দু:সহ সেই দিনের কথা

শৈশব (সেপ্টেম্বর ২০১৩)

বশির আহমেদ
  • ১৩
হানিফ মিয়া নতুন শিল্পপতিদের মাঝে একজন অন্যতম । তিনি হাসনা গ্রুপঅব কোম্পানীজ এর স্বত্বাধিকারী । উক্ত গ্রুপের কসমেটিকস ব্যবসা থেকে শুরু করে হাউজিংসহ কোথায় বিনিয়োগ নেই তা বের করতে গবেষনার প্রয়োজন । হানিফ মিয়া আশির দশকের পরবর্তী সময়ের একজন উঠতি ব্যবসায়ী । বাবুর হাটের লুঙ্গির ব্যবসা দিয়ে ১৯৭৯ সালে শুরু । তারপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । আজ সে ব্যবসায়ী হিসেবে উন্নতির চরম শীখরে । দুই দুইটি জাতীয় দৈনিক সহ একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া দর্শকদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে । এক সময় হানিফ মিয়া মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ছোট্ট একটি চাকরীর জন্যে ধরনা দিয়েছে । আজ হানিফ মিয়া হাজার হাজার বেকার ছেলে মেয়েদের তার বিভিন্ন প্রতিষ্টানে চাকরী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে ।

হানিফ মিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে বসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডেকে আনা গরীব মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বৃত্তির টাকা বিতরন করছেন । সেই সাথে তাদের জীবনের সুখ দু:খের ঘটনা সমুহ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন এবং তাদের বাবা মায়ের খোঁজ খবর নিচ্ছেন । ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান আজকের মত শেষ হয়েছে সেই কখন । হানিফ মিয়া ঠাই বসে আছেন উঠার নাম নেই । পিয়নটা বেশ কবার এসে ঘুরে গেছে । দুবার বলেছে আজ যারা উপস্থিত হয়েছিল তারা সবাই চলে গেছে । দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল । আফিসের কমর্চারীরা বাড়ী ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে । কিন্তু বসের উঠার নাম গন্ধ নেই । তারা সবাই উসখুস করছে । হানিফ মিয়া ভাবছে তার শৈশবের কথা জীবনের চরম দুর্দিনের কথা ।

হানফ মিয়ার বাবা মিদন মিয়া হত দরিদ্র একজন খেটে খাওয়া মানুষ । দৈনিক দিন মুজুরী করে যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে সংসার চালায় । সংসার দিন দিন বড় হচ্ছে । হানিফ তার প্রথম সন্তান । হানিফ খেলার ছলে বন্ধুদের সাথে স্কুলে যেতে যেতে লেখা পড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ জন্মালো । কিন্তু তার পিতা মাতার পক্ষে তাকে পড়া লেখা করানোর মত বিলাসিতা দেখানোর কোন সুযোগ নেই । তাই হানিফ শিশুকাল থেকেই বাবার দেখা দেখি পরিশ্রমের কাজ করতে শিখে ফেললো । ছয় বছর বয়স থেকে বাজারে বাজারে গিয়ে হাটুরেদের ফুটফরমাস খেটে দু পয়সা আয় করতে শুরু করে দিয়েছিল । দৈনিক হাট বাজার থেকে যা আয় করতো তা এনে মায়ের হাতে জমা করতো । তার মা সেই জমানো টাকা দিয়ে মোরগের বাচ্চা, হাসের বাচ্চা কিনে লালন পালন করে বড় করে বাজারে বিক্রি করে সংসারে অভাবে কাজে লাগাতো । হাস,মুরগীর ডিম বিক্রি করে হানিফ তার বই খাতা পেন্সিল ক্রয় করে পড়া লেখা চালিয়ে যাচ্ছে ।

একদিন হানিফ মিয়া কাজ শেষে রাত করে বাজার থেকে ফেরার পথে দেখতে পেল মাংস ব্যবসায়িরা সব মাংস বিক্রি করতে না পেরে অর্ধেক দামে ডেকে ডেকে মাংস বিক্রি করছে । হানিফ আজ সর্ব মোট দুই টাকা পঞ্চাশ পয়সা রোজগার করেছে । মাংস বিক্রেতারা প্রতি সের মাংস দুই টাকায় বিক্রি করছে । হানিফরা কতদিন মাংস খায় না ইচ্ছে করছে এক সের মাংস কিনে নেয় । হানিফ বার বার আজকের রোজগারটা গুনছে আর একবার মাংসের দোকানের দিকে আগাচ্ছে আবার দু কদম পিছিয়ে আসছে । শেষ পযন্ত হানিফ মাংস না কিনেই বাড়ী ফিরে এল । বাড়ী ফিরে এসে তার মাকে বললো- জানিস মা আজ বাজার থেকে ফেরার পথে দেখলাম বাজারে গরুর মাংস অনেক সস্তায় বিক্রি করছে । কিনতে চাইয়াও কিনলাম না ।
মাংসের কথা শুনে হানিফের মায়েরও জিবে জল এসে গেল । আহারে কত বছর মাংস খাই না । তাইলে বাপ তুই নিয়া আইলি না কেন ?

মারে আইজ যে টাকা রোজগার করছি তা দিয়া এক সের মাংস কিনতে পারতাম কিন্তু চিন্তা করলাম খালি মাংস কিনলে কি আর হবে তার জন্য তেল নুন, মরিচ, মসলা দরকার । এ সব কিনমু কি দিয়া । তাই আর কিনলাম না । মাংস গুলি যা ভাল ছিলগো মা মনে হইছিল কাচাই চিবাইয়া খাওন যাইবো ।

আরে বেডা এইডা একটা কাম করলি । শুধু এক সের মাংস লইয়া আইতি । তেল মরিচ মসলা ছাড়াই আমি রাইন্দা দিলে কত রাজা বাদশা খাইয়া যাইতো ।

ঘরের পাশ দিয়া একজন যাচ্ছিল সে হঠাৎ করে বলে উঠলো- রাজা বাদশা খাইলেও এই চান্দু খাইতো না গো চাচি ।

খাড়া গোলামের ঘরের গোলাম তরে দেখাইতাছি মজা বলেই ঘর থেকে তেরে বের হলেন ।
চান্দু দিল ভো দৌড় । রাজা মিয়া, বাদশা মিয়া আর চান মিয়া তিন ভাই । তাদেরই গ্রামের প্রতিবেশী ।

হানিফের মা বার বার আফসোস করতে লাগলো আর বললো দুর বেডা তুই কামডা ভালা করস নাই । অহন গেলে কি পাইবি ? তাইলে যা না ।

মাই যে কি কয় ।এত রাতে তারা আমার জন্য বইসা রইছে নি কোন । দেখি অন্য দিন পাইলে লইয়া আসমু নে ।

দরিদ্র পিতার সন্তান হানিফ মিয়া পঞ্চম শ্রেনী থেকে প্রথম হয়ে ষষ্ট শ্রেনীতে উর্ত্তীন হয়েছে । কিন্তু দরিদ্র পিতার পক্ষে স্কুলের বেতন ও বই খাতা কিনে দিবার সামর্থ সংস্থান কিছুই নেই । ফলে হানিফ মিয়া ক্লাসে প্রথম হয়ে ও হাই স্কুলে আর বোধ হয় পড়া হয়ে উঠবে না । বন্ধুরা সবাই পাশের গ্রামের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে । হানিফ মিয়া ছেড়া ময়লা কাপড় পড়ে একদিন বন্ধুদের সাথে স্কুলে ক্লাসে হাজির হলো । হানিফ মিয়া জড়সড়ো হয়ে বসে আছে ।ক্লাস টিচার তাকে এমন চুপচাপ জড়োসর হয়ে বসে থাকতে দেখে তার পরিচয় জানতে চাইলো । অন্যরা জানালো স্যার সে আমাদের স্কুলের সেরা ছাত্র কিন্তু তার বাবা খুবই গরীব ফলে হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারছে না । সব শুনে শ্রেনী শিক্ষক মজিদ সাহেবের বেশ মায়া হলো । সাথে সাথে তাকে নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে গেল । প্রধান শিক্ষক বিনা বেতনে পড়ানো তার অপারগতা জানিয়ে তাদের বিদায় করলেন । শ্রেনী শিক্ষক হানিফ মিয়াকে তিনদিন পর তার সাথে দেখা করার কথা বলে তাকে বিদায় দিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন ।

তিনদিন পর মজিদ স্যার হানিফ মিয়াকে দশ মাইল দুরে লক্ষিপুরা হাই স্কুলে নিয়ে গিয়ে বিনা বেতনে ভর্তি করিয়ে দিলেন । সেই সাথে হানিফ মিয়াকে মজিদ সাহেবের ফুফুর বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন । মজিদ স্যারের চেষ্টায় বিনা বেতনে পড়া,থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাতো হলো কিন্তু স্কুলে যাবার মত কাপড় কোথায় এবং বই খাতা কেনার পয়সা কোথায় পাবে ? কয়েকজন বন্ধু মাঝে মাঝে বই না হয় ধার দেবে কিন্তু কাপড় চোপড় আর খাতা, কাগজ, কলম, পেন্সিল এর জোগার তো তাকেই করতে হবে । তাই সিদ্ধান্ত নিল প্রাইমারী স্কুল জীবনের মত সাপ্তাহিক ছুটি ও বন্ধের দিন গুলোতে অন্যের জমিতে দৈনিক মুজুরী কিংবা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে টাকা জমিয়ে বই কলম খাতা কিনে পড়া লেখা চালিয়ে যাবে ।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্কুল হতে তিন কিলোমিটার দুরে একটি বিশাল হাট বসে । হানিফ মিয়া সে দিন ভোর বেলা বেড়িয়ে পরে । হাটে গিয়ে বাজারে আনা মালামাল নৌকা থেকে নামিয়ে বাজারে তুলে আবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত অবিক্রিত বা নতুন ক্রয়কৃত মালামাল নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে মজুরী হিসেবে ভালই আয় করতে পারছে । এভাবে দীঘ পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে শেষ পযর্ন্ত নিজের পড়া লেখার খরচ নিজের রোজগার দিয়ে চালিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় বসেছে ।

সেই স্কুলে পড়া কালীন অনেক স্মৃতিই হানিফ মিয়ার চোখে জ্বল জ্বল করে ভাসছে । স্কুলটি আড়িয়ল খা নদীর পাড়ে । বর্ষার দিনে নদী দুকুল ছাপিয়ে গ্রাম গুলোতে বানের পানি ঢুকে পড়ে । হানিফ মিয়াদের স্কুলটি অনেকটা টিলা এলাকায় বিধায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে না । তখন নদীতে প্রচন্ড স্রোত বয়ে যায় । কখনে কখনো স্রোতের সাথে সাথে বড় বড় গাছ মানুষের ঘর বাড়ী ভেসে আসে । গ্রামের মানুষ তখন অসহায়ের মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে এ সব দৃশ্য দেখতে থাকে । এক দিন স্কুলের ক্লাস চলছে । হানিফ মিয়া ও তার বন্ধুরা দেখতে পেল নদীতে এক জোড়া হালের বলদ স্রোতের টানে ভাটির দিকে এগিয়ে চলছে । গরু গুলো প্রানপন চেষ্টা করেও তীরে ভিরতে পারছে না । গরু গুলোকে তীরে ফিরিয়ে আনতে নৌকা নিয়ে যেতেও কেউ সাহস পাচ্ছে না । হানিফ মিয়া এই অসহায়ত্ব আর সইতে পারলো না ।একটা নীতি কথা বারবার তার মনে পড়তে লাগলো “জীবে দয়া করে যেই জন, সে জন সেবিছে ইশ্বর”। দুরন্ত ডানপিটে হানিফ মিয়া গরু গুলোকে উদ্ধারে পানিতে একাই ঝাপিযে পড়লো । প্রায় পাঁচশত গজ দুরে গিয়ে হানিফ মিয়া গরুগুলোর রসি টেনে ধরলো । স্রোতের টানে হানিফ মিয়া ও গরু গুলো ভেসে চলেছে । তীরে দাড়িয়ে স্কুলের সকল ছাত্র আর শিক্ষকরা চিৎকার করতে লাগলো । হানিফ মিয়া ভেসে চলছে । স্কুল থেকে আর দেখা যাচ্ছে না । প্রায় এক ঘন্টা স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে স্কুল থেকে দশ মাইল দুরে গিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় মাহমুদাবাদে গ্রামে এক বাশঝাড়ে এসে আটকা পড়লো । সেই গ্রামের মানুষ তাকেসহ গরু গুলো উদ্ধার করে হানিফ মিয়াকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়ে জীবন বাচিয়ে ছিল ।

শীত কাল নদীটা শুকিয়ে মৃত প্রায় । কোথাও হাটু পানি কোথও বা তার চেয়েও কম । দুই পাড়ে খাখা বালু চর । সেখানে কেউ কেউ মিষ্টি আলু, খিরাই, বাঙ্গি, তরমুজের চাষ করেছে । বিকাল বেলা খেলতে গিয়ে দেখে এসে বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিতো । খিরাই ক্ষেত থেকে কচি কচি খিরাই, আলু, বাঙ্গি, তরমুজ খাবার । এমনিতে চাইলেও খাওয়া যায় কিন্তু চুরি করে সবাই মিলে খাবার মজাই আলাদা । রাতের আধারে নদী পেরিয়ে চরায় চলে যেতো । আর সারা রাত ধরে খিরাই, তরমুজ ,বাঙ্গি, আলু খেয়ে ভোর রাতে বাড়ী ফিরে আসতো ।

শীত কাল বাইরে ঘন কুয়াশা । রাত তখন প্রায়এগারটা । গ্রামের মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । হানিফ মিয়া ও তার লজিং বাড়ীর একমাত্র ছাত্র হারিকেনের টিমটিমে আলোতে সামনে বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে । আকাশে পূর্নিমার ভরা চাঁদ । উত্তরীয় দমকা হাওয়া মাঝে মাঝে বইছে । উভয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ায় নিমগ্ন । হঠাৎ ঘরের উত্তর পাশের একটি জানালা খুলে গেল । জানালার ফাঁক গলে বাইরে কিছু দুরে তারা দেখতে পেল সাদা আলখেল্লা পরিহিত এক মহিলা হাত দিয়ে ইশারায় তাদের ডাকছে ।দুই জনেরই ভয়ে অন্তরাত্না কেপে উঠছে । হানিফ যেমনি দুরন্ত তেমনি দু:সাহসীও বটে । অল্পক্ষনের মধ্যেই সে নিজকে শক্ত করে হাতে একটা লাঠি নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে পড়লো ।তার ছাত্র দরজা খুলে আর একটি লাঠি হাতে দরজা ধরে দাড়িয়ে রইল । হানিফ মিয়া একপা দুপা করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল । হানিফ মিয়া শুনেছে জিন বা ভুতের শরীরের কোন ছায়া পড়ে না । সে ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলো মহিলারও কোন ছায়া নজরে পড়ছে না । হানিফ মিয়ার স্থির বিশ্বাস জন্মালো এই মহিলা ভুত অথবা জিনই হবে । আরও একটু এগিয়ে গিয়ে হানিফ মিয়া চোখ বন্ধ করে ধরাম ধরাম করে কয়েকটি বাড়ি লাগিয়ে দিয়ে এক দেৌড়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল ।তার ছাত্র কোন রকমে জানালাটা লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো ।সকাল বেলা পাশের বাড়ীর মহিলার চিৎকারে হানিফ মিয়াও তার ছাত্রের ঘুম ভেঙ্গ গেল । ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখতে পেল পাশের বাড়ীর মহিলার বীজের জন্য লাগানো বড় ডাটা গাছটি দুমরে মুছরে পড়ে আছে । হানিফ মিয়াও তার ছাত্র বিষয়টি বুঝতে পারলেও কাউকে কিছুই বললো না ।

হানিফ মিয়া সেই স্কুল থেকে ষ্টার মার্কস সহ এসএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়ে পুরো থানায় তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিল । তাদের থানার মধ্যে সেই প্রথম এমন কৃতিত্ব পূর্ন ফলাফল করে ছিল । এসএসি পাশের পর নিজের পরিশ্রমে রোজগারের কিছু জমানো টাকা দিয়ে মফস্বল কলেজে ভর্তি হলো । কলেজটি তার নিজ গ্রাম থেকে চার মাইল দুরে । রোজ হেটে হেটে কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে হয় । সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা বন্ধের সময় অন্যের জমিতে চুক্তি ভিত্তিক কাজ করে বই খাতা কিনে পড়া লেখা চালিয়ে আসছিল । ছয় মাসের মাথায় তার দরিদ্র পিতা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো । হানিফ মিয়ার মাথায় যেন বর্জ্র পতন হলো । পাঁচ পাঁচটি লোকের সংসারের সব দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হলো । কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । এত বড় একটি সংসার কি ভাবে চালাবে হানিফ মিয়া ভেবে পায়না । ছোট্ট একটি চাকরীর জন্য এখানে ওখানে ধরনা দিল । কিন্তু কোথাও চাকরী পেল না ।

গ্রামের এক মুরুব্বি তার সাথে তাকে বাবুর হাটে লুঙ্গির ব্যবসায় নিয়োজিত হতে পরামর্শ দিল । হানিফ মিয়া নিজের জমানো কিছু টাকা ও তার মায়ের পালা দুটো গরু ও তিনটি ছাগল বিক্রি করে পাঁচশত টাকা পুঁজি নিয়ে বাবুর হাটে লুঙ্গির ব্যবসায় নেমে পড়লো । গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাতীদের কাছ থেকে লুঙ্গি ক্রয় করে মাথায় করে নিয়ে বাবুর হাটে বিক্রি করতে শুরু করলো । এক বছরের মাথায় হানিফ মিয়া সংসার চালিয়ে বাবুর হাটে নিজের একটি ভিটি ক্রয় করতে সক্ষম হলো ।সেই যে শুরু তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । কয়েকটি তাত কিনে কয়েক জন তাতী দিয়ে নিজের কারখানা চালু করলো । আস্তে আস্তে উইভিং ফ্যাক্টরী চালু করে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে চললো । আজ সে বেশ কয়েকটি টেক্সটাইল মিল, কটন মিল, সহ প্রায় চল্লিশ পয়তাল্লিশটি কারখানার মালিক । গুলশান বনানীতে পাঁচটি বাড়ীর মালিক । পরিবারের সকল সদস্যের জন্য আলাদা আলাদা নতুন মডেলের গাড়ী । তিন ছেলে মেয়ের বড় ছেলে অষ্টেলিয়ায়, মেজ ছেলে আমেরিকায়, মেয়ে সুইডেনে পড়া লেখা করছে ।
হানিফ মিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা এএসসি পযর্ন্ত হলেও দেশের বড় বড় বাঘা বাঘা অথনীতিবিদ , রাজনীতিবিদ হানিফ মিয়ার কাছে যেন নস্যি । টেলিভিশন টক শোতে জানু জানু অথনীতি ও রাজনীতির পন্ডিতরা নতজানু হয়ে পড়ে । কিন্তু হানিফ মিয়া তার শৈশবের সেই কষ্টের দিন গুলো ভুলতে পারে না । সংসারে অর্থ কষ্টের কথা, অনেক দিন না খেয়ে থাকার কথা, পাশের গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের কথা, পড়া লেখা করতে না পারার কথা, মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবার কথা, হাটে হাটে মুটে মুজুরী করে দু পয়সা রোজগারের কথা, অসুস্থ বাবা বিনা চিকিৎসায় মরে যাবার কথা । তাইতো হানিফ মিয়া কোথাও কোন মেধাবী দরিদ্র ছাত্রের খবর পেলেই তাকে ডেকে এনে নিজ হাতে সাহায্য সহযোগিতা করে লেখা পড়ায় উৎসাহ যোগায় । পড়ালেখা শেষে তাদেরকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্তানের সুযোগ করে দেন ।

হানিফ মিয়া তার নিজ গ্রামে মায়ের নামে একটি অবৈতনিক হাইস্কুল স্থাপন করেছে । বাবার নামে একটি ডিগ্রী কলেজ, মসজিদ, ঈদ জামাতের জন্য বিশাল মাঠ স্থাপনসহ গ্রামের দরিদ্র ছেলেদের যোগ্যতা অনুযায়ী তার নানান প্রতিষ্ঠানে চাকরীর সুযোগ করে দিচ্ছেন । লক্ষীপুরা হাই স্কুলে নিজ খরচে তিন তলা পাকা একাডেমিক ভবন নির্মান করে দিয়েছেন । স্কুল শিক্ষক মজিদ স্যার কে তার একটি প্রতিষ্ঠানের জিএম হিসেবে নিয়োগ করেছেন । প্রতি বছর কোরবানী ঈদে গ্রামে পাচ/ছয়টি গরু কিনে কোরবানী করে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষকে মাংস সহ মসলাপাতি সরবরাহ করে মাংস খাবার বন্দোবস্ত করে থাকেন ।

এভাবে বিভিন্ন প্রকার জন হিতকর কাজ করে হানিফ মিয়া তার শৈশবের দু:খের দিনের স্মৃতিকে ভুলে থাকতে চাইছেন । হানিফ মিয়া সমাজে আজ মান্যগন্য ও ধনশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন । কিন্তু সব কিছু ভুলে থাকতে চাইলেই কি সব কিছু ভুলা যায় । অতীত হচ্ছে ভাঙ্গাঘাটের শেওলা পড়া স্বচ্ছ সিড়ির মতন । যা মানুষকে যেমনি হাসায় তেমনি কাদায়ও । হানিফ মিয়া চেয়ারে বসে বসে অতীতের সেই সব দু:সহ দিনের কথা মনে করে দুই হাতে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক চমৎকার আত্ম উপলব্ধি ও শিক্ষানিয় গল্প ... অনেক অনেক ভালো লাগলো ভাইয়া ... শৈশবের দুরন্ত জীবন... কৈশোরের সাহসী উচ্ছ্বাস ... যুবক বয়সে হানিফ মিয়ার মনোশক্তির লড়াই ... প্রেরণা ...পাওয়া না পাওয়া ... এবং অবশেষে একজন পরিপূর্ণ ভালোমানুষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরো গল্পটি ।। আসলে ভাইয়া অর্থে বিত্তে... হয়ত আমাদের সমাজে অনেক মানুষ ই পরিপূর্ণ আছে ।। কিন্তু হানিফ মিয়ার মতো সত্যিকারের পূর্ণতা ভরা হৃদয়ের অধিকারি সফল মানুষ ক জন আছে ? হানিফ মিয়া আমদের গর্ব সমাজ ও দেশের গর্ব ।। আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও সালাম আমার পক্ষ হতে এই অপূর্ব গল্পটির জন্য ...
ভালো লাগেনি ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
আপনার সুন্দর সাবলিল মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ বোন । আপনার প্রান উচ্ছল করা মন্তব্য আমাকে আবার নতুন করে লেখায় উৎসাহ যোগায় ।
ভালো লাগেনি ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মিলন বনিক অতীত হচ্ছে ভাঙ্গাঘাটের শেওলা পড়া স্বচ্ছ সিড়ির মতন । যা মানুষকে যেমনি হাসায় তেমনি কাদায়ও । - দাদা অসাধারণ গল্প...এত ডিটেলস আর সুন্দর উপস্থাপনা...গল্পের ভিতরে ঢুকে পাঠককে মুগ্ধ করতে পেরেছে...খুব খুব ভালো লাগলো....
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
দাদা আপনাদের মত লেখকরা এসব বলে আমায় লজ্জা না দিয়ে উৎসাহ দেবেন তাতেই আমি যার পর নাই খুশী । গল্পটি পড়ার জন্য অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা ।
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মোঃ সাইফুল্লাহ খুবই সুন্দর। আমার মা গলব্লাডারে ক্যান্সারে আক্রান্ত। আল্লাহর কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন ও আমার মায়ের শাররিক অসুস্থতার বিষটি মানবিক দিক দিয়ে বিচার করে যে যতটুকু পারেন আর্থিক সাহায্য করবেন । সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা : মোঃ সায়ফুল্লাহ ,সঞ্চয়ী হিসাব নং -১০১৭৪০৪, সোনালী ব্যাংক,মাগুরা শাখা মাগুরা। যোগাযোগের ঠিকানা :০১৯১১-৬৬০৫২২।
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ধন্যবাদ সাইফুল্লা । ধর্য্য ধরুন দেখা যাক আমরা সবাই মিলে আপনার মায়ের জন্য কি করা যায় ।
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
সালেক শিবলু সুন্দর
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
খোরশেদুল আলম শৈশব থেকে অতিকষ্টে প্রতিষ্টিত মানুষের কথা। একজন হানিফ মিয়া হতে পারে হাজার মানুষের দিশারী।সুন্দর উপস্থাপন। ভালো লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ধন্যবাদ খোরশেদুল আলম ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
হিমেল চৌধুরী শৈশব থেকে কষ্ট করে দাড়ানোর গল্প। এমন মানুষ আজকাল খুবই কম। ভালো লিখেছেন, ভালো লাগলো।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
আজকাল আমরা সবাই রোজগারের সহজ রাস্তার সন্ধান করি । ফরে ন্যায় অন্যায় সব বিসর্জন দিয়ে অন্যের মাথায় কাঠাল ভাঙ্গি । ধণ্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্যে ।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন এমন সব চমতকার মানুষ আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এখনো বাসযোগ্য হয়ে আছে। ভাল লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইল।
ভালো লাগেনি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ওয়াহিদ হোসাইন ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ অনবদ্য ও চেতনা সমৃদ্ধ গল্পকথন। ভাল লাগলো প্রিয় ।
জালাল উদ্দি মুহম্মদ ভাই অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা নেবেন ।
মোঃ আক্তারুজ্জামান সব বিত্তবানদের চিন্তা আর কর্ম হানিফ মিয়ার মতাদর্শের মত হোক। আমাদের সামাজিক পটভূমি আপনার হাতে সাবলীল সুন্দরভাবে ভাবে ধরা দেয়। খুব ভাল লাগলো।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ভাই হানিফ মিয়ার মত কোন বিত্তবানই নয় । হনিফ মিয়ার বর্তমান অবস্থান কেবল শৈশবের দারিদ্র অবস্থার কারনে । তার সন্তানরাই আর তার মত হবে না । ভাল থাকুন ভাই ।
সুমন সংগ্রামী জীবনে সফলতা দেখতে বা শুনতে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে যদি সে সংগ্রামটাকে কেউ ধরে রাখে। আপনার গল্পে দুটোই পেয়েছি। খুব ভাল হয়েছে।
ভালো লাগেনি ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মি: সুমন গল্পটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪