রাজধানীর পিচঢালা কালো পথ ধরে ছুটছে অনেকেই। সবারই একটা ঠিকানা আছে। ঠিকানা নেই ওদের দু'জনের। ওরা গন্তব্যহীন গন্তব্যে ছুটে চলছে।
পাঁচ মাসের ঘরভাড়া বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বাড়ীওয়ালা আজ সকালে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। তালতলা বস্তিতে একটি খুপড়ির মতো ঘরে ভাড়া থাকত ওরা। বাড়ীওয়ালাকে কত করে বলেছে আকবর আলী, পৌষ মাসের এই হাড় কাঁপানো শীতে ছয় মাসের অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাবে সে...। একটু রহম করার জন্য বাড়ীওয়ালার পা ধরে কতই না কান্নাকাটি করলো ওরা। বাড়ীওয়ালার রহম হল না।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা চিড়িয়াখানার সামনে এসে দাঁড়ায়। চল্লিশার্ধো আকবর আলীর স্ত্রী কমলা খাতুনের মুখে হতাশার কোন ছাপ নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো সে ঘুরতে বেরিয়েছে।
রাজধানীর শত শত আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার ভিড়ে এমনকি দুর্গন্ধময় বস্তির মাঝেও ওদের মাথা খোঁজার ঠাঁইটুকু নেই। গ্রামে ফিরে যাবে সেই সুযোগও নেই। আড়িয়াল খাঁ নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতেও কমলা খাতুনের আবদার, আপনে না একদিন কইছলাইন আমারে চিড়িয়াখানা দেহাইবাইন। আজগা লইন দ্যাহি।
: তর আসলে মাইট্টা কইলজা নাই। ইমুন অবস্থায় তুই আজগা চিড়িয়াখানা দেহুনের কতা ক্যামনে কইলি?
: ক্যামনে কইলাম? মনডা চায়ছে হের লাইগগা কইলাম। এ্যাই লইন কুড়ি ট্যাহা, দুইডা টিকেট কাইটটা লইয়াইন।
চিড়িয়াখানা দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওরা বানরের খাঁচার সামনে বসে বাদাম খায়। কমলার কাছে বানরের লাফালাফি খুব ভাল লেগেছে। তাই বানরগুলোকে শেষ বারের মত দেখে নিচ্ছে কমলা। এভাবে সবগুলো জীবজন্তু দর্শনেই কমলার চোখে মুখে ছিল বিস্ময় আর আনন্দ। কিন্তু আকবর আলীর কমলার মত কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। তার কেবলি মনে হয়েছিল এসব জীবজন্তুর চেয়ে বরং সে নিজেই আজব এক প্রাণী। তার ঘর নেই, বাড়ী নেই। জঙ্গলে বাস করার বিধান নেই। জেলখানায় বাস করার মতো অপরাধ নেই। এমনকি জীব জানোয়ারের মতো চিড়িয়াখানায় বাস করবে সেই সুযোগও নেই।
চিড়িয়াখানা দারোয়ান বাঁশি বাজাচ্ছে। চিড়িয়াখানা দেখার সময় ফুরিয়ে এসেছে। দর্শনার্থীদেরকে চলে যাওয়ার জন্য দারোয়ান বাঁিশ বাজাচ্ছে।
কমলা বিষয়টি বুঝতে পেরে তার স্বামীকে বললো, এ্যাই লইন উইটটা পড়ি। চিড়িয়াখানা দেহুনোর টাইম শেষ অইয়া গ্যাছে গা।
: আকবর আলী নিরুত্তর। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বানরগুলির দিকে।
: কমলা এবার কিছুটা রাগ্বত সুরে বলল, উডুইন্না কেরে হুনতাছুইন্ন টাইম শেষ।
: হ, হুনছি। কমলা...
: হু।
: কই যাইবামরে কমলা?
: আল্লাহর দুইন্নাডা অনেক বড়-লইন-উডি। একটা উপায় একবা না একবা অইবঅই অইব।
: কমলা, দ্যাখ-দ্যাখ, বান্দরগুলো কি ছুন্দর কইরা যার যার ঘরে যাইতাছেগা। আমি যদি বান্দর অইতামরে কমলা,ত-অ ভালা আছিন। চিড়িয়াখানাত আশ্রয় পাইতাম।
: আর আমি বুঝি অইতাম বান্দরনি। থুবাস থুবাস! কি পাগল-ছাগলের মতন কতা কইতাছুইন। কমলা কিশোরী মেয়ের মতো হাসতে লাগলো।
সহাস্যে আকবর আলী বলল, হাসলে তরে জবর ছুন্দর লাগেরে কমলা-জবর ছুন্দর লাগে। জানছ কমলা মানুষ সৃষ্টির সেরা এই কারনে যে, আমডা হাসতাম পারি বইল্লা। দুইন্নার আর কুনু জীব হাসতে পারে না। চিড়িয়াখানাত কত কিসিমের জীব-জানোয়ারইনা দ্যাখলাম কই কেউরে হাসত দ্যাখছস?
: হ, হাছাইত। বাঘ, ভাল্গুক, হাতি, ঘোড়া, হাপ কেউরেত হাসতে দ্যাখলাম না। জবর দামি কতাডাত কইছুইনগো। কইত্তে হুনলাইনগো কতাডা?
হঠাৎ চিৎকার করে উঠে কমলা। পেটের ব্যাথাটা শুরু হয়ে গেছে। কমলা একেতো দীর্ঘদিনের গ্যাস্টিকের রোগী দ্বিতীয়ত: অন্ত:স্বত্ত্বা। ব্যাথাটা ক্রমেই বাড়ছে। ডাক্তার আরো তিন মাস পূর্বেই বলেছিল, কমলার ষ্টোমাকে আলসার হয়ে গেছে। জরুরী ভিত্তিতে তাকে অপারেশন করাতে হবে। দিন মজুর আকবর আলীর পক্ষে বিশ হাজার টাকা যোগাড় করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না বলে আজো অপারেশন করা হয়নি কমলার।
আকবর আলী কমলাকে নিয়ে একটা রিঙ্ায় উঠে। রিঙ্া ছুটে চলেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ রিঙ্াওয়ালা সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে। কমলার চিৎকারের শব্দে রিঙ্াই যেনো হয়ে উঠেছে এ্যাম্বুলেন্স। এক জীবন্ত এ্যাম্বুলেন্স। শ্যামলীতে পেঁৗছার পর রিঙ্া পড়ে গেল ট্রাফিক জামে। শত শত যানবাহন থামিয়ে থামিয়ে দিয়েছে ট্রাফিক সার্জেন্ট। পাশের রাস্তা দিয়ে মন্ত্রী যাবেন। মন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য জনসাধারণের যানবাহন চলাচাল বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়টি জানার পর চেচিয়ে উঠে কমলার রিঙ্াওয়ালা। রাগে ক্ষোভে সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, মাগার আমাগো দেশ নাকি গণতান্ত্রিক। হালায় গণতন্ত্র থাকলে রাস্তা বন্ধ করে ক্যামতে? মাইয়্যাটা পেটের ব্যাথায় চিক্কুর পাইরা মরতাছে-কেউ হুনবার লাগছে না। মন্ত্রীর নিরাপত্তা আছে, আমাগো নিরাপত্তা নাই? আমরা কি হালায় কুত্তা বিলাই নাকি?
নিরুপায় হয়ে পথিমধ্যে কমলাকে নিয়ে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যাওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। ওরা বলল, যাও যাও ঢাকা মেডিকেলে যাও।
অবশেষে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌছতে পৌছতে অনেক রাত হয়ে যায়। জরুরী বিভাগের বারান্দায় পড়ে আছে কমলা। কমলা ব্যাথায় হাউমাউ করে কাঁদছে, তবুও কেউ এগিয়ে আসছে না। আকবর আলী ভেতরে গেলে কম্পাউন্ডার তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। ডাক্তার সাহেব ক্যান্টিন থেকে এলে আকবর আলীকে ডাকা হবে বলে জানায় কম্পাউন্ডার।
আকবর আলী বিভিন্ন দোয়া দরুদ পড়ে কমলার গায়ে ফু দিতে লাগলো। ভুলে ভরা এই দুরুদ পড়তে দেখে দু:ষহ ব্যাথার মধ্যেও কমলা হি হি করে হেসে উঠে। আকবর আলী কমলার হাসি দেখে শিশুর মত কেঁদে উঠে।
: কমলা তুই একটা আজগুবী মাইয়্যারে-আজবগুবী একটা মাইয়্যা। মরনের সময় অ তুই হাসছ।
: হ ঠিকঅই কইছুইন। আমার সময় শেষ। আমারে বিদায় দেইন। আপনারে কত কতা কইছি, কত জ্বালাইছি-আমারে ক্ষ্যামা দেইন। অরে আল্লারে, অরে মাইয়্যারে...।
: না কমলা না, এ্যাই কতা কইছ না। তরে আমি মরুনের লাইগগা দিতাম না। ডাকতর অহনেঅই আইয়া পড়ব।
: ডাক্তার আইলে আর কি অইব? অপারেশনের অত ট্যাহা আপনে কই পাইবেন? অরে আল্লাগো...।
: ট্যাহার কতা তুই কুনু চিন্তা করিছ না। আমার লক্ত বেইচ্ছা তর অপারেশনের ট্যাহা বাউ করবাম।
স্বামীর একথায় কমলা এবার বেশ শব্দ করে হাসতে লাগলো। কমলার দু\'চোখে শ্রাবনের বৃষ্টি, ঠোঁটে তার হাসি। এই দৃশ্য দেখে আকবর আলীর বুকটা হু হু করে উঠে।
আকবর আলী ছুটে যায় দোকানে। খাবার সোডা খেলে কমলার পেটের ব্যাথাটা কিছু কমে। অনেক খোঁজাখোঁজির পর এক পুটলা সোডা এনে দেখে কমলার চারপাশে মানুষের ভীড়। কমলার কান্নার কোন শব্দ নেই। নেই হাসির শব্দও। আকবর আলীর পা আর সামনে এগুচ্ছে না। কমলার লাশের কাছে যাওয়ার মত কেন যেন সাহস পাচ্ছে না সে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে মানুষের জটলা কমতে শুরু করে। এক সময় জনশূন্য হয়ে পড়ে হাসপাতালের বারান্দা। বারান্দায় শুধু পড়ে রয়েছে কমলার নিথর দেহ। লাশের দিকে লাল পিঁপড়ার দল লাইন বাঁধতে শুরু করেছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়টা তেলাপোকা লাশের উপর দিয়ে হাঁটছে। কমলার মুখের উপর একশো পাওয়ারের এটি বাতি ঝুলছে। বাতির আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কমলাকে। মৃত কমলাকে এখন কেমন যেন এক অদ্ভুত ধরনের সুন্দর লাগছে। হাসিটি এখনো ফুটে আছে তার ঠোঁটে।
আকবর আলী কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না কমলার লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর। লাশ বহনের গাড়ি ভাড়ার টাকা নেই তার কাছে। এছাড়া লাশ নিয়ে রাখার মত ঠিকানাও নেই তার। লাশের পরিচয় দিলেই তাকে লাশটি বহন করতে হবে। সেই জন্য আকবর আলী ভিন্ন এক দর্শকের মত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রাত যতই বাড়ছে শীত ততই ঝাকিয়ে আসছে। কুয়াশায় ডেকে দিচ্ছে সব। কুয়াশা আকবর আলীকে লুকাতেও সাহায্য করছে।
গভীর রাতেও যখন লাশের পরিচয় এবং সাথের কাউকে পাওয়া গেল না তখন হাসপাতালের কতর্ৃপক্ষ লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ কাটা ঘরে পাঠিয়ে দেয়। কমলার লাশ কেটে সকালে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিকেল একটা ক্লাশ করবে। তারপর লাশটি আঞ্জুমানে মফিদুলে দিয়ে দেওয়া হবে।
বিষয়টি জানতে পেরে আকবর আলী হাসে আর বিড় বিড় করে বলতে লাগলো, তর কি ভাগ্যরে কমলা। তর লাশ কাইটটা ছাত্ররা ডাক্তারি হিকব। তুই কি ছুন্দর একটা ঘরঅ আশ্রয় পায়ছসরে কমলা-তর কি ভাগ্য--।
আকবর আলীর এ কথাগুলো শুনে ফেলেন জরুরী বিভাগে পরিদর্শনে আগত প্রফেসর ডা: মোয়াজ্জেম হোসেন।
: মহিলার লাশটি কি তোমার?
: চমকে উঠে আকবর আলী। মৃদুমাথা ঝাঁকিয়ে সে এর সত্যতা স্বীকার করে নিলো।
: লাশটি কি হয় তোমার?
: আমার বউ-বউ স্যার বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠে আকবর আলী।
: শুনেছি লাশটি দীর্ঘক্ষন ধরে বারান্দায় পড়েছিল। তুমি এতোক্ষণ পরিচয় দাওনি কেন?
: স্যার আমার কাছে লাশটা নিওনের গাড়ি ভাড়ার ট্যাহা নাই।
: কি বলছো তুমি! লাশ নেওয়ার মত ক'টা টাকা নেই তোমার কাছে?
: হ স্যার। হাছা কতাঅই কইতাছি। লক্ত বেচতাম গেছলাম। আমার লক্ত বলে ভালা না। কি জানি একটা দোষ আছে। হের লাইগগা আর লক্ত বেইচতাম পারলাম না। লক্ত বেচতারলে কমলারে আমি এইহানে ফালাইয়া রাখতাম না, কিছুতেই না।
: আচ্ছা ঠিক আছে, গাড়ী ভাড়ার টাকা আমি দিচ্ছি-তুমি লাশটি নিয়ে বাড়ী যাও। এসো আমার সাথে এসো আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
: বাড়ি ঘরঅ নাই স্যার। লাশ নিয়া কই রাখবাম? হুনছি কমলার লাশ কাইটটা ছাত্ররা ডাক্তারী হিকব। একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ছেড়ে প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, হঁ্যা তোমাদের মত গরীব মানুষের লাশ কেটেই আমরা ডাক্তারী শিখি। ধনী মানুষের লাশ কাটার সুযোগ আমরা কখনোই পাই না। অথচ সেই তোমরাই বিনা চিকিৎসায় মারা যাও। তোমাদের জন্য আমরা কিছুই করি না। আমরা ব্যস্ত ধনী মানুষদের জন্য। আমরা টাকার মোহে অধিকাংশ চিকিৎসকই আজ অন্ধ হয়ে গেছি। আমাদের মতো এ জাতীয় চিকিৎসকদেরকে তোমরা কখনো ক্ষমা করো না। কখনো না।
০৬ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৪