আমাদের মরা গাঙ্গে পানি আসে বর্ষায় । গ্রামের শিশুরা পুলের উপর উঠে লাফ দিয়ে পড়ে নতুন পানিতে । খানিক ধাপাধাপি করে উঠে এসে আবার লাফিয়ে পড়ে । ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফিরতে গেলে সেই কাঠের পুল পার হতে হয় । আমি প্রতিবারই প্রাণপন শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকি যেন সেই পুল পার না হতে হয় । বাড়িতে ফেরার আরেকটি অব্যবহৃত রাস্তা আছে মাঠের মধ্য দিয়ে । সে পথ দিয়েও ঘরে ফেরা যায় । কাঠের পুলটি নিয়ে আমার ভয়ানক এক স্মৃতি আছে । একবার মা আমাকে ও আমার ছোট ভাইকে নিয়ে সেই পুল পার হচ্ছিলেন । পাচঁ বছরের আমি সেই কাঠের পুলের ফাকঁ গলে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম অনেক নিচে। সেই থেকে এই পুলটি পার হতে গেলে আমি আতংকিত হয়ে যেতাম ।
আমরা গ্রামে নানা বাড়িতে থাকতাম । বাবা শহরের কাজ শেষে প্রতি বৃহষ্পতিবার রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরতেন । আবার শনিবার ভোরে চলে যেতেন কাজে । সকালবেলা উঠে বাবার আনা ঘিয়ে ভাজা বিস্কুট খেতে দেখে আমাদের হিংসা করত আশপাশের বাড়ির অন্য শিশু এমনকি অনেক বড়রা পর্যন্ত । আমাদের বাড়ির পর কয়েকটি বাড়ি পার হলে উত্তর পাশে ঘন বাশঁবন । তারপর তেপান্তরের মাঠের মতই প্রান্তর জুড়ে শস্যক্ষেত এবং এই ক্ষেতেরই নিচু অংশ বর্ষাকালে বিল হয়ে উঠে । বাশঁবনের পশ্চিম দিকে খানিকটা জায়গা উচুঁ টিলার মত । সবাই বলত চানুমা’র কবর । যদিও আমি চানুমা’কে দেখিনি বা কবে তিনি মারা গিয়েছেন তাও জানি না । তবু একাকী কখনো ক্ষেত থেকে বাড়ি ফিরতে হলে আমি ভয়ে এক পা এক পা করে সেই চানুমা’র কবরের পাশ দিয়ে হেটেঁ এসে এক দৌড়ে আক্কিদের উঠানে এসে হাফঁ ছাড়তাম । এখনো প্রতিনিয়ত আমার স্বপ্নে সেই শীতকালের ধোয়াঁশা বাশেঁর ঝাড়, নিস্তব্ধ প্রায় আক্কিদের উঠান, দৌড়ে আসা শিশু আমি বার বার ফিরে ফিরে আসে । মনের বয়স হয়তো আমার আটকে আছে সেখানেই ।
সারা বছর নীল রঙের ছোট্ট ফুল ফুটে থাকতো আগাছায় । আমি ভাবতাম এটাই বুঝি শিউলি ফুল । পাশের বাড়ির বাবা মা ছাড়া সমবয়সী কোমল মেয়ে শিউলির সাথে হয়তো ফুলটির কোন মিল খুজেঁ পেয়েছিলাম । আজও সেই শিউলি ফুল আমাকে যে স্মৃতির সৌরভে ভরিয়ে তুলে কোন গ্লাডিওলাস বা গোলাপও তা পারেনা । একবারের কথা মনে আছে খুব । তীব্র খরায় অস্থির চারপাশ । চৈত্র মাস পেরিয়ে বৈশাখ মাস যায়, বৃষ্টির দেখা নেই । আমার মামার পরিবার প্রায় লাল মরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত খায় । তরকারী কেনার সামর্থ তাদের নেই সেই দাবদাহের দিনগুলিতে । আমার বড় বুবু আর তার সইরা ব্যাঙের বিয়ে দিতে উদ্যোগী হয় । সারাবেলা খুজেঁ এক কুনো ব্যাঙ ধরা হল । আমরা ছোটরা উঠোনে পানি দিয়ে কাদা বানিয়ে গড়াগড়ি করলাম আর গলা ফাটিয়ে গাইলাম “আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই……” । সন্ধ্যার পর ছোটরা ঘুমিয়ে পড়লে তারা ব্যাঙের বিয়ের জন্য বাড়ি বাড়ি ভিখ মাগতে বের হয় । কয়েক বাড়ি পরেই আবিদ আলীর বাড়ি গিয়ে আবিদ আলীর ছেলে বজলুর বাধাঁতে সব পন্ড হয়ে যায় । ব্যাঙটাকেও ছেড়ে দেয় সে জোর করে । পরদিন সে কি আফসোস আমাদের সবার !
গ্রামের আশরাফুলের মাকে একবার জ্বীনে ধরেছিল । পুরুষালী গলার স্বর, তেজোদীপ্ত ভাবভঙ্গী দেখে ভয়ে আমার বুক কাপঁছিল । আশরাফুলের মা পাশে দাঁড়ানো স্মৃতির বাবার কাছ থেকে দুইটি সিগারেট নিয়ে ফুকেঁছিল সবার সামনে । তারপর কবিরাজ এসে সর্ষের তেল আর শুকনো মরিচ পুড়িয়ে নাকের সামনে নিয়ে, ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে তার জ্বীন ছাড়ায় । যাবার সময় গ্রামের এক পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে কড়ই গাছের নিচে অমাবস্যার রাতে ভোগ দিতে বলে যায় দুষ্ট জ্বীনটি ।
তারপর সত্যি সত্যি আশরাফুলের মা বাবা আত্মীয়রা মিলে এক শনিবার অভুক্ত সেই আত্মাকে খাবার দিয়ে আসে আমার অবাক চোখের সামনে দিয়ে । আমার বাবা অবশ্য বিশ্বাস করতেন না কোন কুসংস্কার । তিনি বলেছিলেন এটা একটা মানসিক রোগ ।
আমাদের লাগানো জমি থেকে প্রথমবার ধান দিয়ে চিড়ে কোটার দৃশ্য এখনো মনে আছে আমার । বুবু ঢেকিঁতে পাড় দিচ্ছিল। সেখান থেকে চালের বদলে চিড়ে বের হতে দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম । কেন জানি আমার ধারনা ছিল ধান কুটলে বুঝি চালই বের হবে সবসময় । রৌদ্রদীপ্ত দুপুরে অনেক সময় সাথীদের সাথে ভিজিয়ে রাখা পাট থেকে পাটকাঠি ছাড়িয়ে সারা শরীরে কাদা মেখে ঘরে ফিরতাম । কি অফুরন্ত অবসরের দিনগুলি যে কাটিয়েছি !
আর একটা শখ ছিল আমার । কাফিলা গাছের আঠা পাটকাঠিতে লাগিয়ে ফড়িং ধরা । আঙ্গিনায় শুকোতে দেয়া খড়ে রাজফড়িং, গঙ্গা ফড়িং এসে বসে । একটু নড়াচড়ার শব্দেই উড়ে যায় । একদিকে খড়ের সুউচ্চ গাদা আর একদিকে শিশু আমি এক ঠায় দাঁড়িয়ে ফড়িং ধরার নিশ্চুপতায় ! কি সোনালী সেই মুহূর্ত । কি কাম্য আজ সে সময়গুলো !
মরা গাঙ আমাদের গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে । কিন্তু বাড়ির খুব কাছাকাছি একটা বিল ছিল । আমার কাছে তা নদীর মতই বড় মনে হতো । তার পাশ গেষেঁ নল খাগরা আর ইকরের ঝোপ । ইকরের শুকিয়ে যাওয়া শক্ত ফল দিয়ে আমরা মালা গাথঁতাম । সেই মালা পুথিঁর মালার মতই গলায় পরতাম । বর্ষাকালে বানের পানি আসা সেই উলুখাগরা ঘেরা বিলকেই আমার একান্ত নদী ডাকতাম । আমি স্বপ্ন দেখতাম, ডুব সাতাঁর দিতাম, খেলার সাথীদের সাথে অভিমান করতাম সেই নদীকে ঘিরে । মাঝে মাঝে হাসেঁর জন্য শামুক ঝিনুক কুড়াতাম হাটুঁ জল থেকে । একবার কেউ একজন একটি মুক্তাও পেয়েছিল কুড়ানো ঝিনুক থেকে । সেই ব্যক্তিগত নদীর ঘোলা জলে আমি একদিন ডুবে গিয়েছিলাম ।
সামনেই আমার গ্রাম উন্নয়নের সরকারী প্রজেক্ট শুরু হবে । প্রকল্প পরিচালক এবং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমাকে কাজ করতে হবে । গ্রামবাসীর আগ্রহ এবং অন্যত্র এত বড় খোলা জায়গার অভাবে আমারই ছোট্ট নদী ও তার পাশের জায়গাটুকু নির্বাচিত হয়েছে নতুন কারখানা করার জন্য । যে নদী আর কোনদিন কচুরীপানার অর্থহীন ফুলে ভরে উঠবেনা , যেখানে দারিদ্রতা দূরীকরনে শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে, পল্লীবাসিরা সাবলম্বী হবে তবু কেন বছরের অর্ধেক সময় শুকিয়ে থাকা সে নদীর জন্য আজ আমার ভিতরটা হুহু করছে ! সে নদী আমাকে একদিন তার বুকে টেনে নিয়েছিল তার জন্যই কি ! অথবা সে নদীর কোন দিন সাগরে মেশার আকাঙ্ক্ষা ছিলনা বলেই ! নাকি শেকড়ঁ হারিয়ে যাবার শংকা আমাকে তাড়া করছে আমি জানিনা !
কতবার গ্রামে ফিরতে চেয়েছি স্থায়ীভাবে । পারিনি । শৈশবের তেপান্তরের মাঠে একখন্ড মাটিতে ঋতুর পালাক্রমে আমি হাসি ফুটাতে চেয়েও বড্ড দেরী করে ফেলেছি । ব্যর্থ হয়েছি আমি সূর্যাস্তের সোনালী আলোয় ভরা দিগন্তের পানে শৈশবের মত ছুটে যেতে মাঠ পেড়িয়ে । সূর্যকে স্পর্শ করার মোহে গ্রাম থেকে ছুটতে ছুটতে একাকী আজ নিজেকে আবিষ্কার করি তোমাদের এই নগরীতে । এখানে কোন বন্ধু নেই । নির্জনতা নেই । গ্রামের প্রতি আমার পিছুটান ছিল, একদিন ফিরে যাবার কথা ছিল । কিন্তু আজ আমার কুয়াশাছন্ন বাশঁঝাড়, চানুমা’র কবর, কাক ফলের লতানো গাছ, আমার শৈশব স্বপ্নের সাথে সাথে বাস্তবেও দূরে সরে যাবে কর্মকর্তা হিসেবে আমারই একটি স্বাক্ষরের কারণে ! শিল্পায়নের কল্যাণে ! বাস্তবতা আর আবেগের দ্বন্দ এতটাই অবশ্যম্ভাবী !
বহুদিন প্রার্থনা করিনা। আজ বুভুক্ষের মতই চাইছি “ হে প্রবাহমান সময়, আমাকে আর একটিবার শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। অন্তত একটি মুহূর্তের জন্য। “
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।