আলায় অনধকার ( ২য় খন্ড )

বৃষ্টি (আগষ্ট ২০১২)

রুহুল আমীন রাজু
  • ২৫
ফুলগুলি দেখে চমকে উঠলো রহমত। ধবধবে সাদা ফুলগুলি হঠাৎ এমন রূপ ধারণ করলো কিভাবে ? একই গাছে সাদা ফুলের পাশাপাশি লাল টকটকে আবার কিছু অংশ আংশিক লাল। রাস্তার পাশে ঝোপ-ঝাড়ে ফুটে থাকা এই ফুলগুলোকে গ্রামের মানুষ জংলী ফুল নামেই চিনে।

জংলী ফুলগুলির দিকে এগিয়ে যায় রহমত। কাছে যাওয়ার পর ছোট ছোট কিছু বৃষ্টির ফোটা পড়ে ফুলগুলির উপর। মুহুর্তেই ফুলগুলির রূপ পরিবর্তন শুরু করলো। বৃষ্টির ফোটা যখন আরো বড় করে পড়তে লাগলো , তখন সবগুলি ফুল সম্পুর্ন সাদা রংয়ে ফিরে গেল।

রহমত লক্ষ্য করলো , ফুল গাছটির নীচে ডানা ঝাপটানোর মতো একটা কিছুর শব্দ হচ্ছে। আরো কাছে যায় সে। একটা আহত সাদা রংয়ের পায়রা কাঁতরাচ্ছে। পায়রাটি উদ্ধার করলো ও। বাম পায়ে ক্ষত চিহ্ন পায়রাটির। রহমত এখন বুঝতে পারলো , জংলী ফুলের রূপ পাল্টানোর রহস্যটি। সে আরো বুঝতে পারলো , এই পায়রাটি কিছুক্ষন আগে তার কলেজের নবীন বরন অনুষ্ঠানে আকাশে উড়ানো হয়েছিল। শান্তির পায়রা আকাশে উড়তে না উড়তেই কে গুলি করলো তাকে ?

রহমত পায়রাটিকে বাড়ী নিয়ে যায়। বাড়ীর আঙিনায় পা রাখতেই বৃষ্টি শুরু হলো তীব্র গতিতে। রহমতের মা রাহেলা খাতুন সন্ধ্যার বাতি জ্বালাবে না বৃষ্টি মোকাবেলায় হাড়ি পাতিল ধরবে বুঝতে পারছে না। এ অবস্থায় তার ছেলের হাতে পায়রা দেখে রাগে ফেটে পড়ে সে।ঃ

মানুষ থাহুনের জাগা নাই , আমার পুতে লইয়া আইছে আবার কইতর। হের বাপে আনছিন বিলাই। জাউরা কপাল আমার-----------

রহমত অত্যত্ন নরম সুরে বললো , মা একটু পানি আনছ না।ঃ

পানি ইকটু কেরে যতক্ষন লাগে নে-------, বলে চালের ফুটোয় থেকে পড়া এক পাতিল পানি এনে দেয় রাহেলা খাতুন।

রহমত পায়রাটির ক্ষত স্থান পরিষ্কার করার সময় গুলির অংশ বের করে আনলো। রাহেলা কাঁচা হলুদ বাটা এনে লাগিয়ে দেয় তার ক্ষত স্থানে। পায়রাটি প্রশান্তির ডানা ঝাপটে জানান দেয় , সে এখন শংকা মুক্ত। বিষয়টি বুঝতে পারে রাহেলা খাতুন। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে সে। আর বলতে লাগলো , বনের একটা পক্ষীরে গুলি করলেও মানুষ চেরেষ্টা করে তারে বাঁচানির লাইগ্গা। আর একটা মানুষ তারে ক্ররস কইরা মারলো -তারে বাঁচানির লাইগ্গা কেউ একটা ইন্ডিশান পর্যন্ত দিল না। মানুষটা যদি অপরাধ কিছু কইরা থাকত , তাইলে স্বাক্ষী প্ররমান লইয়া সাব্যস্থ কইরা তাইনেরে ফাঁস দিত - কুনু আফসোস আছিন না। ফাঁস অইলে অইত। হুনছি ফাঁস দিওনের আগে আসামী যা খাইত চা তাঅই খাইত দে। তাইন নিশ্চয় হুটকি পিডা খাইত চাইত। ও আল্লা আমার আললা গো ---- আমি তর আদালত বিচার দিয়া রাখলাম আমার স্বামীরে যারা বিনা বিচারে ক্ররস কইরা মারছে , তুই হের বিচার করিছ। হাশরের দিন তারে এক ফোডা পানিও দিছ না। তার বুক পদণার চর বানাইয়া দিছ।

রাহেলা যখন তার স্বামীর জন্য এভাবে কাঁদে-তখন ছোট মেয়ে রূপালী বিছানার নীচ থেকে পত্রিকা বের করে আনে। পত্রিকায় প্রকাশিত তার বাবার ছবি দেখে আর বলে , কুত্তা সুলুজ---------- কুত্তা সুলুজ---------এই যে আমার লাল জামা , লাল জুতা , লাল--------------



পায়রা শিকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা ফারজানা। পাখি প্রেমী ফারজানার বাসায় নানা ধরনের পাখি রয়েছে। ও পাখি পুষতে যেমন ভালবাসে , পাখির বুকে গুলি করতেও ভালবাসে। রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে সে। সপ্তাহে একদিন বাড়ী আসে। গ্রামে এসে পাখি শিকার প্রকৃতি দর্শন আর লোহার খাঁচায় পোষা পাখিকে খাওয়ানো তার হবি।

আহত পায়রাটি নিয়ে পরদিন সকালে ফারজানার বাসায় যায় রহমত। ফারজানা পাখি গুলিকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত। নীল শাড়ীতে কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। চোখ দুটো টলটলে নদীর স্বচ্ছ জলের মতো। এমন মায়াময়ী একটা মেয়ে বনের পাখিগুলিকে লোহার শক্ত খাঁচায় বন্ধী করে কিভাবে ----------ভেবে পায়না রহমত।

রহমত শব্দহীন পায়ে কাছে এগিয়ে যায়।ঃ

ম্যাডাম আসসালামুআলাইকুম।ঃ
হু--------কে তুমি।ঃ
আমি রহমত।ঃ
তুমিই কি সেই কুত্তা সুরুজের ছেলে রহমত ? তুমিতো এসএসসি পরীক্ষায় এবার তাক লাগিয়ে দিয়েছো সারাদেশে। তো আমার এখানে কেন এসেছ ?ঃ
এই পায়রাটিকে গতকাল আপনি গুলি করেছিলেন।ঃ
হ্যাঁ করেছিলাম। ঝোপে পড়ে গিয়েছিল।ঃ
আমি এটাকে উদ্ধার করেছি। নিন আপনার শিকার।ঃ
আহত পাখি আমি খাইও না পুষিও না। এটা বরং তুমি নিয়ে যাও।ঃ
আমি নিয়ে কি করবো ? আমি পাখি পোষা পছন্দ করি না । আর খাওয়াতো অসম্ভব। আচ্ছা আপনি খাঁচায় পাখি বন্ধী করে খুব মজা পান----তাই না ?ঃ
হু , এনি প্রবলেম?ঃ
নো প্রবলেম। কষ্ট পান না ? এতোটুকু কষ্ট-----------ঃ
কেন , কষ্ট পাবো কেন ? এটাতো বিনোদনের একটা অংশ মাত্র।ঃ
ম্যাডাম , পাখিদের জন্যেই আকাশ।ঃ
আকাশ শুধু পাখিদের জন্য হবে কেন ? ওখানে সবারই অধিকার রয়েছে।ঃ
হ্যাঁ আছে , তবে মানুষের চেয়ে ওদের অধিকার সবচেয়ে বেশী।ঃ
যেমন------ঃ
পাখিদের ডানা আছে , আমাদের ডানা নেই।

রহমত পায়রাটি নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। পায়রাটি বাড়ীর উঠোনে ছেড়ে দেওয়ার পর উড়াল দিয়ে ঘরের চালায় গিয়ে বসে। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে - ও যাবে না কোথাও। কুত্তা সুরুজের পোষা বিড়ালটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পায়রাটির দিকে। বিড়ালটির চোখ শিকারী মনে হলো না। ওর চাহোনী ছিল , দৃঢ় শান্ত। বিড়ালটি হয়তো অতিথিকে আপন করেই নিয়েছে।





মানবাধিকার সংগঠনগুলো কুত্তা সুরুজের বাড়ীতে একের পর এক আসছে। স্থানীয় ও রাজধানীর বিভিন্ন সেমিনারে ক্রস ফায়ার সম্পর্কে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে কুত্তা সুরুজ ক্রস ফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনাটি আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সন্তান কৃতি শিক্ষার্থী রহমত এসব সেমিনারের বিশেষ আকর্ষন। মিডিয়ার বদৌলতে রহমতের চেহারা এখন সারাদেশে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। আর্তি জানাতে জানাতে রহমত ইতিমধ্যে ভাল একজন বক্তায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে। তার অসামান্য কৃতিত্বের পিছনে সন্ত্রাসী পিতার সহযোগীতা----বৃষ্টির মধ্যে ঘরে থেকেও সন্তানের মাথায় ছাতা ধরে রাখার গল্প ------এবং ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ-------- সন্ত্রাসী বানানোর কারিগরদের ধরার পদক্ষেপ --------সাধারন মানুষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। জনমতও গড়ে উঠেছে। এবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মুখেও ক্রসফায়ার এবং কুত্তা সুরুজ আর অদম্য মেধাবী রহমত ।



রহমতকে নিয়ে সারদেশ যখন তোলপাড় শুরু করেছে , সেই রহমত হঠাৎ উধাও । কলেজ যাওয়ার পথে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে কেটে যায় তিন দিন। তার মা রাহেলা এবাড়ী ওবাড়ী পাড়া গ্রাম থেকে গ্রামে পাগলের মতো ছুটে বেরাচ্ছে। সহপাঠিরাও হন্যে হয়ে খুঁজছে। পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে কেটে যায় আরও কিছু দিন।

পত্রিকায় খবর বেরোয় --- রহমত গুম হয়েছে। রহমতকে নিয়ে এবার রাজনীতির মাঠও বেশ গরম হয়ে উঠেছে। সরকারের লোকজন বলছে , সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দল রহমতকে গুম করেছে। তবে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক । রহমতকে খুজে পেতে র্যায়ব ও পুলিশ বাহিনী জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। অপরদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মিরা বলছে , ক্রসফায়ারে নির্বিচারে নিহত পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ায় সরকারের লোকজন মেধাবী ছাত্র রহমতকে গুম করেছে।

ফারজানা একদিন বর্ষণমুখর বিকালে সান্ত্বনা দিতে রহমতের বাড়ী যায়। রাহেলা চকির উপর ছাতা মাথায় দিয়ে রূপালীকে কোলে নিয়ে বিলাপ করে কাঁদছে। তার পাশে বসে আছে
একটি বিড়াল ও পায়রা।

পায়রাটিকে ফারজানার চিনতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। ও রাহেলার হাত থেকে ছেঁড়া ছাতাটি নিয়ে নিজের ছাতাটি ধরল তাদের উপর। ফারজানা ভিজে একাকার । রাহেলা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ঃ

মা গো তুমি ক্যাডা গো মা---ঃ
আমি ফারজানা। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই রহমতকে খুঁজে বের করবো। করবোই।

ফারজানা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় , রহমতকে যেদিন খুঁজে পাওয়া যাবে - সেদিন সে তার সব পাখি আকাশে উড়িয়ে দিবে। রহমত ঠিকই বলেছিল , পাখিদের জন্যই আকাশ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক সমসাময়িক বিষয়গুলো খুব সুন্দর ভাবে উটে এসেছে...খুব ভালো লাগলো...শুভ কামনা...
আহমেদ সাবের আপনার জীবনমুখী গল্পগুলো প্রচণ্ড আবেদনময়। তবে, পাঠক-শূন্যতা বরাবরের মতই দুঃখজনক।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন .................................একটা antagonistic বিষয় তুলে এনেছেন। এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার আছে। আর ক্ষমতাবানদের মানষিক্তার পরিবর্তন? সে দিল্লি অনেক দূর। আপনার লেখা ভাল লাগল। শুভেচ্ছা রইল।
Sisir kumar gain খুব সুন্দর গল্প। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া,মানবতা বিরোধী কর্ম কাণ্ডের প্রকৃত দলিল এটি।আমরা এই বর্বরোচিত ঘটনার তিব্র নিন্দা জানাই।আর লেখককে জানাই অশেষ ধন্যবাদ।
সিয়াম সোহানূর একটা পরিচ্ছন্ন গল্প পড়লাম। জোড়ালো বাক্যবিন্যাস আর জীবনঘনিষ্ট উপজীব্য শক্তিশালী কলমের পরিচয় বহন করে। এ কলমের নিরন্তর জয় হোক।

০৬ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪