নবজন্ম

মা (মে ২০১১)

fahmida farjana
  • ১৯
  • 0
  • ১৩
গত বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে কিছু কিছু লক্ষণ অনুভব করা শুরু করলাম। আমাদের দুজনের মনে তখন একটু একটু আশার সৃষ্টি হলো, হয়ত এ লক্ষণগুলো নতুন কারো আগমনী বার্তা নিয়ে আসছে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমরা নিশ্চিত হলাম, সে আসছে। আমাদের দুজনের টোনা টুনির সংসার আর দুজনের থাকছে না। অন্য একজন আসছে তাতে ভাগ বসাতে। অন্যরকম এক ভালোলাগার সৃষ্টি হলো।

একদিকে সময়ের সাথে সাথে শারীরিক নানা সমস্যা বাড়তে লাগল। আর সেই সাথে বাড়তে থাকল আমার প্রতি ওর বাবার যত্নের পরিমাণ। সারাক্ষণ সে আমাকে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে লাগল, যেটুকু কষ্ট একান্তই আমার তা তো সে লাঘব করতে পারবেনা। এছাড়া বাকি সব দায়িত্ব তার- রান্না করা, ঘর গোছানো, বাইরের সব কাজ- সব কিছু।

নানা জটিলতা নিয়ে অফিস করতে করতে হঠাৎ করে বেশি অসুস্থ হওয়ায় এক সকালে সিদ্ধান্ত নিলাম, কয়েকদিন ছুটি কাটাবো। ১১ দিন ছুটি কাটিয়ে বাসায় বসে অনলাইনে কাজ শুরু করলাম। আর টাইম মতো খাওয়া দাওয়া, ঠিকভাবে চলাফেরা করা, পর্যাপ্ত রেস্ট নেওয়া, ডাক্তারের কাছে যাওয়া- সব বিষয়েই তার খেয়াল। মাঝে মাঝে আমি একটু নিয়মের বাইরে যেতে চাইলেও সে আমাকে নিয়মের মধ্যে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝাত।

বাসায় বসে অফিসের কাজ, গর্ভের সন্তানের চিন্তা, শারীরিক নানা সমস্যা, বিশেষ দিনটি আসতে আর কতদিন বাকি তার হিসাব--এভাবেই কাটছিল দিনগুলো। আর শুরুতেই দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শেষের দিকে বাড়ি চলে যাব। সেখানেই জন্ম নেবে আমাদের সন্তান। সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটা নিলেও খুব খারাপ লাগছিলো নিজের সংসার ছেড়ে চলে যেতে।

আস্তে আস্তে চারটা মাস কেটে গেল। পাঁচ মাসে গিয়ে আমার সোনামণির নড়াচড়া অনুভব করার তীব্রতা বেড়ে গেল। কিন্তু প্রথমদিকের নড়াচড়া কেমন হয় তাতো জানতাম না। তাই ঠিক বুঝতে পারতাম না, নড়ছে কিনা। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বললেন, প্রথম বেবির ক্ষেত্রে সাধারণত ৬মাস থেকে বোঝা যায়। ওনাকে বললাম, আমি হার্ট বিট শুনতে চাই। বললেন, আর কিছুদিন যাক, তারপর আপনাকে শোনাব।

৬ মাস থেকে একটু একটু নড়াচড়া বুঝতে পারলাম। কি যে আনন্দ! ওর বাবাকেও দেখাতাম। এটা যে কত আনন্দের তা বোঝানো সম্ভব নয়।

আস্তে আস্তে নিজের অদেখা সন্তানের প্রতি তীব্র মায়া বাড়তে থাকলো। খুব মনে হতো- ও কি ছেলে না মেয়ে, দেখতে কেমন হয়েছে?

সুযোগ গেলেই ওর জন্য সুন্দর নাম খুঁজতাম। কখনও আমি একা, কখনও ওর বাবা সহ।

সাত মাসে গিয়ে হঠাৎ এক সকালে পেটে তীব্র ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি নড়াচড়া করতে পারছিনা আর মনে হচ্ছে আমার পেট এ মুহূর্তে ফেটে যাবে। আমার মনে হচ্ছিলো, এটাই বুঝি সেই ব্যথা। তীব্র ব্যথায় চোখের পানি আটকাতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন। উনি বললেন, পুরো রেস্টে থাকতে।

সাত মাসে গিয়ে হঠাৎ এক দিন খেয়াল করলাম, আমার সোনামণি তেমন নড়ছে না। পরদিন সকালে উঠে বুঝলাম সারা রাতেও তেমন নড়েনি। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন দেওয়াতে উনি বললেন, তখনই যেন ক্লিনিকে ভর্তি হই। একথা শুনেই অজানা এক আশঙ্কায় কেঁদে ফেললাম। তারপর ক্লিনিকে ভর্তি হলাম, সাথে সাথে অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়া হলো। আমি কিছুতেই আর কান্না আটকাতে পারছিলামনা। এর কিছুক্ষণ পর তার নড়াচড়া টের পেলাম। সারাদিন সব কিছু ঠিক থাকায় রাতে বাসায় চলে এলাম।

এর এক সপ্তাহ পর এলো সেই দিনটি-বাড়ি যাওয়ার। যাওয়ার কয়েকদিন আগ থেকেই খুব খারাপ লাগছিলো। একে তো এ মুহূর্তে আমি তাকে ছেড়ে থাকতে চাইনা। আমি চাইতাম, পুরো ৯টা মাস আমার পাশে যেন আমার সন্তানের বাবা থাকে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিলোনা।

দ্বিতীয়ত বার বার মনে হচ্ছিলো আমি হয়ত আর এখানে ফেরত আসতে পারবনা।

তারপরও যেতে হলো।

বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। ১৫ দিন পর পর সে যেত বাড়িতে। এটা এক অপেক্ষা। আর কবে আমার সন্তানের মুখ দেখব- তার জন্য আর এক অপেক্ষা। আস্তে আস্তে তার নড়াচড়া আরো ভালোভাবে বোঝা শুরু করলাম। আর বুঝতাম সে পা বা হাত দিয়ে আমার পেটে ঠেলা দিচ্ছে। খুবই ভালো লাগত।

আস্তে আস্তে শরীর আরো ভারী হয়ে যাচ্ছিলো। খুব বেশিক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না। রাত ২/৩ টা পর্যন্ত একা জেগে থাকতাম। বালিশে মাথা দিলে খুব কষ্ট হতো, তাই বালিশ উঁচু করে হেলান দিয়ে থাকতাম। এক পাশে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকলে মনে হত পেটের মধ্যে ওর চাপা লাগছে কিনা। তখন অন্য পাশ ফিরতাম। আর মনে হতো, ও পৃথিবীতে এলেই বুঝি আমার কষ্টগুলো শেষ হবে।

এরইমাঝে একদিন কিছু সমস্যা নিয়ে আবারো ক্লিনিকে ভর্তি হলাম। তবে সব ঠিক হওয়ায় পরদিন বাসায় চলে এলাম।

তারপর নির্ধারিত সময়ের নয়দিন আগে একদিন সকালে সোনামণির আগমনী বার্তা পেলাম। সেই রাতে ৪টার দিকে ঘুমায়ে ঠিক সকাল সাতটার দিকে কিছু লক্ষণ নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝতে পারলাম, আমাদের সোনামণি আসছে। সে মুহূর্তে তার বাবা পাশে ছিলোনা। ফোনে আমাকে জানালো, কোনো চিন্তা করো না। ডাক্তার যা ভালো মনে করে করতে বলো। আর আমি আসছি।

সাথে সাথে হাসপাতালে চলে গেলাম। আস্তে আস্তে কষ্টের মাত্রা বাড়তে থাকলো। আরো নানা লক্ষণ দেখা গেল। ডাক্তার বললো, আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। সব কিছু ঠিক আছে। কিছুক্ষণ পাপরই ডাক্তার আসছে, দেখছে। সব কিছু কেমন যেন লাগছিলো।

এরপর ঠিক ১২টায় ডাক্তার জানালো, সিজার করতে হবে। একথা শুনেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা। এতক্ষণ ধরে কষ্ট হলেও কাঁদিনি। অথচ সে মুহূর্তে কেঁদে ফেললাম। ওর বাবা তখন বাসে। তাকে জানানো হলো। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো, ওর বাবা যদি এ মুহূর্তে আমার পাশে থাকত! আমি পুরো ৯টা মাসই চেয়েছি এ মুহূর্তে ও যেন পাশে থাকে কিন্তু হলোনা। আর মনে হচ্ছিলো ও যদি এখন আমার সাথে একটু ফোনে কথা বলত! কিন্তু তখন আমার কি অবস্থা তা বুঝতে না পারায় সে আমাকে কল দেয়নি।

ঠিক ১২:৩০ টায় আমাকে ওটিতে নেওয়া হলো। কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিলো আমার। জীবনে কখনও ওটিতে ঢুকতে হবে- চিন্তাও করিনি। যাই হোক, পৌনে একটায় অপারেশন শুরু হলো। মাথার পাশে আমার বড় ভাই (হাসপাতালের ডাক্তার)। ডাক্তাররা আমার সাথে বিভিন্ন কথা বলছিলো। আমার কেমন যেন খারাপ লাগছিলো। আর পিপাসায় গলা শুকায়ে যাচ্ছিলো। আর বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম, অপারেশনে কখন শেষ হবে?

যাই হোক, একটা সময় অনুভব করলাম, পিপাসা প্রচণ্ড বেড়েছে। আমার ভাই জোরো জোরে নিশ্বাস নিতে বলল। আর জানালো, এখনই বেবিকে বের করবে। সে আমার পাশে মোবাইল ধরল, বলল টাইম দেখ।

ঠিক দুপুর একটায় আমি আমার বেবির কান্না শুনলাম। ভাইয়া বলল, ছেলে হয়েছে। ডাক্তার সুর করে গেয়ে উঠলেন- হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। এরপর তিনি আমার গালের সাথে ছেলের গাল ঠেকায়ে তাকে সরিয়ে ফেললেন। আর সেই মুহূর্তে আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে যাচ্ছিলো। কিছুতেই আটকাতে পারছিলাম না। আর আমি মা হয়ে গেলাম। আমার নব জন্ম হলো।

দেড়টার দিকে আমাকে ওটি থেকে বেডে নেওয়া হলো। এর কয়েক মিনিট পরেই ছেলের বাবা এসে পেঁৗছালো। দেখলাম ও এসে ছেলেকে দেখছে। তারপর আমার কাছে এসে বলল, কনগ্র্যাচুলেশন। কিন্তু আমার তখন আনন্দ, কষ্ট কোনো অনুভূতিই হচ্ছিলোনা। একটু পর কাপড়ে মোড়ানো ছেলেকে কাছ থেকে দেখলাম। এরপরই লম্বা ঘুম।

পরদিন ছেলেকে প্রথম ঠিকমতো কোলে নিলাম। কি যে এক অন্যরকম অনুভূতি! ছোট্ট মানুষ, ছোট্ট মুখ, সবাই বলছিলো দেখতে একদম বাবার মতো।

ওর জন্মের মুহূর্ত থেকে আমার পুরো লাইফটাই পরিবর্তন হয়ে গেল। ওর সাথে রাত জাগা, ওকে খাওয়ানো, ওকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানো- কত কিছু করতে হয়। চোখের সামনে ওর কত পরিবর্তনও দেখছি। প্রথমদিকে যেভাবে শুয়ে রাখতাম সেভাবেই থাকত। আস্তে আস্তে সে পাশ ফিরে শোয়া শিখল। একদিন দেখলাম সে উপুড় হচ্ছে। আর এখন সে বসতে পারে। আমরা (ওর নতুন বাবা মা) খুব উপভোগ করি সব কিছু।

দুজনেই চাকরি করি, ওর জন্য রাত জাগি, ওকে সময় দেই, সংসারও সামলাই দুজনে। কোনো কোনো দিন খুব কষ্টও হয়ে যায়। তারপরও যখন ও আমাকে দেখে লাফ দিয়ে কোলে চলে আসে বা খিল খিল করে হেসে ওঠে, তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। আর মনে হয়, এটাই হলো মা হওয়ার সার্থকতা। এখানেই সব সুখ। এখানেই সব পূর্ণতা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Akther Hossain (আকাশ) অনেক অনেক ভালো তবে আমি অনেক দেরীতে পরেসী
বিন আরফান. গল্পের শুরুটা আরো একটু আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে করলে বেশি ভালো হত. এছাড়া চমত্কার. সালাম মা জাতিকে , লাখো সালাম. চালিয়ে যান. শুভ কামনা রইল.
আহমেদ সাবের আপনার রোজনামচা পড়ে ভালই লাগলো। এতো আমাদের সকলের অভিজ্ঞতার গল্প। আপনাদের আনন্দ কাহিনী সবার সাথে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
সূর্য শুভকামনা প্রথমেই। সাবলীল লেখা। যেন পুরো ঘটনাটার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হয়েছিলাম পুরোটা সময়। এই লেখাটায় আমি যা কখনও করিনা তাই করলাম। অসাধারণে ভোট করলাম। কারণটাও বলে দেই> (বিশেষ ধণ্যবাদ sakib কে। সেই আমার সব কিছুর সঙ্গী, আমার ছেলের বাবা। যেকোন বিষয়েই, যেকোন কাজে যার সহযোগিতার কথা আমি কখনই লিখে শেষ করতে পারবনা।) এই ভালবাসাটার কারণেই হা হা হা হা হা
এফ, আই , জুয়েল প্রকৃতির ইশারা হলো--- "মা"-হতে পারা সহজ । কিন্তু একজন ভালো মা হতে পারার মধ্যেই সার্থকতা নিহিত ।।
ফাতেমা প্রমি চমত্কার গল্প...আপু আপনি কি নিজের ঘটনাই লিখেছেন? অনেক বাস্তব গল্প... বেশ ভালো লেগেছে..
এস, এম, ফজলুল হাসান ভালো লাগলো গল্পটি , ধন্যবাদ আপনাকে
fahmida farjana মন্তব্য করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। বিশেষ ধণ্যবাদ sakib কে। সেই আমার সব কিছুর সঙ্গী, আমার ছেলের বাবা। যেকোন বিষয়েই, যেকোন কাজে যার সহযোগিতার কথা আমি কখনই লিখে শেষ করতে পারবনা।

২৩ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪