ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ মনের দৃশ্য পটে কত কি ভাসিয়ে দেয় জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টির। নিজের সাথে নিজেরি কথা, আড়ি – আবার নিঃশব্দে হাসি। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুহূর্তেই মিশে একাকার হয় আকাশের বৃষ্টির জলে। কোথায় আজ আমি, কেনই বা ?
শাশুড়ি মা বলছে তুমি যা রাঁধ তা কি মুখে তুলা যায়? বাপের বাড়িতে এই রাঁধে আর এই খাও। মরিচ নাই লবন নাই-এগুলো কি? ছি! বৃষ্টি খুব অবাক হয় নিঃশব্দ অবয়বে ড্যাবড্যাব নয়নে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষগুলো মাত্র কিছুদিন আগেও তার বাপের বাড়িতে কবজি ডু বিয়ে খেয়েছে আর বলেছে সত্যি আপনার(বৃষ্টির বাবা) রান্নার তুলনা হয়না। তা মেয়ে বুঝি অমনি ই রাঁধে –ভাল, তাহলে তো বেশ ভাল।অথচ এখন তারাই উঠতে – বসতে হাজারটা কথা শুনাচ্ছে বৃষ্টিকে।
এত উকুন বোধয় পঞ্ছাশ জনের মাথায় ও হয়না যা আছে একা বৃষ্টির মাথায়। কিরে মাথায় উকুনের খনি কেম্নে করলি-শুধয় বৃষ্টির ফুফাতো বোন । ঈষৎ হেসে বলে ওইখানে তো চুল শুকাতে পারতাম না । কেন? আবার জিজ্ঞাসা করে ঋতু দিদি। শ্বশুর – শাশুড়ির কড়া নির্দেশ বাড়িতে ভাসুর / শ্বশুরদের সামনে চুল ছাড়া দিয়ে ঢং যেন করা না হয়।তাই প্রতিদিন ভেজা চুল নিয়েই তার বসবাস।
দারুন স্বভাবের ছেলে বলে মনে হয়েছিল সঞ্জয়কে। যবে থেকে ঘটক তাকে পরিচয় করে দিয়েছিল –খুব নরম কথা, যুগপোযোগী হিসেবে নিজেকে ভালই উপস্থাপন করতে পেরেছে । বৃষ্টির মায়ের বেশ পছন্দ হোল সঞ্জয়কে মেয়ের জন্য। সুঠাম দেহ,খারা নাক, স্বচ্ছ আঁখিদ্বয় সবই অনুকূলে মনে হোল । বৃষ্টির বাবার প্রথম প্রথম একটু দ্বিমত ছিল কারন, বড় ভাই রনি যে এক কথায় বলে দিয়েছে –বাবা চকচক করলে সোনা হয়না। এই ছেলেটাকে কেমন যেন অতি চালাক বলে মনে হচ্ছে –উক্তি রনির।
যাই হোক ওর নিজের ও মোটামুটি ভালই লেগেছে । শুরু হয় আসা – যাওয়া বৃষ্টির বাসায় সঞ্জয়ের। শুভ দিনক্ষণ দেখে স্বর্ণবস্ত্র(Engagement) হয়ে গেলো। তাও বাসায় না – জামাইয়ের দাবী তাই ক্লাবেই হোল। খাতির করে শ্বশুর মশায় থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে নিল। মাঝখানে আড়াই কি তিন মাস বেশ আসা –যাওয়া হোল এবং ভাল আচরণ ই দেখাল ।
বৃষ্টি প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এক একটি নতুন নতুন ছোট ছোট স্বপ্ন বুনতে শুরু করল। বুক ভরা স্বপ্ন, দু’চোখে রঙ্গিন সব আশা। ধীরে ধীরে দিন যায় –অবশেষে আসে সেই দিন, বাজে সানাইয়ের করুন সুর। আত্মীয় –স্বজন সকলের উপস্থিতিতে বৃষ্টির শুভ বিবাহ সম্পন্ন হোল। অন্যদের মুখে যেমন শুনেছিল তার বেলায় তা হয়নি। মায়ের থেকে নাকি মেয়েকে ছাড়ানো যায় না বিদায়ের বেলায়। অথচ বৃষ্টির মা নিজেই মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত।
একটু হাসল আর বলল কাঁদছিস কেন আবার আসবি কয়দিন পরে কেমন? আসলে উনি কয়েক মাস বেশ ভাল-স্বাভাবিক থাকেন ইনজেকশন দিলে। আবার কয় মাস পরে একই সমস্যা দেখা দেয়। শুধু বাবাকে জাপটে ধরে চিরবিদায়ের কান্না কেঁদেছিল বৃষ্টি। মাকে কে দেখবে-আমার ছোট বোনদের কে দেখবে-বাবা তুমি একা কেমনে সামাল দিবা –আমারে আজ থেকে বুঝি কুলা কাটা করে দিলা। আমারে পর করে দিলা বাবা। আমি কেমন করে থাকব তমাদের ছাড়া। বরাবরই মেয়েরা বাবার ভক্ত হয়-বৃষ্টির ক্ষেত্রে ও তাই।
বৃষ্টির বাবা অফিস শেষে বাজার সেরে সমস্ত কুটাকাটি করে রান্না সারেন। আবার অসুস্থ স্ত্রী ও সন্তানদের খাবার বেড়ে ও দেন। বেচারা সারাদিন খাটুনি –বড় মেয়ে (বৃষ্টি)বাসায় থাকতে তবুও কিছু কম খাটুনি হতো – অন্তত রান্নার কাজটা থেকে ছুটি ছিল যদিও তিনি নিজেই বেশ ভাল মানের পাচক । রাঁধতে খুব পছন্দ করেন। ছুটির দিনে তেহরি, আকনি, মোরগ পো লাউ, বিরিয়ানি যা মন চায় রাঁধেন আর আত্মীয় স্বজনদের নেমন্তন্ন করেন। বিশেষ করে উনার ভাগ্নি (ঋতু) কে খাওয়াতে বেশ আনন্দ বোধ করেন। যখন তখন বলে বসেন কিরে মা আজ তো ছুটির দিন আয় নাএকটু বেড়িয়ে যা আর নাতি-নাত্নিদের আমার হাতের অমৃত খাওয়াবো।
ঋতু ও লোভ সামলায় না –যেমন মামা, তেমনি ভাগ্নি ছেলেমেয়ের গাঁটটি নিয়ে দেয় দৌড় মামার বাসায়। বিয়েতেও যথানিয়মে এসছিল ঋতু আর সাধ্যমত সহযোগিতা ও করেছে। বিয়ের সানাই বৃষ্টিকে নিয়ে গেলো তার নতুন সংসারে, সবাই আসছে নতুন বউ দেখতে। কেউ বলছে বাহ! ভারি সুন্দর হয়েছে তো বউটা। আবার কেউ বলছে বাহবা এত জিনিসপত্র দিয়েছে মেয়ের বাপ যে ছেলের ঘর ভরে গেছে।কি দেয়নি তাদের- ফ্রিজ, টেলিভিশন, আলনা, ফ্যান, খাট, সোফাসেট, আলমিরা আর ও কত কি! মেয়ে জামাই যাতে খুব সুখী হয় তার নিশ্ছিদ্র চেষ্টা করেছেন বৃষ্টির বাবা।
তাদের চাহিদা মত তিন অনুষ্ঠান সবই কমিউনিটি সেন্টারে করা হোল। ভালই কাটে দিন সঞ্জয়-বৃষ্টির বিয়ের কিছুটা দিন। একদিন দুপুর বেলা, সবাই খেতে বসেছে হঠাৎ সুজন(বৃষ্টির দেবর) একটা চিৎকার দিল। এই তরকারি কে রানল? ছি! মুখে দেয়া যায়না। লবন-মরিচ কিছুই তো নাই –ওয়াক থু । বড়রা সবাই ছিলেন কিন্তু কেউ কিছুই বললেন না । রাতে বৃষ্টি সঞ্জয় কে কথাটা বলতে চাইল যে তোমরা বড়দের সবার সামনে সুজন এমন অপমান করলো চুপ রয়েছিলে কেন? কিছু তো বলতে পারতে। সেকি তোমাকে ফুল- চন্দন দিয়ে পুজা করবে নাকি! সবাই খেতে পেরেছিল ওই অখানা ? বৃষ্টির গলায় অভিমানের দলা পাকিয়ে ভারি হয়ে আসলো। কিছুই বলতে পারলোনা, শুধু গাল দুটি ভিজল নয়নের জলে।
দিন যায় মাস যায় বৃষ্টি আর সঞ্জয়ের দূরত্বটা ও যেন বাড়তে থাকে। কেমন যেন অমনোযোগী স্বামী , খেয়েছে কিনা, শরীর ভাল আছে কিনা, সব কাজ একা করতে কষ্ট হচ্ছে কিনা কোন কিছুই জানার নাই। অথচ প্রতিটি নারী চাই তার জীবনসঙ্গী অন্তত ছোটোখাটো চাওয়াগুলি যেন পুরন করে যার মূল্য তার কাছে অতুলনীয়। অনুভূতি কে মূল্যায়ন করাই হলো আসল টান -ভালবাসা।
এক রাতে তারা বেড়াতে গেল বাপের বাসায়। জামাইয়ের সাথে শ্বশুর বেশ খোলামেলা আচরণ করেন। সেদিন ও খোলা মনেই বলেছিল সঞ্জয় কি দেখছ –বাংলা সিনেমা? আরে এগুলো তো আমাদেরি জীবন –সংসারের গল্প। দেখতো স্পোর্টস চ্যানেলে কি চলে? চুপ করে রিমোট দিয়ে দিল সঞ্জয়। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি ভাত খেতে বসতে বলল তার স্বামীকে। না-সে খাবেনা, চলো এখুনি চলো এখানে আর এক মুহূর্ত ও না । দুনিয়ার গালাগালি, হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল –বাপের বাড়ির ভাত আর খাইতে হবেনা ।
চলে এল শ্বশুর বাড়ি –রাতে আবার নতুন করে ঝগড়া। তোর বাপ বেশি চালাক না? আমারে খোঁচা দিয়া কথা কয়-আমি বুঝি না? কে বলছে আমার সংসারে তুই শান্তিতে নাই ,আমার বাড়িতে কি হয় –নাহয় সব গিয়ে ওই বাড়িতে লাগাস জানি তো। কথায় কথায় হাত তুলে বৃষ্টির গায়ে। এদিকে বিয়ের বছর না ঘুরতেই শাশুড়ির কত কথা বাচ্চা হচ্ছেনা কেন, লোকে যে ভাজা মেয়েমানুষ বলাবলি করতেছে। খুব চাপাচাপিতে নিতেই হোল। খাওয়া বন্ধ, শরীর প্রচণ্ড দুর্বল কিছুই খেতে পারছেনা –তবুও তার শাশুরি,দেবর,শশুর বলছে এসব নাকি সব অভিনয়। সঞ্জয়ের ও একমত।
এভাবে দিন কাটে- স্রষ্টার কাছে এটাই জিজ্ঞাসা কেন এত লোভী –অমানুষ একটা সঙ্গী দিলে? এমন তো চায়নি সে। একজন ভাল মনের মানুষ উপহার কি দেয়া যেতনা ঠাকুর-কেন কেন ? বাচ্চা নিলনা তাতে ও গণ্ডগোল, যেই বাচ্চা আসছে শুনল অমনি একটা চাল চেলে দিল সঞ্জয়।আগে থেকে বলে রাখছি কিন্তু, তোর বাবাই সব খরচ–পাতি দেবে। এখন থেকে টাকা জমাতে বলে দে। এক দুপুরে তুমুল কথা কাটাকাটি –এক পর্যায়ে বৃষ্টির পেটে লাথি –আঃ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে রইল। অচেতন অবস্থায় অনেকক্ষণ পর চেতনা আসলো –চোখ মেলতে ও পারছেনা তার মাঝেই শুনতে পাচ্ছে-আরে ওইভাবে পড়ে থাক- মরবেনা অত্ত সহজে,বলছে শাশুড়ি মাতা।
চোখ খুলে কোনপ্রকারে দুটো জামা নিয়েই আস্তে আস্তে বাপের বাসায় এল বৃষ্টি। কিচ্ছু আনতে পারেনি সে,স্বর্ণ গুলি ও খেয়ে নিয়েছে কি একটা ব্যবসা করবে বলে,আবার সমিতি থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়েছে ব্যবসায় লস হোল । তাই সব টাকা শ্বশুর থেকেই নিতে হবে এমনি প্রতিজ্ঞা করেছে হয়ত সে।কয়দিন পর পর টাকা চেয়ে বসে যাই হোক বাপের বাসায় আসার পর অনেক জনকে দিয়ে ফোন করিয়েছে সঞ্জয় ভয় দেখিয়েছে,বাজে কথা বলেছে হাজারো। বলে তোর বাপ আমার কি করবে –খেয়ে ফেলব না, সিমুল্যা আমার কি করতে পারবে সে আমার জানা আছে।
২/৪ দিন পাড়ার বৈঠক বসে। তাতে বলা হয় মেয়ে খুবি খারাপ, ওর নামে আজে-বাজে লোকের কাছ থেকে চিঠি আসে। আসলে ওটা একটা ওদের চালমাত্র। ভীষণ সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে সে –কি করবে বাবার সংসারের অবস্থা মোটেও ভাল না। মা অসুস্থ, বোনেরা ছোট ,ভাইয়ের এখনও দামি চাকরি হয়নি। পেটের বাচ্চাটাকে রাখবে কি রাখবেনা এ নিয়ে মহা চিন্তিত সে। যাক শেষপর্যন্ত ওর পিসতুতো (ফুফাতো) দিদির উপদেশ ই কাজে লাগলো। আসলে তোর যে দুরবস্থা তাতে তুই মামার বাসায় থাকলে ও উনার সমস্যা, আবার শ্বশুর বাড়ি গেলেও সমস্যা-বারে বারে ঝগড়া, মারপিট এগুলো হবে আর কয়দিন পর পর টাকা চাইবে। বরং তুই ফ্রি থাকলে অনেক প্রতিকূল অবস্থা ফেইস করতে পারবি—আমাকে দেখে বুঝিস তো—বলে ঋতু।
অবশেষে দিন ক্ষণ ঠিক করা হোল অনাগত পবিত্র নিস্পাপ প্রানটিকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা ।সারাদিন খোঁজ নিতে হোল পিসতুতো দাদা দুর্জয় কে। নিজের দাদা ও অতটা করবেনা। যাহোক ঋতু,দুর্জয় মিলে বৃষ্টিকে নিয়ে গেলো স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে। চেক করে দেখা হোল। এত দুর্বল মানুষটা কে কি করে এবরশান করবে সে চিন্তায় পড়ল ডাক্তার।দুটো ইনজেকশন দেয়া হল। যেই ডাক্তার কাজ শুরু করলো বৃষ্টি এক হৃদয় বিদারক চিৎকার দিল-ঋতু তার বুকের মাঝে যত জোরে সম্ভব চেপে রাখল সন্তান সম বৃষ্টিকে আর বিধাতাকে স্মরণ করতে লাগলো ।
মুহূর্তেই বৃষ্টির সমস্ত আসা-ভালোবাসা, স্বপ্ন দুমরে মুচড়ে শিখর ছিঁড়ে দূরে কোথাও উৎপাটিত হোল। জীবনের প্রথম সন্তান তার নাড়ির ভেতরে সযতনে লালিত হবার কথা, তা না হয়ে বিসর্জন দিতে হোল নোংরা কর্দমাক্ত পচা রক্তের স্তূপে—বৃষ্টির মনের সমস্ত সবুজের রং ঘৃণায়-ক্ষোভে-দুঃখে-বেদনার কষ্টে নীলাভ হয়ে উঠলো। যেন পুরো জীবনটাই নীলাভ সবুজ।
২১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪