নিথর চোখে জোছনা

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

রুহুল আমীন রাজু
  • ৩৩
  • 0
  • ৩১
মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাঁড়ি গোফওয়ালা অর্ধনগ্ন মতি পাগলের শরীরে গুয়ের গন্ধ। গলায় চটের ব্যাগ। এই ব্যাগে দু'টাকা না দেওয়া পর্যন্ত পথচারী ও ব্যবসায়ীদের নিস্তার নেই। যতই ধমক আর গালিগালাজ করা হোক না কেন-দু'টাকা তাকে দিতেই হবে। এভাবেই এ বাজার ও বাজার ষ্টেশনে ঘুরে বেড়ায় সে। যেখানেই রাত সেখানেই কাত। মতি পাগলের দিনের শুরুটা হয় পত্রিকা পড়ে। প্রতিদিন সকালে ঠেলাগাড়ি-রিঙ্াওয়ালা ও শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলো মতি পাগলের শ্রোতা। একজন পত্রিকা ধরে রাখে, আর মতি পাগল একটার পর একটা খবর পড়তে থাকে। উচ্চারণ মন্দ নয়, ধরাজ গলা। লেখাপড়া সপ্তম শ্রেণী। হাত দু\'টো না থাকায় পত্রিকা পড়তে অন্যজনের সহযোগীতা নিতে হয় তাকে।
মতিপাগলের দু'হাতের কব্জি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিরা কেটে দিয়েছিল। তাকে হত্যা'ই করা হতো। কিন্তু গ্রামের এক রাজাকারের সুপারিশে তা না করে কব্জি কাটা হয়। সুপারিশের কারণ ছিলো, গুলি করলে তো খেলা শেষ। নির্মম খেলা দেখার জন্যই ছিল সেই সুপারিশ।
দেশ স্বাধীন হয়। মতি পাগলের ঘর আলো করে আসে প্রথম কন্যা সন্তান। নাম রাখা হয় হাসি। দ্বিতীয় কন্যার নাম খুশি। সর্বশেষ ছেলের নাম আনন্দ। পঙ্গুত্বের কারনে অভাব-অনটন তার নিত্যদিনের সাথী হলেও সুখ ছিলো সংসারে। এ জন্যই তার সন্তানদের নাম রাখা হয় হাসি, খুশি, আনন্দ। হাসির বিয়ে হয়েছে। খুশী জন্মান্ধ বলে ওর বিয়েটা হচ্ছে না। তাই বলে পরিবারের কেউই তাকে বোঝা মনে করে না। মতিপাগল খুশিকে লক্ষী খুশি বলে ডাকে। মতি পাগল মাঝে মধ্যে বাড়ী এলে অন্ধ খুশি পরম মমতায় তার সেবাযত্ম করে থাকে। তখন মনেই হয় না, খুশি অন্ধ।
আনন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার এই ঢাবিতে পড়ার বিষয়টি নিয়ে গ্রামে বিস্ময়ের শেষ নেই। একটা পাগলের ছেলে কিনা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে!!! মতি মিয়া পাগল হয় ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। তার যেটুকু জমি ছিল, তাতে সংসার ও পড়ালেখার খরচ যোগানো কঠিন হয়ে পড়ে। ষাটোর্ধ মতি মিয়া পঙ্গু জীবন নিয়ে কর্ম করার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। ছেলের পড়ালেখা বন্ধ হোক-এটাও মেনে নিতে পারেনি। এমনি একা দুর্বিষহ সময়ে মতি মিয়ার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আর এলোমেলো পাগল জীবনের পরই আর্থিক ভারসাম্য কিছুটা ফিরে আসে তার। যা নিয়ে তার পরিবারে ও গ্রামে রহস্যের শেষ নেই।
এ বছর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অর্থনীতিতে তাক লাগানো ফলাফল অর্জন করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনন্দকে দশ হাজার টাকা পুরুস্কৃত করেছে। টাকা গুলো পেয়ে সে কিছুটা সমস্যায় পড়ে যায়। টাকা দিয়ে সে কোনটা রেখে কোনটা করবে ভেবে পায় না। মায়ের পেটের পাথর বের করতে অপারেশনে প্রয়োজন ৫০ হাজার টাকা। অন্ধ বোনটার চোখে কর্নিয়া সংযোজন করতে লাগবে ৬০ হাজার টাকা। বড় বোনের স্বামীকে যৌতুকের দাবী মেটাতে প্রয়োজন হিরো হোন্ডা হান্ড্রেট সিসি মটর সাইকেল। এই টাকা দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। হঠাৎ আনন্দের মনে পড়ে যায় কাঁটার কথা। বুকটা হু হু করে উঠে তার। এই কাঁটার কথার আঁচরে একদিন রক্ত ঝরার কারনে আনন্দ আজ সেরা ছাত্র। কাঁটা এখন কোথায়...? কেমন আছে ও...? তার সন্ধান যদি পাওয়া যেত ,তাহলে না হয় টাকাগুলো দিয়ে তাকে ভাল কিছু একটা প্রেজেন্ট করা যেত।
অবশেষে টাকাগুলো আনন্দ তার পাগল বাবাকে দিয়ে দেয়। টাকা পেয়ে মতি পাগল তার বাড়ীর পাশে আড়িয়ালখাঁ নদীর তীরে নিজের জন্য অগ্রীম পাকা একটি কবর বানায়। কবর বানানোর পর কিছু টাকা রয়ে গেছে। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে সে এক খাঁচা রুটি কিনে আনলো। গ্রামের সব কুকুর জড়ো করে তাদের রুটি খাওয়ানোর আয়োজন করলো। নিমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে অনেকগুলি কুকুরের সমাগম ঘটেছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য লোকজনও জটলা বেধেছে।
কুকুরগুলি গোগ্রাসে রুটি খাচ্ছে আর ফ্যালফ্যাল চোখে মতি পাগলকে দেখছে। এর মধ্যে একটা বয়স্ক লোমপড়া ন্যাড়া কুকুর বার বার তাকাচ্ছে মতিপাগলের দিকে। মনে হচ্ছে এই ন্যাড়া ক্ষুধার্ত কুকুরটি তাকে বলেছে, ধন্যবাদ মতি পাগলা--ধন্যবাদ। কুকুরটি ও-ও-ও শব্দ করছে কিছুক্ষন পর পর। হয়তো কুকুরটির ও-ও-ও শব্দের অর্থ ধন্যবাদ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটেএলো স্থানীয় সাংবাদিকগন। মতিপাগলকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলো, লোহাজুরী গ্রামেতো ভিক্ষুকের অভাব নাই, তাদেরকে না খাওয়াইয়া কুকুরকে রুটি খাওয়াচ্ছো কেন? আর এতো টাকা পাইলা কই? মতিপাগল মৃদু হেসে উত্তর দিলো, আমি পাগল মানুষ আমি যদি মাইনষেরে লুডি খাওয়াই তাইলে যে চেরম্যান মেম্বাররার দূর্নাম অইব। হের লাইগগা কুত্তাডিরে খাওয়াইতাছি। আর ট্যাহা----ট্যাহা দিছে আমার ছেরা আনন্দ। জবর ভালা পাশ দিছে আমার ছেরা। হেই পাশের পুরুস্কারের হগল ট্যাহা আমারে দিছে।
সাংবাদিকদের দ্বিতীয় প্রশ্ন-শুনেছি সেই টাকা দিয়ে তুমি তোমার অগ্রীম কবরও বানিয়েছে?
হ, হ সাম্বাদিক সাব, ঘটনা সত্য। আইয়ূ্যন আমার কবরটা ইকটু দেইখখ্যা যাইন।
সাংবাদিকরা মতি পাগলের সাথে যেতে লাগলো। ন্যাড়া কুকুরটিও পিছু নিয়েছে। মতি পাগলের বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আড়িয়ালখাঁ নদী। বর্তমানে পানি শূন্যতার কারনের খাঁ এর উপর থেকে চন্দ্রবিন্দু উঠে গিয়ে খা খা করছে নদীটিতে। এই নদীর তীরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে কবর বানানো হয়েছে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের সাথে মিল রেখে কবরে লাল রং করা হয়েছে।
সাংবাদিকরা মতি পাগলকে তার কবরের পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললো। পরেরদিন সব পত্রিকায় তা প্রকাশ হয়। তার পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও প্রকাশ হয় সচিত্র প্রতিবেদন। বেশ পরিচিত হয়ে উঠে মতি পাগল। পাশাপাশি পাগল হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়ে যায় সকলের। ক'দিন আগে তার পাগলামীকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখতো। এখন আর কারো সন্দেহ নেই। দোকানের সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দু'টাকা দিয়ে দিচ্ছে সবাই। ভাংতি না থাকলে পাঁচ টাকা এমনকি দশ টাকাও দিচ্ছে।
হঠাৎ আয় রোজগার বেড়ে গেল তার। এবার একটি স্কুল নির্মাণের কাজে হাত দেবে মতি পাগল। অভাব-অনটনের কারনে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য স্কুল। শুধু নিজের সন্তানকেই মানুষ করলে হবে না, গ্রামের সবাইকে মানুষ করতে হবে। মনে মনে স্কুলের নাম নির্ধারণ করে ফেলে সে। "মতি পাগলের স্কুল"। স্কুলের হেড মাস্টার করা হবে আনন্দকে।
এমন দেশপ্রেম যার বুকে, সে পাগল হয় কি করে? আসলে মতি পাগল 'পাগল' নয়। সে পাগলের চমৎকার অভিনয় করে যাচ্ছে। পঙ্গুত্বের কারনে কর্ম অক্ষমতা, সংসারে অভাব, ছেলের উচ্চ শিক্ষায় অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতিতে অগত্যা নিরুপায় হয়েই সে পাগলের অভিনয় করতে বাধ্য হয়। কি কঠিন এক মিথ্যা অভিনয়। নিধারুন কষ্ট-তবুও নিজেকে সুখী ভাবে সে। কিন্তু সুখ যে বড় ক্ষনস্থায়ী। মতি পাগলের সুখের দিন বোধ হয় শেষ। মানিকখালী রেলষ্টেশনে এই মাত্র পত্রিকা এসে পৌছলো। আজকের প্রধান শিরোনাম দেখে হতভম্ব আর বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মতি পাগল। বাবা হয়ে নিজ কন্যার ধর্ষণের খবর সে কিভাবে পড়ে তার শ্রোতাদের শুনাবে...? যন্ত্রনায় তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। রেল গাড়ীর হুইসেলের চেয়েও আরো বিকট শব্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার পাশে বসা শ্রোতারা অপেক্ষায় আছে দেশের খবরাখবর জানতে। বাদাম বিক্রেতা যুবকটি বললো, কই মতি পাগলা পত্রিকা পড়া শুরু করতাছো না কেরে? লালকালি দিয়া বড় বড় কইরা কি লিখছে? নীচে দ্যাহি ছুন্দুরী একটা ছেড়ীর ফডুও। আরে পাগলা তাড়াতাড়ি পড়া শুরু কর। গাাড়ি আইয়া পড়লে আর খবর টবর জানুন জাইতনা।
মতিপাগল উঠে দাঁড়ালো। পত্রিকাটি লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো, বাংলাদেশ অহনো স্বাধীন অইছে না। এটকা শিশু জন্ম নিতে লাগে দশ মাস। এর আগে জন্ম নিলে শিশুর চোখ ফুডে না। বালা কইরা কথা কইতে পারে না। আর এই দেশটা জন্ম নিছে মাত্র নয় মাসে-এইডা অইছে না। দেশ অহনো আন্ধা...দেশের চোখ ফুডছে না। দেশ আন্ধা.....। রেল লাইনের মধ্য দিয়ে দৌড়াতে লাগলো সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চাল, ডাল তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আনন্দের অন্ধ বোন ধর্ষনের বিচারের দাবিও যুক্ত হয়েছে এই আন্দোলনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছাত্ররা মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাযর্ালয় ঘেরাও করবে।
হাজার হাজার শিক্ষার্থী নেমে গেছে রাজপথে।
"চালের দাম বাড়লো কেন? প্রধানমন্ত্রী জবাব চাই"
"তেলের দাম বাড়লো কেন? প্রধানমন্ত্রী জবাব চাই"
"অন্ধ যুবতী ধর্ষণ কারীর, বিচার চাই, বিচার চাই"
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে রাজপথে মিছিল এগিয়ে চলছে। প্রেসক্লাব পেরিয়ে মৎস্য ভবনের কাছে পেঁৗছতেই মিছিলে বাধা দিলো পুলিশ। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পুলিশ বেষ্টনীর মাঝেই শুরু করলো আরো জোরে শ্লোগান।
অন্ধ যুবতী ধর্ষণকারীর-বিচার চাই, বিচার চাই...............
শুরু হয়ে গেল পুলিশী এ্যাকশন। বেদম লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, অত:পর গুলি.....।
থমকে যায় মিছিল। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ছাত্ররা। দিকবিদিক ছুটতে থাকে সবাই। ব্যস্ততম রাজধানীর মহাসড়ক মূর্হুেতই জনশূন্য হয়ে যায়। পীচঢালা কালো রাস্তার পাশে এক যুবকের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। ঘন্টাখানেক পর একদল ছাত্র রাস্তায় পড়ে থাকা লাশটি নিয়ে মিছিল শুরু করলো -
আনন্দের বুকে গুলি কেন?
প্রধানমন্ত্রী জবাব চাই.....
পুলিশ এসময় জলকামান নিয়ে চড়াও হলে ছাত্ররা লাশটি ফেলে পালিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর আরেকটি ছাত্র সংগঠন লাশটি তুলে নিয়ে মিছিল ধরলো-
আনন্দ লাশ কেন? বিরোধীনেত্রী জবাব চাই...।
পুলিশ লাশটি তাদের হেফাজতে নিলো। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিঙ্ মিডিয়ার সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলো লাশটি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের এডিসির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন -
পুলিশ ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করলো কেন?
আনন্দ কার গুলিতে প্রাণ হারালো?
লাশ নিয়ে দু'টি ছাত্র সংগঠনের পৃথক পৃথক মিছিল করার রহস্য কি?
আনন্দ আসলে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য?
পুলিশের এডিসি পাশ কাটিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। এসময় একটি ফোন আসে তার মোবাইলে। সঙ্গে সঙ্গে বোবা হয়ে গেলেন তিনি। লাশ ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন পুলিশ কর্তা।
লাশের ময়না তদন্ত করতে এসে পাথরের মূর্তিরূপ ধারণ করলো কর্তব্যরত ডাক্তার। একি? এতো সেই আনন্দ। মফস্বল কলেজ জীবনের বন্ধু। ডাক্তার কাঁটা আনন্দকে চিনতে এতোটুকু ভুল করেনি। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। বুকে শুরু হয়েছে সুনামী। তীব্র যন্ত্রণায় বুক ফেটে যেতে চায়ছে। একজন ডাক্তার হিসাবে সে এ মূহুর্তে কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তার এ অবস্থা দেখে প্রফেসর ডা: এম.এ মান্নান জানতে চাইলেন, এনি প্রবলেম?
কাঁটা কোন উত্তর দিতে পারলো না। দু'হাতে মুখ চেপে ধরে অবুঝ শিশুর মতো কেঁদে উঠলো।
৫ বছর আগের কথা। বাবার চাকুরির সুবাদে কটিয়াদী ডিগ্রী কলেজে লেখাপড়া করার সময় কাঁটার পরিচয় হয় আনন্দের সাথে। আনন্দ অত্যন্ত শান্ত ও নিরীহ টাইপের ছিল। কাঁটা ছিল ক্লাসের যেমন সেরা ছাত্রী দেখতেও ছিল সেরা। পোষাক পড়তো একটু সেন্সর বিহীন। তাই কলেজের সবার চোখ থাকতো কাঁটার দিকে। ব্যতিক্রম ছিল আনন্দ। সে কখনো আগ্রহ করে তাকাতো না কাঁটার দিকে। বিষয়টি নিয়ে সহপাঠিদের নানান হাস্যরসের খোরাক ছিল সে। কাঁটাও লক্ষ্য করছিল বিষয়টি।
একদিন কলেজ যাওয়ার পথে হঠাৎ বৃষ্টি এসে পথরোধ করে দেয় কাঁটা ও আনন্দের। রাস্তার পাশের এক বাড়ীর বারান্দায় ওরা দু'জন দাঁড়িয়ে। কাঁটা আনন্দকে কাছে ডাকে। অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ী সমর্্পকে জানতে চায়। আনন্দ যেটুকু জানে তা বলে, উনার বাড়ীটি এইতো ৬/৭ কি: মি: দূরে মসূয়া গ্রামে। জমিদার বাড়ীটি একটি কংকাল ভবন হিসাবে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে শান বাঁধানো ঘাট। শুনেছি খুব শীঘ্রই এটিকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
কাঁটা বললো ও তাই। একদিন যাবো ওখানে। আচ্ছা আনন্দ আমাকে তোমার দেখতে ভাল লাগে না?
: হঠাৎ একথা?
: না, এমনি জানতে চাইলাম। তুমি আমাকে হিংসা কর, তাই না?
: কেন, হিংসা করবো কেন?
: এই যে আমার দিকে সবাই তাকায়, আর তুমি তাকাও না যে?
: কে বলেছে? সুন্দরকে কে না দেখে।
: আমার তো তা মনে হয় না।
: তুমি যখন হাসো তখন তোমার গালে টোল পড়ে। আমার কাছে তা অদ্ভুত সুন্দর লাগে। একটু ইতস্ত করে সে বলল, আমার ইচ্ছে হয় ওখানে ছুঁয়ে দেখতে।
কাঁটা অবাক হয় আনন্দের কথায়। গোবেচারা মনে হলেও সে অনেক গভীর জলের মাছ। অহংকার বোধ থেকে নাকি অন্য কোনো কারনে কাঁটা বললো, ওখানে ছুঁতে হলে এ জাতীয় লেখাপড়ায় হবে না। আনন্দ সেই থেকে কাঁটার এ কথায় আঁচড়ে পরিণত হয় অন্য মানুষে। যার প্রমাণ ঐ বছরই আই.এ পরীক্ষায় সেরা হয় আনন্দ। দ্বিতীয় হয় কাঁটা। যা খাল কেটে কুমির আনার মতো অবস্থা। এতে এতোটুকু কষ্ট পায়নি কাঁটা। তার কথায় বদলে যায় একটি মানুষ। বরং সে নিজেকে একটু গুরুত্বপূর্ণই মনে করেছিল। এভাবেই মনের অজান্তে ওরা একে অপরের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে।
কাঁটার বাবা হঠাৎ বদলী হয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় ঠিকানা দেওয়ার সময় হয়নি। সেই থেকে অজ্ঞাত আর অজানা রয়ে যায় কাঁটা। দীর্ঘদিন পর আবার তাদের দেখা হলো। কাঁটার দেয়া শর্ত পূরণ সত্ত্বেও আনন্দের আর তা ছুঁয়ে দেখা হলো না। অদ্ভুত সেই সুন্দর অদ্ভুত'ই রয়ে গেল।
সন্ধায় কড়া পুলিশ প্রহরায় এ্যাম্বুলেন্সে করে আনন্দের লাশ তার গ্রামের বাড়ীতে আনা হয়েছে। গ্রামের সব মানুষের গর্ব ছিল আনন্দ। মাঠে-ঘাটে চায়ের স্টলে রূপ কথার গল্প ছিল সে। একটা পাগলের ঘরে জন্ম নিয়েছে আকাশের চাঁদ। মতিপাগলের বাড়ীতে নারীপুরুষ শিশুর ঢল নেমেছে। সবার চোখে জল। গগন বিদারী চিৎকার আর জলে একাকার আনন্দের মা-বোন। শুধু জল নেই মতি পাগলের চোখে। তার চোখ দু'টি লেলিহান শিখার মতো। লাশবাহী খাটিয়ার পাশে বৃক্ষ মানবের মতো ঠাঁয় বসে আছে মতি পাগল। কোন কথা নেই, আর চোখেতো জল নেই'ই।
কটিয়াদী মডেল থানার ওসি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দ্রুত কবর খুঁড়া ও জানাযার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। চেয়ারম্যান সরকারী গোরস্থানে চৌকিদারকে কবর খুঁড়ার কথা বললে মতি পাগল হুংকার দিয়ে উঠলো। না,কারো জায়গায় আমার আনন্দের কবর দিওনের লাইগগা দিতাম না!
চেয়ারম্যান বললেন, তাহলে কোন জায়গায়? বলো মতি পাগল? মতি পাগল মাথার ইশারায় দেখালো কবরের স্থান। মাথা নাড়াতে গিয়ে তার মনে হলো, মাথায় কয়েকটন ওজনের কোন বস্তু। প্রচন্ড ভারের চাপে থর থর করে কাঁপছে মাথাটা। পিতার কাছে সন্তানের লাশ বহন করা পৃথিবীর বড় ট্রাজেডি।
মতিপাগলের অগ্রীম কবরের পাশে মাটি খুঁড়তে গেলে সে ধরাজ গলায় বললো, চেয়ারম্যান নতুন কইরা আর কবর করুনের দরকার নাই। আমার কবরে আনন্দরে শোয়াও।
বিস্ময়ভরা কন্ঠে চেয়ারম্যান বললো, কি বলতাছো এইসব...?
যা কইছি তাই কর চেয়ারম্যান, বলেই হা-হা-হা করে হেসে উঠলো মতি পাগল। হাসির তোড়ে পড়নের পরিহিত চটের বস্তা বার বার নীচে পড়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা চালাচ্ছে সে।
হাজার হাজার মানুষ জানাযায় দাঁড়ালো। স্থানীয় মসজিদের ইমাম নামাজের তাহরিমা বাধলেন- আল্লাহু আকবার... আল্লাহু আকবার...
রাত তখন দশটা। আজ ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় মানিকখালী রেলষ্টেশনটি অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব লাগছে ছোট্ট এই ষ্টেশনটি। জোছনা ভরা এমন রাতে ষ্টেশনের ডান পাশের খোলা জায়গায় মতি পাগল মরে রয়েছে। তার নগ্ন লাশের চারদিকে উৎসুক মানুষের ভিড়। একটু দূরে বসে আসে একটা ন্যাড়া কুকুর।
মানুষগুলো এখনও লাশটি দাফনের কোনো ব্যবস্থা না করে নগ্নদেহ দেখছে। মতিপাগলের চোখ দু'টি খোলা। যেনো মনে হচ্ছে, সে জোছনা রাত উপভোগ করছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন অনেক বেদনাদায়ক গল্প। মন খারাপ করা ভালো লাগলো।
এস, এম, ফজলুল হাসান চমৎকার একটা লেখা , ভালো লাগলো , ধন্যবাদ ভাই |
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অসম্ভব ভালো লেগেছে আপনার গল্প পড়ে। শুভ কামনা বন্ধুর জন্য....
সুমননাহার (সুমি ) অনেক সুন্দর লিখা সুভকামনা রইলো.
আয়েশা সাফা wao.....new look......ভালো লাগলো
শেখ একেএম জাকারিয়া চমৎকার একটি গল্প ।বাস্তবধমী।শুভকামনা।
মোঃ আক্তারুজ্জামান দম বন্ধ করে এক টানে যেন পড়ে ফেললাম| অসাধারণ গল্প এই বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই| লেখকের প্রতি অনেক অনেক শুভ কামনা রেখে গেলাম|
রওশন জাহান মন্তব্য করার ভাষা এই মুহুর্তে আমার নেই অসাধারণ এবং নান্দনিক এই লেখার. অনেক অনেকদিন পর এরকম একটি লেখা পড়লাম.
Azaha Sultan রাজু, আপনার লেখা তবে পূর্বে পড়া হয় নি আমার......সূর্যের লিঙ্ক দেখে আগমন.....অসাধারণের চেয়ে বেশি বোধহয় মার্ক আর নেই.......

০৬ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪