তার নিশ্চিত মৃত্যু। কেননা বেড়ালের হাতে পড়ে ইঁদুর ছানার যে কী দশা হয় তা এর আগে আকমল অনেক বারই দেখেছে। ইঁদুর টা শেষ পর্যন্ত মারা যায় কিন্তু বেড়ালের সাথে নির্মম বাঁচা মরার লড়াই তাকে করতে হয়। ধরা শিকার ছেড়ে দিয়ে ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় থাকে বেড়াল তার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। তবে ইঁদুর যতবারই পালাবার চেষ্টা করে ততবারই বিপদে পড়ে। এ ভাবেই তাকে তাকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়। আকমলের কপালে আজ কী আছে তা তার ভাগ্যই বলে দেবে।
বেড়ালটা তাকে নিয়ে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। গোপন কোন জায়গায় না নিয়ে ঘরের মধ্যিখানে ফেলে ছুটে পালাল। পিছন থেকে কারো তাড়া খেয়েই সম্ভবত বেড়ালটা এমন কাণ্ড করে বসল। ব্যাপারটার জন্য মোটেই তৈরি ছিল না আকমল।
আকমল এবার ধরা পড়ে গেল কিশোরী সেই মেয়েটার হাতে। বেড়ালটিকে সেই তাড়িয়েছিল। বেড়ালটা তাকে মুখে করে নিয়ে আসলেও একটুও আহত করেনি। খুব আলতো করে দুই ঠোঁটে চেপে ধরেছিল সে। ফলে একেবারে অক্ষত অবস্থায় আকমল বেড়ালের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ দিল সে। আর যাই হোক, কিশোরী মেয়েটার হাতে পড়ে নির্মম নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বেঁচে গেল আকমল। মেয়েটা তাকে ধরে একটা উঁচু তাকের উপরে রেখে প্রশ্ন করল , ‘তুমি কে?’
আশ্চর্য হয়ে গেল আকমল। মেয়েটার ভাষা বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না তার। অথচ এই প্রথম সে তাকে দেখছে...পরিচয়ও জানেনা, দেশটাই অদ্ভুত। খুব সংক্ষেপে উত্তর দিল সে, ‘আকমল।’
মৃদু হেসে মেয়েটা এবার বলল, ‘তুমি আমার চাইতে অনেক ছোট আকৃতির মানুষ। তোমার দেশ কোথায়? আর এখানেই বা এলে কী করে?’
মেয়েটার কৌতুহলী প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আকমল বলল, ‘আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি...আমার ভীষণ ক্ষুধাও পেয়েছে।’

আকমলের কথা শুনে মেয়েটা দুঃখ প্রকাশ করে বলল,‘আমারই ভুল হয়েছে...;দাঁড়াও এক্ষুণি তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আকমলের জন্য অনেক খাদ্য-দ্রব্য এনে হাজির করল মেয়েটি। তারপর খেতে খেতে দু’জনের মধ্যে কথা হল অনেক। শুধু একটা কথাই আকমল মনে করতে পারল না অমন এক বদ্ধ পঁচা কুয়া থেকে সে এ দেশে কেমন করে এসেছে। তবে এতটুকু বলল পৃথিবীতে পরী হিনা নামে একজনের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু তার সাথে তার বেশ কিছুদিন আগে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তা ছাড়া সে নিয়ে এলে নিশ্চয় এভাবে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে যেত না। সব শুনে মেয়েটি তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলল,‘ওসব পঁচা কুয়ায় অনেক সময় দুষ্ট ভূত পেতিœ থাকে। তাদেরও কাজ হতে পারে। তবে এসব নিয়ে ভেবে এখন আর লাভ নেই কোন। ধরে নাও এমনটা হবে আর তোমার আমার দেখা হবে এমনই ইচ্ছা ছিল খোদার।’
তারপর আকমল তার মায়ের গলার হার হারানো আর মামার বাড়িতে তার দুঃখের কাহিনী শোনাল মেয়েটিকে। আকমলের দুঃখের কাহিনী শুনে মেয়েটা আফসোস করে বলল, ‘এই দুঃখ শুধু তোমার একার না এই বিশ্ব-জগতের সব সৎ মানুষের। এই বিশ্ব-জগতের এটাই বুঝি অলিখিত নিয়ম। যে সৎ হবে, সত্যি কথা বলবে আর সৎ পথে চলবে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে দুঃখ কষ্ট আর লাঞ্ছনা। কিন্তু এইসব দুঃখ আর কষ্ট তার সততা কে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, যদি সে সত্যিই সৎ হয়। আর এটাই বুঝি এই বিশ্ব-জগতে সৎ মানুষের জন্য একমাত্র পরীক্ষা।’
তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিয়ে মেয়েটা আবার বলল, ‘এই দেখ, আমার জীবনের দুঃখটাই বা কম কিসে? আমি ছিলাম এই দেশের একমাত্র রাজকন্যা। অথচ আজ কপাল দোষে নিজের বাড়িতে নিজেই আমি বন্দিনী। আজ আমি কোন দেশের রাজকন্যা না, আমি এখন এই বাড়ির চাকরানী।’
রাজকন্যার কথা শুনে তাজ্জব হয়ে আকমল তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ মুখে কোন কথা সরল না তার। তারপর শেষে বলল, ‘তাহলে আমার ধারণাই ঠিক। আমি প্রথমে এই প্রাসাদে ঢুকেই মনে মনে নিজেকে বলেছি নিশ্চয় এটা কোন রাজ প্রাসাদ আর তোমাকে দেখেও মনে হয়েছে তুমি কোন রাজকন্যা।’
কৌতুহল মানুষ কে তাড়া করে ফেরে। আকমলও তার বাইরে কেউ না। তার আর তর সহ্য হচ্ছিল না। সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে বলল, ‘তাহলে এখন আমাকে বলতে হবে তোমার এই দুরবস্থা হল কেমন করে?’
রাজকন্যার চোখ পানিতে টই-টুম্বর হল। বলল, ‘এখন না; তুমি ক্ষুদে মানুষ। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছ। নিশ্চয় তুমি খুব ক্লান্ত। আজ এখন আর কোন কথা নয়। খোদা চায় তো তোমার সাথে বাকি কথা কালই হবে।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি মোশাররফ ভাই আপনার গল্পের আকমল চরিত্রটি আমার খুব প্রিয় 'পরীহিনা' পর্বের নায়ক....এই গল্পেও আকমলকে পেয়ে খুশী হলাম আপনাকে ধন্যবাদ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২
পরী হিনার `আজোব দেশে আকমল ' সিরিজ গল্পটি পড়ছেন, সুতরাং আকমল কে প্রতি পর্বেই পাবেন ....মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ ...
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২
সূর্য মোশারফ ভাই আপনার গল্পগুলো নিয়মিতই পড়ছি। ভাল লাগে প্রতিবারই বলি। এবার একটা অনুরোধ করি বিষয়ের সাথে মিলিয়ে কয়টা গল্প চাই আপনার কাছে
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১২
অনেকে অপেক্ষায় আছেন পরবর্তী পর্বের জন্য, সেজন্য আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না বিধায় আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত....ধন্যবাদ আপনাকে
তানজিয়া তিথি ভাইয়া ছোটদের জন্য লেখা আদর্শ একটি গল্প । অভিনন্দন ও সালাম আপনাকে ।
ভালো লাগেনি ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২
তিথি কে আমার সালাম সেই সাথে অভিনন্দন ...মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ |
ভালো লাগেনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২
তাপসকিরণ রায় হ্যা,অনেকটা রূপকথার মত গল্প--শিশু কিশোরদের গল্প বলা যায়.এ ধরনের গল্প সবারই ভালো লাগে.এর পর কি হবে এমনি ভাব নিয়ে পাঠক এগিয়ে যায়.কিন্তু শেষ টুকু না পেয়ে পরের পর্বের অপেক্ষা করে .আমিও অপেক্ষায় থাকলাম.বেশ ভালো লাগলো.ধন্যবাদ লেখক!
ভালো লাগেনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
আপনি অপেক্ষায় থাকবেন ? ঠিক আছে থাকুন , আমিও আছি আপনাদের সাথে ....ধন্যবাদ আপনাকে ...
ভালো লাগেনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২
বশির আহমেদ আপনার আগের পর্ব গুলোর মত এ পর্বে তেমন আকর্ষন খুঁজে পেলাম না । অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত মত । পরের সংখ্যা আরও অাকর্ষনীয় হবে এই আশায় রইলাম ।
ভালো লাগেনি ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২
অকপটে সত্য কথা টি বলার মজাই আসলে আলাদা, আপনি তা পেরেছেন এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই...জানিনা পরের পর্বে আপনার আশা পূরণ করতে পারব কিনা ... তবে ভয়ে ভয়ে আছি ......
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২
আহমেদ সাবের "খোদা চায় তো তোমার সাথে বাকি কথা কালই হবে।" - কালকের অপেক্ষায় থাকলাম মোশাররফ ভাই।
ভালো লাগেনি ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২
ঠিক আছে ভাইজান আপনি অপেক্ষায় থাকেন .....আমি আসছি .....
ভালো লাগেনি ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২
এশরার লতিফ এই প্রথম পড়লাম আপনার সিরিজের কোন সংখ্যা. ভবিষ্যতে কোন দিকে লেখাটি বাক নিবে জানি না তবে এই মুহুর্তে সেরা রূপকথাগুলোর মতই লাগছে, মনে পড়ছে এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মত ধ্রপদী কাহিনীর কথা. রূপকথা হিসেবে অনেক ভালো লাগলো.
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, সাথে থাকুন ....আপনার মতামত জানাতে ভুল করবেন না যেন......
ভালো লাগেনি ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২
সিয়াম সোহানূর নির্মল আনন্দে ভরপুর গল্প কাহিনী । বরাবরের মতই ভাল লাগলো।
ভালো লাগেনি ১১ ডিসেম্বর, ২০১২
আপনাকে আনন্দ দিতে পেরে আমিও আনন্দিত হলাম......মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ ..
ভালো লাগেনি ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২
Lutful Bari Panna আপনার সিরিজটা বরাবরই আগ্রহ নিয়ে পড়ি মোশাররফ ভাই। এবারের পর্বে জনাথন সুইফটের ব্রবডিগনাগ আর রূপকথার বন্দী রাজকন্যার গল্পের একটা মিশেল পেলাম যেন। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।
ভালো লাগেনি ১১ ডিসেম্বর, ২০১২
আপনি ঠিকই ধরেছেন পান্না ভাই , তবে গল্পের এই পর্বেও কিন্তু পরি হিনা অনুপস্থিত.... তাকে আগে আসতে দিন হয়ত সে আসার পর গল্পের খোল নলচে পাল্টে যেতে সময় লাগবে না .......আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্য প্রাপ্য ধন্যবাদের পুরোটাই দিলাম আপনাকে .........
ভালো লাগেনি ১২ ডিসেম্বর, ২০১২
মিলন বনিক আপনার ধারাবাহিক কাহিনীগুলো সুখ পাঠ্য...ভালো লাগে...এবার তার ব্যতিক্রম হয়নি...অনেক শুভ কামনা....
দেরিতে হলেও প্রথম পাঠক হওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ........

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী