পড়ন্ত বিকেল বেলা,তন্দ্রা ভাব লেগে আছে এখনও দু’চোখের পাতায়। অস্থির গরম সূর্যের তপ্ত জিদ যেন কমছেই না। কাঁপা হাতে চোখ ডলে স্বপ্ন ভেঙ্গে উঠল বৃদ্ধ রমিজ মিয়াঁ । সপ্নে দেখছিল তার কলজার টুকরা একমাত্র ছেলে আহসান (আহসু) তাকে খুব যত্নে খাওয়াচ্ছিল আর বাবা রমিজ নারে খোকা আর খামুনা, হু-আমি আর খাইতে পারতাছিনা বলে ছোট বাচ্চার মত তাল করছিল।
ছেলে শাসন করছে, বাবা–না অমন কইরনা তোমার অহন এগুলান খাইতে লাগবো । নাইলে আবার শরীর খারাপ অইব। কি সুখের দৃশ্য-ইস কেন যে মরার ঘুমডা ভাইঙ্গা গেলো ? জলের বানে চক্ষের কেতুর বেয়ে নামে দু’ গালে। মুছে গলার ভেজা গামছা দিয়ে, ডাকে তার হারিয়ে ফেলা প্রিয় সঙ্গিনীকে। আমিনা-শুন্তাছ,আমার কথা –দেখতাছ আমি কই ? তুমিত মইরা বাঁচছ –আর আমি !পাশের রুমের আরেক বুড়োর ডাকে মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় যে সে কোথায় আছে ।
কি ভাবতাছ রমিজ মিয়াঁ ? শুধোয় এক সময়কার দাপটে ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জলিল উদ্দিন। আজ এখানে সবার একটাই পরিচয়, কোন ভেদাভেদ নাই-সকলেই একি দুঃখ পথের পথিক। স্মৃতির পাতায় আনাগোনা শুরু হল দুজনের ।
রমিজ বলল তার (আহসানের) মায় তারে নিজের পরানডার চাইতেও বেশি ভালাবাসতো। একদিন খাওন যদি জোগাড় করতে না পারতাম তাইলে তার চিন্তার শেষ আছলনা পুলাডারে কি খাওয়াইব। আমারে কইত আমরা তো বড় মানুষ দেইখো না খাইলে কিছু অইবনা, কিন্তু আমার ছাওয়ালডা ছোড মানুষ- অরে খাইতেই অইব।
জানেন আমিনার কত্ত আশা আছল পুলা বড় অইব –অনেক বড় আমগো রে মাথায় তুইলা রাখবো। আমি দিন্মজুরি করতাম,রিকশা চালাইতাম, যহন যা পাইছি করছি বইসা থাহিনাই। স্কুলের বেতন, মাসটরের বেতন যেন ঠিকমত দিতারি । পুলা আমার কইত, বাজান-আম্মু তোমরা আমার লগে খাওনা –আইয় ভাগ কইরা খাই। আমরা বাহে-মায় হাইসা কইতাম তুই খুশী অইলে আমগো কলজা ঠাণ্ডা অয় ।আহসু কইত বাজান আমি বড় অইয়া তুমারে আর কষ্ট করতে দিমুনা। দেখবা আমি বড় হমু।
পোলার মার কথা দইরা ঢাকা হস্টেলে রাইখা পড়াইছি,পরতেক হপ্তাই এইডা –ওইডা নিয়া গেছি। একদিন হস্টেল দুয়ারে দেখা অইতেই আহসু’র চক্ষে পানি। কইলাম কি অইছে বাপ? সব্বাই তো বালা বালা পোশাক পরে খালি আমার গুলান...। আচ্ছা বাজান আগামি হপ্তায় আইনা দিমু।
সব কডা পরীক্ষায় কত্ত বালা রেজাল করল-আমিত মুক্ষু মানুষ অইসব বুজিনা। খালি বুজতাম আমার পোলাই সেরা। আহসু কলেজে পড়তাছে। আমিনা দিন দিন অসুস্থ হইতে লাগল। শুধু পোলা মানুষ করতে গিয়া নিজে ও কম খাডেনাই। হাতের মেলা কাম করত, ওগুলান বেইচা আমারে দিত । ঝামেলা বাড়বো কইয়া আর পোলাপানের নাম ও লয়নাই—কইত এক চান্দ(চাঁদ) দুনিয়া ডারে আলো দেয়। আমাগো ডর কি? আহ রে আনু(আমিনা) কিছুই পাইলানা, কিছুই দেখলানা। এক ঝড়- বাদলার রাইতে আমিনার প্রচণ্ড জর । ওষুধ –পত্র খাওয়াইছি। কিন্তু কেডা জানত না খাইয়া,অত পরিস্রম কইরা মরন ব্যাধি জুডাইছে ডাক্তার আইল কইল তার নাকি ক্যান্সার ।আল্লাহ্ রে-এই ডা কি হুনাইল, আমি অহন কি করুম,কই যামু? তারপর দিন পোলারে খবর দিলাম আইল। সারাদিন মা মা কইরা পাগলের মত কানল।
সারা রাইত বইসা কাটাইলাম বাহে-পুতে। রাইত শেষের দিকে, আযান শুনা যাই হঠাৎ উলটা নিঃশ্বাস আমার চোখ লাইগা—আমিনা হাতের চাপে চোখ মেইলা দেখি হা করতাছে। পানি খাওয়াইলাম আহসু’র হাতে আমার হাতডা দিয়া কুনরকমে কইল বাবা আহসু, তুমার লাইগা আজীবন আমরা খাটছি । আমারত থাকা অইলনা তুমার বাজানরে তুমিই দেইখো-কহনও দাগা(আঘাত) দিওনা । পুলা কইল হ মা আমার সবডা দিয়া বাজানরে আগলাইয়া রাখুম।
আমিনা গেলো আইজ ১৫ বছর। আমি অহন ও আছি । আহসু বড় বড় পাস দিছে। আমার জন্য ও অনেক কিছু করছে। অহন তার সংসার অইছে। অনেক সুন্দর আমার বউ(পুত্র বধু)ডা,শিক্ষিত বিরাট বড়োলোকের মাইয়া। আমি কইদিন তাগো বাসায় আছলাম। খুব বালায় আদর-যতন পাইছি । একদিন গভীর রাইতে চাপা শব্দে আমার ঘুম ভাইঙ্গা—আহসুর ঘর থিকা আসতাছে ।দুয়ারের লগে খাড়াইতেই হুনলাম, এটা একটা বাড়তি ঝামেলা, তুমি কেন বুঝতে পারছ না, আমাদের বাবুর ভাষাগত-পরিবেশগত সমস্যা হচ্ছে তোমার বাবার কাছ ত্থেকে ত ভাল কিছুই শেখার নাই তাই না?
খোকা অনেক বুজাইতে চাইল কিন্তু বউমা কইল হয় আমি অথবা তোমার বাবা দুজনের এক জনকে তুমি বেছে নিতে হবে। তাছাড়া আমরা ত সব সময় উনার পাশে আছি,থাকব। দেখ পৃথিবী এখন অনেক এগিয়ে- “বৃদ্ধাশ্রমে” অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ও থাকেন। তুমি কেন অমত করছ?
সারা রাইত ঘুম আর চোখের কিনারে আইলনা। ভাবলাম না কইয়া নিজে নিজে বাইর অইয়া যামু। কেন জানি মনে অইল, আমিনা আমারে মানা করল কইল আহসুর বাপ আমাগো পোলার সুখের লাইগা আমরা সব করতে পারি –ভুইলা গেছ শপথ খান?
শুন আমার বাজান যাই কইব তুমি তাই মাইনা লইবা তাইলে আমি ও খুশী আর আমার পোলা-বউ ও সুখী অইব।পরদিন সকালে নাতি খান আর আসেনা আমার কাছে। আমি বুজতে পাইরা নিজ থিকা ডাকলাম না । সারাদিন পার অইল সন্ধ্যা অইতেই আহসু ঘর আইল। আমারে জিগাইল বাজান কেমন আছ,ঔষধ খাইছ ঠিকমত? কইলাম হ বাজান সব ঠিকাছে । আহসু আমতা আমতা করতাছে – আমি কইলাম বাজান তুমি কি কিছু কইবা?
আমার পাও দুইডা দইরা কি কান্দন টাইনা বুকে লইলাম, বুক ফাডাইয়া কানল পোলা। কইল বাজান আম্মুরে কথা দিয়া রাখতে পারলাম না। আমি যে তোমারে আমার থিকা আলাদা...চোখ মুছাইয়া কইলাম বাজান আমি সব জানি । তোমাগো যাতে ভালা অয় তাই আমার বালা। তয় আমার পোলার সুখী সংসার আর আমার নাতি ডার উপর বড় লোভ জন্মাইয়া গেছে। ও আস্তে আস্তে সাইরা যাইব ।
পরিপাটী একখান বাসায় আহসু তার বাজানরে গেলো। অইহানে অনেক বুড়া –বুড়ি । মনে পড়লেই আহসু আহসু কইরা দুই চোখ ভরে।
আহসু প্রায় আসে, কাপড় চোপড় আনে, ভাল খাবার আনে। কিন্তু এসবের প্রয়োজন বোধ খুব একটা করেন না বৃদ্ধ রমিজ। তার চাওয়া-ছেলেটার সাথে বসে কথা বলা,চোখের সামনে দেখা। জলিল সাহেব আর বলতেই পারলেন না। তাঁর ও এমন দশা। শুধু বলতে লাগলেন, আমরা কেবল সন্তানদের সুখ টাই ভাবি—বুনি কত সুরম্য স্বপ্নের জাল । এখন বুঝি, ওসব সত্যি নয় ‘ঘুনে ধরা স্বপ্ন’।
২১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী