কনক রহমানের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলায়। যে গ্রামে বাড়ি তাকে গ্রাম না বলে উপশহর বলা যেতে পারে। কনক রহমান থাকে ঢাকা। চাকরি করে একটা এন.জি,ও. তে। ওর স্ত্রী, শায়লা রহমান একটা ব্যাংকে আছে। শায়লার চাকরির জন্য তো বটেই, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও শায়লাকে গ্রামে থাকতে হয়েছে।
কনক রহমানের ইচ্ছা, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করবে। কিন্তু টাকার জোগাড় করে উঠতে পারছে না। ভেবেছিলো, ব্যবসা শুরু করতে পারলে গ্রামে চলে যাবে। এই কথা ভেবেই শায়লাও আর ঢাকা আসতে চায় নি। একবার বদলি হলে আবার ফিরে আসা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই শায়লা গ্রামেই রয়ে গেছে। ওখান থেকে ওর ব্যাংকে আসতে রিকশায় ত্রিশ মিনিট লাগে। ঢাকার মতো যানজট তো নেই ওখানে। ঢাকায় তো যানজটের জন্য সব কাজেই লেট হয়ে যায়। কিংবা সঠিক সময়ে পৌঁছতে চাইলে নিদেনপক্ষে ঘন্টাখানেক সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়।
মায়ের স্ট্রোক করেছিলো। একপাশ অবশ। বিছানায় শুয়ে থাকে। মা, শায়লার কাছেই থাকে। সব কাজই করে দিতে হয়। মায়ের বেশীরভাগ কাজ গুলো কনকের স্ত্রী, শায়লাই করে। কনকের খুব লজ্জা করে তাতে। ও মায়ের জন্য সময় দিতে পারে না। অফিসের কাজে দেশ-বিদেশ করতে হয়। মায়ের কাছে বাড়িতেও প্রতিমাসে যেতে পারে না।
অফিস, বাড়ি, ঘর-সংসারের কাজসহ মায়ের দেখ-ভাল করা, শায়লার জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। মায়ের জন্য সবসময়ের একটা কাজের লোক পাচ্ছে না। চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের মেয়েরা যারা একটু লেখা-পড়া জানে তারা ঢাকায় এসেছে। এখন তারা সেলাই কর্মী। যারা গ্রামে আছে, তাদের অনেকে ধান - কলে কাজ করে।
স্বাধীন কাজ রেখে কেউ অন্যের বাসায় কাজ করতে আসতে চায় না। ধান-কলে ধান সেদ্ধ, শুকানো, চাউল ঝাড়া এইসব কাজ। মাস গেলে বেতন তো আছে, আরও আছে চাউল ঝাড়লে তুষের ভেতরের চাউলের খুদ পাওয়া যায়। অনেক সময় মিল মালিক এই খুদ নেয় না। ওদের দিয়ে দেয়। এতে ওইসব মেয়েদের ভালোই উপার্জন হয়।
কেউ কেউ বাড়ির আঙিনায় সবজীর বাগান, হাঁস,মুরগি লালন-পালন করে। কারও গরু আছে, আছে ছাগল। দুধ বিক্রি করে, ডিমের জোগান দেয় দোকানে দোকানে। কেউ বা সেলাই ট্রেনিং নিয়েছে, পেয়েছে সেলাই মেশিন, তাই দিয়ে গ্রামের মেয়েদের পেটিকোট, ব্লাউজ, বাচ্চাদের শার্ট,প্যান্ট সেলাই করে। নকশি কাঁথা বানায়।
এখন যে মেয়েরা কর্মঠ, তারা অল্প লেখা-পড়া জানলেও তাদের অবশ্য কাজের অভাব নেই। স্বাধীনভাবে তারা অনেক কাজই করতে পারে। বর্তমানে শহর ঘেঁষে ই.পি.জেড. হওয়াতে অনেক মেয়েই এখন ওখানেও চাকরি করছে। তাছাড়া, সরকার থেকে কম মূল্যে ভিজিডি কার্ডে চাউল,গম পায়। এখন সব মিলিয়ে বাড়িতে কাজের জন্য লোক পাওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লোক পাওয়া যাচ্ছে না তাই শায়লাকেই সব করতে হয়। শায়লা না করে না, বিরক্তি প্রকাশও করে না, তবুও কনক রহমানের লজ্জা লাগে। শায়লাকে বলেছে, মাকে দেখ-ভালের জন্য তোমাকে কোন হেল্প করতে পারছি না, আমাকে ক্ষমা করো। শায়লা হেসেছে কি যে বলো, আমার মা হলে কি তাকে ফেলে দিতাম। তাছাড়া, তুমি এখানে থাকলে তো মায়ের
কাজগুলো করতে আমাকে হেল্প করতে, না কি করতে না। এ নিয়ে মন খারাপ করো না।
শায়লা বলে, মা, মানে মা। মায়ের জন্যই এ পৃথিবীতে আসা। মায়ের অবদানেই এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা। মা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মা, ঈশ্বরের স্বর্গীয় অবদান। মায়ের অবহেলা করা মানে জীবনকে অবহেলা করা। মা, তোমার মা, আমার মা বলে কোন কথা নেই। একজন মা, মানে সবারই মা। মায়ের জন্য ভালোবাসা সবার মনে জেগে উঠুক।
কনক রহমানের আরও এক ভাই আর এক বোন আছে। বোন, স্বামীর সঙ্গে কানাডা থাকে। মিশা বলেছিলো, ওর কাছে মাকে পাঠিয়ে দিতে, কিন্তু কনক পাঠায় নি। ছেলে থাকতে মেয়ের কাছে কেন থাকবে মা। বড়ো ভাই, তামির থাকে রাজশাহী। ব্যবসা করে। ভাবী স্কুলে। ভাবী, তার ছেলে,মেয়ে নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না, তাই মাকে রাখে নি কনক।
অসুখের পর দুই মাস ছিলো বড়ো ভাইয়ের কাছে, কিন্তু অযত্ন, অবহেলায় মায়ের অসুখ বেড়ে যাওয়াতে কনক নিয়ে এসেছে।
কনক রহমান গ্রামে এসেছে। ছুটি নিয়েছে সাত দিন। বাড়ি এসেছে বড়োভাই তামির রহমান, ভাবী। কী সব কথা আছে।
বিকেল বেলা। ড্রয়িং রুমে ভাই, ভাবী, কনক আর শায়লা। ছেলে,মেয়ে সঙ্গে আনে নি ওরা। থাকবে দুই দিন। চা খেতে খেতে কথা বলছে।
ভাবী বলে, কনক শোন মা তো কখন আছে কখন নাই তার ঠিক নাই। তাই তোমার ভাই বলছিলো, জমি গুলো সব ভাগ করে নিলে ঠিক হয়। তোমাদের কাছে মা থাকে, কখন তোমরা লিখে টিখে নাও তার ভরসা তো নাই। তাই আর কি!
তোমার কথা নয়, তুমি তো আর নিজের ভাইকে ঠকাবে না। কিন্তু আর কারও তো ভরসা নেই।
কথা শুনে কনকের রাগ হয়ে যায়। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। বলে ঠিক আছে। কিন্তু মায়ের পক্ষে তো এখন এসব করাও সম্ভব না। মায়ের অসুখ বেড়েছে। গত মাসে আবার স্ট্রোক হয়ে গেছে জানোই তো।
সেই জন্যই তো বলছি। শুনেছি, তিনবারের স্ট্রোকে মানুষ আর বাঁচে না। তোমাদের কাছে আছে তাই---
ভাবী! কনক নিজেকে সামলাতে পারে না। জমি, বাড়ি লিখে নেওয়া নিয়ে যদি এতোই তোমাদের ভয় মাকে নিয়ে যাও।
এখানে মাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা আসছে কেন? তামির উষ্মা প্রকাশ করে।
ভাইজান, আমি তোমাকে বলছি না। ভাবীকে বলছি। তাছাড়া, মা তো তোমারও। শুধু আমার একার নয়। আর শাশুড়িও, শায়লার একার নয়, ভাবীরও। সম্পত্তির ভাগ সমান সমান হবে আর দায়িত্ব সমান হবে না, তাতো ঠিক নয়।
কি, তুমি আমাকে দায়িত্ব শেখাচ্ছিস! মিলা, ঠিকই বুঝেছে। তোরা সম্পত্তির জন্যই তো মাকে দেখ-ভাল করছিস।
ওর কথা মতো এসে তো ভালোই করেছি। আসলে মেয়েরা সংসার সম্পর্কে ভালো বুঝে।
সংসার ভাবী ভালো বুঝে, দায়িত্ব বুঝে না, তাই না। মা, আমার মা, তোমারও মা। শায়লা তাকে দেখ-ভাল করছে, এর জন্য শায়লার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। ইচ্ছা করলে সে আমার মাকে না দেখলেও আমার বলার কিছু ছিলো না। আমি, তাকে কিছু বলতামও না। তাই বলে তুমি এমনভাবে কথা বলবে তা আমি মেনে নিব, কখনই না।
তুমি চুপ করো। কেউ যদি মায়ের সেবা না করে, না দেখে, আমি দেখবো। দোহাই তোমাদের, তোমরা চুপ করো। মা, পাশের ঘরে সব শুনতে পাবে। শায়লা ওর স্বামীকে থামতে বলে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, আমি আমার মনের তাগিদে মায়ের দেখাশোনা করছি, কোন সম্পত্তি পাওয়ার জন্য নয়। সবাই দেখছে, দেখবে, আমি কী জন্য কী করেছি, করছি।
শায়লা, এতক্ষণ কথা বলে নি। ভাইদের কথার মধ্যে কথা বলা ওর পছন্দ নয়। কিন্তু কথা না বলে থাকতে পারে না। এর বেশী কথা বলা উচিত হবে না। শায়লা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
শায়লার কষ্টটা ওকে আহত করে। এইটুকু বিষয়-সম্পত্তি! মায়ের থেকে কী সম্পত্তিই বড়ো। মা ইকুয়াল টু সম্পত্তি,তাই যদি হয়,তাহলে সে সম্পত্তির আসল হকদার হওয়ার কথা তো শায়লার। শায়লাই মায়ের দেখ-ভাল করেছে, করে। এবং ভবিষ্যতেও করবে তা কনক ভালোভাবেই জানে। তাহলে কনক, বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বড়ো ভাইয়ের ব্যবহার, ভাবীর কথাবার্তা ওকে খুবই পীড়িত করে।
তবুও তামিরকে বলে, ভাইয়া, তুমি কাগজপত্র সব ঠিক করো, ইচ্ছা করলে সব তোমার একার নামেও নিতে পারো। আমি
কিছু বলবো না।
তামির খুশি হয়ে যায়। ঠিক আছে, সব আমি ঠিক করেই এনেছি। আমি একা না, তোরও ভাগ আছে। যাও মিলা, দলিলটা নিয়ে এসো।
আমার আর তোমার করেছো, মিশার ভাগ করো নি? ও তো আমাদের বোন। মায়ের সম্পত্তিতে তো ওরও অধিকার আছে।
ও কি মায়ের দেখ-ভাল করেছে? তাছাড়া ও বিদেশে থাকে, ওদের টাকার দরকার নেই। এমনিতেই ওদের অনেক টাকা।
আর একটা কথা, মায়ের সব সম্পত্তি যদি মা, আমাকে দেয় আমি, মাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
বিস্মিত কনক, চুপ করে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের মুখের দিকে। কথা বলে না। এই তার ভাই! এই ভাইয়ের জন্মের মধ্য দিয়েই তো মায়ের মাতৃ জীবনে প্রথম পা রাখা। তার প্রথম মা হওয়া। এক জীবনে একটা নারীর তিনটি অধ্যায়। কন্যা, জায়া, জননী। এক অধ্যায়, এই মাতৃত্ব। মা হওয়ার পর এক নারীর সব আশা আকাঙ্ক্ষা, সব স্বপ্ন থাকে তার সন্তানকে ঘিরে। একজন মায়ের অনেক সন্তান থাকতে পারে, কিন্তু প্রথম সন্তানের আবেদন মায়ের কাছে অন্যরকম। কারণ প্রথম সন্তানের জন্মের মধ্য দিয়েই তার নতুন অধ্যায়ের শুরু। এক জীবনের মধ্যেই অন্য এক জীবন।
কি রে, কথা বলছিস না কেন? আমার কথা পছন্দ হয় নি তোর?
পছন্দ হবে না কেন? মিলা বলে। হাফ ছেড়ে বাঁচবে। দেখলে না ওর বউ কি ভাবে কতো কথা বললো, তারপর আবার ঢং দেখিয়ে চোখের পানি ফেললো। তুমি, পুরুষমানুষ, তুমি এসব চালাকি ধরতে পারো নি কিন্তু আমি সবই ধরতে পেরেছি।
শায়লা,রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজগুলো সেরে ফিরে আসে আবার। কিন্তু ঘরে ঢুকতে গিয়ে মিলার কথাগুলো শুনে খুব কান্না পায় ওর। ও ভাবে, সবসময়ই এইরকমই 'পাওয়া' হয় কেন ওর। সব সময়েই দেখেছে কোন কাজের কোন প্রশংসা কিংবা কোন ভালো কিছু পাওয়া ওর জন্য থাকে না। ও যেন শুধু কর্মের অংশীদার, কর্মফলের অংশীদারিত্ব ওর জন্য নয়।
যে কথাগুলো ও বলেছে, ও তো ঠিকই বলেছে। ওর এটা অভ্যাস, ও কারও মন রেখে কথা বলতে পারে না। ও আর কিছু বলে না। ঘরেও ঢোকে না। শাশুড়ির ঘরে চলে যায়। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে শাশুড়ি। চোখ খোলা। কেমন সন্দেহ হয় শায়লার। দৌড়ে কাছে আসে। হাতের পালস দেখে। নাকের সামনে হাত নিয়ে পরীক্ষা করে। বুকে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে। তারপর চিৎকার করে ডাকে। মা, মাগো।
ওর চিৎকার শুনে ওঘর থেকে ছুটে আছে ওরা। ডাক্তার আসে। আবার স্ট্রোক করেছে। পৃথিবীর সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে চলে গেছে তার নিজের ঠিকানায়। মায়ের মৃত্যু নীরবে বলে চলেছে, তোমাদের কাছে আমার কিছুই চাওয়ার নেই, ছিলো না কখনও। সারাটা জীবনে আমার শুধু একটাই চাওয়া, তোমরা ভালো থাকো, সুখে থাকো। আমার সব কিছু, আমার এই জীবনটাও তো তোমাদের জন্যই।