পরী হিনা ও আজব দেশে আকমল

২১শে ফেব্রুয়ারী (ফেব্রুয়ারী ২০১২)

হোসেন মোশাররফ
  • ১৬
  • 0
  • ৪৭
একটা পাহাড়ের উপরে নেমেছিল ওরা। পাহাড়টা এতই ছোট যে ওটাকে পাহাড় না বলে ছোটখাটো একটা টিলা বলাই ভাল। কিন্তু পাহাড়ের নিচের বাড়ি ঘর গুলো দেখে মনে হয় না ওটা টিলা। ছোট ছোট দালান গুলোর তুলনায় ওটা বিশাল আকারের এক পাহাড়। দালান গুলোর আয়তন লৰ্য করলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না এখানকার পরিস্থিতি।
হিনা অনেকটা ফিস্ ফিস্ করে বলল, 'এটাই হল আজব দেশের সবচে' উঁচু পাহাড়। আর নিচে ঐ যে ছোট ছোট বাড়িঘর গুলো দেখা যায় ওগুলোই এখানকার উঁচু উঁচু দালান।'
অবাক হয়ে আকমল বলল, 'এত ছোট ছোট ঘর গুলোতে মানুষ থাকে কেমন করে?'
'সেটা জানতে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।' বলল হিনা।

তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছিল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামল। এই সময়টুকু ওরা পাহাড়ের উপরেই ঘুরাঘুরি করে কাটাল। আকমল অবশ্য একবার নিচে নামতে চেয়েছিল কিন্তু পরী হিনা তাতে মোটেও রাজি হয়নি। হিনা তাকে নামতে তো দেইনি বরং বলল, 'এখানকার বেঁটে খাটো লোকেরা পাজির পা-ঝাড়া। যাই করি না কেন আমরা; একবার ওরা দেখে ফেললেই বিপদ হবে আমাদের।' তারপর একটু থেমে আবার বলল ও, 'তবে রাত অনেক গভীর হলে হয়তো একটা সুযোগ জুটতে পারে আমাদের।'
হিনার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই না বুঝে আকমল বলল, 'রাত গভীর হলে তো ওরা নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়বে সবাই।'
'সেই সুযোগেই তো আমরা ওদের শহরে ঢুকবো-' বলল হিনা।

এদিকে পাহাড়ের উপরে হাঁটতে হাঁটতে আকমল লৰ্য করল এখানকার বিশাল বিশাল বট্ অশ্বত্থ গাছগুলোও তার হাঁটুর নিচে পড়েছে। 'সত্যিই অদ্ভুত আর আজব দেশ এটি......মনে মনে বলল আকমল। কিন্তু আজব দেশ দেখার তখনো বাকি ছিল আকমলের। একটু পরেই তা পরিষ্কার হল তার কাছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছিল। তারই আলোয় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল প্রান্তরে। হঠাৎ সে লৰ্য করল কয়েকজন বেঁটে খাটো লোক পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। হিনাকে তা দেখাতেই আর দেরি করল না হিনা। আকমলকে নিয়ে দ্রুত সে পাহাড়ের পিছনে একটা খাঁজের মধ্যে আত্মগোপন করল। তারপর সেখান থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল লোকগুলোকে। তখনো লোকগুলো পাহাড়ের উপরে উঠতে পারেনি। খাঁজের ভিতর থেকে মাথা বের করে লোকগুলোকে দেখতে লাগল ওরা। সম্ভবত ওরা ভারি কোন বস্তু উপরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। ফলে ওরা নিজেদের কাজে এতটাই ব্যস্ত অন্য কোনদিকে তাকানোর সময় নেই ওদের।
ওদের দিকে লৰ্য করে আকমল বলল, ' দেখে মনে হচ্ছে এরা সবাই বেঁটে লোক। হয়তো ওরা এ দেশের বামুন সস্প্রদায় কিংবা বামুন পরিবারের অনর্ত্দভুক্ত।'
আকমলের কথা শুনে হিনা বলল, 'এ জন্যেই কথায় বলে ভাল করে না জেনে না বুঝে কারও সম্বন্ধে মন্তব্য করতে নেই।'
মাথা চুলকাতে চুলকাতে আকমল বলল, 'ঠিক আছে, আমার ভুল হয়েছে মানলাম। এবার তুমিই বলে দাও এরা কারা।'
'অহেতুক বেশি কৌতূহল কখনো ভাল না, সময় হলেই সব জানতে পারবে।' বলল পরী হিনা।
আগুন্তুক লোকগুলো ভারি যে বস্তাবন্দি বস্তুটা টেনে উপরে তুলছিল সেটা টেনে তুলতে যেয়ে তাদের গলদঘর্ম হলেও মোটেও পিছপা নয় তারা। দেখে মনে হল বেশ করিতকর্মা ওরা। কোন দিকে বিশেষ নজর নেই। একনিষ্ঠভাবে তারা দ্রুত উপরের দিকে উঠে আসতে লাগল। অনেকটা কোন ভারি বস্তু নিয়ে পিপড়ার দল যেভাবে গন্তব্যস্থলের দিকে ছুটে যায়। ঠিক সেভাবেই ওরা ধেয়ে আসতে লাগল উপরের দিকে।
পরী হিনা এবার বলল, 'আর মোটেও দেরি করা যাবে না এখানে, এক্ষুণি চল এখান থেকে সরে পড়ি। ওরা একবার দেখে ফেললে আর রক্ষা নেই আমাদের।'
তারপর আবার খাঁজের মধ্যে যেয়ে নিজেদের আত্মগোপন করে ফেলল ওরা। লুকিয়ে পড়লেও মোটেও ওদের দিক থেকে দৃষ্টি সরাল না হিনা। আকমলও পিছন থেকে ওদের কার্যকলাপ গুলো দেখতে লাগল। শেষ রক্ষা হল এই যা, ওরা শেষ পর্যন্ত আর পাহাড়ের উপরে উঠে এলো না। খানিকটা বাকি থাকতেই একটা সরু রাস্তা ধরে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে লুকানো এক গোপন গুহা মুখে যেয়ে থামল ওরা। তারপর ওদের কষ্ট করে এতক্ষণ ধরে বহন করে আনা ভারি বস্তাটা সেখানে গুহার মধ্যে নামিয়ে রাখল। একবার এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হল কেউ দেখেনি ওদের। এরপর সবাই ধরাধরি করে একটা ভারি পাথর গড়িয়ে এনে বন্ধ করে দিল গুহা মুখটা। এত পরিশ্রমের পর কাজটা শেষ করা মাত্রই আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ওদের সবার চোখ-মুখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁধভাঙা আনন্দে ফেটে পড়ল ওরা। কোমর দুলিয়ে নাচ করল আর পিঠে বাঁধা বোচকা থেকে কাল কাল রঙের সুরার বোতল বের করে গোগ্রাসে গিলতে লাগল। তারপর মাতাল হয়ে কিছুক্ষণ মাতলামিও করল। কিন্তু সবই করল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। হঠাৎ করেই রণে ভঙ্গ দেয়ার মতো করে ঝপাঝপ লাফ দিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে পড়ল সবাই। তারপর দে- ছুট্- , যে যার মতো পালিয়ে গেল।
এবার পরী হিনা আর আকমল একে অপরের দিকে তাকাল। পরী হিনাই প্রথম বলল, 'কিছু বুঝেছ?'
দু'পাশে মাথা দুলিয়ে আকমল তার মতামত প্রকাশ করল; কিছুই বোঝেনি সে।
'তাহলে চল ওখানে যেয়েই একবার দেখে আসি পুরো ব্যাপারটা, হয়তো ওরা বস্তায় পুরে কোন কিছু লুকিয়ে রেখে গেল ওখানটায়।' বলল পরী হিনা।
ওদের জন্য বিশাল ভারি পাথরটা আকমলের কাছে তেমন কোন বস্তু মনে হল না। খুব সহজেই সে ক'টা আঙুলের সাহায্যে গুহামুখ থেকে সরিয়ে ফেলল ওটা। তারপর আবিষ্কার করতে আর দেরি হল না মুখ বাঁধা বসত্দাটা। কিন্তু সবচে' আশ্চর্যের যে বিষয়টা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য তা হল; বস্তাটা আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা গেল ওটা অল্প অল্প নড়ছে। আকমল এতক্ষণ মনে মনে ভেবেছিল ওটার মধ্যে নিশ্চয় ধন রত্ন বোঝাই করে লুকিয়ে রেখে গেল ওরা। কিন্তু এখন নিজেই তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলল, 'মনে হচ্ছে ওটার মধ্যে জ্যানত্দ কিছু পুরে রেখে গেছে ওরা।'
পরী হিনা এবার বলল, 'অনুমান নির্ভর কোন কথা বলা ঠিক না, এখনই ওটা বের করে খুলে দেখা উচিত আমাদের।'
আকমল অতি সন্তর্পণে আলগোছে আলতো করে ধরে বসত্দাটা বাইরে বের করে আনল। তারপর ওটার মুখ খুলতেই দেখা গেল। ওটার মধ্যে অতি ছোট্ট একটা বামুন মানুষ মুখ বাঁধা, চোখ বাঁধা অবস্থায় গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। চোখ বিস্ফোরিত করে 'আশ্চর্য' বলে আকমল হিনার দিকে এক পলক তাকাল।
হিনার চোখ মুখ দেখে মনে হল এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো কোন বিষয় সে খুঁজে পায়নি। অত্যান্ত স্বাভাবিক গলায় সে বলল, 'আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, যেমন খুলেছিলে তেমনি আবার ওটার মুখ বেঁধে রেখে দাও এখন।'
কথায় আছে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়। কিন্তু বেশি আশ্চর্য হলে মানুষ কী হয় তার কোন হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। তথাপি হিনার কথা শুনে আকমলের অবস্থা যেন তাই হল। কিন্তু কোন উপায়ান্তর না দেখে হিনার কথা মতো কাজ করতে বাধ্য হল আকমল। আবার ওটার মুখ বেঁধে পূর্বের জায়গায় রেখে দিল সে।
হিনা বলল এবার, 'বেচারা এখন কষ্টের মধ্যে আছে মানছি কিন্তু এ অবস্থায় আমরা ওকে দেখা দিলে ভয়ে হয়তো সে মারাই পড়বে। কেননা ওর তুলনায় আমরা এখন বিশাল আকারের কোন দৈত্য কিংবা রাক্ষস। আগে আমাদের পরিবর্তন হতে হবে। তখন সেও আমাদের দেখে ভয় পাবে না আবার আমরাও ওর ভাষা বুঝতে পারব। আর সে পর্যন্ত থাকতে গিয়ে ওর যদি একটু কষ্ট হয়ই তাতে আমাদের কিছু করণীয় নেই। '

বিষয়টা আকমলের কাছে একটু গোলমেলে মনে হল। তবুও হিনার কথা মেনে নিতে বাধ্য হল সে। যার হাত ধরে সে এ দেশে এসেছে। তার কথামতো চলাটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে; ভাবল মনে মনে আকমল।
ইতোমধ্যে পরী হিনা জঙ্গল ঘেঁটে কতগুলো গাছ তুলে এনেছে। তারই দু'টো আকমলের হাতে দিয়ে বলল, 'এর শিকড় গুলো চিবিয়ে এর রস টুকু খেয়ে ফেল।'
আকমল মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাই করল। হিনা এবার বলল, 'এবার আমার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে বল....আমি হতে চাই আজব দেশের আজব মানুষ।'
আকমল হিনার কথামতো চোখ বন্ধ করে ফিস্ ফিস্ করে তাই বলল।
আর সঙ্গে সঙ্গে 'ভস'্ করে একটা শব্দ হয়ে যেন হঠাৎ কোন কিছু নিচে পড়ে গেল। ভয়ে আঁতকে উঠল আকমল। চোখ খুলে দেখতে পেল; সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই আছে। কিন্তু উচ্চতায় সে আগের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গেছে। হাতের মাপে মাপলে আধা হাতের কম হবে তো বেশি হবে না। আর ইঞ্চি-ফুটের স্কেলে মাপলে পৌনে এক ফুট কী তার চে' কম। কী ভাবে তার অবস্থা এমন হল সে নিজেই আঁচ করতে পারল না। ভয়ে ভয়ে এবার চারপাশে তাকিয়ে যা দেখতে পেল তাতে শুধু অবাক না রীতিমতো অক্কা পাওয়ার মতো অবস্থা হল তার। বড় মানুষ হওয়ার অহংকার তার এক মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সামান্য গুহার উচ্চতাই এখন তার মাথার উপরে। যে গাছের শিকড় চিবিয়ে সে রস খেয়েছিল সেগুলো এখনো পাশেই পড়ে আছে। কিন্তু সেগুলোর শিকড় চিবিয়ে খাওয়া দূরে থাক সেগুলোকে নড়ানো তার জন্য এখন দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিশাল বিশাল এই গাছ গুলোর উপর তার মতো দু'চার জন অনায়াসে চড়ে বসে থাকতে পারে।
আশপাশে তাকিয়ে কোথাও সে পরী হিনাকে দেখতে পেল না। মনে মনে প্রমাদ গুনল এবার সে। কিন্তু ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়েছে , যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে কোন লাভ নেই।
কেননা মামা তাকে গুহায় বন্দি করে পালিয়েছিল। তাকে শত ডেকেও কোন ফলাফল হয়নি। বরং খোদাকে ডেকে হিনাকে পেয়েছিল সে। এবার তাকে আজব দেশে ফেলে হিনাও সরে পড়ল। কিন্তু তাতে মোটেও ঘাবড়াল না আকমল। মায়ের উপদেশটা তার আবার মনে পড়ল একবার। মা তাকে বলেছিল, 'বিপদ-আপদে খোদাকে স্মরণ করো।' আকমল তাই করল।
তারপর সামনে পড়ে থাকা বস্তা বন্দি লোকটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। এখানে এখন আশপাশে আর কেউ নেই। অসহায় এই বিপন্ন লোকটিকে বাঁচানো এখন তারই কর্তব্য। কর্তব্যই বলে দেয় মানুষ কে, কোন কাজটি করা তার জন্য জরুরী। তাই আর দেরি করল না আকমল। তাড়াতাড়ি গুহার অভ্যন্তরে ঢুকে বস্তার মুখ খুলে ফেলল সে। এবার আর আকমল কে দেখে ভয় পাবে না বস্তাবন্দি মানুষটি। কেননা সে এখন তার মতোই দেখতে পুরোপুরি আজব দেশের আজব মানুষ হয়ে গেছে; আর সবচে' মজার ব্যপার, সে তার কথাও পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে এখন। সুতরাং বন্দি লোকটাকে উদ্ধার করতে পারলেই বিনা ক্লেশে একজন চমৎকার বন্ধু জুটে যাবে তার। কেননা অসহায় মানুষ সহজেই অপরের বন্ধুত্ব গ্রহণ করে। আর চাই কী, কপালে থাকলে একটা আশ্রয় জুটে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। মন্দের ভাল সবচে' বড় কথা এই আজব দেশটি সম্পর্কে অনেক কিছুই তার কাছ থেকে জানতে পারবে সে। যা তাকে ভবিষ্যতে অনেক বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। এতসব ভাবতে ভাবতেই বস্তার মুখ খুলে আগন্তুক লোকটিকে বাইরে বের করে আনল আকমল। তারপর খুব সাবধানে তার চোখ-মুখ আর হাত-পায়ের বাধন খুলে দিল। বেচারা অশীতিপর বৃদ্ধ। মুখে লম্বা দাড়ি কিন্তু সেগুলো পেকে সাদা হয়ে গেছে। মাথার চুলও শণের মতো সাদা শুভ্র। তাকে দেখে দয়া হল আকমলের। কী এমন কারণে কিংবা অকারণে এই বৃদ্ধ লোকটিকে নির্মম শাস্তি দিয়ে এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল তা বোধগম্য হল না আকমলের।
একটু পরেই লোকটা পিট পিট করে তাকাতে শুরু করল। আরও কিছু সময় কেটে গেলে লোকটা উঠে বসল। তারপর আশপাশে তাকিয়ে আকমল কে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল সে। তার হাবভাব দেখে মনে হল নিতান্ত বৃদ্ধ না হলে এতক্ষণে এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়াটা তার জন্যে বিষ্ময়ের কিছু ছিল না। পরী হিনা ঠিকই বলেছিল আগের চেহারায় যদি দেখতো লোকটা তাকে তাহলে অকপটে অক্কা পাওয়াটাও বিচিত্র কিছু ছিল না তার পৰে। মনে মনে ভাবল একবার আকমল।
দু'জন দু'জনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে থাকার পর বৃদ্ধ লোকটা বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে বলল, 'তুমি কে বাবা? কী তোমার পরিচয়?'
তার কথা পরিষ্কার বুঝল আকমল। মনে মনে একরকম স্বস্তি অনুভব করল সে। নূতন কোন অচেনা জায়াগায় ভাষা না বোঝা সবচে' বড় সমস্যা মানুষের জন্য। ভাষা আয়ত্বে আসা মানে ষোল আনার অর্ধেকটাই আয়ত্বে চলে আসা। আকমলের এখন আজব দেশের ষোল আনার আট আনাই আয়ত্বে চলে এসেছে। অনায়াস লব্ধ কোন কিছু পেলে কার না আনন্দ হয়।
মুচকি হেসে আকমল বলল, 'আমি আকমল। তবে আমাকে তুমি নাম পরিচয়ে চিনতে পারবে না। আমি অচেনা দেশের অজানা মানুষ। শুধু এতটুকুই জেনে রাখ আমি তোমার ভাল ছাড়া কোন ক্ষতি করব না।'
হাবভাবে বোঝা গেল বৃদ্ধ লোকটি তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি। তবে আকমলের কথায় তার মনের ভয়টা যে কেটে গেছে তা চেহারা দেখেই বেশ বোঝা গেল। এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেল বৃদ্ধ লোকটার আকমলের ভাষা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়নি। যে যার ভাষায় কথা বললেও উভয় পক্ষ যে বুঝতে পারছে এটাই বা কম কী? মনে মনে ভাবল আকমল।
একটু থেমে আকমল বলল, 'কিন্তু আমি তো ভেবে অবাক হচ্ছি তোমার এমন অবস্থা হওয়ার পিছনে কারণ কী? নিশ্চয় ওরা তোমাকে মেরে ফেলার জন্যই এমন ভাবে বন্দি করেছিল।'
আকমলের কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটা এবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। একটা আড়মোড়া ভেঙে চোখ দুটোর পাতা বার কয়েক পিট পিট করে নিয়ে বলল, 'তুমি ঠিকই বলেছ নওজোয়ান ছেলে। তবে সময় মতো তুমি চলে না এলে এতক্ষণে আমি বসত্দা বন্দি হয়ে মরে পড়ে থাকতুম। সবই খোদার ইচ্ছা ।'
তারপর একটা ছোটখাটো হাই তুলে নিয়ে আবার বলল, 'তবে তুমি যেই হও না কেন, এ দেশে বেশিক্ষণ থেক না যেন। বড়ই দুষ্ট লোকের দেশ এটা। বয়সটা তো আর আন্দাজ কম হয়নি আমার। আট মাস পেরুল প্রায়। এই দুই পোড়া চোখে সবই দেখতে হল আরও কত দেখতে হবে খোদাই জানে। '
আকমল এবার সত্যিই অবাক হল। চুল দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে বুড়োটার। তিন কাল কেটে গিয়ে কোথায় এক কালে ঠেকেছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে আর বয়স বিবেচনায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় নিঃসন্দেহে তার বয়স আশি বছরের বেশি হবে তো কম না। আর সে বলে কিনা বয়স তার মাত্র আট মাস পেরিয়েছে কেবল। এর একটা বিহিত করতেই হবে....মনে মনে ভাবল এবার আকমল।
কিন্তু এখন ওসব গোলমেলে কথার মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতে নূতন এসেছে সে এই দেশে। অচেনা অজানা জায়গা, জীবনে যার নামও শোনেনি কোনদিন। এর উপর মৃত্যু পথযাত্রী নূতন পরিচয় হওয়া বুড়ো। এমনও তো হতে পারে বুড়ো মানুষ, হয়তো মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। বয়সটা তার আশি বছর পেরুলেও বেমালুম ভুলে গিয়ে বলছে কিনা আট মাস। সে যাই হোক, তর্কের মধ্যে মোটেও যাওয়া যাবে না এখন। এই নিয়মটা সে পরী হিনার কাছ থেকেই শিখেছে। এই পৃথিবীটা এতই বিচিত্র যে এখানে তর্কে জড়ানোটা মোটেও বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়। বোকারাই তাতে জড়িয়ে শুধু শুধু বিপদ ডেকে আনে। তা ছাড়া কথায় আছে 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।'
পুরো বিষয়টা ষোলআনা চেপে গিয়ে আকমল এবার বলল, 'পরী হিনা আমাকে বলেছিল এটা নাকি বোকাদের দেশ, আর তাই বোকাদের দেশ দেখতেই আমার এই দেশে আসা...কিন্তু তুমি এখন বলছ এরা বড়ই দুষ্ট। বোকা লোকেরা কখনো দুষ্ট হয়না বরং চালাক লোকেরাই দুষ্ট হয়।'

ঘোলা চোখ পাকিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বুড়ো লোকটা আকমলের দিকে। তারপর সন্দেহের তীর আকমলের চোখের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, 'পরী হিনা? সে আবার কে?'
'ও--, আমারই ভুল হয়েছে। তাকে তুমি চিনবে না। বেশিদূর কী, তাকে আমিই চিনতাম না। তোমার মতো আমিও এক গুহায় বন্দি হয়ে পড়েছিলাম, সেখান থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। তারপর তার হাত ধরেই এ দেশে এসেছি আমি।' গড় গড় করে বলে গেল আকমল।
আকমল ভেবেছিল বেফাঁস মুখ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া কথা 'পরী হিনা'র মোটামুটি একটা সমাধান বোধহয় বুড়োর কাছে সে দিতে পেরেছে । কিন্তু কথাটা শোনার পর মনে হল আকমলের কথায় বুড়োটা মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ঘোর সন্দেহবাদী-দের মতোই সে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে বলল, 'শোন বাছা, ছেলে পেলে মানুষ তুমি। ক'মাস আর বয়স হয়েছে তোমার। বয়সটা তো আর কম হয়নি আমার; আট মাস পেরম্নল প্রায়। বেশিদিন হয়তো আর বাঁচব না, তবে তোমাকে একটা উপদেশ দিয়ে যাই, ওসব পরী-টরীদের কথা কখনো বিশ্বাস করোনা। ওরা সাধারণত দুষ্ট হয়। এই দেশের মানুষের মতো চালাক মানুষ আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। চালাকিতে বুদ্ধিতে এরাই সবার চেয়ে সেরা, বোকা হবে কেন এরা? পরীর কথা ষোলআনা মিছে, শুনে রাখ কথাটা।'
আকমল মনে মনে ভাবল, 'এই ফোকলা দাঁতের বুড়োটার জ্ঞান বুদ্ধি তো ভালই আছে দেখা যায় তবে তার কথা মোটেও বিশ্বাস করা যাবে না। আটমাসে সাধারণত মানুষের দাঁতই ওঠে না, আর সেখানে কিনা ওর ওঠা দাঁত আবার সব পড়েও গেছে। বয়সটা আন্দাজ আশি বছরই হবে তার। অথচ বলছে কিনা আট মাস বয়স তার। দিন দুপুরে মিথ্যে কথা ; পরী হিনার কথাই সত্যি, এরা চালাক না বরং নিরেট বোকা। চোখে মুখে ডাহা মিথ্যে কথা সাধারণত বোকারাই বলে। তবে এর সাথে বেশি কথা বলে তর্কে না জড়ানোই ভাল।'


মিথ্যাবাদী নিজেকে চালাক মনে করে, তার ধারণা সে ছাড়া আর কেউ বুঝি সত্যটা জানে না। অথচ মনের আয়নায় সে যদি একবার তার নিজের চেহারাটা দেখতে পেত তাহলেই জানতে পারত সবচে' বোকা সে নিজেই। অপরদিকে যাচাই বাছাই না করেই যে সত্য কে মিথ্যা মনে করে সেই বোকাদের রাজা। বাকি মিথ্যুকরা তারই প্রজা।

( আজব দেশের বাকি রহস্য জানতে যারা আগ্রহী তারা পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকুন।)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মুহাম্মাদ মিজানুর রহমান অপেক্ষা.....আর অপেক্ষায় থাকলাম......পরবর্তী সংখ্যার জন্য......
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না মিজান ভাই , এখনি পড়ুন.....
sakil এবার গল্পে আসতে অনেক দেরী হল . তবে আজ সকালটা বেশি ভালো কাটল আপনার লেখার তো ভক্ত হয়ে গেছি তাই ভালো লাগে বললে ভুল হবে , বলতে হবে মুগ্ধ হই . শুভকামনা রইলো চিরন্তন
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
অসুবিধে নেই আমার উত্তর দিতেও কিন্তু একটু দেরি..ই হলো .....শুভ কামনা রইল আপনার জন্যও...
মোঃ আক্তারুজ্জামান সবার সাথে আমিও আগামী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম|
ভালো লাগেনি ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
অপেক্ষার বুঝি এবার অবসান হলো.......
ফাতেমা প্রমি চমৎকার লেখনী, কাহিনী.........আর আমিও রূপকথা পছন্দ করি। পরী হিনার ভক্তদের আগামী পর্বের জন্য অপেক্ষা না করে আর উপায় কি!
ভালো লাগেনি ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় দুঃখিত....ভাল থাকুন নিরন্তর.....( পরবর্তী পর্ব হাতের কাছেই .....চটপট পড়ে ফেলুন ..)
ঝরা ২১ কথাও নাই
ভালো লাগেনি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
ধন্যবাদ ঝরা, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ .......
তানি হক পরী হিনা আমাকে বলেছিল এটা নাকি বোকাদের দেশ, আর তাই বোকাদের দেশ দেখতেই আমার এই দেশে আসা...কিন্তু তুমি এখন বলছ এরা বড়ই দুষ্ট। বোকা লোকেরা কখনো দুষ্ট হয়না বরং চালাক লোকেরাই দুষ্ট হয়।' .......খুব ভালো লাগলো ..আকমলের জন্য সুভকামনা রইলো ,,,ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
akmoler pokho theke apnakeo suv kamona janano holo ......montobber jonno onek dhonnobad, sotot val thakun..........
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
ম্যারিনা নাসরিন সীমা হিনার ভক্ত হয়ে গেছি । পড়তে খুব ভাল লাগে । ধন্যবাদ !
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
হিনা কে নিয়ে বইও বের হযেছে এবারের বই মেলায় .... আজ থেকে তা পাবেন বইমেলার `নওরোজ সাহিত্য সম্ভার ' স্টলে........ মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ , সতত ভাল থাকুন .....
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি hoshain mosharrof vai amio legei achchi ....valo kichchur proti laine ta legei thake......jinis furay kintu laine legei thake.......valo laglo........ khub moja pelam.....dhonnobad apnake....
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
লেগে থাকলেই পাবেন .......অনেক ধন্যবাদ যতি ভাই.......ভাল থাকুন নিরন্তর ......
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
Lutful Bari Panna আপনার সিরিজটায় মজে আছি পুরোপুরি। অসাধারণ গল্প। বিষয়ের সাথে মিল রাখার জন্য ভাষার বিষয়টাও তুলে আনলেন। খুবই ভাল লিখেছেন ভাই।
ভালো লাগেনি ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
rupkotha'r golpo porar jonno apnake amar torof theke ek rash shuvechha,.....dhonnobad panna vai .....
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
বশির আহমেদ আপনার আজব দেশের রূপকথার গল্প পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম । প্রতিটি পর্বে চমক সৃষ্টিতে যে আপনি সিদ্ধ হস্ত তার প্রমান রাখছেন । ধন্যবাদ পরের পর্বের অপেক্ষায় ----।
ভালো লাগেনি ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
apnader opekha amar jonno prerona boshir vai.........
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪