শৈত্য প্রবাহ চলছে ।কনকনে শীত ।সুরাইয়ার পায়ের দগদগে ঘা চিনচিন করে উঠে ।সারাদিন দু’পয়সা আয় করা যায়নি, অথচ ঔষধ গিলতে হবে প্রায় দেড়শ টাকার ।ভেবে আকুল কখনও কই আর নিজের পায়ে স্বাধীন ভাবে ছোটাছুটি করতে পারবেনা?
হায়রে জীবন! একদিন এ মনে ছিল অনেক প্রত্যাশা,নয়নে ছিল স্বপ্ন,শরীর ছিল সুন্দর-সুঠাম । অই মায়া ভরা মুখখানি ছোট কপালে ভ্রু-জোড়া, নিরীহ দুটি চোখ , খাঁচ করা ওষ্ঠ দুটি সুরাইয়ার চেহারাটাতে যেন দেবী ভাবের প্রকাশ করতো । আজ আর অতটা নেই কিছু – নিজেরে চেনা ও দুষ্কর । শান্তির নীড় যাকে বলে সুরাইয়া শিশুকাল থেকে বুঝেনি। যুদ্ধে পাঞ্জাবীরা তার বাবাকে নিয়ে বেনেটের খোঁচায় নির্মমভাবে মারল, বয়স তখন মাত্র নয় দিন – বাবার সংজ্ঞা আর বাবার স্নেহ এ দুটোই অজানা রয়ে গেল।
পাঁচ বছর বয়সে আগুনে ডান পায়ের আঙ্গুল পুড়ে লেগে গেলো আজিবনের জন্য। মামার বাড়িতে মানুষ, কারন অত অল্প বয়সের মেয়েকে নিয়ে কই করবে সুরাইয়ার নানা-নানি? তাই বিপত্নীক এক মহান মানুষের সাথে তার মায়ের দেয়া হোল বিয়ে । সুরাইয়া মায়ের আদর থেকে ও বঞ্চিত হোল। নানাদের গোলা ভরা ধান,পুকুর ভরা মাছ, ফল ভরতি গাছ সব ই ছিল, ছিলনা শুধু এতো কিছুর মাঝে ও সুরাইয়ার আত্মতৃপ্তি ।
ডিগ্রি পাশ করেই চলে এল শহরে । একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকুরী শুরু করল । ১৯৯৬ সাল, কলেজে গেল নম্বর পত্র ও সার্টিফিকেট তোলার জন্য । হঠাৎ কলেজ গেইটের পাশ ফিরতেই নজরুলের সাথে ধাক্কা খেল । দুজন দুজনকে সরি বলে চলে গেল ।দিন সাতেক পরে সুরাইয়া দেখল তার বাসার সামনে ই সেই লোকটা ।দেখেই একটা সুবিনয়ের হাসি মাখা মুখে সালাম জানালো।সুরাইয়া অবাক দৃষ্টিতে জানতে চাইল আপনি? ধীরে ধীরে পরিচয়, পথ চলা,তারপর ভাল লাগা,অতপর শেষ পরিনতি বিবাহ। চলছিল দিন বেশ ভালোই দুজনার । নজরুলের ব্যবসা আর সুরাইয়ার চাকুরী মিলে দারুন পরিপূর্ণ সংসার। বেড়ানো হয়েছে অনেক জায়গা । বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় সুরাইয়ার কোল জুড়ে এল ছোট শোভা ।ঘরময় আনন্দ আর সুখ । নজরুল সুরাইয়ার সৎ ভাইদের খুব যত্ন করতো । কখনও ওদের থাকা –খাওয়া নিয়ে ফোঁড়ন কাটেনি ।সংসারে যখন যা প্রয়োজন সুরাইয়া বলতেই –নিয়ে হাজির হতো নজরুল ।
এভাবে কাটল বছর নয় ।হঠাৎ এক রাতে নজরুলের মোবাইল বেজে উঠল। সুরাইয়া নিজেই মোবাইল টা তুলে দিল নজরুলের হাতে। কিন্তু না, নজরুল ফোন টা কেটে দিল এবং ইতস্তত বোধ করতে লাগল । সুরাইয়া কখনও এমনটি দেখেনি তাকে । তাই সে আরও উৎসুক হয়ে জানতে চাইল কার ফোন যে কেটে দিতে হোল!নজরুল প্রথমে ধামাচাপা দিতে ছাইলে ও এক পর্যায়ে ক্ষেপে গেল এবং ফোনের সুইচড অফ করে দিল। এতে করে সুরাইয়ার সন্দেহ হোল। তার ও কিছুদিন পর ঢাকায় গেলো নজরুল ,বলল ব্যবসার কাজে যাচ্ছে । আসার পর ব্রিফকেস থেকে সব জিনিস নামাতে গিয়ে দেখে একটা মেয়েদের চিরুনি । জিজ্ঞেস করতেই ডাহা মিথ্যা কথা বলল জোর গলায়। আরে নাহ , তোমারি চিরুনি ই হবে আমি কোথায় পাবো ? হয়ত আমার জিনিস গুছানোর সময় ওটা ও ঢুকে গেছে। যাক আর কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ বাদ দিল সুরাইয়া । কিন্তু মনের ভিতরকার সন্দেহ তো আর দূর হলনা । এভাবে আরও কয়মাস কাটল। সুরাইয়া আরও এমন কিছু নম্বর জোগাড় করল । অথচ কোনটাতেই কথা বলা হয়নি । আজকাল নজরুল খুব একটা ঘরে ফিরে না । জানতে চাইলেই বলে ব্যবসার কাজে ভীষণ চাপ যাচ্ছে তাই। একটা ফোন তো দিতে পারো, আমার নাহোক তোমার মেয়েটার কথা? এ কথা ও কথা বলে পার হয়ে যায়।
সূর্য ডুবুডুবু প্রায় ।সুরাইয়ার ফোন বেজে উঠল । পরিচয় দিতে গিয়ে ঘটল প্রমাদ । নজরুলের কোন এক বন্ধু হবেন যে কিনা অনেক টাকার পাওনাদার।লোকটি বিশ্রীভাবে প্রশ্ন করল আপনি কত নম্বর “বৌ”? মানে বলছেন কি আপনি ? ভদ্রভাবে কথা বলুন নাহয় ফোনটা রাখুন ।আরে বাবা আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? ওহ, আপনি তাহলে কিছুই জানেন না মনে হয়। আবারও ধমকি দিল সুরাইয়া ভাই কে আপনি দয়া করে আমার স্বামীর নামে বাজে কথা বলবেন না । আমার ধারনা আপনি নজরুলের চতুর্থ বৌ । না না এ হতে পারেনা – পা দুটো টলতে টলতে ধপাস করে পড়ে গেলো মেঝেতে । মেয়ের ডাকে আর কাজের বুয়ার সেবায় তন্দ্রাচ্ছন্ন কাটল । ঘরটা নয় শুধু , মনে হয় পুরো দুনিয়া টা নিকষ কালো আঁধার । বুয়া বারেবারে শুধল কি অইছে আফা ? আমনের তো এই রকম কুনোদিন দেখিনাই । ছয় বছরের মেয়েটা কান্না জুড়ে দিল মায়ের জন্য ।
কয়দিন পর একটু শক্ত হয়ে সংগৃহীত নম্বর গুলোতে ফোন করার একটা ঝোঁক আসলো । রিং হচ্ছে, হ্যাঁ ওপাশ থেকে খসখসে ঠাণ্ডা জড়ানো এক নারী কণ্ঠ। সুরাইয়া কে জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রমহিলা বললেন তিনি মিসেস নজরুল । এতদিন তা ও দোটানায় ছিল যে হয়ত কেউ শত্রুতা করে । কিন্তু, আজ এখুনি যা শুনল নিজের কানকে বিশ্বাস করানো কঠিন । রান্না করার জন্য চুলায় কড়াই তাতে তেল দেয়া ছিল। মনে হোল ওর হৃদয়ের আগুনটা ধরে উঠেছে অই কড়াইয়ে । দিশেহারা হয়ে নামাতে গিয়ে ছিটকে পড়ে নিচে আর তার বেশির ভাগই পড়ল ডান পায়ে। মুহূর্তে মনে পড়ে গেলো সেই মহান চিত্তের অধিকারী, অতি যত্নশীল, দয়ালু মানুষটার মুখ যার উপর বিশ্বাস করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সুন্দর ঘর বাঁধার স্বপ্নে ।
আর আমার পূর্বে আরও তিনজন – আমি চতুর্থ?তবে এতো মায়া-মমতা, ভালোবাসা সব সবই কি ভান? কেন এত মিত্থাচারিতা,কেন ঠকানো ? আত্ম জিজ্ঞাসায় অস্থির মন । নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হোল । কাউকে না পারছে বলতে, না পারছে সইতে ।কারন আম্মা নিজেও অনেক দুঃখী কি করে এইসব জানাবে । ছোট ভাইয়েরা যে যার মত চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত। কাকে বলবে – আর বললে ও সমাধান কি? ফোন বন্ধ , বাসায় আসা বন্ধ এমন কি খোরপোষ টা ও।
মরতে ও চাইল অনেকবার –মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে পারেনা । নিজের নিওতির উপর অভিমান করে এক সময় চলে যায় অনেক দুরের এক শহরে যেখানে তারা (মা-মেয়ে)এক্কেবারে নতুন । কিছু সেলাই - ব্লকের কাজ করে কোন প্রকারে চলে দুজনার ।মা-ভাইয়েরা হয়ত আজও খুঁজে কিন্তু অভিমানে-কস্তে-লজ্জায় নিজেরে আড়ালে ঢাকা দিতে চায় ভালোবাসায় হেরে যাওয়া সুরাইয়া । বহুদিন পরে ফেলে আসা দিনগুলির চিত্র ভেসে উঠে চোখের সামনে যবে দেখল এক রিক্সায় মা-বাবার কোলে ফুটফুটে একটা সুন্দর মেয়ে ।
কিসের যেন আওয়াজ বারেবার । তবে বুঝে উঠার আগেই ডান পায়ের উপরেই সজোরে একটা চাপ অনুভব করলো। আহ! কি ব্যথা গাড়ির চাকায় পা টা- চোখ মেলে বুঝল হাসপাতালের বিছানায়। ডান পা টা নাড়ানো যাচ্ছে না। উফফ বারেবার অই ডান পাটাতেই কেন –অই যে দুঃখী যে জন বারেবারে দুঃখটাই তার প্রাপ্য হয়ে থাকে । আজও প্রতি শীতের দিনগুলো মনে করিয়ে দেয় নজরুলের দেয়া অন্তরে ঘা যা কিনা সুরাইয়ার ডান পায়ের দগদগে ঘায়ের ও বেশী ক্ষত, অধিক বেদনাময় আমরনের ।।
'সমাপ্ত'
২১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী