দুপুর। চারদিকে সুনসান নিরবতা। উঠোনের পাশে এক দঙ্গল বাচ্চা নিয়ে কুটকুট করছে মা মুরগী। ঘরের ছায়ায় ঝিমুচ্ছে একটি কুকুর। নিশ্বাসের সাথে উঠানামা করছে হৃৎপিন্ড। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় গাছের ডালপালা কেঁপে ওঠে। জোরে আছাড় খায় জানালার পাল্লা। বাতাসে তার প্রতিধ্বনি ঝুলে থাকে কিছুক্ষণ।
জাভেদ ঘুমাচ্ছিল। জানালার সশব্দ উল্লাসে জেগে ওঠে। এতে বরং ভালই হল। আরেকটু ঘুমালে হাট ধরতে পারতনা আজ। মুখে পানির ছিটা দিয়ে দ্রুত বিল থেকে গরুগুলো এনে গোয়ালঘরে বাঁধে। রওয়ানা হয়। যেতে যেতে গান ধরে “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবনা আর বেশিদিন তোদের মাজারে। হায়রে ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে!” জাভেদের সুর বিলের বিলের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ভেদ করে খুঁজে নেয় আকাশের কিনারা।
জাভেদের মা ঘুমুচ্ছিলেন। ঘুম ভেঙ্গে যায় কোন এক দুঃস্বপ্নে। মনে করতে পারছেন না ঠিক কি দেখেছিলেন। কিন্তু ছেলের জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে। জাভেদকে ডাকেন। কোথায় জাভেদ! মায়ের ডাকে জবাব দেয় গরুগুলো। ওগুলোর হাম্বা হাম্বা রবে গোয়ালঘরে ঢোকেন মা। গরুগুলোর সামনে পানি দিয়ে আবার এদিক ওদিক খোঁজা শুরু করেন ছেলেকে। বিলের মধ্যে পাশের বাড়ির কেরামতকে দেখে ডাক দেন, -ও কেরামত! আমাগো জাবেদরে দেখছো নি বাবা ? -জাবেদ তো হাটের দিকে গেলো দেখলাম চাচী ! -ও আইচ্ছা। যদিও ঘুম থেকে উঠেই বুঝেছেন ছেলে হাটের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে। তবু কেন তার প্রাণ অজানা আশংকায় দুলে দুলে উঠছে? কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। আজ হঠাৎ কেন এমন হল ? জাভেদের বাবা সৌদি যাবার সময় এমন অনুভূতি হয়েছিল। আজ আবার সেই পুরনো স্মৃতি! ‘তাইলে কি জাবেদও অর বাপের মত আর ফির্যা আইবনা!’ গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। তবু মনে সংশয়! ‘হুদাহুদি কানলে মাইনষে কইব কি !’ বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন কোন এক অশুভ সংবাদের।
বিলের শেষে খালটায় পানি নেই বললেই চলে। হাঁটু পানি পার হয়ে হাটের কাছে পৌঁছে যায় জাভেদ। আজ তার মনে অফুরান ফূর্তি। একটার পর একটা গান গেয়েই চলেছে। এবার ধরেছে “তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে হৃদয়ের কোঠরে রাখবো, আর হৃদয়ের চোখ মেলে তাকিয়ে সারাটি জীবন ভরে দেখবো....”
সূর্য ঢলে পড়েছে অনেক আগে। ‘দুপুরে ঘুমাইলে এই এক সমস্যা! ঘুম কখন ভাঙব ঠিক নাই। ধুর হালায় তাড়াতাড়ি করতে গিয়া দেহি টর্চ আনতে ভুইলা গেছি। এহন বাড়িত ফিরার লাইগা আবার কার জন্য খাড়াই থাকতে হয় কে জানে!’ হঠাৎ শব্দটা কানে আসে। একদল গ্রামবাসী লাঠি সোটা নিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সাত আটজনকে। আবছা আলোয় মানুষগুলোর চেহারা চেনা যায়না। ডাকাত ডাকাত ধর ধর- এই সব শব্দের তোড়ে তাড়া খাওয়া লোকদের মুখের কোন শব্দ বোঝা যায়না। এদিকে হাটের দিক থেকেও ডাকাত ডাকাত রবে বের হয়ে আসছে আরেকটি জনস্রোত। কোন এক অপার্থিব টানে দাঁড়িয়ে পড়ে জাভেদ। ওর মনে পড়ে, গতবছর হাটে ডাকাতদের গুলিতে তিনজন মারা গিয়েছিল। পাশের গ্রামের স্বপনও মারা যায় সেদিন। মনে মনে একটা ডাকাতের বুকে লাথি মারে জাভেদ।
ভিড়টা তীর বরাবর ওর দিকেই ছুটে আসছে। একটু সরে যাওয়া দরকার। কিংবা লাঠি নিয়ে ডাকাত মারার জন্য তারও কিছু করা দরকার। কিন্তু সরতে পারেনা। কেন এমন হল! পা নড়ছেনা কেন! আতঙ্ক গ্রাস করে জাভেদকে। আশপাশে আর কোন হাটুরেও নেই যে তাকে ডেকে একটু সাহায্য নেবে। একি হল তার! সে খেয়াল করতে থাকে দুই দিক থেকে আগুয়ান দুটি জনস্রোত বন্যার পানির মত তেড়ে আসছে দ্রুত। যেন এক্ষুণি গ্রাস করে নেবে সব।
তাড়া খাওয়া লোকগুলো প্রাণের ভয়ে দৌড়াচ্ছে। কাছা খুলে যাওয়ায় লুঙ্গির সাথে পেঁচিয়ে একজন পড়ে গেল। সাথে সাথে কয়েকটি বাড়ি পড়ল তার মাথায়। রক্ত বের হলেও এখান থেকে বোঝা যাচ্ছেনা। উঠে আবার দৌড়াতে চাইল। কিন্তু আজ বোধহয় তার মরণসময়। আঘাতের পর আঘাত মাটিতে শুইয়ে দিল। পাশব উল্লাসে যেন মেতে উঠেছে জনসমুদ্র। এতদিনের জমানো ক্রোধ উপশমের একটি উপায় পেয়েছে আজ। হাতছাড়া করতে রাজী নয় কেউ।
তাড়া খাওয়া লোকগুলো হঠাৎ একেকজন একেকদিকে দৌড় দিল। জনস্রোত ভেঙ্গে গেলো। পাঁচ ছয় ভাগ হয়ে তস্করদের ধাওয়া করতে লাগল। পড়ে যাওয়া তস্করকে মারতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়া জনস্রোতটি সরাসরি এসে পড়ল জাভেদের উপর। একটু থমকে জাভেদের দিকে তাকায়। ‘না, ওরে তো ঠিক ডাকাইতগো মত মনে হইতেছে না।’ দ্বিধান্বিত জনস্রোতকে উস্কে দেয় পেছন থেকে আসা আরেকটা স্বর। ‘ধর শালারে। শালায় জামা পইরা লাট সাজছে। ভাবছে কি শালায় আমরা চালাকি বুঝিনা !’ সাথে সাথে আরো চার পাঁচটা কণ্ঠ বলে উঠে ‘ধর ধর ধর’। এবার যেন জাভেদের পা নড়ে উঠে। প্রাণের তাগিদে দৌড়াতে থাকে। হাটের দিকে নয় দিকভোলা মানুষের মত এদিক ওদিক।
দ্রুত ধরে ফেলে আগুয়ান জনস্রোত। আঘাতে আঘাতে লুটিয়ে পড়ে একটি তাজা প্রাণ। হঠাৎ যেন জাভেদের চোখ খুলে যায়। উঠানের পাশে নতুন শশা গাছটায় শশা ধরেছে। মা বলছে ‘তাড়াতাড়ি বিয়া কইরা নতুন বউ ঘরে আন। এত সোন্দর নতুন বাড়ি, নতুন বউ না অইলে মানায়?’ জাভেদ হাসে। লাজুক। মায়ের সাথে এইসব কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পায়। মা টা যে কবে এসব বলা বাদ দিবে! হঠাৎ দেখে ঘরের দরজায় লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে নতুন বউ। মা কি তবে ওকে না জানিয়েই নতুন বউ নিয়ে আসল? জাভেদ গান ধরে, “ মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোস বানাইয়া দিলেও ভবে শোধ হবেনা, এমন দরদী ভবে কেউ হবেনা আমার মাগো...”
অন্ধকারে টর্চ জ্বালায় একজন। লাশগুলোর উপর ঘুরাঘুরি করে। টেনে খালের কিনারে নামায়। হাত দিয়ে পানি ছুড়ে মারে লাশের মুখে। কেউ একজন চিনতে পারে জাভেদকে। -হায় হায় করছস কি! এইডা তো আমাগো গেরামের জাভেদ। অরে পাইলি কই ? -আরে হালারা সব একদলের। সবকয়ডা নৌকার মইদ্যে ঘাপটি মাইরা আছিল। -ওই তুই চুপ করবি। অরে বিকালেও আমি দেখছি বিলে গরু চরাইতে। আর তুই কস অয় আছিল ডাকাইতগো লগে? -ডাকাইতগো লগে না থাকলে দৌড় দিব ক্যান ? -দৌড় দিছে মানে ? তোরা মারার লাইগ্যা অর দিকে দৌড়াই যাইতাছস আর অয় দৌড় দিব না তো কি খাড়াই খাড়াই মাইর খাইব? ওই হারামীর পোলা! তোরা যখন ডাকাইতগো দৌড়ানি দিছিলি তখন কি অগো মইদ্যে লাল শার্ট পরা কেউ আছিল? -হ হেইডা তো আছিলনা। -তাইলে এইডা তোরা কি করলি ? -এহন কি হইব মেম্বার সাব ?
মেম্বার চুপ। কণ্ঠরুদ্ধ সম্মিলিত জনস্রোত। ধীরে ধীরে ফিসফাস গুঞ্জন বাড়ে। ডাকাত মারতে গিয়ে একজন নিরীহ মানুষও মেরে ফেলেছে তারা। উপস্থিত মানুষগুলোর চোখে চোখে ঘৃণার জায়গা দখল করে নোনা অশ্রুর ধারা।একজন গলা ছেড়ে বিলাপ শুরু করে। ‘হায় আল্লাহ এইডা কি করলাম’। কিছুক্ষণের মধ্যে থানা থেকে পুলিশ আসবে। এই ঘটনা জানতে পারলে বিপদে পড়বে সবাই। অস্থির গলায় কেউ একজন চিৎকার করে ‘কিছু একটা করেন মেম্বার সাব, পুলিশ তো আইয়া পড়ল’। মেম্বারের ভরাট গলায় আস্থা পায় সবাই, -হোন, আমি যা শিকাইয়া দিমু হেই অনুযায়ী সবাই কথা কবি। এর বাইরে গেলে কিন্তু সবাইরে ফাঁসীতে ঝুলতে হইব।
পরদিন সকালে জাভেদের লাশ আসে। ছেলের লাশ দেখে মাও লাশ হয়। নতুন বাড়িতে নতুন বউ আর আসেনা। নতুন বাড়ি পোড়োবাড়ি হয়ে যায় দ্রুত। সম্পদগুলো ভাগাভাগি করে নেয় আত্মীয়স্বজন।
জাভেদ ডাকাতের বাড়িতে এখন মানুষ যেতে ভয় পায়। ‘রাইত বিরাইতে এইখানে অনেক মানুষের ঘাড় মটকাইছে জাবেইদ্যা। বাইচ্চা থাকতে মাইনষের বাড়ি ডাকাতি করত। আর মইরা গিয়াও মাইনষেরে শান্তিতে থাকতে দেয়না বদমাইস ব্যাটা।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
নামকরণে যে কতটা ভুগি তাতো জানোই, এ গল্পে পারফেক্ট হয়েছে সেটা। আর তোমার গল্প বলার স্টাইলটাতো স্বকীয় তা বেশ কটা লেখা পড়েই বুঝেছি। প্রথম প্যারাদুটো যেন মনের মাঝে একটা চিত্রকল্প এঁকে দেয়ার স্ক্রিপ্ট। সাবলীল সুন্দর গল্প ভাল লাগা নিয়েই পড়লাম।
প্রজ্ঞা মৌসুমী
'জাভেদ' শুনেই ভাবছিলাম কখন বলা হবে 'জাবেইদ্যা'। ২বার সংলাপ পার করে...শেষেই বসালেন যে হাসতে গিয়েও হাসতে পারছিনা। দুপুরের দৃশ্যের বর্ণনাটা দারুণ লাগলো। ফাঁক-ফোকর খুঁজছি কিন্তু বেশ যত্ন নিয়েছেন গল্পের। হাট থেকে বাড়ি ফিরার পথেই কি ঘটনা ঘটেছে? সেক্ষেত্রে হাতে বাজার বা ব্যাগ থাকার কথা। সময়টা আরেকটু স্পেসেফিক হলে ভালো হতো। 'সূর্য ঢলে পড়েছে অনেক আগে" আমার কাছে সন্ধ্যাই লাগছে কিন্তু ডাকাতির জন্য আরেকটু গভীর রাত দরকার। এই জিনিসটা আরেকটূ পরিষ্কার হলে ভালো হতো। তবে এটা তেমন কিছু না। আর তেমন ফোকর পাইনি। গান বাছাই বেশ হয়েছে... প্লটের সাথে মিলেছে। কাহিনী, প্রাঞ্জল লেখনী সব মিলিয়ে ভালো লাগার মত গল্প। নিয়মিত লেখা পাবো প্রত্যাশাতো করতেই পারি।
আপনার পর্যালোচনা আমার পরবর্তি লেখাকে আরো শানিত করবে এ আমার বিশ্বাস। (আজ দুটো লেখা নিয়ে আমাদের সাহিত্য সভায় গিয়েছিলাম আজই প্রথমবারের মত আমার লেখা ওদের কাছে প্রসংশা পেল, এ সময়ের লেখা হিসেবে) সন্ধ্যাই বুঝিয়েছি...ওরা নৌকায় ছিল সেখান থেকে তাড়া খেয়েছে। অর্থাৎ গ্রামবাসী আগেই টের পেয়ে তাদের তাড়া করে।হয়তো আরো পরিস্কার করা যেত বিষয়টা।অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।
আহমাদ মুকুল
শুরুটা স্বপ্নের মত হল। মনে হয়, স্বপ্নে গল্পের এ রকম শুরু দেখি।....আমিনবাজার ট্রাজেডি মনে করিয়ে দিলেন। গল্পকবিতার ‘নতুন’ সংখ্যাটি দারুন চ্যালেঞ্জিং করে দিচ্ছেন আপনারা দারুন কিছু লেখা দিয়ে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।