রক্তক্ষরণ

মা (মে ২০১১)

নাঈম হাসান আসিফ আসিফ
  • ১২
  • 0
  • ৫০
মা, ছোট ভাই, ছোট বোন নিয়ে আমাদের সংসার। বাবা গত হয়েছে বছর দেড়েক হলো। সামান্য একজন প্রেস মেকার ছিলো আমার বাবা, তবে তার চেয়ে বেশী ছিল এক আদর্শবান মানুষ। বাবা তাঁর এই চাকুরীটাকে শ্রদ্ধা করত খুব, আর আমি শ্রদ্ধা করতাম বাবার এই আদর্শটাকে। দিন এনে দিন খেতাম এই ছিল আমাদের সংসার জীবন। ছন্দময় সংসার ছিল আমাদের তা বলবো না কখনো, দিন বদলের সাথে সাথে কখনো ছন্দহীন হয়েছে এটা যেমন ঠিক, ঠিক তেমনি আমার বাবা ধৈর্য সহকারে সেগুলো মোকাবেলাও করেছেন। আমার মা ছিলো তাঁর আদর্শবান পুষ্ট এক গৃহিণী। মা’কে দেখিনি কখনো রঙ্গিন কোনো পোশাকে। তবুও কোনো দাবী ছিলো না আমার মা’র। আমার মা’র চোখের দিকে তাকালে মনে হতো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় আমার মা। বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো আমাকে অনেক বড় মাপের আদর্শবান মানুষ বানাবেন। একদিন ভাত খাওয়ার সময় বাবা আমাকে ডেকে বললেন, “ বাবা, জীবনে আদর্শটা বেচিস না, আদর্শটাকে সব সময় ধারণ করবি”। বাবার এই কথাটা এখন মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। হারিয়ে যাই ফেলে আসা সেই শৈশবে। একদিন আমার বাবা বাহির থেকে ঘরে ঢুকে মা’কে বলেছিলেন, “ জানো, বাজারে অনেক আম দেখলাম, টাকা ছিল না বলে কিনতে পারলাম না” । পাশের ঘর থেকে শুনে ফেলেছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই আম কখনই খাব না, একদিন আমার টাকা হবে, বাবা’র সামনে বাজারের সব আম রেখে দিব, আমার বাবা পরাণ ভরে সেই আম খাবে, আর আমি দেখব তাঁর হাস্যজ্জোল মুখ। না, টাকা নামক দুর্লভ বস্তু আজও ধরা দেয় নি আমার কাছে, বাবাও চলে গেছেন অনেক দূর দেশে, হয়ত অনেক অভিমান বুকে নিয়ে। কিছুদিন আগে অনার্সটা শেষ করলাম। অনার্সে পড়ার সময় ভালবেসেছিলাম স্বপ্না নামের এক মেয়েকে ।জানতাম এটা নিছক এক পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। তবুও ভালবেসে গেছি, আর দশ জনের মতো স্বপ্ন দেখেছি, নতুন নতুন স্বপ্ন বুনেছি।স্বপ্নার বাবা-চাচারা ছিল অনেক ধনী, ওদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ আমাদের ছিল না।বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর হঠাৎ আমার এক বন্ধু এসে আমাকে বললো, স্বপ্নার বিয়ে হয়ে গেছে। কিছু বলতে পারলাম না, জানতেও চাইলাম না কোনো কিছুই। সদ্য বিধবা মা’র দিকে তাকিয়ে ভুলে গেলাম সব কিছু।অনার্স শেষে হন্য হয়ে খুঁজলাম একটা চাকরী। শুধু একটা চাকুরী। একটা চাকুরীর আশায় দিনের পর দিন অফিসার দের বাসায় গিয়ে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দেখা করেছে, কখনো বা দরজা খুলে মুখের সামনে বলে দিয়েছে, “ টাকা ছাড়া ত কাম পাইবা না”।ফিরে এসেছি সেখান থেকে আর মনে পড়েছে আমার আদর্শবান বাবার কষ্ট মাখা মুখটার কথা। একদিন ঘরে বসে আছি । ছোট বোন মা’র ঘরে গিয়ে কিছু টাকা চাইল পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে হবে বলে। পাশের ঘর থেকে বুঝতে পারলাম আমার মা এক সাথে এত টাকা দিতে পারছেন না। মা’র সেই কষ্টমাখা মুখটার কথা মনে পড়ে নিজেরই খারাপ লেগেছিলো। সেই রাতে ছুটে গেলাম বন্ধু আফজালের বাসায় । বন্ধু আফজালের বাবা বিরাট ধনী মানুষ। না, সেখানে গিয়েও কোনো কাজ হলো না। বাড়ির পুকুর পাড়ের ঘাটে বসে আছি। চিন্তা করছি জীবনের হিসেব-নিকেশ। পেছন দিক থেকে কে যেন কাঁধে হাত রাখল। দেখলাম কুপি হাতে আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন। কুপির নিবু নিবু আলোতে দেখলাম মা’র ছল ছল চোখ। মা বললো, “ ঘরে আয়, শুয়ে পড়”। কোনমতে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রঞ্জুও ঘুমিয়ে পড়েছে। মা’র বিছানায় গুটি সুটি মেরে ঘুমিয়ে গেছে লতা। মা’কে কিছুই বলতে পারলাম না। নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম। চিন্তা করতে লাগলাম সামনেই ঈদ। কতদিন আমার মা, আমার ভাই, বোন নতুন কোনো জামা কাপড় পরে না। কতদিন আমার বোনকে দেখি না আমার সামনে এসে বলতে, “দাদা, কিছু টাকা দিবি?” ছোট্ট ভাইটার মুখে শুনি না, “ ওই দাদা, আমার জন্য একটা খেলনা আনবি”। ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে গেলো। পাশে শুয়ে থাকা ভাইটার কপালে চুমু দিয়ে দিলাম। ভাবলাম ভোরেই ঢাকায় ছুটবো। দেখি কিছু করা যায় কিনা। ঘুম থেকে উঠে মা’কে বললাম। যাওয়ার সময় আমার হাতে মা কিছু টাকা গুঁজে দিল। হঠাৎ করেই চোখে জল এসে গেলো, মা কে বুঝতে দিলাম না। ঢাকায় এসে চাকুরী খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ একদিন স্বপ্নার সাথে দেখা হয়ে গেলো রাস্তায়। অনেক প্রশ্ন করলো। আমি কেমন আছি, কোথায় আছি, কি করছি আরও অনেক কিছু।কিছুতেই বুঝতে দিলাম না আমার বর্তমান অবস্থা। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেমন আছ? স্বপ্না কিছু বললো না, মাথা নিচু করে রইলো।কিছুক্ষণ কথা বলে আবার শুরু করলাম চাকুরী খোঁজা। কিছু দিন পর পেয়েও গেলাম চাকুরী।সেই প্রেসের চাকুরী। বাবার কথা মনে পড়লো খুব। রাতে ঘুমাতে গেছি। স্বপ্নে দেখলাম বাবা আমার কাছে এসে বলছেন, “ বাজান, শেষ পর্যন্ত বাপের চাকরীই ধরলি” হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঈদের কিছু দিন আগে পারিশ্রমিকের টাকা পেলাম। মা’র জন্য শাড়ী, ভাই এর জন্য শার্ট, বোনের জন্য সালোয়ার-কামিজ কিনে বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরলাম। নিজের জন্য কিছু কিনলাম না। গত বছর স্বপ্না একটা শার্ট দিয়েছিলো, ওইটা ধুয়ে নিলেই চলবে। ট্রেনে যাচ্ছি আর নিজের কাছে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। কত দিন পর মা’কে দেখবো নতুন শাড়ীতে, রঞ্জুকে দেখবো নতুন শার্ট গায়ে ঘুরে বেড়াতে, লতাকে দেখবো সুন্দর করে সেজেছে। ভাল লাগার মানুষ গুলো সুখে থাকলে নিজেরই ভাল লাগে। বাসায় যখন পৌঁছাই তখন প্রায় সন্ধ্যা। নিবু নিবু হয়ে আসছে দিনের আলো। মা তখন সাঁঝ বেলার প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন। কিছু একটা আওয়াজ শুনে মা প্রদীপ হাতে বাইরে এলেন। মা বলে ওঠেন, “ বাজান, আসলি?” । কতদিন ধরে এই ডাকটা শুনি না। হঠাৎ করে মনে পড়লো বাবার কথা। যখন প্রথম একা একা ঢাকা যাই তখন ফিরে আসার সময় বাবা দাঁড়িয়ে ছিল বাস স্ট্যাণ্ডে। বাবা বাড়ি ফিরে আসার সময় কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “ বাবা, ঢাকা শহর কেমন দেখলা?” ঘরের ভেতর ঢুকার আগেই রঞ্জু এসে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদা, কেমন আছিস?” আহা!!! রঞ্জুও আজকাল কোনো আবদার করে না, আচ্ছা, ও কি বোঝে, ওর দাদা ওর স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ। রঞ্জুকে বললাম, তোর জন্য শার্ট –প্যান্ট এনেছি। বলার সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লো রঞ্জু আমার ব্যাগের ওপর। ও খুব খুশি হলো। আহা!!! কতদিন পর ও একটা নতুন শার্ট পেলো। রঞ্জু ছুটে গেলো ঘরে। লতা দৌড়ে আসলো আমার কাছে, বললো, দাদা, আমার জন্য আনিস নি? আমি না করলাম। ঠোঁট ফুলিয়ে রেগে চলে গেলো লতা। ছুটে গেলাম ঘরে, বললাম, দিদি, তোর জন্য না এনে পারি? তোর জন্যও এনেছি। ও আমার বুকে মাথা রাখলো।খুব, খুব খুশী হলো লতা। নতুন কাপড় পেয়ে দুজনই খুশীতে আত্মহারা। একটু পরেই ঘুমাতে গেলো রঞ্জু আর লতা। মা’র নতুন কাপড় হাতে নিয়ে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি মা খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর ছেঁড়া কাপড় সেলাই করছেন। মা’র সেলাই এ বাঁধা দিলাম। নতুন কাপড়টা মা’র হাতে দিয়ে বললাম, মা, এটা আপনার জন্য। মা কাপড় হাতে নিয়ে বললেন, ভালই ত কিনতে পারিস। একটু পর মা আমাকে বললেন, বাবা, তোর জন্য কিনেছিস তো? মা’র কাছে কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারি নি। তবুও আজ কেনো জানি মাথা নিচু করে হঠাৎ করে মিথ্যা কথা বলে বসলাম, হ্যাঁ, কিনেছি। মা আমার হাত ধরে বললেন, সত্যি কিনেছিস? এখন একটু রেগে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ, মা, কিনেছি। মা আমার মুখ খানি তাঁর মুখের দিকে ধরে বললেন, বাবা, সত্যি করে বল, কিনেছিস তো? কিছু বলতে পারলাম না চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল পড়ে গেলো। শাড়ীটা টেবিলে রেখে মা শু’তে চলে গেলেন। জানি, কয়েক ফোঁটা জল মা’র চোখ দিয়েও পড়ছে। সবাই কি সব কথা বলতে পারে? কেউ বলে মুখে, কেউ বা আবার চোখের জলে। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী লাগলো। রাত বাড়তে থাকে। পশ্চিমের চাঁদটা তখন হেলে পড়েছে পুব আকাশে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শিশির সিক্ত পল্লব সবাই কি সব কথা বলতে পারে? কেউ বলে মুখে, কেউ বা আবার চোখের জলে.......সত্যিই মা অতুলনীয়া....শার তুলনা শুধু মা..........মা ছাড়া আর কে বুঝবে সন্তনের কষ্ট
আনিসুর রহমান মানিক অনেক অনেক ভালো লাগলো /
সূর্য আসিফ, তোমার যে জন্ম সাল/তারিখ দিয়েছে তখন আমি কলেজে পড়ি। সেই এতটুকুন ছেলে তুমি, তোমার লেখা পড়ে চোখে পানি চলে এসেছে। যেন আমার জীবনটাই তুমি লিখে দিয়েছ। ........... ভালো থেকো এবং এরকম আরো লিখো.........
sakil অনেক ভালো একটা গল্প পরলাম সেজন্ন্ন আপনাকে ধন্যবাদ . লিখে যান
মাহমুদা rahman আবেগটা সত্যি আমাকে ছুয়েছে...আমি এইলেখকের সাফল্য কামনা করি তবে গল্পের প্যারবিরাম চিহ্ন ঠিক থাকলে হয়ত কোন অপূণর্তা থাকত না............
আবু ফয়সাল আহমেদ এত চমৎকার একটা লেখা কারও চোখে পড়েনি!!! সহজ কথায় আবেগকে থরে ফেলেছেন। ভাল লাগলো? মানুষের আত্ম-উপলব্ধিই মানুষকে বড় করে তোলে।
আহমেদ সাবের বড় হৃদয়কাড়া গল্প। সুন্দর প্রকাশভঙ্গী। শুভেছা থাকলো। বপ্না কিছু বললো না, মাথা নিচু করে রইলো ...গল্পটা বাড়ানোর একটা সুত্র রেখে দিলেন মনে হয়।
বিন আরফান. মায়ের সাথে বাবার প্রসঙ্গ এনেছেন তাই প্রথম ধন্যবাদ. ২য ধন্যবাদ গল্প গল্পের মত মধুময় হয়েছে. বেদনার গল্পে যত সুখ সব খুজে পেয়েছি. প্যরা করে লিখলে আরো ভালো লাগত.
এস, এম, ফজলুল হাসান ভাই আপনার গল্পটা ভালো লাগলো , আরো সুন্দর সুন্দর গল্প চাই

০৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪