পরী হিনা ও আজব দেশে আকমল ( চতুর্থ পর্ব)

নতুন (এপ্রিল ২০১২)

হোসেন মোশাররফ
  • ১৯
  • 0
নাহ্ ; যত সহজ ভেবেছিল আকমল, ঠিক তত সহজে সব কিছু হলো না। একটু পরেই সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। গাছ থেকে নামারও সুযোগ দিল না ওরা তাকে। খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল আকমল ওদের হাতে। শেষমেশ একটা কাঠের খাঁচায় বন্দি করা হল তাকে। আশপাশের লোকজন ভিড় করল খাঁচার চারপাশে। যতই বেলা বাড়তে লাগল ততই ভিড় বাড়তে লাগল। সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগল আকমলকে। তবে আকমল যা ভেবেছিল মনে মনে; তা মোটেও সত্যি হল না। কেউ তাকে চোর ঠাওরাল না, কিংবা কেউ তাকে আপেল চোর হিসাবেও উপহাস করল না। বরং সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল শুধু। তারপর নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কিছু বলাবলি করতে করতে দূরে সরে যেতে লাগল।
ব্যাপারটা কিছুই আঁচ করতে পারল না আকমল। আজব দেশের মানুষ গুলো অবাক হয়ে তাকে দেখছে। অথচ এর পেছনে কোন কারণ খুঁজে পেল না আকমল। শেষমেশ দুপুর গড়াতে যখন একটু বাকি তখন ভিড়টাও একটু পড়ে এল। কোথা থেকে অল্প বয়সি একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল সেখানে। আশপাশে কাওকে না দেখে মেয়েটা হটাৎ বিস্ফোরিত চোখে প্রশ্ন করল, 'তোমার বাড়ি কোথায় গো?'
খুব সাধারণ ভাবে আকমল বলল, 'আমার বাড়ি দিয়ে তোমার কাজ কী?'
'তাই শুনি।' তারপর আবার চারদিকটা একবার ভালভাবে দেখে নিয়ে কথার মধ্যে বেশ আনত্দরিকতা ফুটিয়ে তুলে বলল মেয়েটা, 'সবাই বলা-বলি করছে কী জান তুমি? সবাই বলছে যে তুমি নাকি ভিন দেশের আজব মানুষ। এর আগে তোমার মতো মানুষ সাত জন্মেও কেউ আর দেখেনি।'

পুরো বিষয়টা এবার আকমলের মাথায় ঢুকতে আর দেরি হল না। ওরা ভেবেছে নূতন দেশের নূতন মানুষ হওয়ায় এদের ভাষাটাও বোধহয় আমার আয়ত্তে নেই; সে জন্যেই কেউ কথা বলতে এগিয়ে আসছে না। মনে মনে ভাবল আকমল; মেয়েটির বয়স অল্প হওয়ায় অতশত চিনত্দা না করেই কথা বলতে শুরম্ন করেছে সে। আকমল মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল চুরির দায়ে সে গ্রেপ্তার হয়নি। কিংবা তাকে বন্দিও হতে হয়নি অন্য কোন কারণে। নিছক নূতন মানুষ হওয়া আর আজব দেশে আসাটাই তার অপরাধ। এখন এদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কীভাবে তাই মনে মনে ভাবতে লাগল আকমল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়।
মেয়েটা তখনো গরাদের কাঠ ধরে স্রেফ অবাক হয়ে চেয়ে আছে আকমলের দিকে। আশপাশ থেকে সবাই সরে গেছে ততৰণে। এখন একটা মোৰম সুযোগ তার হাতে চলে এসেছে, ভাবল মনে মনে আকমল। তারপর মেয়েটার কাছাকাছি এসে আকমল বলল, 'তুমি আমাকে দেখে ভয় পাওনি তো? '
ছোট্ট মেয়েটা দু'পাশে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে মোটেও ভয় পায়নি তাকে দেখে। সুযোগটা তাহলে ষোল আনাই পাওয়া গেল; মনে মনে আবার ভাবল আকমল। তারপর কাছাকাছি অবস্থানে থেকেই মেয়েটাকে বলল সে, 'তোমাদের গ্রামের গ্রাম-প্রধান কে চেন তুমি?'
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে আমূল মাথা কাত করে বুঝিয়ে দিল সে তাকে ভালই চেনে। তারপর বারো আনা উৎসাহ নিয়ে হেসে বলল, 'আমার বাবাই এ গ্রামের প্রধান।'
আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেল আকমল। বলল, 'তাকে একবার ডাকতে পার তুমি?'
কোন দ্বিধা-সংকোচ না করেই মেয়েটা বলল, 'হঁ্যা-, এখনই একবার ডেকে দেব তাকে?'
খুব আদরের সাথে বলল আকমল, 'তাহলে তো খুবই ভাল হয়।'
'দাঁড়াও, দিচ্ছি ডেকে -' বলেই মেয়েটা দে-ছুট লাগাল।
আকমল মনে মনে স্বসত্দির নিশ্বাস ফেলল।

বড়দের দিয়ে যা হয় না ছোটদের দিয়ে অনেক সময় তা অতি সহজে ও অল্প সময়েই হয়ে যায়; তাও প্রায় বিনা ক্লেশেই। এ ৰেত্রেও যেন তাই হল। কিছুৰণের মধ্যেই মেয়েটা প্রায় ছুটতে ছুটতে তার বাবাকে সাথে নিয়ে সেখানে এসে হাজির হল। তারপর আকমল কে দেখিয়ে বাবাকে বলতে লাগল, 'বাবা বাবা, দেখ দেখ; বন্দি ঐ আজব দেশের ছেলেটা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।'
তার কথা শুনে বাবা তাকে বলল, 'তা কি করে সম্ভব? সে আমাদের ভাষা বুঝবে কীভাবে আর আমি বা কীভাবে তার কথা বুঝব?'
বাবার কথা শুনে আকমল বলল, 'কোন সমস্যা নেই, আমি আপনার কথা বুঝেছি। আপনিও নিশ্চয় আমার কথা বুঝেছেন। যেহেতু আমাদের দু'জনার ভাষা একই।'
লোকটা আশ্চর্য হয়ে আকমলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, 'কিন্তু আমি তো এর মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না, কীভাবে এটা সম্ভব হল। ভিন দেশের আজব মানুষ অথচ ভাষা এক হল কেমন করে?'
আকমল মিটি মিটি হেসে বলল, 'এ সবই পরী হিনার কেরামতি।'
'পরী হিনা? সে আবার কে?' অবাক হয়ে জানতে চাইল লোকটা।
আকমল এবার খুক খুক করে কেশে নিয়ে বলল, ' বেশিদুর কী, তাকে আমিও চিনতাম না। যদি না মামা আমাকে গুহায় আটকে রেখে, পালিয়ে না যেত।'
আকমলের কথা শুনে লোকটার বিশেষ পছন্দ হল বলে মনে হল না। বরং আগের মতোই তার মুখের গোমড়া ভাবটা একচুল নড়ল না। উপরন্তু রাজ্যের বিষ্ময় আর অসনত্দোষ প্রকাশ করে বলল, 'তোমার কথা শুনে আমার এমনিতে সন্দেহ হচ্ছে। তার উপর আবার কোথা থেকে পরী হিনা কে নিয়ে এসে সন্দেহটা আরও বাড়িয়ে দিলে। নাহ্ ! তোমাকে আমি এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। '
'নেও ঠ্যালা, এ যে দেখছি ভাল বিপদেই পড়া গেল। কোথায় ভেবেছিলাম পরী হিনার কথা শুনে গ্রাম প্রধানের মন নরম হবে; হয়তো এই বন্দি দশা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু এখন দেখছি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-' মনে মনে বলল একবার আকমল। কিন্তু কথায় আছে ধনুকের তীর আর মুখের কথা একবার বের হয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। কাজেই উপস্থিত বুদ্ধির জোরে এখন মোটামুটি চুপ থাকাই ভাল বলে মনে করল আকমল।
কিছুৰন বাদে লোকটা অন্য আর একজন লোককে সাথে করে নিয়ে এল সেখানে। লোকটা দেখতে বেশ কেতাদুরসত্দ ; পরনের পোশাকও বেশ মার্জিত আর পরিপাটি। নূতন এই আগুন্তুক লোকটিকে দেখেই বোঝা যায় বেশ সম্ভ্রানত্দ আর উচ্চ পদের অধিকারী হবে হয়তো সে।
নূতন এই আগন্তুক লোকটি আকমলকে ভাল ভাবে পর্যবেৰণ করে নিয়ে বলল, 'হুঁ, বুঝলাম সবই। দেখতে বাচ্চা ছেলের মতো হলেও লম্বা চওড়ায় একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতো। মোটেও ভাল ঠেকছে না আমার কাছে।'
লোকটার কথা শেষ হওয়া মাত্রই গ্রাম প্রধান পিছন থেকে ফোড়ন কেটে বলল, 'আবার বলে কিনা সব নাকি পরী হিনার কেরামতি।'
গ্রাম প্রধানের কথা শুনে আগন্তুক লোকটি ভীষণ অসন্তুষ্ট হল। একবার চোখ কটমট করে আকমলের দিকে চেয়েই বলল, 'না না একে মোটেও বিশ্বাস করা যায় না। আজই রাজার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। বলা যায় না আরও কী ষড়যন্ত্র এর পিছনে আছে।'
'যাক, শেষ পর্যনত্দ বুড়োর কথা্ই সত্যি হল।' মনে মনে আর একবার বলল আকমল। বুড়োই তাকে বলেছিল ধরা পড়লে রাজার কাছে পাঠানোই এদেশের বিধান। তাও ভাল, রাজার কাছে যেয়ে হয়তো সু-বিচার পেলেও পেতে পারে আকমল। কিন্তু বুড়োর কথা মনে পড়তেই নূতন চিনত্দা মাথা চাড়া দিয়ে দিয়ে উঠল আকমলের মাথায়।
বেচারা ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করে রয়েছে। এদিকে বেলা উঠে গেছে। এখন সে না পারবে সেখান থেকে বের হতে না পারবে ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে। আবার কেউ দেখে ফেললেও নিশ্চিত মৃতু্য। বিষয় টা এখনই সমাধান করা উচিৎ।
একটু তফাতে যেয়ে গ্রাম প্রধানের সাথে কেতাদুরসত্দ আগন্তুক লোকটি ফিস্ ফিস্ করে কিছু আলাপ করছিল। সুযোগটা হাত ছাড়া করল না আকমল। বেশি উঁচুও না আবার একেবারে ৰীণস্বরেও না; গলার স্বরটা মধ্যম করে এনে চেঁচিয়ে বলল, 'আমার সাথে আরও একজন আছে।'
আকমলের কথা শুনে সাথে সাথেই ভূত দেখার মতো হতবাক হয়ে দু'জনা চেয়ে রইল ওর দিকে। কেতাদুরসত্দ আগন্তুক লোকটি এবার জোরেই বলল, 'দেখেছ, আমি বললাম না এর পিছনে আরও কী ষড়যন্ত্র আছে।'
গ্রাম প্রধান ইশারায় আগন্তুক লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে খাঁচার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তারপর তার গলার স্বরটা গাড় করে গোপন শলা-পরামর্শ করার ভঙ্গিতে বলল, 'এ বেলা ভালই ভালই তোমার অপর সঙ্গীর কথা বলে দিলে তুমিও প্রাণে বেঁচে যাও আমরাও বেঁচে যাই।'
আকমল একটু ইতসত্দত করে বলল, 'কিন্তু বুঝতে একটু ভুল হয়েছে। সে আমার সঙ্গীও না কিংবা আমার সঙ্গেও আসেনি। সে তোমাদেরই লোক, এ বাড়ির কর্তা। এর মধ্যে বিন্দু মাত্রও কোন ষড়যন্ত্র নেই।'
গ্রাম প্রধান নিজের বিশ্বাস থেকে বিন্দু মাত্রও টলে না গিয়ে বলল, 'বুঝলাম, সবই বুঝেছি আমি। আমরা তো আর ঘাস খেয়ে এত বড়টি হইনি। তুমি যে কতবড় ধড়িবাজ শেয়াল তা বুঝতে আর বাকি নেই আমাদের। এখন ভালই ভালই সব বলে দিলেই তোমার মঙ্গল।'
আকমলের বুঝতে আর বাকি রইল না এরা মোটেও বিশ্বাস করছে না তাকে। বুড়ো কথাটা মোটেও বে-ঠিক বলেনি, এরা বুড়োর ফিরে আসাটা আদৌ বিশ্বাস করবে না। বরং ভূত ধারণা করে হত্যাও করতে পারে। তবুও মৃতু্য যেখানে নিশ্চিত সেখানে ঝুঁকি নেয়াটা মোটেও বোকামির পরিচয় নয়। বরং ঝুকি নিয়ে মরাও ভাল।
আকমল বলতে শুরম্ন করল, 'গ্রামে ঢোকার মুখেই যে বড় ঝোপটা আছে তারই মধ্যে আত্ম-গোপন করে আছে আমার অপর সঙ্গী; বুড়ো, এ বাড়ির কর্তা। কিন্তু সাবধান তার কোন ৰতি করার চেষ্টা্ করো না যেন তাহলেই কিন্তু বিপদ হবে তোমাদের।'
মুখের কথায় যদি একজনের প্রাণ বেঁচে যায় তাতে মন্দ কী, দেখাই যাক্ না বুড়োটার প্রাণ আবারো রৰা পায় কিনা। মনে মনে বলল আকমল।
কিছুৰণের মধ্যেই দেখা গেল বুড়োটাকে জঙ্গল থেকে বের করে টেনে হিঁচড়ে কয়েক জন ষণ্ডামার্কা লোক এদিকেই নিয়ে আসছে। তাকে টানতে টানতে খাঁচার কাছাকাছি এনে ফেলল ওরা। ওদের মধ্যে থেকে একজন গাট্টা গোট্টা সুঠাম দেহের লোক এগিয়ে এসে পড়ে থাকা একটা মোটা গাছের গুড়ি তুলে নিল মাথার উপরে। তারপর সেটা বুড়োর দিকে তাক করল। বুড়ো হাত জোড় করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, 'বাছা, আমি তোমার বাবা, আমাকে চিনতে পারছ না। আমাকে মেরে ফেল না।'
কিন্তু শক্ত সামর্থ লোকটা মোটেও তার কথা শুনল না। বরং রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, 'তুমি মিথ্যা কথা বলছ, আমার বাবা বেঁচে নেই। তুমি তার অশুভ আত্মা।'
আর একটু হলেই বুড়োর মাথাটা দু'আলাদা হত। কিন্তু গ্রাম প্রধান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'খবরদার! আর একটুও এগিয়ো না, ঐ যে খাঁচার ভিতরে তার সঙ্গী বলে দিয়েছে ৰতি করার চেষ্টা করলেই বিপদ হবে।'
দুষ্ট লোকেরা সাধারণত ভীরম্ন কাপুরম্নষ হয় সেজন্যই বোধহয় বুড়োটা ওদের হাত থেকে আর একবার প্রাণে রৰা পেল। শেষমেশ গ্রামের লোকেরা আলোচনা করে বুড়োটাকে একরকম জোর করেই আকমলের সাথে খাঁচায় আবদ্ধ করল। তারপরও বুড়োটা থেমে রইল না। বার বার চেঁচিয়ে তার ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ধরে ডাকতে লাগল আর বলতে লাগল। আমাকে তোমরা পর ভেবনা, আমি ভূতও না, প্রেতাত্মাও নই; আমিই তোমাদের বাবা। আমি মরিনি, এই দেখ আমি এখনো জীবিত......কিন্তু পারতপৰে কেউ তার কথা কানেই তুলল না। না তার মেয়েরা না তার ছেলেরা। শেষ পর্যনত্দ অধৈর্য হয়ে বুড়ো তার ছোট ছেলের নাম ধরে ডাকতে লাগল আর বলতে লাগল, 'তুমি আমার ছোট ছেলে, কত আদর করেছি সোহাগ দিয়েছি। তার বিনিময়ে হলেও; আজ একটি বারের জন্য তুমি আমার দু'টি কথা শুনে যাও, বাবা।'
ছোট ছেলে বলেই কথা! বাবার অনুরোধ ফেলতে পারল না সে। না হোক,অনিচ্ছার সাথে একবার এসে দাঁড়াল খাঁচার কাছে। তারপর নাকে টেনে বলল, 'নেও বঁল তোঁমার কী কঁথা, শুনি।'
বুড়ো তার কথা রাখল। সে মাত্র দু'টো কথাই তার ছোট ছেলেকে শোনাল। প্রথমটা হল, 'আমি তোমাদের সত্যি বাবা।' আর দ্বিতীয়টি, 'বিশ্বাস কর তুমি, এ কথাটা মোটেও মিথ্যে না।'
কিন্তু ছেলেটি তার বিশ্বাসে অনড় থেকে দু'বার না-সূচক মাথা নেড়ে বলল, 'যদি তুমি আমাদের সত্যি বাবা হতে তাহলে বন্দি অবস্থায় বসত্দার মুখ খুলে বের হতেও পারতে না। আবার গুহা মুখের অত বড় পাথরটা সরানোও তোমার কম্ম হতো না।'
বুড়ো এবার সত্যি সত্যিই বিপদে পড়ে গেল। এ কথার কোন জবাব তার জানা নেই। ছেলেটা এবার মিটি মিটি হাসতে বলল, ' এ কম্ম শুধু ভূত-প্রেতাত্মাদের দ্বারাই সম্ভব। সুতরাং তুমি আমার বাবা নও। তুমি তার অশুভ আত্মা।'
অন্ধ বিশ্বাসের কাছে সত্যি কথার কোন ঠাঁই নেই। এ কথাই এখানে সত্য প্রমাণিত হল।
বুড়োকে নিরম্নত্তর দেখে তার ছোট ছেলে এবার উৎসাহের সাথে বলল, 'তোমাদের দু'জনকেই আমরা রাজার কাছে পাঠাব। সেখানেই তোমাদের উপযুক্ত শাসত্দি হবে। আর তোমাদের মত দুষ্ট ভূত আর প্রেতাত্মাদের গলা কাটা যাওয়াটাই উপযুক্ত শাসত্দি।'
বুড়ো এবার নিরাশ হয়ে আকমলের দিকে তাকাল। বুড়ো কে দেখে বড় মায়া লাগল আকমলের। কিন্তু কী বলবে কিছু ভেবে পেল না । কেননা ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা এদের বলা কিংবা বুঝানো মোটেও সম্ভব নয় আকমলের পৰে। তা ছাড়া এরা শুনতে চাইলে তো ? দেখে শুনে মনে হচ্ছে ভীষণ ব্যসত্দ আর অধৈর্য প্রকৃতির মানুষ এরা। সুতরাং যা ঘটে গেছে তার বিসত্দারিত বর্ণনা দেয়া এখন শুধু বোকামিই হবে না রীতিমতো বিপজ্জনকও হতে পারে। কাজেই রাজার কাছে না যাওয়া পর্যনত্দ চুপ থাকাই ভাল। কেননা রাজাদের কাছে সাধারণত জ্ঞানী গুনী সব উপদেষ্টা পরিষদ থাকে; তারা হয়তো আকমলের কথা আমলে নিতেও পারে। তবে বুড়ো কে সান্ত্বনা দিতে যেয়ে আকমল শুধু বলল, 'এরা বোধহয় তোমাকে আর মেনে নেবে না।'
বুড়ো কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, 'মেনে না নিক্ কিন্তু বিশ্বাসটুকুও তো পেলাম না। বুড়ো বয়সে আমি এই দৃশ্য দেখার জন্যই কী আবার ফিরে এলাম মৃতু্যর মুখ থেকে এদের মাঝে?'
এ প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই আকমলের। তাই চুপ থাকা ছাড়া কোনই উপায় দেখল না সে। খাঁচার ভিতরে পরিবেশটা একটু ভারি হয়ে এসেছিল। এদিকে বাইরে ইতোমধ্যেই আনন্দ উৎসব শুরম্ন হয়ে গিয়েছিল। ছোট-বড় সবাই নাচছিল আর গলায় গলা মিলিয়ে কোরাস গাচ্ছিল। সম্ভবত অশুভ আত্মাকে খাঁচা বন্দি করার আনন্দেই মেতেছে ওরা। পরিস্থিতি দেখে আকমল বুড়োকে আবার বলল, 'তুমি বিশেষ চিনত্দা করো না, খোদার উপরেই সব ছেড়ে দাও।'
বুড়ো খানিকটা হতাশ খানিকটা আশার সাথে বলল, 'হঁ্যা, তাই দিলাম। তা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার।'

কিছুৰণ বাদেই বাইশ চাকার একটা গাড়ি এনে রাখা হল সেখানে। তাতে জোড়া হল ষোলটা তেজি ঘোড়া। ব্যস্, রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার জন্য গাড়ি তৈরি হয়ে গেল। এখন শুধু রওয়ানা হওয়া বাকি। খাঁচা থেকে বের করার ঝুঁকি-টাও নিল না ওরা। মোটা দড়ির সাহায্যে খাঁচাটা বেঁধে টেনে নিয়ে চলল গাড়ির কাছে। তারপর সবাই মিলে ধরে ওটা তুলে দিল গাড়িতে। গাড়িতে ওঠানোর পর মোটা দড়ির সাহায্যে আবার আষ্টেপৃষ্ঠে বজ্রআঁটা বেঁধে ফেলল খাঁচাটা। সাথে উঠল বেশ কয়েকজন পাহারাদার। তাদের হাতে সড়কি, বলস্নম, বর্শা আর ইয়া বড় বড় সব তলোয়ার। গাড়ি চলতে শুরম্ন করল। গ্রামের অনেক অতি উৎসাহী লোক পিছন পিছন খানিকটা হেঁটে এল। গাড়ি জোরে ছুটতে শুরম্ন করলে ওরা ফিরে গেল সবাই।
ষোল ঘোড়ার বাইশ চাকার গাড়িটা রাসত্দার দু'পাশের ধুলো উড়িয়ে দ্রম্নত ছুটতে লাগল রাজধানীর পথে। বেশ কিছুৰণ চুপচাপ থাকার পর বুড়োটা হঠাৎ ফিস ফিস করে আকমল কে বলল, 'ষোলঘোড়ার গাড়ি বটে, কিন্তু রাজধানী শহরটাও তো আর নেহাত কম দূরে না। নিদেন পৰে দু'দিন দু'রাত্রির ধাক্কা......'
চোখ মাথায় তুলে আঁতকে উঠে আকমল বলল, 'সে কী! আমাদের প্রেতাত্মা ভেবে আজ সারাদিন খেতে দেয়নি ওরা। এর উপর যদি আরও দু'দিন এভাবেই থাকা লাগে তাহলে তো মিথ্যে মিথ্যে না, এবার সত্যি সত্যি ভূত হয়ে যাব আমরা।'

বুড়োটা নিভর্ীক ভাবে বলল, 'রওয়ানা হওয়ার সময় প্রহরীরা গাড়িতে অনেক খাওয়া দাওয়া নিয়েছে সঙ্গে; বুড়ো হলেও সব লৰ্য করেছি আমি। ওদের বললে হয়তো তার কিছুটা আমাদের কপালেও জুটতে পারে।'
গাড়ি ছুটতে লাগল ঊধর্্বশ্বাসে, রাত নামলে একটা সরাইখানায় যেয়ে দাঁড়াল গাড়িটা। সেখানেই সে রাতের মতো আশ্রয় নিল ওরা। ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দেয়া হল সেই সাথে খেতেও দেয়া হল। তবে প্রহরীরা মোটেও ছেড়ে গেল না ওদের। বরং পালা করে খাঁচার চারদিকে পাহারায় বসে রইল ওরা। বুড়ো ওদের কাছে খাওয়া চাইতেই খাওয়া মিলল কিন্তু তা যৎ-সামান্য। কোন রকমে জানটা বেঁচে গেল ওদের।
এটাই নিয়ম; কোন না কোন এক অন্ধ বিশ্বাসের কাছে অনেক মানুষ বন্দি হয়ে আছে। অথচ সে নিজেও জানে না এই অন্ধ বিশ্বাস শেষ পর্যনত্দ তাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে। যদিও এই বিশ্বাস কে কেন্দ্র করেই তার সারা জীবনের সব হিসাব-নিকাশ, চাওয়া-পাওয়ার দীর্ঘ খতিয়ান। আর এ ভাবেই চলে আসছে অদৃশ্য এই কারাগারের অল্প সময়ের জন্য বন্দি মানুষের জীবনের সরল-সহজ জীবন-ধারণের সহজ সমীকরণ।
(চলবে.....)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খোরশেদুল আলম রূপকাথার গল্প এখন আর শোনা হয় না। গল্পকবিতায় আপনাকে পেয়ে যেন আবার মন ঠিক ছোটবেলার মতো হয়ে গেল। লেখকের প্রতিও আকর্ষন বাড়ছে। গল্প ভালো লাগছে। চলুক। মোশাররফ ভাই, শুভকামনা রইল।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি হোসেন মোশারফ ভাই আপনার পরীহিনা না পড়লে ভালো লাগেনা....আপনি আজীবন এভাবে লিখে যাবেন এই আশা রাখি ......অশেষ শুভ কামনা আপনার জন্য.....৫
দোয়া করবেন যেন এমনি ভাবে আপনাদের আনন্দ দিয়ে যেতে পারি ...ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা রইল আপনার জন্য...
আদিব নাবিল আপনার লেখার ত্রুটি নেই, সাহিত্যের চিরায়ত এই ধারায় লেগে থাকাটি বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য। তবু যেন মনে হয় পরী হিনা সিরিজটি একটু ঝুলে যাচ্ছে। গল্পদাদুকে আরেকটু বৈচিত্র্যে দেখতে চাই।
পর পর কযেকটি পর্বে পরী হিনার অনুপস্থিতির সুযোগে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক .....একটু অপেক্ষা করুন ...পরী হিনা আসছে ......
ওবাইদুল হক আর হে আপনাকে দেখার ভাবে এত রসিক মনে হয়নি কেন একটু বলবেন ।
বলছি, শুনুন .......হয়ত , সময় মত আমাকে পাননি তাই ....
ওবাইদুল হক দাদা আপনার সেই পরী হিনাকে আমার আবার দেখতে মন চাইছে কেন জানি বার বার আপনার উঠানে বসে থাকতে ভাল লাগে । চালিয়ে যান আমরা আছি আপনার পিছে ।
একটু অপেক্ষা করুন পরী হিনা আশে পাশেই আছে ...যে কোন এক পর্বে তার দেখা পেয়ে যাবেন...পিছে আছেন, থাকুন ক্ষতি নেই ...মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ......
সূর্য মোশারফ ভাই ছেলেবেলায় বুদ হয়ে রূপকথা শোনার সময়টা ফিরে পেতে আপনার ঘরে আসি আর আবার আসার প্রেরণাটা নিয়ে যাই। চলুক পরী হীনার গল্প...............................☼
আচ্ছা ঠিক আছে, চলুক না পরী হিনার গল্প; তাতে আমার আপত্তি নেই ....তবে আবার আসার জন্য এক রাশ ধন্যবাদ রইল .....
Lutful Bari Panna মোশাররফ ভাই নিয়মিত পাঠক হয়ে আছি আপনার। বই বেরোতে দেখে খুবই ভাল লাগল। বিক্রি কেমন? যদিও প্রথমবার বই বের করে সাড়া আশা করা একটু বেশীই হয়ে যায়।
আপনি ঠিকই ধরেছেন .....একটু বেশিই হযে যায়.....তবুও আশা করতে তো দোষ নেই....হোক না তা একটু বেশি কিম্বা কম ....কোন কিছুতেই একেবারে নিরাশ নই কিন্তু আমি (ফলাফল যাই হোক ) .....আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা সেই সাথে শুভকমনাও .....
মিলন বনিক ধারাবাহিক কল্পকাহিনীর সার্থক বিশ্লেষণ..আমাদের সাথে রাখুন সবসময়..সাথে থাকব..এবং অপেক্ষায় থাকব নতুন কোনো রূপকথার....
আমি আপনাদের সাথেই আছি........তবে মাঝে মধ্যে একটু সাড়া শব্দ দিলে আমার বুঝতে অসুবিধে হবে না আপনারা আছেন ..সুতরাং ....ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্যের জন্য ......
তানি হক এটাই নিয়ম; কোন না কোন এক অন্ধ বিশ্বাসের কাছে অনেক মানুষ বন্দি হয়ে আছে। অথচ সে নিজেও জানে না এই অন্ধ বিশ্বাস শেষ পর্যনত্দ তাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে। যদিও এই বিশ্বাস কে কেন্দ্র করেই তার সারা জীবনের সব হিসাব-নিকাশ, চাওয়া-পাওয়ার দীর্ঘ খতিয়ান। আর এ ভাবেই চলে আসছে অদৃশ্য এই কারাগারের অল্প সময়ের জন্য বন্দি মানুষের জীবনের সরল-সহজ জীবন-ধারণের সহজ সমীকরণ। ...দারুন লিখেছেন ভাইয়া ..আগামী পর্ব আরো জমজমাট রুপকথার জাদু ছড়াবেন..এই অপেক্ষায় রইলাম ধন্যবাদ
চেষ্টা করছি ......ধন্যবাদ নেবেন ...শুভ কামনা রইল .....
আহমেদ সাবের কাহিনী চলতে থাকুক। আমরাও নাছোড়বান্দার মত সাথে সাথেই আছি, থাকব। শুভেচ্ছা হোসেন মোশাররফ ভাই।
.... নাছোড়বান্দা hoe thakar karoney bodhhoy amaro obosor milchhe na saber vai ...apnio amar shuvechha nin ...

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪