আজগর আলী শুয়ে রয়েছে। একটা ওভারব্রিজের উপর। তার পাশদিয়ে মানুষ আসছে যাচ্ছে। সে মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে তার থালায় কয়টা পয়সা পড়লো। পয়সা কিছু বেশি জমে গেলেই সে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে পয়সাগুলো নিয়ে ভরছে নিজের পকেটে। মানুষ থালায় পয়সা দেখলে দিতে চায় না। কিন্তু কেউ কি বোঝে এই কটা পয়সা দিয়ে কিভাবে জীবন চলে! আজগর আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজগর আলী সামনের দিকে হাত পেতে বসে থাকে। মাঝে মাঝে মানুষের পা ধরতে চেষ্টা করে। সবাই হাত যেন পায় না লাগে সেই চেষ্টা করে। যেন হাতটা বিষাক্ত কিছু। মাঝে মাঝে কেউ কেউ সহানুভূতিশীল হয়। তার থালায় দুই একটা পয়সা পরে। আজগর আলীর কাছে মনে হয় মানুষের মাঝে বুঝি কোন সহানুভূতি নেই। মানুষ পাথরের হয়ে গেছে। রাস্তার মাঝে কেউ বিপদে পড়লে ফিরেও তাকায় না। আরও পা চালিয়ে হেটে যায় যেন সে কোন বিপদে না পড়ে। আজগর আলী চোখে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য। কয়েকদিন আগের ঘটনা। সন্ধ্যার সময়। আজগর আলী ব্রিজের উপর থেকে দেখছিল। নিচ দিয়ে একটা রিক্সা যাচ্ছে। রিকসায় একটা মেয়ে বসা। হঠাৎ উল্টোদিক থেকে একটা ছেলে এসে রিকসা থামিয়ে চাকু বের করলো এবং চাকু দেখিয়ে টান দিয়ে মেয়েটার হাত থেকে ব্যাগ ও গলা থেকে চেনটা নিয়ে দৌড় দিল। মেয়েটা একটা চিৎকার দিল। কিন্তু কেউ ফিরেও তাকাল না। সবাই উল্টো দূরে সরে গেল। আজগর আলী নিচে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন বয়স হয়ে গেছে। শরীরে জোড় পায় না। তাই নিচে নামার আগেই ছিনতাইকারী চলে গেল। আজগর আলীর কাছে তাই মনে হয় মানুষ বদলে গেছে। সবাই নিজের নিজের চিন্তা করে। আরেকদিন এক লোক ব্রিজের উপর দিয়ে হেটে আসছে। লোকটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ আজগর আলীর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। উঠে হঠাৎ করে আজগর আলীর গালে একটা চড় লাগিয়ে দিল। আজগর আলী সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল। লোকটার বাবার বয়সী একজনকে সে কিভাবে চড় লাগালো। মনে দু:খও পেয়েছিল। চিন্তা করেছিল ব্রিজের উপর আর বসবেই না। কিন্তু এই বয়সে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিক্ষা করতে ইচ্ছা করে না। তাই ব্রিজের উপর এসে শুয়ে পড়ে। সাথে করে একটা ছেড়া কাঁথা নিয়ে আসে শোয়ার জন্য। আজগর আলীর শুয়ে থাকতে ভালই লাগে। আগেকার দিনের কথা মনে করে। ভিক্ষা করতে গিয়ে তার জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। সেইসব কথা শুয়ে শুয়ে মনে করে। কিছু দু:খের স্মৃতি, কিছু সুখের স্মৃতি। আজগর আলী বিয়েও করেছিল। তাদের একটা সুখের সংসার ছিল। সে আর তার স্ত্রী একসাথে ভিক্ষা করতে বের হত। আজগর আলী ভিক্ষা চাইত রাস্তায় রাস্তায়। সিগনাল পড়লে গাড়ির কাছে গিয়ে। একদিন রাস্তায় ভিক্ষা করছে। সিগনাল পড়ার পর একটা গাড়ির কাছে গেলো ভিক্ষা চাইতে । সে দেখলো গাড়ির ভেতর একজন বিদেশী বসে রয়েছে। তবুও সে ভিক্ষা চাইল। সে শুনেছে বিদেশীরা নাকি ডলার দেয়। তা থেকে অনেক টাকা পাওয়া যায়। তো ভিক্ষা চাওয়ার পর সাহেবটি কী যেন ভাবলো। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'ক্যান আই টেক আ পিকচার অফ ইউ।' আজগর আলী কিছু বুঝলো না। সামনে একজন বাঙালি বসে ছিল। সে বুঝিয়ে বললো, "এই সাহেব তোমার ছবি তুলতে চায়।" আজগর আলী একটা দাঁত কেলিয়ে হাসি দিল। অর্থাৎ তার কোন সমস্যা নেই। তখন সাহেবটি তার একটি ছবি তুললো। তারপর তার হাতে একটি নোট ধরিয়ে দিল। পরে দেখেছিল ওটা একটা পাঁচ ডলার। আরেকদিন এক সাংবাদিক আসলো তার সাক্ষাৎকার নিতে । তাদের হেনতেন প্রশ্ন। কোথায় গ্রামের বাড়ি, কোথায় থাকেন, কবে বিয়ে করেছেন, প্রতিদিন কয় টাকা পান, কখন বেশি পান, কখন কম। রাজ্যের প্রশ্ন। আজগর আলী সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিলেন। তারপর তারা যাওয়ার আগে তাকে একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে গেল। সে জেনে রেখেছিল কোন পত্রিকায়, কবে ছাপা হবে। সেদিন সে সেই পত্রিকা কিনে পড়েছিলো। আসলে আজগর আলী খুব সৌখিন ছিলো। সে কোন জমা করতো না। ভিক্ষা করে যা পেতো তার সবই ভেঙে ফেলত। আজগর আলী সিগারেট খেতো। ভালো সিগারেট ছাড়া সে আবার খেতে পারতো না। সিগারেটের পেছনেই অনেক টাকা খরচ করতো। এছাড়া ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য খরচতো আছেই। তাই আজগর আলীকে মোটেই কিপটে বলা যায় না। আজগর আলী সেসব দিনের কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজগর আলীর বউটা বিয়ের কয়েকদিন পরেই মারা গেল। এরপর আর আজগর আলী বিয়ে করেনি। তাদের কোন ছেলেপুলেও হয়নি। আজগর আলী প্রায় একা একাই জীবনটা কাটিয়ে দিল। এখন এই বয়সে মনে হচ্ছে আরেকটা বিয়ে করলে খারাপ হতো না। তাহলে এখন দুই-একটা ছেলেপুলে থাকতো। এই বয়সে শুয়ে শুয়ে ভিক্ষা করতে হতো না। তবু আজগর আলী ভালই আছে। তেমন কোন কষ্ট হচ্ছে না। সে তো আর কোন কঠিন কাজ করছে না। সারা জীবন যা করে আসছে এখনো তাই করছে। ছোটকালে বাবা মায়ের সাথে ভিক্ষা করতো। সেই থেকে তার ভিক্ষার জীবন শুরু। এই জীবন থেকে সে আর বের হয়ে আসতে পারেনি। জীবনে আর কয়েকটা দিন বাকি আছে। এই কয়েকটা দিনও হয়তো এভাবে কেটে যাবে। আজগর আলি তার পাত্রটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়ায়। রাত হয়ে আসছে, তার বাড়ি ফিরতে হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শাহ্নাজ আক্তার
আসলে ভিক্ষা করা মহাপাপ ...কিন্ত আমাদের দেশে যেভাবে বেকারত্ব বাড়ছে, কর্ম সংস্থানের অভাবে এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই , সরকার এবং ধনী লোকেরা এগিয়া আসলে হয়ত সমসসা কিছুটা লাঘোভ হত ...ভালো লিখেছেন আপনি I
আহমাদ মুকুল
সমস্যা তো আমার আরো বেশী- আমি জড়বস্তু, জীবজন্তু নিয়ে লিখি। সেখানে সর্বনাম ব্যবহার আরো জটিল। যাই হোক, পার পাওয়ার চেষ্টা করছি কোনক্রমে। তবে এই গল্পটি এবং রনীলের গল্প দুটোতেই নাম উচ্চারনের আধিক্য এড়ানো যেত। অনেকক্ষেত্রেই চলমান বাক্যে কর্তা ব্যবহার না করলেও চলে। উপযাজক হলাম। গল্পটা ভালই লেগেছে।
রনীল
মামুন ম আজিজ ভাইকে বলছি- ঠিক একই রকম সমস্যায় আমি পড়েছিলাম জানালার ওপারে নীল লেখার সময় (জাহানারা)... কিছু কিছু চরিত্র আছে যাদের ঠিক আপনি বলতে ইচ্ছে করেনা (তিনি) আবার তুমি ও (সে) বলা যায়না ... যে কারনে চরিত্রের নামটাই বার বার ব্যবহার করতে হয়, সর্বনাম এর ব্যবহার আর হয়না... এর সমাধান কি আমার জানা নেই... আপনার কোন পরামর্শ আছে?
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।