দুর্গম পাহাড় ঘেরা চীনের এক ছোট্ট পল্লি। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত ছোট্ট এই পল্লিতে সব সাধারণ মানুষের বাস। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানকার অধিবাসীদের নিরাপত্তার বড়ই অভাব। তারপরও সাধারণ মানুষের অন্য কোন উপায় না থাকাতে এখানেই ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। আকমলের বাবাও ছিল তাদেরই একজন। সে ছিল এক গরিব কাঠুরিয়া। বন থেকে কাঠ কেটে এনে তা বাজারে বিক্রি করে যৎসামান্য যা আয় হতো তাই দিয়ে তার সংসারটা কোনরকমে চলে যেত। আকমলের কোন ভাই বোন ছিল না। গরিবি হালে তাদের দিনগুলো একরকম ভালই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু গরিবের অল্প সুখও বুঝি বেশিদিন কপালে সয় না। একদিন আকমলের বাবা যখন তার কাঠের বোঝা বিক্রি করে ঘরে ফিরছিল তখন বেশ সন্ধ্যা ঘোর হয়ে এসেছিল। নির্জন পাহাড়ি পথে তাকে একাকী পেয়ে ডাকাতদল আক্রমণ করে তার সর্বস্ব লুটে নিলো। আর আকমলের বাবা তার সারাদিনের পরিশ্রমলব্ধ সামান্য ক'টি টাকা বাঁচাতে যেয়ে সেখানেই তাদের হাতে প্রাণ হারাল। আকমলের মা কোন উপায় না দেখে ছেলেকে নিয়ে তার ভাইয়ের বাড়ি এসে উঠল।
কিন্তু এতটুকু সুখও আকমলের কপালে সইলো না। অল্পদিনের ব্যবধানে সে মাকেও হারাল। দু'দিনের জ্বরে তার মাও তাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেল। তবে সে মারা যাওয়ার আগে ভাইয়ের হাতে তার যৎসামান্য সম্পদ একটা গলার হার তুলে দিয়ে বলল, 'আমার কাছে এই সম্পদটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। আকমল যখন বড় হবে তখন হয়তো তার কোন কাজে লাগবে এটা।'
তারপর আকমল কে কাছে ডেকে বলল, 'বাবা, তোমাকে দেয়ার মতো আমার কাছে এখন আর কিছুই নেই তবে একটা উপদেশ দিয়ে যাই হয়তো তোমার কাজে লাগবে উপদেশটা। আর তা হল জীবনে যত বিপদই আসুক মিথ্যা কথা কখনো বলোনা যেন। আর বিপদে-আপদে ধৈর্য হারিয়ো না, খোদাকে স্মরণ করো।'
তারপর আকমলের মা চোখ মুদল আর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মা বিদায় নেওয়ার পর পিতৃ-মাতৃ-হীন আকমল বোঝা হয়ে পড়ল মামার সংসারে। মামা ছিল লোভী প্রকৃতির মানুষ। তারপর যা হওয়ার তাই হল। না জুটল তার খাওয়া না পোশাক-আসাক। পাহাড়িয়া অঞ্চলের কঠিন শীতের রাতে তাকে একটা ছেঁড়া কাঁথায় কোনরকমে রাত পোহাতে হত। সারাদিন উপোষ থেকে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে তার শরীর গেল শুকিয়ে। কিন্তু কোন উপায় না থাকায় মামার বাড়িতেই তাকে উদো- পরিশ্রম করে দিন কাটাতে হত। মামা বাড়িতে সবাই যখন খেতে বসে তখন আকমল জানালায় উঁকি দিয়ে তা দেখে দেখে ক্ষুধা মিটায় ; এ ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিল না। তার জন্য বরাদ্দ ছিল দৈনিক একটা আধপোড়া শুকনো রুটি আর এক গ্লাস পানি। কিন্তু তারপরও তার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এক শীতের মৌসুমে তার ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গেল। সেবার প্রচণ্ড শীত পড়েছিল। তার একটি মাত্র শীতের অবলম্বন ছেঁড়া কাঁথায় আর শীত কাটছিল না। পাথরের ঠাণ্ডা মেঝেয় তার ছেঁড়া কাঁথায় গুটি-শুটি মেরে শুয়ে যদি রাতের ঘুমটা একটু আসত তাও সে বেঁচে যেত। কিন্তু তাও তার কপালে জুটল না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে আর শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তার প্রাণ বায়ু প্রায় বের হওয়ার উপক্রম হল। তখন একদিন রাতের অন্ধকারে কেউ যেন তার কানে কানে বলে গেল, 'তোমার মায়ের সোনার হার জমা আছে তোমার মামার কাছে। সেটা বিক্রি করলেই তো তোমার একটা মোটা কম্বল জুটতে পারে।' আকমল মনে মনে ভাবল নিশ্চয় সে শীতের কষ্ট আর জ্বরের ঘোরে ভুল শুনেছে। কিন্তু পরের রাতেও আবার একই ঘটনা ঘটল। এভাবে পর পর আরও কয়েক রাতে...... শেষে সে মামার কাছে যেয়ে একদিন দাঁড়াল। তারপর সে তার মামাকে বলল, 'আমার মায়ের গলার হারটা বিক্রি করে যদি একটা মোটা কম্বল পাওয়া যেত তাহলেই এই শীতে আমার প্রাণটা রক্ষা পেত।'
তার কথা শুনে মামাতো আকাশ থেকে পড়ল। মনে মনে সে বলল মায়ের গলার হারটা যে আমার কাছে জমা আছে সেটা সে জানল কিভাবে; নিশ্চয় সে চুরি করে আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছে। কাজেই এর একটা বিহিত করতেই হবে। কিন্তু মুখে সে বলল, 'তাইতো তাইতো আমার যে মোটেও মনে ছিল না সে কথা। ঠিক আছে , ঠিক আছে আমি কালই তোমার হার খুঁজে বের করে রাখব।'
তারপর সে তার লোভী স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে একটা ফন্দি এঁটে ফেলল মনে মনে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে রাজ্যের বিস্ময় চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলে বলল, 'বাবা আকমল, ভারি একটা অন্যায় হয়ে গেছে যে তোমার কাছে।'
মামার মুখে এমন দরদ মাখা সুরে কথা সে এর আগে আর কখনোই শোনেনি। তাই মনে মনে যেমন অবাক হল; উপরে উপরে তেমনি খুশিও হল। সে ভাবল মামা বোধহয় আজ থেকে আবার তাকে ভাল বাসতে শুরু করেছে। তাই ভক্তিতে গদ গদ হয়ে সে বলল, 'মামা আমার কাছে আবার কিসের অন্যায়, আমি না তোমার একমাত্র ভাগিনা।'
তার কথা শুনে মামা তো খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, 'তাইতো তাইতো। আসলে হয়েছে কী শোন তাহলে।' তারপর মিছেমিছি একবার খুক খুক করে কেশে নিয়ে বলল, 'হয়েছে কী, তোমার মায়ের সোনার হারটা ভুলে আমার পকেটেই ছিল। আর এমনই বোকা আমি হারটা পকেটে নিয়েই কিনা গিয়েছিলাম হাটে। তারপর হাট থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে একেবারে ঘোর হয়ে গেল....'
ভয়ে চোখ গোল গোল করে আকমল বলল, 'তারপর মামা, কোন বিপদ হয়নি তো তোমার?'
'ওমা বিপদ হবে কেন রে, আমি না তোমার মামা? আমি বিপদে পড়ব এতই সস্তা?'
'তারপর কী হল মামা....?' উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল আকমল।
'তারপর আর কী হবে, সামনেই পড়ল একটা গুহা। আমি সেই গুহাতেই ঢুকে সেই রাতের মত আত্মগোপন করে ফেললাম নিজেকে। তখন আর পায় কে আমাকে, শুধু ডাকু কেন; ডাকুর বাপ-দাদাদের ক্ষমতা নেই সেখান থেকে আমাকে খুঁজে পায়।'
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল আকমল, 'তোমার ভয় করেনি তো মামা?'
'সে কী রে ভয় করবে কেন? আমি তোমার মামা, আমি কী এতই ভীতু? তবে হয়েছে কী জান, ঘুমের ঘোরে কখন জানি তোমার মায়ের হারটা সেই অন্ধকারে পড়ে গেছে।'
'যাঃ! তারপর কী হল?' ভারি অবাক আর হতাশ হয়ে বলল আকমল।
'তারপর আর কী হবে সেখানেই পড়ে আছে সেটা।' বড় নিশ্চিন্তেই বলল মামা।
'ও-মা, চুরি হয়ে যায়নি তো সেটা?' অবাক বিস্ময়ে কথাটা বের হয়ে গেল আকমলের মুখ দিয়ে।
'সেকি রে-, চুরি যাবে কেন ওটা? চোরের বাবার সাধ্যি আছে ওখান থেকে ওটা খুঁজে বের করে। যেখানে রেখেছিলাম এ-ই থুক্কু যেখানে পড়েছিল ঠিক সেখানেই পড়ে আছে দেখোগে...' কথাগুলো বলা শেষ করেই তার দু'পা দোলাতে শুরু করে দিল মামা।
'হার না পাওয়া গেলে আমার কম্বলের কী হবে?' অনেকটা কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল আকমল।
'আরে মরল তো দেখছি, কাল সকালে আমরা মামা আর ভাগিনা দু'জনেই একবার সেখানে যেয়ে দেখে আসব। তাহলেই সব যাবে চুকে বুকে।' কান চুলকাতে চুলকাতে বলল মামা।
পরদিন সকালে ভাগিনা আকমল কে নিয়ে বের হল তার মামা। দু'চারটে পাহাড় পেরিয়ে একটা সংকীর্ণ গিরিপথ ধরে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গেল মামা তাকে। তারপর একটা খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠল ওরা দু'জন। সেখানে একটা অন্ধকার গুহার দেখা পাওয়া গেল। মামা তখন বলল আকমলকে, 'এই যে পেয়েছি, এখানেই হারিয়েছে তোমার মায়ের গলার হার।' তারপর মশাল জ্বলিয়ে আকমলের হাতে দিয়ে বলল, 'নাও বাপু, এখনই এর ভিতরে যেয়ে ঢোক আর খুঁজে আন তোমার মায়ের গলার হার।'
তারপর একটু ইতস্তত করে আবার বলল, 'আমি না হয় একানেই দাঁড়াচ্ছি, তুমিই যাও। দেখো আবার ভয় পেয়োনা যেন।'
কী আর করা, মামার সাবধান বাণী মাথায় নিয়ে মশাল হাতে করে ঢুকে পড়ল আকমল গুহার অভ্যন্তরে। আর এদিকে মামা মনে মনে তৈরিই ছিল। আকমল গুহার অভ্যন্তরে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতেই আর দেরি করল না সে। একটা বড় পাথর গড়িয়ে এনে গুহা মুখে চাপা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল। অল্প যেটুকু ফাঁক দেখা যাচ্ছিল তাতে মুখ লাগিয়ে সে তখন চেঁচিয়ে বলল, 'তোমার মায়ের হার আর গরম কম্বল দু'টোই এখানে পাবে তুমি।' কিন্তু গুহার পাথরের খাঁজে খাঁজে ধাক্কা খেয়ে কথা গুলো আবার তার কাছেই ফিরে এলো, আকমল আর শুনতে পেল না সেসব।
তারপর মনে মনে বলল সে, 'যাক বাবা, ল্যাঠা চুকল এবার। হারের মালিক এখন আমি। আর তুমি? ওখানে; ঐ গুহার অন্ধকারে পঁচে মর হেঁ হেঁ ।' তারপর সে সোজা বাড়ি এসে শুয়ে পড়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
পরদিন আকমলের মামির কান্না শুনে প্রতিবেশীরা সবাই বুঝল আকমলকে বাঘে খেয়েছে তাই সেই শোকে সে কাঁদছে। আর এ ভাবেই সব ঝামেলা চুকিয়ে ফেলল আকমলের মামা।
এদিকে মশাল হাতে অনেকটা সময় ধরে খুঁজে আকমল শুধু হয়রানই হল। তার মায়ের গলার হার পাওয়া দুরের কথা এক টুকরো সুসুতো খুঁজে পেল না কোথাও। শেষে মশালটাই গেল নিভে। বাইরে বের হতে গিয়ে দেখল গুহা মুখে পাথর চাপা দেয়া। মনে মনে প্রমাদ গুনল সে। গুহা মুখে দাঁড়িয়ে 'মামা' বলে বার কয়েক চিৎকার দিয়েও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না মামার। বরং গুহার বিশাল গহ্বরে ধাক্কা খেয়ে তার কথাগুলোই প্রতিবিম্বিত হয়ে সে আবার শুনতে পেল। আবছা অন্ধকারে ভাল করে লৰ্য করতেই আকমল বুঝল ভারি পাথরটা খাঁজে খাঁজে আটকে আছে। ওটা এখন তার মতো জনা বার জন মিলে ধাক্কা দিলেও সহজে আর খুলবে না। তার বুঝতে আর বাকি রইল না মামা তাকে গুহার ভিতরে রেখেই সটকে পড়েছে। এখন তাহলে উপায়? এদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করতে শুরু করেছে তার।
মায়ের উপদেশ বাণী একবার মনে পড়ল তার, 'বিপদে-আপদে ধৈর্যহারা হয়ো না আর খোদাকে স্মরণ করো।' মনে মনে খোদা কে ডাকল সে। কোন উপায়ান্তর না দেখে শেষ মেশ ক্লান্ত আকমল পাথরে ঠেস দিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ কারো ডাকে তার ঘুম ভাঙল। সামনে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। এই অন্ধকার গুহায় অপূর্ব সুন্দরী এক কিশোরী বসে আছে। তার হাতে একটা প্রদীপ জ্বলছে মিটি মিটি। তারই ক্ষীণ আলোয় তাকে আরও সুন্দর দেখাতে লাগল। আকমলের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে সে। তাজ্জব হয়ে বলল আকমল, 'তুমি? তুমি কে? এই অন্ধকার গুহায় আমি ছাড়া আর কেউ তো ছিল না।'
কিশোরী মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতেই লাগল। একসময় সে হাসি থামিয়ে বলল, 'আমি হিনা।'
'হিনা? কে তুমি? তোমাকে তো চিনলাম না; কোনদিন নামও শুনিনি তোমার। আর এখানেই বা এলে কী করে?' প্রশ্নগুলো একবারে করে থামল আকমল।
'শুধু তুমি কেন, খুব কম লোকেই চেনে আমাকে। তবে খোদার ইচ্ছায় প্রত্যেক সৎ আর সত্যবাদী মানুষের পাশে আমি থাকতে চাই; সেই লৰ্য নিয়েই তোমাকে খুঁজে পেয়েছি আমি।' বলল হিনা।
'কিন্তু এখানে তো কেউ ছিল না। তা ছাড়া গুহামুখেও পাথর চাপা দিয়ে আটকানো....তাহলে তুমি.......ও হাঁ, বুঝেছি তুমি আমার আগেই ঢুকেছিলে আর আমি তা দেখিনি তাইতো? কিন্তু তাহলে এই অন্ধকার গুহায় আমাদের দু'জন কেই পঁচে মরতে হবে।' আকমল আমতা আমতা করে কথাগুলো বলল।
আকমলের নাকাল অবস্থা দেখে হিনা হেসে দিয়ে বলল, 'আসলে তুমি যে শুধু সত্যবাদী ছেলে তাই না রীতিমতো বড্ড বোকাও.....আর হবেই বা না কেন, যারা সত্যবাদী তারা একটু আধটু বোকাও হয়। যা সত্য তাই সুন্দর আর বোকামি তার অলঙ্কার।'
'তোমার হেঁয়ালি কথাবার্তা আমার এখন মোটেও ভাল লাগছে না। আমরা দু'জনই যখন এখানে আটকা পড়েছি তখন উচিত হবে এখান থেকে কী করে বের হওয়া যায় তার উপায় খুঁজে বের করা। বোকার মতো বক বক করাই এখন যত বোকামি।' এক নিশ্বাসে বলল আকমল।
আকমলের অভিমানটুকু লৰ্য করে হিনা বলল, 'ঠিক আছে বাবা মানলাম আমিই বোকা। কিন্তু ঐ ভারি পাথরটা সরানোর শক্তি যখন আমার নেই তখন শুধু শুধু ওটা নিয়ে ভেবে কী করব?'
এত বড় একটা বিপদেও হিনাকে সহজ ভাবে কৌতুক করে কথা বলতে দেখে আকমল শুধু অবাকই হল না রীতিমতো তার ভীষণ রাগও হল। কিন্তু রাগটা মনে মনে চেপে গিয়ে বলল, 'দেখ, আমার কিন্তু ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে, তোমার সাথে বাজে বক বক করার সময় এখন আমার নেই।'
আকমল কথা শেষ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে গুহা-মুখে চাপা দেয়া ভারি পাথরটার দিকে চেয়ে রইল। হিনা এবার বলল, 'এই পৃথিবীতে সবচেয়ে হতভাগা মানুষ কারা জান তুমি? যারা বিপদে ধৈর্য ধরতে পারে না আর ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে পারে না।'
আকমল আবার ফিরে তাকাল হিনার দিকে। কিছু একটা যেন সে খুঁজতে লাগল হিনার চোখে। আর হিনাও তার জবাব দিল সাথে সাথেই। সে তার হাত পাতল শুন্যে আর তাতে একটু ফুঁ দিতেই মুহূর্তের মধ্যে চলে এল এক ডালা পূর্ণ নানা রসাল খাদ্যের সমাহার। আকমল এবার সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে চেয়ে রইল হিনার দিকে। তারপর আবার জানতে চাইল , 'সত্যি করে বলতো তুমি কে?'
অস্ফুটে উচ্চারণ করল হিনা, 'আমি হিনা, পরী হিনা।'
'তুমি পরী? না, না এ আমার বিশ্বাস হয়না; আমার মতো গরিব অসহায় একটা ছেলের কাছে কোন পরী আসতে পারে না। এ মিথ্যে, সব ছলনা। হয়তো তুমি কোন দুষ্ট পরী, আমাকে কোন বিপদে ফেলতে চাও, এমনিতেই বিপদে পড়েছি আমি।' কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে থামল আকমল।
আকমলের কথা শুনে হিনা মনে ব্যথা পেল। তার দু'চোখ পানিতে টলমল করে উঠল। চোখের পানি মুছে পরী হিনা বলল, 'তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ? আমি হিনা ভাল ছাড়া কারো ক্ষতি করিনা। তবে একটা ক্ষতি হয়তো তোমার কষ্ট দেখে আমি করতে বাধ্য হয়েছি। সেটা হল তোমার শীতে কষ্ট পাওয়া দেখে তোমার মায়ের সোনার হারের কথা তোমাকে জানিয়েছি আমিই। আর সে কারনেই হয়তো তুমি এখন এই গুহার অন্ধকারে বন্দি।'
হিনার কথা শুনে আকমল বলল, 'তুমিই যদি তা জানিয়ে থাক তাহলে তুমি দুষ্ট পরী না তুমি ভাল পরী। আর আমি এখানে বন্দি হয়েছি আমারই বোকামিপনার জন্য। তবে তা আমার জন্য ভালই হয়েছে কেননা অমন লোভি মামার হাতে বান্দি থাকার চাইতে অন্ধকার এই কারাগার আমার জন্য অনেক নিরাপদ।'
'তুমি ভুল বললে আকমল। তোমার বোকামির জন্য নয়, বল তোমার সততাই তোমাকে নিয়ে এসেছে এই অন্ধকার গুহার বদ্ধ কারাগারে।' বলল হিনা।
'কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমি বোকা বলেই আজ আমার এই পরিণতি।' অনেকটা হতাশ হয়ে বলল আকমল।
'আমার নাম হিনা, আমি তর্ক মোটেও ভালবাসিনা। যদি তুমি দেখতেই চাও সত্যিকারের বোকা কে তাহলে তোমাকে এক্ষুণি আমি নিয়ে যেতে পারি বোকাদের দেশে। যাবে তুমি সেখানে?'- বলল পরী হিনা।
আকমল মনে মনে ভাবল এই সুযোগে যদি গুহা থেকে বের হওয়া যায় তাহলে মন্দ কী? সাত পাঁচ না ভেবেই চটজলদি পরী হিনার কথায় রাজি হয়ে গেল আকমল।
পরী হিনা তাকে তখন বলল, 'তাহলে তোমার জন্য নিয়ে আসা খাবার গুলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তারপর একবার শুধু চোখ বন্ধ করে বলতে হবে, আমি যেতে চাই আজব দেশে।'
গুহার এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে মন্ত্র-মুগ্ধের মতো আকমল তাই করল। খাওয়া শেষ করে একবার শুধু চোখ বন্ধ করে বলল, "আমি যেতে চাই আজব দেশে-"
তারপর পরী হিনার নির্দেশ মতো চোখ খুলল আকমল। চোখ খুলে যা দেখতে পেল তাতে আকাশ থেকে পড়ল বললে একান্তই ভুলই হবে। বলতে গেলে নিদেনপক্ষে বলতে হবে রীতিমতো পাতাল ফুড়ে আকাশে উঠল। একেবারেই তাজ্জব হয়ে গেল সে। কোথায় গুহা আর কোথায় বা গুহার অন্ধকারের বন্দি জীবন। এক নিমিষে সব হাওয়া।
অপূর্ব এক দেশে ওরা উপস্থিত হল। এমন দেশ এর আগে আর কখনো দেখেনি আকমল। শুধু দেখেনি বললে কমই বলা হবে। সোজাসাপ্টা বলা উচিত এমন দেশও যে আছে কোথাও, তার নাম নিশানা তো শোনেই নি; বরং ঘুণাক্ষরে কোনদিন কল্পনাও করেনি সে। অবাক হয়ে সে ভাবতে লাগল এমন দেশ যে আছে তা সে এতদিন জানতোই না।
কথায় আছে সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্য থাকলে কী না হয়, চাই পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়ও আনা যায়। ধৈর্য যার নেই, সে যেন নিজেকে একাকী একটা বদ্ধ ঘরে বন্দি করে রেখেছে; যেন অসহায় অবস্থায় অভিশপ্ত রাজপ্রাসাদের এক বন্দি রাজকুমার সে। যার রাজপ্রাসাদ আছে, রাজত্বও আছে; প্রজারা অপেক্ষায় আছে দেশের ভবিষ্যৎ রাজা হিসাবে তাকে বরণ করে নিতে.....অথচ দুর্ভাগ্য তার। সে নিজেই জানে না সে-ই সে দেশের ভবিষ্যৎ রাজা। তাই ধৈর্যহীন একজন নিঃসঙ্গ, অসন্তুষ্ট আর অসহায় রাজা হওয়ার চাইতে ধৈর্যশীল ও নিজের উপর সন্তুষ্ট গরিব কৃষক হওয়াও অনেক ভাল।
( অবাক করা আজব দেশটিতে যারা যেতে ইচ্ছুক তার পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকুন। )