হ্যাকিং গোল্ডওয়েজ

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

নাজমুল হাসান নিরো
  • ১৪
গেটিং মিশন
দারোয়ানকে আগে থেকেই বলা ছিল। আমরা পরিচয় দিতেই দ্রুত গেট খুলে দিল। শৈল্পিক নকশার কারুকাজ করা লোহার দরজা পেরিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ডেনিশদের ধাঁচে তৈরি করা খয়েরি আর ছাই রঙা বেশ বড় আকারের কটেজ বাড়িটা। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত চওড়া পায়ে হাঁটা পথ। পথের দু’ দিকেই অনেক খোলামেলা জায়গা। এক পাশটা উঁচু-নিচু ঘাসের লন দিয়ে সাজানো। লনের ধার ঘেঁষে একটা বকুল গাছ প্রাকৃতিক শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। গাছের ঠিক নিচে একটা বড়সড় দোলনা ঝুলছে। বাড়িটার মালিক ভদ্রলোক যে যথেষ্ট সুরুচি-সম্পন্ন আর উৎফুল্ল মনের অধিকারী, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের অনুমানে অবশ্য কিছুটা ঘাটতি পড়ে গিয়েছিল। বাড়ির কর্তা কিছুটা ব্যতিক্রম রুচির ধারকও বটে। পায়ে হাঁটা পথটার অন্য পাশটা ভর্তি যতসব ঔষধি গাছ দিয়ে। কুড়চি, অশ্বগন্ধা, হিমটক, বাসক, অর্জুন, দাড়িম, বনজমানী, ভীমরাজ আরো নাম না জানা কত কী! এর মাঝে কতগুলো তো আবার একেবারেই ভারতীয়। সবগুলো গাছের গোড়ায় বড় বড় টব।
হরতন দা বলল, ‘গাছের গোড়ায় টবগুলোর মানে বুঝেছিস?’
‘কেন মাটি?’
‘নিচে মাটি থাকতে আবার টব কেন?’
‘তাহলে?’
‘ইন্ডিয়ান মাটি।’
এপাশের বাগানটা আবার পার্টিশন করা। পার্টিশনের অন্য ভাগটা দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! চবিবশ শ প্রজাতির ক্যাকটাসের সবগুলোই বোধ হয় আছে এখানে। আর দু’চারটার কি সাইজ মাইরি! একেবারে মানুষ সমান। ওগুলোর দাম কম করে হলেও টাকায় লাখ দুয়েক হবে। কতগুলো বিষাক্ত প্রজাতির ক্যাকটাসও চোখে পড়ল। আমার জীবনে কখনো ক্যাকটাসের এত বড় কালেকশন দেখি নি। হরতন দা’কেও বেশ খুশি মনে হলো। দাদার ছোটবেলা থেকেই ক্যাকটাসের প্রতি বেশ দুর্বলতা আছে বলে জানি।
আমরা বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি।
‘বুঝলি রে পাকুল, এবার মনে হয় আমরা পারিবারিক কোনো ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছি।’
‘চারদিকে এলোমেলো আর অগোছালো ভাব দেখে বলছ?’
‘তোর বুদ্ধিটায় তো বেশ পাক ধরেছেরে পাকুল!’

ড্রয়িং রুমে টানা দশ মিনিট বসে থাকার পর ভদ্রলোক মহোদয় এলেন। বয়স অনুমান চল্লিশের কাছাকাছি হবে। বেশ সৌজন্যতা দেখালেন। বোধহয় পরখ করতে চাইছেন, ভুল লোককে ডেকেছেন কিনা! খানিকটা কেশে আমাদের উপর পালাক্রমে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে হরতন কে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
হরতন দা আমাদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আপনার প্রবলেমের যে লিস্টটা তৈরি করছিলেন এতক্ষণ, সেটা কিন্তু এখন আনতে পারেন।’
প্রথম ধাক্কাতেই ভদ্রলোকের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল! খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য! আমি এতক্ষণ প্রবলেমগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলাম তা বুঝলেন কী করে?’
‘সহজ হিসাব, আপনার হাতে এখনো কলমটা ধরেই আছেন।’
তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
‘আর ঠিক এই মুহূর্তে, যখন আমাদের আসার কথা, তখন আপনি কলম দিয়ে কি কাজটাই করবেন তা অনুমান করে নেয়াই যায়।’
‘অদ্ভুত, অদ্ভুত!’ লোকটা নীচুস্বরে খানিকটা স্বগতোক্তি করল।
‘তাহলে কি আমরা এখন বসতে পারি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয় নিশ্চয়। আপনারা বসুন প্লিজ।’
‘আপনার সেই লিস্টটা কি এখন নিয়ে আসবেন?’
‘ওটার মনে হয় আর দরকার হবে না, সব প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।’
আমরা বসলাম। উনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন, ‘বলুন কোনটা চলবে, গরু নাকি ছাগল?’
‘মানে বলতে চাইছেন চায়ের সাথে কোনটা চলবে গরুর নাকি ছাগলের দুধ, এই তো?’
‘বাহ্, আপনি তো বেশ ইন্টেলিজেন্ট! বিশ্বাস করুন, বাসায় নতুন কেউ এলেই আমি এই প্রশ্নটা মজা করেই করি। কিন্তু এর আগে প্রথম বারেই কেউ এটা বুঝতে পারে নি। সবাই ভেবে নেয় মাংসের কথা বলছি। দুধগুলো পূবাইল থেকে আসে দুই দিন পর পর। খেয়ে দেখুন, তৃপ্তি পাবেন।’
‘তাই নাকি?’
‘তাহলে কোনটা দিতে বলব?’
‘ছাগলটাই দিতে বলুন, ওটা এর আগে খাওয়া হয় নি।’
ভদ্রলোক হেঁড়ে গলায় ছাগলের দুধের চায়ের অর্ডার দিতে দিতে চলে গেল ভেতরে। আমি একটা ঢোক গিললাম। জিনিসটার গা থেকেই যে হারে গন্ধ বের হয়! দুধ খেতে কেমন লাগে আল্লাহই মালুম!
একটু পরেই এলো চা-নাস্তা। ছাগলের দুধের চা খেতে খুব একটা খারাপ না, সেটা বুঝলাম। শুধু কেমন যেন গন্ধ লাগে একটু। অবশ্য এটা অবচেতন মনের ভয় থেকে কিনা, কে জানে? ভদ্রলোক চা- নাস্তা নিয়ে আসা কাজের ছেলেটাকে কিছু আনতে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। আপাতত বাড়ি ফাঁকা। আমরা জেঁকে বসলাম।
‘আচ্ছা এবার বলতে শুরু করুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না’ বলতে বলতে হরতন দা শরীরটা এলিয়ে দিলো।
‘দেখুন আমি ব্যবসায়ী মানুষ, অত বেশি প্যাঁচানো ভালো লাগে না। আমি প্রধান বিষয়গুলো বলব, যা যা দরকার আপনি এরপর জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বলতে শুরু করুন।’
‘আমার সমস্যাটা একেবারেই পারিবারিক। আমার স্ত্রীকে নিয়ে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা পারিবারিক এবং সেনসেটিভ। সে কারনে চারদিক থেকে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।’
‘সেগুলো নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না, আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
‘আজকে ও গেছে ওর বাবার ওখানে বেড়াতে। এই সুযোগে আপনাদের ডেকেছি।’
‘বলে যান।’
‘আমরা বিয়ে করেছি ছয় বছর হলো। আমাদের চার বছরের একটা মেয়েও আছে। এতদিন কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যটা শুরু হয়েছে মাস চারেক আগে থেকে। মাস চারেক আগে ওর এক বন্ধু আসে অষ্ট্রেলিয়া থেকে। সমস্যাটা সেখান থেকেই শুরু। ও ওর বন্ধুর ব্যাপারে আমাকে কিছু জানায় নি। আমি খবর পাই ওরা গোপনে দেখা করছে। আমি নিজে একদিন ওদেরকে ফলো করেছি। ব্যাপারটা সত্যি। ...এবং এরপর যা জানতে পেরেছি, তা হলো ওরা আমার অগোচরে নিয়মিত মেলামেশা করছে। আরো মারাত্মক ব্যাপার হলো ওরা নাকি একসাথে অষ্ট্রেলিয়া পাড়ি জমানোর পরিকল্পনাও করছে!’
‘................’
‘আপনার কাজটা খুব ছোট না হলেও খুব বেশি বড়ও নয়। বুঝতেই পারছেন, আলটিমেটলি আমি ডিভোর্সের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছি। যেটা আমার জন্য অনেক অপমানজনক। আমি জানতে চাই ওরা কতদূর এগিয়েছে! শুধু এই তথ্যটই উদ্ধার করে দেবেন। যদি বেশিদূর এগিয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চিত হয়ে ওর আগে আমিই ওকে ডিভোর্স দিতে চাই। আমি কি বলতে চাচ্ছি আশা করি বুঝতে পারছেন। পারবেন ব্যাপারটা হাতে নিতে?’
‘আশা করি বোঝেন বোধহয় যে কারো মনের খবর বের করাটা অনেক কঠিন কাজ। ওরা মনে মনে কতদূর পরিকল্পনা করে ফেলেছে তা জানা কতটুকু সম্ভব জানি না, তবে আমি শুধু আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে পারি। এবার কয়েকটি প্রশ্ন করব, ঝটপট উত্তর দিন তো।’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! বলুন।’
‘আপনি তো বড় ব্যবসায়ী, স্ত্রীকে সময় দিতে পারেন কেমন?’
‘আসলে সময় যে খুব বেশি দিতে পারি, তা না। বোঝেনই তো ব্যবসায়ের কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে খুব যে কম দিই, তাও না। সপ্তাহে তিন-চার দিন অন্তত আমি ওকে নিয়ে বাইরে ডিনার করি। আর বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আমি বিকেলটা প্রায় সব সময়ই ওর জন্য বরাদ্দ রাখি।’
‘আপনাদের যৌন-সম্পর্কের ব্যাপারে বলুন।’
‘মানে?’
‘মানে আপনাদের যৌন-সম্পর্ক কেমন? দেখুন ইতস্তত করাটা ঠিক হবে না। তথ্যটা খুবই জরুরী। দু’ জনই কি তৃপ্ত নাকি কোনো পক্ষে অতৃপ্তি আছে?’
ভদ্রলোক তারপরেও খানিকটা ইতস্তত করে তারপর বললেন, ‘না আসলে সেরকম কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের এত সময় পরে তো আসলে এসব সমস্যা তেমন একটা থাকে না।’
‘আপনার স্ত্রী কী করেন?’
‘ওর আসলে চাকরির দরকার নেই, কিন্তু সময় কাটানোর জন্য একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করছে।’
‘আপনি যেদিন ওদেরকে ফলো করেছেন সেদিন কতটুকু সময় ফলো করেছেন, আই মিন পুরো সময় নাকি অল্প কিছু সময়?’
‘না, পুরো সময়টাই ফলো করেছি।’
‘সেদিন কি ওদেরকে কোনো হোটেল বা কোনো আবাসিকে যেতে দেখেছেন?’
‘না সেরকম কোনো জায়গায় যায় নি। শুধু এক সাথে ঘুরেছে আর লাঞ্চ করেছে এক সাথে।’
‘আপনার স্ত্রী কোন মডেলের মোবাইল সেট ইউজ করে?’
‘ও স্যামসাং S60 মোবাইল সেটটি ব্যবহার করছে এখন।’
‘উনি নেট ব্যবহার করেন কেমন?’
‘ও তো পুরোপুরি নেটিজেন বলতে পারেন। নেট ছাড়া একদম থাকতেই পারে না। দিনের অনেকটা সময় নেট ব্যবহার করে। আর তাছাড়া ওর প্রফেশনের জন্যেও ওকে অনেকটা সময় নেটে থাকতে হয়।’
‘ঠিক আছে আজকে আমরা উঠছি। কখন কী করতে হবে আমি আপনাকে ফোনে জানাব।’
আমরা উঠে ফিরতি পথ ধরলাম।

মিশন বিগ্যান
পরদিন সকালবেলা। হরতন দা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
‘না আর কিছু না, যা যা বলেছি শুধু সেগুলোই আমাকে মেইল না হলে এসএমএস করে দেবেন।’ ...হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে ঠিক আছে।’
হরতন দা লবর ঘরে ঢুকে গেল। কাল সকালের আগে অন্তত বের হবে না এটা অনেকটা নিশ্চিত। আপাতত হাওয়া চিবোনো ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। এক হাতে আইসক্রিম আর অন্য হাতে সিগারেটটা ধরে আমিও গায়ে বাতাস লাগাতে বের হলাম।
হরতন দার লবর ঘরটাতে আমি ঢুকতে পেরেছি মাত্র কয়েক বার। ঘিঞ্জি টাইপের একটা ঘর। এক পাশে দু'টো পিসি আর একটা ল্যাপটপ। উল্টোপাশে ট্যাক্সিডার্মির যন্ত্রপাতি। এটা আবার হরতন দার শখের কাজগুলোর একটি। বড় একটা আলমারি। বইয়ের হিসাব নেই, কিন্তু কোনো গল্প বা উপন্যাস খুঁজলে একটাও পাওয়া যাবে না। যত্তোসব তত্ত্বকথার খটমটে বই। বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্রের বই যেমন আছে, আবার অকাল্ট সায়েন্স আর অপরাধ-তত্ত্বের ক্রিমিনোলজি টাইপের বইও অনেক।
আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাপার নেই যেটাতে হরতন দার কোনো আকর্ষণ নেই। এ জন্যই বোধ হয় সব ব্যাপারে হরতন দা অত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
আরেক পাশে বাহারি ডিজাইনের কয়েকটা দাবার বোর্ড। হরতন দার একমাত্র প্রিয় খেলা। দাদা দাবা ছাড়া অন্য কোনো খেলা জানে না। দাদার ভাষ্য হচ্ছে, দাবা খেললে বুদ্ধি বাড়ে না অবশ্য, তবে বাড়ে ব্রেইনের গতি, আর অব্যবহৃত নিউরনগুলো চালু হয়। হরতন দাকে মাঝে মাঝেই দেখেছি সকাল বেলা ব্রাশ করতে করতে দাবার আসরে বসেছে, আর উঠেছে সন্ধ্যার পর। সারা দিন খাওয়া-দাওয়ার কোনো বালাই নেই।
বিকেলে আমি ঘুরে এসে একবার উঁকি দিলাম দরজার ফাঁক দিয়ে। হরতন দা ফেসবুকের লগ-ইন পেজ খুলে বসে আছে। কিন্তু পেজটার বাম পাশের অংশগুলো নেই কেন? যাহোক আমি আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।

হোঁচট
ভেবেছিলাম দাদা বোধহয় পরদিনই বের হবে। কিন্তু সেই যে ঢুকল আর তো বের হল না! আরেক বার আড়াল থেকে দেখে এলাম। ইয়াহুর লগ-ইন পেজ খুলে বসে আছে। দাদার সাথে দেখা হল চার দিন পর।
‘দাদা কতদূর এগুলে?’
‘আটকে গেছি রে ...’
‘কীভাবে কি করছ দাদা? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। সেই যে কাকে কি যেন পাঠাতে বলে ডুব দিলে। আজকে এসে বলছ আটকে গেছ। কোন পথে এগুচ্ছ কিছু বলবে?’
‘আন্দাজ লাগা তো দেখি।’
‘হুমম, বেশি কিছু বলতে পারব না। তবে এবার মনে হয় ইন্টারনেটকে কাজে লাগাতে যাচ্ছ।’
‘লাগাতে যাচ্ছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’
‘তাহলে উপায়?’
‘একটা উপায় ...’ দাদা চট করে একটা সিগারেট ধরাল। এটা ভোল্টেজ শেষ হবার লক্ষণ। কথা বলতে বলতে যখনই ভোল্টেজ শেষ হয়ে যাবে তখনই দাদা একটা সিগারেট ধরাবে। আর কোনো কথা বলবে না। আরো কিছু জানার আশা বাদ দিয়ে আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য খেতে শুরু করলাম। এছাড়া উপায় কি!

কাছাকাছি
আরো দু’ দিন পর। দাদা লাফাতে লাফাতে লবর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। খুশির সময় দাদা একেবারে ছোট মানুষটি হয়ে যায় অবলীলায়।
‘পেরেছি রে পাকুল, কাজ হয়েছে! এখন এটাকে কাজে লাগাতে পারলেই হয়।’
‘তাই নাকি দাদা! এখন তাহলে ওটা কাজে লাগাবে কীভাবে?’
‘দাঁড়া, একটা ফোন করি।’
‘হ্যাঁ ভালো আছি, আপনার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে ...এখন বলুন আপনার স্ত্রী বই পড়েন কিংবা গান শোনেন কেমন? ... ই-বুক পড়েন? ...আচ্ছা তাহলে উনি কি কোনো ই-বুক বা গান অনেক দিন ধরে খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না? ...আরণ্যক! ওয়াও! তাহলে তো আরো সহজ হয়ে গেল। এটা আমার কাছেই আছে। ...কালকে আমরা আপনার বাসায় আসছি। ...আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা অফিসেই আসব। ...হ্যাঁ তিনটায়।’
অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছিল। সবগুলো হাতে নিয়ে আমরা একটু সকাল সকালই বের হলাম। দাদার ভটভটি মোটরসাইকেলটাই সম্বল। একে একে সবগুলা কাজ সেরে সব শেষে ঠিক তিনটায় গেলাম ভদ্রলোকের অফিসে। দাদা ভদ্রলোকের স্ত্রীর জন্য সুন্দর কভারের একটা ই-বুক কালেকশনের সিডি দিলো ভদ্রলোকের হাতে।
আবার চালু হলো ভটভটি মোটরসাইকেল। আমরা মাঝপথে এসেছি, হঠাৎ মাথায় প্রচন্ড একটা আঘাত পেলাম যেন। তারপর আর কিছু মনে নেই। নিজেকে আবিস্কার করলাম হসপিটালের বেডে। পাশে দাদা বসে আছে। দাদার বাম বাহুজুড়ে দীর্ঘ ব্যান্ডেজ।
ধীরে ধীরে মনে পড়ল সব। ধাতস্থ হবার পর দাদাকে বললাম, ‘দেখলে তো দাদা?’
‘কী?’
‘তোমাকে বললাম সে দিন, দেখো লোকটা আমাদের ফলো করছে, তুমি কান দিলে না। আজ দেখলে তো! আমাদেরকে টার্গেট করে ঠিকই মেরে দিলো।’
‘তোর ধারণা ভদ্রলোকের স্ত্রীর লোক আমাদেরকে মেরেছে?’
‘তাই তো, আবার কী?’
‘সোজা-সাপ্টা হিসেব করতে শিখ পাকুল, আমাদেরকে যখন ওরা এ্যাটাক করেছে তখন আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ ঘন্টা আর ভদ্রলোকের অফিস থেকে বের হয়ে দেড় ঘন্টা। এর মাঝে অনেক বার থেমেছি, অনেক জায়গা পার হয়েছি যেখানে মারলে মারাটা অনেক সহজ হতো। কেউ পিছু নিলে বা টার্গেট করে মারলে এত সময় নেবে না। হিসেব মিলছে না তা বুঝতে পারছিস?’
‘হিসেবটা ঠিক আছে, কিন্তু এটা তো তোমার অনুমান।’
‘উঁহু, আমি খবর নিয়েছি। ওই এলাকায় আমার লোক আছে। ইট ওয়াজ এ মিসটেক। অন্য লোক ভেবে আমাদেরকে মেরে দিয়েছে।’
পৃথিবীর অন্ধকার জগৎ বলতে একটা জগৎ আছে। হরতন দার সেখানে অবাধ বিচরণ সব সময়। সব এলাকারই শেল্টার হোল্ডারদের সাথে হরতন দার যোগাযোগ আছে। ভেলকির মত সব খবর পেয়ে যায়। কীভাবে - আল্লাহই মালুম!
একজন বৃদ্ধা নার্স এলো ওয়ার্ডে। ইঞ্জেকশন দিতে। হরতন দার আচরণ মাঝে মাঝে আমার কাছে পাগলের প্রলাপের মতই অগোছালো লাগে। দাদা তার সাথে প্রচন্ড কর্কশ ব্যবহার করল। আবার বখশিসও কিন্তু দিলো যেচে। আমি কিছুই বুঝলাম না।
মহিলা গেলে আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘দাদা তুমি সিস্টারের সাথে অমন কর্কশ বিহ্যাভ করলে কেন?’
‘কেন, দেখলি না মহিলার গোটা চোখেমুখে ভাঁজ পড়া?’
‘তাতে কি হয়েছে, মুখে ভাঁজ পড়া থাকলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে?’
‘ও, তোকে তো সমুদ্রবিদ্যার কিছুই শেখানো হয় নি, না? ঠিক আছে, আজকে থেকে তাহলে একটু একটু করে তালিম নেয়া শুরু কর। শোন, সমুদ্রবিদ্যার নিয়ম অনুসারে চোখেমুখে ভাঁজ পড়া মানুষেরা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্নক প্রজাতির মানুষ। এদেরকে কুটিল, কুচক্রী, সুবিধাবাদী যে কোনো কিছু বলতে পারিস। সব সময় এদের থেকে সাবধানে থাকবি। এদের থেকে ভালো কিছু পাওয়ার মাত্র দু’টি উপায়। হয় টাকার গন্ধ দিতে হবে, না হয় চাপের মুখে রাখতে হবে। আমি মহিলার উপর দু’টোই এ্যাপ্লাই করেছি। তোকে তো আরো দু’-চারটা দিন এখানে থাকতে হবে নাকি!’

দ্য প্রবলেম হ্যাজ বিন সলভড
হাসপাতাল থেকে ফেরার পরের কথা। আমি রুমে ঢুকে দেখলাম দাদা সুন্দর করে একটা সিডির কভার বানাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, ‘এই সিডিটা ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে... আমার পারিশ্রমিকটা নিয়ে আসবি, পারবি না?’
‘পারব না মানে কী, তোমার ভটভটিটা দিলেই পারব। কিন্তু দাদা, কাজ কি হয়ে গেছে?’
‘সব বলব, আগে কাজটা করে আয়, যা।’
আমি সিডিটার উপর চোখ বুলালাম, তাতে লেখা, ‘সিডিটা দেখলে আপনার দুশ্চিন্তা কমবে না, কিন্তু এর ভেতরে যা আছে সেগুলো দেখলে আপনার মন অনেক আশ্বস্ত হবে।’
কাজ শেষ করে ঘুরে এসে আমি দাদাকে ধরে বসলাম।
‘দাদা আমি তো পুরো অন্ধকারেই থাকলাম। কি করলে কীভাবে করলে কিছুই তো বুঝতে দিলে না আমাকে।’
‘দাঁড়া সব বলছি। আগে ওদের চ্যাট হিস্টোরিটা দেখে নে।’
আমি মনিটরে ওদের চ্যাট হিস্টোরির দিকে চোখ রাখলাম।
২৬-০৮-২০১১ সকাল ১০:১৩
‘ম্যাডাম আপনাকে কি হাই বলতে পারি?’
‘দাঁড়ান, একটু পরে বলেন, আপনার সাথে বকর-বকর করার জন্য মানসিক প্রস্ত্ততি নিয়ে নিই’
‘আজকে কি একটু বের হতে পারবেন? চলুন না একটু ভেসে আসি’
‘না আজকে বের হতে পারব না। এত ঘন ঘন ঘুরলে তো ধরা খেয়ে যাব। ও মনে হয় কিছু টের পেয়েছে, বুঝতে পারছি’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, তুমি জানো না, ও অনেক চালাক। ব্যবসায়ী মানুষ তো! অল্পতে অনেক কিছু ঝুঝে নেয়’
১৪-০৯-২০১১ দুপুর ২:৩৮
‘হ্যাল্লো গুল্লু গুল্লু, কী করো?’
‘কী করো কোন প্রশ্ন হলো না, বলো কী করছিলে অথবা কী করছ’
‘আচ্ছা দুটোরই উত্তর দাও’
‘কাজ করছিলাম, এখন চ্যাট করছি’
‘কেমন আছ?’
‘ভালো আছি, কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি’
‘কি কথা, বলো ...’
‘তুমি আমাকে গুল্লু গুল্লু বলতে পার না’
‘কেন? ...কি হল আবার?’
‘তোমার এটা মনে রাখা দরকার যে আমি তোমার প্রেমিকা না, জাস্ট ফ্রেন্ড’
‘আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, আর বলব না’

১৮-১০-১১ দুপুর ১:৫২
...........................................
‘আর মাত্র ক’টা দিন, আমি চলে যাচ্ছি’
‘হুমম, মিস করব তোমাকে’
‘তুমি চলো আমার সাথে’
‘কোথায়?’
‘অষ্ট্রেলিয়া!’
‘তুমি কি বলছ তুমি জান! আমার একটা মেয়ে আছে’
‘ওকে সাথে নিয়ে চলো, আমি ভিসা রেডি করছি’
‘আর স্বামী, সংসার?’
‘ওসব তো ছেড়ে দেয়া যায়’
‘আবোল-তাবোল কথা বলবে না, এত দিনের সাজানো সংসার এই দুই দিনে ভাঙ্গা কি কোনো মানুষের কাজ হতে পারে!’
‘তুমি কি ক্ষেপে যাচ্ছ?’
‘না, ক্ষেপে যাচ্ছি না, তবে তোমাকে কিছু কথা জানানো দরকার মনে করছি। তুমি জাস্ট আমার বন্ধু, অন্য কিছু না। এটা ভুলে যাও কেন তুমি বারবার? তুমি আগেও বন্ধু ছিলে এখনো আছ, পরেও থাকবে। এর বেশি কিছু চেও না। আর এমন অসংলগ্ন কথা যদি ফারদার তুমি বলেছ তাহলে কিন্তু তোমার সাথে আমি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব’

কনভারসেশনগুলো দেখলাম। আলাদাভাবে কিছু বলার দরকার নেই তা দেখাই যাচ্ছে। এবার দাদা শুরু করল।
‘শোন, ভদ্রলোক আমাদেরকে যে কাজ দিয়েছিলেন সেটা মনের খবর বের করে নিয়ে আসার মতো জটিল ব্যাপার। এটা সম্ভব নয় বুঝতেই পারছিস। একটা রাস্তা ছিল। ওদের কথোপকথনের উপর নজর রাখা। আমার কাছে GrabSky আছে। সফটওয়্যারটা মোবাইল ফোনে ইন্সটল করে দিলেই হলো। ও পুরোপুরি হিডেন থেকে সব কনভারসেশন রেকর্ড করে এক ঘন্টা পর পর সার্ভারে আপলোড করবে। ভদ্রলোককে দিয়ে সেটা করেও নিয়েছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, সার্ভার বন্ধ। পদ্ধতিটা কাজে লাগে নি। তখন তোকে বলেছিলাম আটকে গেছি। বুঝলি?’
‘তারপর, তারপর! দাদা তারপরে কী করলে?’
‘এরপর আর একটা পথ ছিল। ভদ্রমহিলা যেহেতু নেটিজেন, সুতরাং ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে তারা অনেক আলাপ করে থাকবে। কিন্তু সেগুলো পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো এ্যাকাউন্টগুলো হ্যাক করতে হবে। তুই তো জানিস বায়োস, ইউজার, এ্যাডমিন, ফাইল, ফোল্ডার যে কোন পাসওয়ার্ড ব্রেক করা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সমস্যা হলো আমি অনলাইন হ্যাকিং এ পুরোটাই আনকোড়া। আমি সহজ রাস্তাটাই বেছে নিলাম। ফিশিং করতে শুরু করলাম এ্যাকাউন্টগুলোতে। ফেক লগ-ইন পেজ বানিয়ে এ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশনের নাম দিয়ে আর হিডেন লিংক দিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে থাকলাম মেইল বক্সে। সেখানেও সমস্যা। এখনকার মেইল ফিল্টারিং সিস্টেম অনেক শক্তিশালী। আর ভদ্রমহিলাও মনে হয় যথেষ্ট সচেতন এসব লিংকের ব্যাপারে। ক্লিকই করলো না। পেজ স্ক্রিপ্টগুলো কোনো কাজে এলো না। শেষমেষ আর একটা উপায় বের করা গেল।’
‘কি দাদা?’
‘কী লগার।’
‘কী লগার আবার কী?’
‘কী বোর্ডে কী প্রেসের রেকর্ড রাখে। কিন্তু সেটা বানাতে গিয়ে ব্যাপক ঝামেলায় পড়ে গেলাম। কোনো প্রকার ধরা না পড়ে পাসওয়ার্ডগুলো হাতিয়ে নিতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ঢুকাতে হবে ওটায়।’
‘যেমন?’
‘আমি বলি তুই গুনতে থাক।’
‘বলো।’
‘এক - সবগুলো কী প্রেসের রেকর্ড নিতে হবে। দুই - সেগুলো সার্ভারে আপলোড করবে। তিন - অন্য একটা ফাইলের সাথে জয়েন করতে হবে। চার - ওয়ান-ক্লিক-ইন্সটল হতে হবে। পাঁচ - হিডেন ইন্সটল হতে হবে, যাতে যে ফাইলের সাথে জয়েন করা হয়েছে সেটা চালু করা মাত্র এক বারেই ইন্সটল হয়ে যায়। ছয় - ইন্সটল হবার সাথে সাথে ষ্টার্ট-আপে স্থান করে নিতে হবে যাতে প্রতিবার কম্পিউটার চালু হবার সাথে সাথেই ওটা চালু হয়। সাত - এবং এটা প্রোগ্রাম হিসেবে চলা যাবে না, প্রসেস হিসেবে চলতে হবে এবং সিস্টেম প্রসেস। যাতে সহজে বোঝা না যায় যে ওটা চালু আছে। আট - এবং অবশ্যই অবশ্যই এ্যান্টি-ভাইরাসকে ফাঁকি দিতে হবে। এবং ...এবং ... তিন-চার দিন খেটে-খুটে বানিয়ে ফেললাম কী-লগারটা, সেটা ভদ্রমহিলার ল্যাপটপে গেল আরণ্যকের সাথে এবং তার রেজাল্ট এই চ্যাট হিস্টোরিগুলো।’
‘দাদা তুমি কি তবে হ্যাকার হয়ে গেলে?’
‘হ্যাকার, তবে ব্লাকহ্যাট না, হোয়াইট হ্যাট বলতে পারিস।’
আমি মুচকি হাসলাম। নিশ্চিন্ত হলাম। আশা করছি চ্যাট হিস্টোরিগুলো দেখার পর ভদ্রলোকের ঘর আর ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকবে না।

ম্যাটেওরস ডট কম এ পিএইচপি প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মরত এবং ইবাইস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত। আপাতত মহভারতের এখানেই সমাপ্তি।
cknazmul_mde@yahoo.com
হ্যাকিং গোল্ডওয়েজ
নাজমুল হাসান নিরো

গেটিং মিশন
দারোয়ানকে আগে থেকেই বলা ছিল। আমরা পরিচয় দিতেই দ্রুত গেট খুলে দিল। শৈল্পিক নকশার কারুকাজ করা লোহার দরজা পেরিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ডেনিশদের ধাঁচে তৈরি করা খয়েরি আর ছাই রঙা বেশ বড় আকারের কটেজ বাড়িটা। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত চওড়া পায়ে হাঁটা পথ। পথের দু’ দিকেই অনেক খোলামেলা জায়গা। এক পাশটা উঁচু-নিচু ঘাসের লন দিয়ে সাজানো। লনের ধার ঘেঁষে একটা বকুল গাছ প্রাকৃতিক শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। গাছের ঠিক নিচে একটা বড়সড় দোলনা ঝুলছে। বাড়িটার মালিক ভদ্রলোক যে যথেষ্ট সুরুচি-সম্পন্ন আর উৎফুল্ল মনের অধিকারী, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের অনুমানে অবশ্য কিছুটা ঘাটতি পড়ে গিয়েছিল। বাড়ির কর্তা কিছুটা ব্যতিক্রম রুচির ধারকও বটে। পায়ে হাঁটা পথটার অন্য পাশটা ভর্তি যতসব ঔষধি গাছ দিয়ে। কুড়চি, অশ্বগন্ধা, হিমটক, বাসক, অর্জুন, দাড়িম, বনজমানী, ভীমরাজ আরো নাম না জানা কত কী! এর মাঝে কতগুলো তো আবার একেবারেই ভারতীয়। সবগুলো গাছের গোড়ায় বড় বড় টব।
হরতন দা বলল, ‘গাছের গোড়ায় টবগুলোর মানে বুঝেছিস?’
‘কেন মাটি?’
‘নিচে মাটি থাকতে আবার টব কেন?’
‘তাহলে?’
‘ইন্ডিয়ান মাটি।’
এপাশের বাগানটা আবার পার্টিশন করা। পার্টিশনের অন্য ভাগটা দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! চব্বিশ শ প্রজাতির ক্যাকটাসের সবগুলোই বোধ হয় আছে এখানে। আর দু’চারটার কি সাইজ মাইরি! একেবারে মানুষ সমান। ওগুলোর দাম কম করে হলেও টাকায় লাখ দুয়েক হবে। কতগুলো বিষাক্ত প্রজাতির ক্যাকটাসও চোখে পড়ল। আমার জীবনে কখনো ক্যাকটাসের এত বড় কালেকশন দেখি নি। হরতন দা’কেও বেশ খুশি মনে হলো। দাদার ছোটবেলা থেকেই ক্যাকটাসের প্রতি বেশ দুর্বলতা আছে বলে জানি।
আমরা বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি।
‘বুঝলি রে পাকুল, এবার মনে হয় আমরা পারিবারিক কোনো ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছি।’
‘চারদিকে এলোমেলো আর অগোছালো ভাব দেখে বলছ?’
‘তোর বুদ্ধিটায় তো বেশ পাক ধরেছেরে পাকুল!’

ড্রয়িং রুমে টানা দশ মিনিট বসে থাকার পর ভদ্রলোক মহোদয় এলেন। বয়স অনুমান চল্লিশের কাছাকাছি হবে। বেশ সৌজন্যতা দেখালেন। বোধহয় পরখ করতে চাইছেন, ভুল লোককে ডেকেছেন কিনা! খানিকটা কেশে আমাদের উপর পালাক্রমে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে হরতন কে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
হরতন দা আমাদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আপনার প্রবলেমের যে লিস্টটা তৈরি করছিলেন এতক্ষণ, সেটা কিন্তু এখন আনতে পারেন।’
প্রথম ধাক্কাতেই ভদ্রলোকের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল! খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য! আমি এতক্ষণ প্রবলেমগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলাম তা বুঝলেন কী করে?’
‘সহজ হিসাব, আপনার হাতে এখনো কলমটা ধরেই আছেন।’
তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
‘আর ঠিক এই মুহূর্তে, যখন আমাদের আসার কথা, তখন আপনি কলম দিয়ে কি কাজটাই করবেন তা অনুমান করে নেয়াই যায়।’
‘অদ্ভুত, অদ্ভুত!’ লোকটা নীচুস্বরে খানিকটা স্বগতোক্তি করল।
‘তাহলে কি আমরা এখন বসতে পারি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয় নিশ্চয়। আপনারা বসুন প্লিজ।’
‘আপনার সেই লিস্টটা কি এখন নিয়ে আসবেন?’
‘ওটার মনে হয় আর দরকার হবে না, সব প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।’
আমরা বসলাম। উনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন, ‘বলুন কোনটা চলবে, গরু নাকি ছাগল?’
‘মানে বলতে চাইছেন চায়ের সাথে কোনটা চলবে গরুর নাকি ছাগলের দুধ, এই তো?’
‘বাহ্, আপনি তো বেশ ইন্টেলিজেন্ট! বিশ্বাস করুন, বাসায় নতুন কেউ এলেই আমি এই প্রশ্নটা মজা করেই করি। কিন্তু এর আগে প্রথম বারেই কেউ এটা বুঝতে পারে নি। সবাই ভেবে নেয় মাংসের কথা বলছি। দুধগুলো পূবাইল থেকে আসে দুই দিন পর পর। খেয়ে দেখুন, তৃপ্তি পাবেন।’
‘তাই নাকি?’
‘তাহলে কোনটা দিতে বলব?’
‘ছাগলটাই দিতে বলুন, ওটা এর আগে খাওয়া হয় নি।’
ভদ্রলোক হেঁড়ে গলায় ছাগলের দুধের চায়ের অর্ডার দিতে দিতে চলে গেল ভেতরে। আমি একটা ঢোক গিললাম। জিনিসটার গা থেকেই যে হারে গন্ধ বের হয়! দুধ খেতে কেমন লাগে আল্লাহই মালুম!
একটু পরেই এলো চা-নাস্তা। ছাগলের দুধের চা খেতে খুব একটা খারাপ না, সেটা বুঝলাম। শুধু কেমন যেন গন্ধ লাগে একটু। অবশ্য এটা অবচেতন মনের ভয় থেকে কিনা, কে জানে? ভদ্রলোক চা- নাস্তা নিয়ে আসা কাজের ছেলেটাকে কিছু আনতে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। আপাতত বাড়ি ফাঁকা। আমরা জেঁকে বসলাম।
‘আচ্ছা এবার বলতে শুরু করুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না’ বলতে বলতে হরতন দা শরীরটা এলিয়ে দিলো।
‘দেখুন আমি ব্যবসায়ী মানুষ, অত বেশি প্যাঁচানো ভালো লাগে না। আমি প্রধান বিষয়গুলো বলব, যা যা দরকার আপনি এরপর জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বলতে শুরু করুন।’
‘আমার সমস্যাটা একেবারেই পারিবারিক। আমার স্ত্রীকে নিয়ে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা পারিবারিক এবং সেনসেটিভ। সে কারনে চারদিক থেকে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।’
‘সেগুলো নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না, আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
‘আজকে ও গেছে ওর বাবার ওখানে বেড়াতে। এই সুযোগে আপনাদের ডেকেছি।’
‘বলে যান।’
‘আমরা বিয়ে করেছি ছয় বছর হলো। আমাদের চার বছরের একটা মেয়েও আছে। এতদিন কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যটা শুরু হয়েছে মাস চারেক আগে থেকে। মাস চারেক আগে ওর এক বন্ধু আসে অষ্ট্রেলিয়া থেকে। সমস্যাটা সেখান থেকেই শুরু। ও ওর বন্ধুর ব্যাপারে আমাকে কিছু জানায় নি। আমি খবর পাই ওরা গোপনে দেখা করছে। আমি নিজে একদিন ওদেরকে ফলো করেছি। ব্যাপারটা সত্যি। ...এবং এরপর যা জানতে পেরেছি, তা হলো ওরা আমার অগোচরে নিয়মিত মেলামেশা করছে। আরো মারাত্মক ব্যাপার হলো ওরা নাকি একসাথে অষ্ট্রেলিয়া পাড়ি জমানোর পরিকল্পনাও করছে!’
‘................’
‘আপনার কাজটা খুব ছোট না হলেও খুব বেশি বড়ও নয়। বুঝতেই পারছেন, আলটিমেটলি আমি ডিভোর্সের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছি। যেটা আমার জন্য অনেক অপমানজনক। আমি জানতে চাই ওরা কতদূর এগিয়েছে! শুধু এই তথ্যটই উদ্ধার করে দেবেন। যদি বেশিদূর এগিয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চিত হয়ে ওর আগে আমিই ওকে ডিভোর্স দিতে চাই। আমি কি বলতে চাচ্ছি আশা করি বুঝতে পারছেন। পারবেন ব্যাপারটা হাতে নিতে?’
‘আশা করি বোঝেন বোধহয় যে কারো মনের খবর বের করাটা অনেক কঠিন কাজ। ওরা মনে মনে কতদূর পরিকল্পনা করে ফেলেছে তা জানা কতটুকু সম্ভব জানি না, তবে আমি শুধু আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে পারি। এবার কয়েকটি প্রশ্ন করব, ঝটপট উত্তর দিন তো।’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! বলুন।’
‘আপনি তো বড় ব্যবসায়ী, স্ত্রীকে সময় দিতে পারেন কেমন?’
‘আসলে সময় যে খুব বেশি দিতে পারি, তা না। বোঝেনই তো ব্যবসায়ের কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে খুব যে কম দিই, তাও না। সপ্তাহে তিন-চার দিন অন্তত আমি ওকে নিয়ে বাইরে ডিনার করি। আর বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আমি বিকেলটা প্রায় সব সময়ই ওর জন্য বরাদ্দ রাখি।’
‘আপনাদের যৌন-সম্পর্কের ব্যাপারে বলুন।’
‘মানে?’
‘মানে আপনাদের যৌন-সম্পর্ক কেমন? দেখুন ইতস্তত করাটা ঠিক হবে না। তথ্যটা খুবই জরুরী। দু’ জনই কি তৃপ্ত নাকি কোনো পক্ষে অতৃপ্তি আছে?’
ভদ্রলোক তারপরেও খানিকটা ইতস্তত করে তারপর বললেন, ‘না আসলে সেরকম কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের এত সময় পরে তো আসলে এসব সমস্যা তেমন একটা থাকে না।’
‘আপনার স্ত্রী কী করেন?’
‘ওর আসলে চাকরির দরকার নেই, কিন্তু সময় কাটানোর জন্য একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করছে।’
‘আপনি যেদিন ওদেরকে ফলো করেছেন সেদিন কতটুকু সময় ফলো করেছেন, আই মিন পুরো সময় নাকি অল্প কিছু সময়?’
‘না, পুরো সময়টাই ফলো করেছি।’
‘সেদিন কি ওদেরকে কোনো হোটেল বা কোনো আবাসিকে যেতে দেখেছেন?’
‘না সেরকম কোনো জায়গায় যায় নি। শুধু এক সাথে ঘুরেছে আর লাঞ্চ করেছে এক সাথে।’
‘আপনার স্ত্রী কোন মডেলের মোবাইল সেট ইউজ করে?’
‘ও স্যামসাং S-5620 মোবাইল সেটটি ব্যবহার করছে এখন।’
‘উনি নেট ব্যবহার করেন কেমন?’
‘ও তো পুরোপুরি নেটিজেন বলতে পারেন। নেট ছাড়া একদম থাকতেই পারে না। দিনের অনেকটা সময় নেট ব্যবহার করে। আর তাছাড়া ওর প্রফেশনের জন্যেও ওকে অনেকটা সময় নেটে থাকতে হয়।’
‘ঠিক আছে আজকে আমরা উঠছি। কখন কী করতে হবে আমি আপনাকে ফোনে জানাব।’
আমরা উঠে ফিরতি পথ ধরলাম।

মিশন বিগ্যান
পরদিন সকালবেলা। হরতন দা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
‘না আর কিছু না, যা যা বলেছি শুধু সেগুলোই আমাকে মেইল না হলে এসএমএস করে দেবেন।’ ...হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে ঠিক আছে।’
হরতন দা লবর ঘরে ঢুকে গেল। কাল সকালের আগে অন্তত বের হবে না এটা অনেকটা নিশ্চিত। আপাতত হাওয়া চিবোনো ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। এক হাতে আইসক্রিম আর অন্য হাতে সিগারেটটা ধরে আমিও গায়ে বাতাস লাগাতে বের হলাম।
হরতন দার লবর ঘরটাতে আমি ঢুকতে পেরেছি মাত্র কয়েক বার। ঘিঞ্জি টাইপের একটা ঘর। এক পাশে দু'টো পিসি আর একটা ল্যাপটপ। উল্টোপাশে ট্যাক্সিডার্মির যন্ত্রপাতি। এটা আবার হরতন দার শখের কাজগুলোর একটি। বড় একটা আলমারি। বইয়ের হিসাব নেই, কিন্তু কোনো গল্প বা উপন্যাস খুঁজলে একটাও পাওয়া যাবে না। যত্তোসব তত্ত্বকথার খটমটে বই। বিজ্ঞান, ধর্মশাস্ত্রের বই যেমন আছে, আবার অকাল্ট সায়েন্স আর অপরাধ-তত্ত্বের ক্রিমিনোলজি টাইপের বইও অনেক।
আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাপার নেই যেটাতে হরতন দার কোনো আকর্ষণ নেই। এ জন্যই বোধ হয় সব ব্যাপারে হরতন দা অত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
আরেক পাশে বাহারি ডিজাইনের কয়েকটা দাবার বোর্ড। হরতন দার একমাত্র প্রিয় খেলা। দাদা দাবা ছাড়া অন্য কোনো খেলা জানে না। দাদার ভাষ্য হচ্ছে, দাবা খেললে বুদ্ধি বাড়ে না অবশ্য, তবে বাড়ে ব্রেইনের গতি, আর অব্যবহৃত নিউরনগুলো চালু হয়। হরতন দাকে মাঝে মাঝেই দেখেছি সকাল বেলা ব্রাশ করতে করতে দাবার আসরে বসেছে, আর উঠেছে সন্ধ্যার পর। সারা দিন খাওয়া-দাওয়ার কোনো বালাই নেই।
বিকেলে আমি ঘুরে এসে একবার উঁকি দিলাম দরজার ফাঁক দিয়ে। হরতন দা ফেসবুকের লগ-ইন পেজ খুলে বসে আছে। কিন্তু পেজটার বাম পাশের অংশগুলো নেই কেন? যাহোক আমি আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।



হোঁচট
ভেবেছিলাম দাদা বোধহয় পরদিনই বের হবে। কিন্তু সেই যে ঢুকল আর তো বের হল না! আরেক বার আড়াল থেকে দেখে এলাম। ইয়াহুর লগ-ইন পেজ খুলে বসে আছে। দাদার সাথে দেখা হল চার দিন পর।
‘দাদা কতদূর এগুলে?’
‘আটকে গেছি রে ...’
‘কীভাবে কি করছ দাদা? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। সেই যে কাকে কি যেন পাঠাতে বলে ডুব দিলে। আজকে এসে বলছ আটকে গেছ। কোন পথে এগুচ্ছ কিছু বলবে?’
‘আন্দাজ লাগা তো দেখি।’
‘হুমম, বেশি কিছু বলতে পারব না। তবে এবার মনে হয় ইন্টারনেটকে কাজে লাগাতে যাচ্ছ।’
‘লাগাতে যাচ্ছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’
‘তাহলে উপায়?’
‘একটা উপায় ...’ দাদা চট করে একটা সিগারেট ধরাল। এটা ভোল্টেজ শেষ হবার লক্ষণ। কথা বলতে বলতে যখনই ভোল্টেজ শেষ হয়ে যাবে তখনই দাদা একটা সিগারেট ধরাবে। আর কোনো কথা বলবে না। আরো কিছু জানার আশা বাদ দিয়ে আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য খেতে শুরু করলাম। এছাড়া উপায় কি!

কাছাকাছি
আরো দু’ দিন পর। দাদা লাফাতে লাফাতে লবর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। খুশির সময় দাদা একেবারে ছোট মানুষটি হয়ে যায় অবলীলায়।
‘পেরেছি রে পাকুল, কাজ হয়েছে! এখন এটাকে কাজে লাগাতে পারলেই হয়।’
‘তাই নাকি দাদা! এখন তাহলে ওটা কাজে লাগাবে কীভাবে?’
‘দাঁড়া, একটা ফোন করি।’
‘হ্যাঁ ভালো আছি, আপনার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে ...এখন বলুন আপনার স্ত্রী বই পড়েন কিংবা গান শোনেন কেমন? ... ই-বুক পড়েন? ...আচ্ছা তাহলে উনি কি কোনো ই-বুক বা গান অনেক দিন ধরে খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না? ...আরণ্যক! ওয়াও! তাহলে তো আরো সহজ হয়ে গেল। এটা আমার কাছেই আছে। ...কালকে আমরা আপনার বাসায় আসছি। ...আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা অফিসেই আসব। ...হ্যাঁ তিনটায়।’
অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছিল। সবগুলো হাতে নিয়ে আমরা একটু সকাল সকালই বের হলাম। দাদার ভটভটি মোটরসাইকেলটাই সম্বল। একে একে সবগুলা কাজ সেরে সব শেষে ঠিক তিনটায় গেলাম ভদ্রলোকের অফিসে। দাদা ভদ্রলোকের স্ত্রীর জন্য সুন্দর কভারের একটা ই-বুক কালেকশনের সিডি দিলো ভদ্রলোকের হাতে।
আবার চালু হলো ভটভটি মোটরসাইকেল। আমরা মাঝপথে এসেছি, হঠাৎ মাথায় প্রচন্ড একটা আঘাত পেলাম যেন। তারপর আর কিছু মনে নেই। নিজেকে আবিস্কার করলাম হসপিটালের বেডে। পাশে দাদা বসে আছে। দাদার বাম বাহুজুড়ে দীর্ঘ ব্যান্ডেজ।
ধীরে ধীরে মনে পড়ল সব। ধাতস্থ হবার পর দাদাকে বললাম, ‘দেখলে তো দাদা?’
‘কী?’
‘তোমাকে বললাম সে দিন, দেখো লোকটা আমাদের ফলো করছে, তুমি কান দিলে না। আজ দেখলে তো! আমাদেরকে টার্গেট করে ঠিকই মেরে দিলো।’
‘তোর ধারণা ভদ্রলোকের স্ত্রীর লোক আমাদেরকে মেরেছে?’
‘তাই তো, আবার কী?’
‘সোজা-সাপ্টা হিসেব করতে শিখ পাকুল, আমাদেরকে যখন ওরা এ্যাটাক করেছে তখন আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ ঘন্টা আর ভদ্রলোকের অফিস থেকে বের হয়ে দেড় ঘন্টা। এর মাঝে অনেক বার থেমেছি, অনেক জায়গা পার হয়েছি যেখানে মারলে মারাটা অনেক সহজ হতো। কেউ পিছু নিলে বা টার্গেট করে মারলে এত সময় নেবে না। হিসেব মিলছে না তা বুঝতে পারছিস?’
‘হিসেবটা ঠিক আছে, কিন্তু এটা তো তোমার অনুমান।’
‘উঁহু, আমি খবর নিয়েছি। ওই এলাকায় আমার লোক আছে। ইট ওয়াজ এ মিসটেক। অন্য লোক ভেবে আমাদেরকে মেরে দিয়েছে।’
পৃথিবীর অন্ধকার জগৎ বলতে একটা জগৎ আছে। হরতন দার সেখানে অবাধ বিচরণ সব সময়। সব এলাকারই শেল্টার হোল্ডারদের সাথে হরতন দার যোগাযোগ আছে। ভেলকির মত সব খবর পেয়ে যায়। কীভাবে - আল্লাহই মালুম!
একজন বৃদ্ধা নার্স এলো ওয়ার্ডে। ইঞ্জেকশন দিতে। হরতন দার আচরণ মাঝে মাঝে আমার কাছে পাগলের প্রলাপের মতই অগোছালো লাগে। দাদা তার সাথে প্রচন্ড কর্কশ ব্যবহার করল। আবার বখশিসও কিন্তু দিলো যেচে। আমি কিছুই বুঝলাম না।
মহিলা গেলে আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘দাদা তুমি সিস্টারের সাথে অমন কর্কশ বিহ্যাভ করলে কেন?’
‘কেন, দেখলি না মহিলার গোটা চোখেমুখে ভাঁজ পড়া?’
‘তাতে কি হয়েছে, মুখে ভাঁজ পড়া থাকলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে?’
‘ও, তোকে তো সমুদ্রবিদ্যার কিছুই শেখানো হয় নি, না? ঠিক আছে, আজকে থেকে তাহলে একটু একটু করে তালিম নেয়া শুরু কর। শোন, সমুদ্রবিদ্যার নিয়ম অনুসারে চোখেমুখে ভাঁজ পড়া মানুষেরা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মারাতœক প্রজাতির মানুষ। এদেরকে কুটিল, কুচক্রী, সুবিধাবাদী যে কোনো কিছু বলতে পারিস। সব সময় এদের থেকে সাবধানে থাকবি। এদের থেকে ভালো কিছু পাওয়ার মাত্র দু’টি উপায়। হয় টাকার গন্ধ দিতে হবে, না হয় চাপের মুখে রাখতে হবে। আমি মহিলার উপর দু’টোই এ্যাপ্লাই করেছি। তোকে তো আরো দু’-চারটা দিন এখানে থাকতে হবে নাকি!’

দ্য প্রবলেম হ্যাজ বিন সলভড
হাসপাতাল থেকে ফেরার পরের কথা। আমি রুমে ঢুকে দেখলাম দাদা সুন্দর করে একটা সিডির কভার বানাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, ‘এই সিডিটা ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে... আমার পারিশ্রমিকটা নিয়ে আসবি, পারবি না?’
‘পারব না মানে কী, তোমার ভটভটিটা দিলেই পারব। কিন্তু দাদা, কাজ কি হয়ে গেছে?’
‘সব বলব, আগে কাজটা করে আয়, যা।’
আমি সিডিটার উপর চোখ বুলালাম, তাতে লেখা, ‘সিডিটা দেখলে আপনার দুশ্চিন্তা কমবে না, কিন্তু এর ভেতরে যা আছে সেগুলো দেখলে আপনার মন অনেক আশ্বস্ত হবে।’
কাজ শেষ করে ঘুরে এসে আমি দাদাকে ধরে বসলাম।
‘দাদা আমি তো পুরো অন্ধকারেই থাকলাম। কি করলে কীভাবে করলে কিছুই তো বুঝতে দিলে না আমাকে।’
‘দাঁড়া সব বলছি। আগে ওদের চ্যাট হিস্টোরিটা দেখে নে।’
আমি মনিটরে ওদের চ্যাট হিস্টোরির দিকে চোখ রাখলাম।

২৬-০৮-২০১১ সকাল ১০:১৩
‘ম্যাডাম আপনাকে কি হাই বলতে পারি?’
‘দাঁড়ান, একটু পরে বলেন, আপনার সাথে বকর-বকর করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিই’
‘আজকে কি একটু বের হতে পারবেন? চলুন না একটু ভেসে আসি’
‘না আজকে বের হতে পারব না। এত ঘন ঘন ঘুরলে তো ধরা খেয়ে যাব। ও মনে হয় কিছু টের পেয়েছে, বুঝতে পারছি’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, তুমি জানো না, ও অনেক চালাক। ব্যবসায়ী মানুষ তো! অল্পতে অনেক কিছু ঝুঝে নেয়’

১৪-০৯-২০১১ দুপুর ২:৩৮
‘হ্যাল্লো গুল্লু গুল্লু, কী করো?’
‘কী করো কোন প্রশ্ন হলো না, বলো কী করছিলে অথবা কী করছ’
‘আচ্ছা দুটোরই উত্তর দাও’
‘কাজ করছিলাম, এখন চ্যাট করছি’
‘কেমন আছ?’
‘ভালো আছি, কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি’
‘কি কথা, বলো ...’
‘তুমি আমাকে গুল্লু গুল্লু বলতে পার না’
‘কেন? ...কি হল আবার?’
‘তোমার এটা মনে রাখা দরকার যে আমি তোমার প্রেমিকা না, জাস্ট ফ্রেন্ড’
‘আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, আর বলব না’

১৮-১০-১১ দুপুর ১:৫২
...........................................
‘আর মাত্র ক’টা দিন, আমি চলে যাচ্ছি’
‘হুমম, মিস করব তোমাকে’
‘তুমি চলো আমার সাথে’
‘কোথায়?’
‘অষ্ট্রেলিয়া!’
‘তুমি কী বলছ তুমি জান! আমার একটা মেয়ে আছে’
‘ওকে সাথে নিয়ে চলো, আমি ভিসা রেডি করছি’
‘আর স্বামী, সংসার?’
‘ওসব তো ছেড়ে দেয়া যায়’
‘আবোল-তাবোল কথা বলবে না, এত দিনের সাজানো সংসার এই দুই দিনে ভাঙ্গা কি কোনো মানুষের কাজ হতে পারে!’
‘তুমি কি ক্ষেপে যাচ্ছ?’
‘না, ক্ষেপে যাচ্ছি না, তবে তোমাকে কিছু কথা জানানো দরকার মনে করছি। তুমি জাস্ট আমার বন্ধু, অন্য কিছু না। এটা ভুলে যাও কেন তুমি বারবার? তুমি আগেও বন্ধু ছিলে এখনো আছ, পরেও থাকবে। এর বেশি কিছু চেও না। আর এমন অসংলগ্ন কথা যদি ফারদার তুমি বলেছ তাহলে কিন্তু তোমার সাথে আমি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব’

কনভারসেশনগুলো দেখলাম। আলাদাভাবে কিছু বলার দরকার নেই তা দেখাই যাচ্ছে। এবার দাদা শুরু করল।
‘শোন, ভদ্রলোক আমাদেরকে যে কাজ দিয়েছিলেন সেটা মনের খবর বের করে নিয়ে আসার মতো জটিল ব্যাপার। এটা সম্ভব নয় বুঝতেই পারছিস। একটা রাস্তা ছিল। ওদের কথোপকথনের উপর নজর রাখা। আমার কাছে এৎধনঝশু আছে। সফটওয়্যারটা মোবাইল ফোনে ইন্সটল করে দিলেই হলো। ও পুরোপুরি হিডেন থেকে সব কনভারসেশন রেকর্ড করে এক ঘন্টা পর পর সার্ভারে আপলোড করবে। ভদ্রলোককে দিয়ে সেটা করেও নিয়েছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, সার্ভার বন্ধ। পদ্ধতিটা কাজে লাগে নি। তখন তোকে বলেছিলাম আটকে গেছি। বুঝলি?’
‘তারপর, তারপর! দাদা তারপরে কী করলে?’
‘এরপর আর একটা পথ ছিল। ভদ্রমহিলা যেহেতু নেটিজেন, সুতরাং ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে তারা অনেক আলাপ করে থাকবে। কিন্তু সেগুলো পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো এ্যাকাউন্টগুলো হ্যাক করতে হবে। তুই তো জানিস বায়োস, ইউজার, এ্যাডমিন, ফাইল, ফোল্ডার যে কোন পাসওয়ার্ড ব্রেক করা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সমস্যা হলো আমি অনলাইন হ্যাকিং এ পুরোটাই আনকোড়া। আমি সহজ রাস্তাটাই বেছে নিলাম। ফিশিং করতে শুরু করলাম এ্যাকাউন্টগুলোতে। ফেক লগ-ইন পেজ বানিয়ে এ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশনের নাম দিয়ে আর হিডেন লিংক দিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে থাকলাম মেইল বক্সে। সেখানেও সমস্যা। এখনকার মেইল ফিল্টারিং সিস্টেম অনেক শক্তিশালী। আর ভদ্রমহিলাও মনে হয় যথেষ্ট সচেতন এসব লিংকের ব্যাপারে। ক্লিকই করলো না। পেজ স্ক্রিপ্টগুলো কোনো কাজে এলো না। শেষমেষ আর একটা উপায় বের করা গেল।’
‘কি দাদা?’
‘কী লগার।’
‘কী লগার আবার কী?’
‘কী বোর্ড কী প্রেসের রেকর্ড রাখে। কিন্তু সেটা বানাতে গিয়ে ব্যাপক ঝামেলায় পড়ে গেলাম। কোনো প্রকার ধরা না পড়ে পাসওয়ার্ডগুলো হাতিয়ে নিতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ঢুকাতে হবে ওটায়।’
‘যেমন?’
‘আমি বলি তুই গুনতে থাক।’
‘বলো।’
‘এক. সবগুলো কী প্রেসের রেকর্ড নিতে হবে। দুই. সেগুলো সার্ভারে আপলোড করবে। তিন. অন্য একটা ফাইলের সাথে জয়েন করতে হবে। চার. ওয়ান-ক্লিক-ইন্সটল হতে হবে। পাঁচ. হিডেন ইন্সটল হতে হবে, যাতে যে ফাইলের সাথে জয়েন করা হয়েছে সেটা চালু করা মাত্র এক বারেই ইন্সটল হয়ে যায়। ছয়. ইন্সটল হবার সাথে সাথে ষ্টার্ট-আপে স্থান করে নিতে হবে যাতে প্রতিবার কম্পিউটার চালু হবার সাথে সাথেই ওটা চালু হয়। সাত. এবং এটা প্রোগ্রাম হিসেবে চলা যাবে না, প্রসেস হিসেবে চলতে হবে এবং সিস্টেম প্রসেস। যাতে সহজে বোঝা না যায় যে ওটা চালু আছে। আট. এবং অবশ্যই অবশ্যই এ্যান্টি-ভাইরাসকে ফাঁকি দিতে হবে। এবং ...এবং ... তিন-চার দিন খেটে-খুটে বানিয়ে ফেললাম কী-লগারটা, সেটা ভদ্রমহিলার ল্যাপটপে গেল আরণ্যকের সাথে এবং তার রেজাল্ট এই চ্যাট হিস্টোরিগুলো।’
‘দাদা তুমি কি তবে হ্যাকার হয়ে গেলে?’
‘হ্যাকার, তবে ব্লাকহ্যাট না, হোয়াইট হ্যাট বলতে পারিস।’
আমি মুচকি হাসলাম। নিশ্চিন্ত হলাম। আশা করছি চ্যাট হিস্টোরিগুলো দেখার পর ভদ্রলোকের ঘর আর ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকবে না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক ভালো লাগলো তাই ভোট দিলাম....শুভ কামনা...
সালেহ মাহমুদ UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# নিরো, গল্পটি আগেই পড়েছিলাম, মন্তব্য করি নি। আসলে মনে হয়েছে গোয়েন্দা গল্পে আরো বেশী জটিলতা থাকা দরকার। এটা একান্তই আমার মতামত। ধন্যবাদ সুন্দর গল্পের জন্য।
Lutful Bari Panna হ্যাকিং নিয়ে চমৎকার একটা গল্প... বর্ণনাগুলোও দারুণ রিচ...
ধুমকেতু খুব খুব ভালো লাগলো নাজমুল নিরো, ধন্যবাদ।
Sisir kumar gain সুন্দর গোয়েন্দা কাহিনী।ভালো লাগলো।তবে গল্পটি দুবার ছাপা হয়েছে কেন?
মামুন ম. আজিজ নিরো, পূর্বে প্রকাশিত লেখা না জমা দেয়ার একটা রুলও বোধহয় গল্পকবিতায় আছে।
মামুন ম. আজিজ নিরো , নতুন নামকরণে গল্প লেখার কারন কি?
নতুন নামকরণ কি মামুন ভাই? গল্পের নাম তো একই আছে। গল্পটা আমি আমার আইডি থেকে পোষ্ট করতে পারছিলাম না। বারবার ফেইল দেখাচ্ছিল। জাকিয়া আপুকে বলার পর উনি লেখাটা মেইল করে দিতে বলেন। আমি আমার জিমেইল আইডি থেকে মেইল করি। কিন্তু আমার মনে ছিল না যে ঐ জিমেইল আইডি থেকে প্রজন্মের দায়ভার নিকটা খোলা ছিল। এর কারণে এই আইডি থেকে লেখা পোষ্ট হয়েছে। গল্পকবিতাকে আমার আইডি এবং প্রজন্মের দায়ভার আইডি দুটো থেকেই মেইল করেছি, কিন্তু ওরা লেখা স্থানান্তর করছে না। এখন আমি কি করব বুঝতে পারছি না।
মোঃ সাইফুল্লাহ ভালো লাগলো.--------------------- ///

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী