ছবিটায় অভিনয় নেই কোন। আমরা যেমন ক্যামেরার জন্য তৈরি হই সেরকম নয় বরং ক্যামেরাই যেন অপেক্ষায় থাকে এরকম আশ্চর্য মূহুর্তের। বড়ো সরল ঐ ছবির কালো-সাদা নীলাচল, উড়ে যাওয়া অচেনা পাখি, পায়রারঙা খোঁপায় পড়িয়ে দেয়া কাঠ মালতি ফুল, লাস্যময়ীর বয়সী হাসি, একটু খসে যাওয়া চাদর, চশমার ফ্রেম, শার্টের পকেট থেকে উঁকি দেয়া এক চিলতে কলম- সবকিছু মিলিয়ে যেন এক যাদু বাস্তবতা। ছবির দুটো মানুষ কখনো ভাবেনি ছোট ছেলের হঠাৎ ক্লিকের বদৌলতে এই গোপন প্রেমটুকু এভাবে ফ্রেমবন্দী হবে। তারপর মিশে যাবে কতকালের রোদে, ছায়ায়, আমাদের সাংসারিক গল্পের উজানে, ভাটিতে।
ছবিটা যেন এক নৌকো। আমাদের বয়ে নিয়ে যায় পুরনো এক গল্পের কাছে। সে গল্পে মেয়ের বাড়ির সামনে দিয়ে হাইস্কুলে যেত ছেলেটা, দেখে মায়া হতো। ব্যাস এইটুকুই। হয়তো এর বেশি অনুভূতি ধারণের বয়স তখনও হয়নি মেয়ের। তারপর এক পহেলা ফাগুনের রাতে হলদিয়া বরণ মেয়ের হাতে মেহেদি, মুখে স্নো আর দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে যখন চন্দন পরানো হচ্ছিল, দশম ক্লাস শেষ করা ছেলেটা তখন দেয়াগঞ্জে বোনের বাড়িতে ঘুমোচ্ছে। হয়তো সেই সকালে চোখের কোণ দিয়ে দেখা এক লাস্যময়ীকে মুখোমুখিতে রেখে স্বপ্ন দেখছে। হয়তোবা না।
মেয়ের উঠোনে বরপক্ষ চলে এসেছে ততক্ষণে। সুদর্শন তোরাজ আলীর সাথে আর কিছুক্ষণ পরেই মেয়ের বিয়ে। হঠাৎ শোরগোল শুরু করে দিল মেয়ের বাপজি যিনি নিজেকে কখনো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মনে করেননি। এমন কি তিনি তাঁর বড়ো মেয়েকে পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন। সেবার মেয়ে বরের পকেট থেকে খুয়া যাওয়া পোটলা পেয়ে বাপজিকে দেখেয়েছিল, "বাপজি এইটা কিসের পোটলা? সকালে না পাইয়া সে চিল্লাচিল্লি করছে।" বাপজি চিনতে পেরে রেগে যান, "এ তো গাঁজা। আজকে ধমকায়, কালকে মারবে, এমন গাঁজা খাওয়া লোকের ঘর তোমার করা লাগতো না।" এমনি বললে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দেবে না কখনো, বউকে আটকে রাখবে। সেদিন বাপজি চলে গেলেন ঠিকই তবে মেয়েকে শিখিয়ে দিলেন পরের দিন গোসল করার নাম করে বের হয়ে আসতে। বাপজি লুকিয়ে ছিলেন পুকুরের পাশের ঝোঁপে। কিশোরী মেয়ে আসতেই সোজা মেয়েকে দু’হাতে তুলে, কাঁধে করে বাড়ি ফিরলেন।
এরকম সাহসিকতা, জেদ কিংবা অফুরন্ত ভালোবাসা যে পিতার, সে পিতা আবারও শোরগোল তুলেন পরের মেয়ের বিয়ের লগ্নে। ছেলেপক্ষ কথামতো মেয়েকে সাজিয়ে দিতে গয়না দিয়েছে ঠিকই তবে কানের ঝুমকো জোড়া নতুন নয়। তাই পিতাজি শোরগোল তুলেন, "আগেই বল্তা যে নতুন দিতে পারবা না, তোমাদের জবান ঠিক নাই, তোমাদের সাথে আত্নীয়তাই খাটে না।" তারপর কেবল এক পিতা ছাড়া ফাগুনের রাতের আকাশ ভেঙে পড়ে এই বাড়িতে সবার ওপর।
পাত্রপক্ষ পাশের বাড়িতে গিয়ে ওঠে, মধ্যস্থতা করার জন্য লোক পাঠায়, মেয়ের মা কাঁদেন, বুঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু বাপজির একই কথা- জবান ঠিক নাই। অনড় বাপজি হঠাৎ অন্ধকাৱে হেঁটে চলেন উত্তর পাড়ার মনসুর গেরস্তের বাড়ি, "মনসুর, তোমার পোলা আমার মেয়ের লাগি দিবা?" মনসুর মিঞাও এক মাথা আকাশের বোঝা নিয়ে তাকায়, ভাবেন মাথা-মোতা ঠিক আছেনি! এই ছোট্ট ঘর আর একটুখানি জমি ছাড়া কিবা আর আছে ওঁদের। এমন বাড়ির মেয়েকে বউ করার কল্পনাইতো কোনদিন করেননি। যে পিতা কন্যাদায়গ্রস্ত কাকে বলে জানেন না তিনি দয়া চাইতে আসেননি, মেয়েকে জলেও ফেলে দিতে আসেননি। কোন এক অদ্ভুত কারণে তিনি মনসুর মিয়ার ছেলেকেই চাইছেন, "কিচ্ছু দেয়া লাগতো না, শুধু পোলা আমারে দাও।" আর তখনই মনসুর মিয়ার বউ বড়ো ঘোমটার ভেতর থেকে বলে ওঠেন, " ছেলে তো বাড়িতে নাই। বইনের বাড়ি গেছে।"
সেদিন রাতেই দেয়াগঞ্জে লোক পাঠানো হয়। ঘুম কিংবা স্বপ্ন থেকে ডেকে তুলে আরেক স্বপ্নে পাঠানো হয় ছেলেকে, "উঠো, তোমার আজকে বিয়া।" সবটা ঘোর, সবটা স্বপ্ন নিয়ে গাঁয়ে ফেরা ছেলেটির সাথে ফাগুনের রাতে বিয়ে হয় সেই মেয়ের যারা দূর থেকে শুধু দুজন দুজনকে দেখতো, মায়া বুনতো। নিয়তিতে ভর করেই ওঁরা খুঁজে পায় ফেরারী স্বপ্নকে। তবে সে স্বপ্নও ঘোলাটে হয়ে আসে যখন বাপজি প্রস্তাব দেয়, "দেখো বাবা, এই বাড়িতে তুমি থাকবা, এখনতো তুমি আমার পোলাই।" আত্নসম্মানে লাগা ছেলে ‘সম্ভব না’ বলতেই পিতাজি হঠাৎ জেদ ধরেন, "ঘরজামাই না থাকলে বউ পাবা না।" ছেলেও রাগ করে বাড়ি ফিরে আসে। এই হঠাৎ ঘটে যাওয়া কাণ্ডের ফল- বউয়ের সাথে দেখাশোনা বন্ধ।
অবশ্য কখনো সখনো দুপুর গড়ালে পাড়া পৃথক করা বিদীর্ণ খালকে সামনে রেখে দু'জন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভালোবাসা বুনে। মেয়ের আঁচল ভিজে নোনতা হয়। তবু লজ্জা, ভয় আর সংকোচকে মাঝখানে ভাসায় বলে, ভীষণ কাছের মানুষটা স্পর্শের বাইরেই থেকে যায়। এভাবে দিন গড়াতে গিয়েও হঠাৎ গড়ায় না। একদিন দুপুরের অনেকটা আগে অথবা পরে যখন পাড়া অনেকখানি নীরব হয়ে যায়, থেকে থেকে শোনা যায় নিঃসঙ্গ ঘুঘুর ডাক, মেয়ে তখন পুকুর থেকে চাল ধুয়ে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ পাশের ঝোঁপ থেকে বের হয়ে আসে ছেলে। বউকে ঝাপটে ধরে, কপালে চুমু খায়, তারপর দু’হাতে বউকে বুকের সাথে জড়িয়ে পাথালি কোলে করে কোন একটা দূরের পথের দিকে এগোয়। মেয়ের হাত থেকে পড়ে যায় বাঁশের চালুনি, পড়ে যায় চাল, ভয় কেটে গেলে যা থাকে তা হলো তুমুল তোলপাড় আর চুরি হওয়ার এক অপূৰ্ব সুখ... কে জানতো চুরি হওয়াতেও সুখ থাকে এমন!
এই যা! এত গল্প করছি, পরিচয়টাই দেয়া হলো না। সবটা ভালোবাসায় আটকে থাকা এই যে ছবি অথবা গল্পের দুটো মানুষ- আমাদের বড়মা, বড় আব্বা। আজ তাঁদের
একশতম বিবাহবার্ষিকী।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একটি বিয়ের স্মৃতিচারণ
১০ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪