অন্ধকারে ৪১৬ ঘন্টা

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

ধীমান বসাক
  • ৯৩
সকাল সকাল বাড়ী থেকে বেড়িয়েছিল মেয়েটি। প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ, হরতাল লেগেই আছে।
ওদের কথা কেউ ভাবেনা।কাজ না করতে পারলে খাবে কি ? মালিক তো আর বসিয়ে
বসিয়ে বেতন দেবে না! আগের দিনই ন’তলা ভবনটিতে ফাঁটল ধরেছিল ।স্থানীয় এক ইন্জিনীয়ার বলেছিল ভবনটা বিপদ্জনক।কিন্তু মালিক বললো ওসব কিছু না। প্লাষ্টার খসে পড়েছে মাত্র ! পরের দিন কাজে আসার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল।ওদের মত সাধারণ শ্রমিকের এত খবর পাওয়ার কথাও নয় ।ওরা দিন আনে দিন খায়।মেয়েটি ওর কাজের জায়গা রানা প্লাজার কাছেই থাকে, একা। স্বামী পরিত্যক্তা! ভাড়া বাড়ী।মালকিন মেয়েটিকে খুব স্নেহ করেন।সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশেই রানা প্লাজার তিনতলায় এক গার্মেন্টস কারখানার সেলাই কর্মী ও ।

সাভারের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতি সৌধের কথা । কত শহীদের আত্মবলিদানে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ । বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রুপসী বাংলা, রুপের যে তার নেইকো শেষ । সবই ভালো কিন্তু গরীবের ভাগ্য সব দেশেই এক। দারিদ্রের বিষচক্র থেকে নিস্তার নেই।
ওরা গরীব,তাই শিক্ষার সুযোগ নেই,তাই সরকারি সহায়তা পায়না, তাই ভালো কাজ জোটেনা, তাই ওরা গরীব-ই থেকে যায় । ওদের দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানার কশিগাড়ি গ্রামের কথা খুব মনে পড়ে রেশমার । হ্যা মেয়েটির নাম রেশমা ।বাবা মার আদুরে মেয়ে ।অনেক আশা করে নাম রেখেছিল রেশমা । রেশমের মত নরম মোলায়েম চুল ।কবির ভাষায় বলা যায় ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ । রেশমা নামটা বড়লোকের মেয়েদেরই মানায় ।গাড়ী চেপে ঘুরবে, কলেজে যাবে, ফটাফট ইংরেজী বলবে,ফ্ল্যাটে থাকবে ।হয়তো বাবার মনের গোপন কোনে এমন সাধই ছিল! কিন্তু গরীবের সাধ কি আর পূর্ন হয় ! অল্প বয়সেই বিয়ে,অভাবের তথা টানাটানির সংসারে ঝগড়াঝাটি মারধোর লেগেই থাকতো ।ভালোরকম মারধোরই চলতো । দু তিন দিন অনাহার লেগেই থাকতো । অদ্ভুত সহনশক্তি ! কারো কাছে কিছু বলতোনা, কোন নালিশ, কোন অভিযোগ নয় । সবই নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিত । তবুও একদিন স্বামী বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে কুড়ি বছরের রেশমাকে ফেলে চলে গেল!

তারপর প্রতিদিন রানাপ্লাজায় গার্মেন্টস কোম্পানীতে সেলাইয়ের কাজ । বাসায় ফিরে রান্নাবান্না করে খাওয়া দাওয়া ।বাসার মালকিনের সাথে একটু গল্পগুজব ।এই মহিলাকে রেশমা মায়ের মতো দেখে।গ্রাম থেকে এতদূরে রেশমার ভরসা একমাত্র এই মহিলাই। তারপর ? ‘সব পাখি ঘরে ফেরে,সব নদী, সব গান শেষ হয়ে যায়, থাকে শুধু অন্ধকার !‘



বুধবার ২৪শে এপ্রিল ২০১৩ সকালে পৌছে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সকাল ৯টা বাজতে ৫মিনিট বাকি ।হঠাৎ জেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায় ।পুরো রানা প্লাজা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো ।হাজার হাজার মানুষ চাপা পড়লো ভবনের নীচে ।আলো চলে গিয়ে ভয়াবহ অন্ধকারে ঢেকে গেল চারিদিক ।মৃত্যুচিৎকারে ভরে গেল আকাশ বাতাস।রেশমা
আটকে গেল এক খাঁজের ভিতরে ।

এই কি সেই নরক ! আলো নেই,খাবার নেই,অবিরাম মরণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের আর্তনাদ ! তবুও সাহস হারায়নি রেশমা ।মা ওর নাম রেখেছিল জয়া ।সেই নামের সন্মান ওকে রাখতেই হবে ।ভবন চাপা পড়ে যখন মরেনি ,তখন ওকে বাঁচতেই হবে ।সঙ্গে থাকা পানি আর শুকনো খাবার অল্প অল্প করে খেয়ে ক’দিন বা ক’রাত কাটলো কে জানে ।এখানে আলো নেই, শুধুই অন্ধকার।সময় এখানে থেমে আছে।


সাথের খাবার, পানি ফুরিয়ে গেল ।এখন টেকাও দুষ্কর ! মরা পচার দুর্গন্ধে আর তিষ্ঠানো যায় না ।নিশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে ।ওর পাশেই ছিল তিন সহকর্মীর লাশ । ওদের সাথে থাকা পানি আর খাবার নিয়ে নিল জয়া ।মৃত্যুকে জয় ওকে করতেই হবে ।সেই খাবার আর পানিতে কেটে গেল আরো কিছুটা অন্ধকার সময়। এদিকে সরকার কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছে ।এমনকি লাশ উদ্ধারের আশাও ছেড়ে দিয়ে ভবনটি ডেমোলিশ করার দিকে এগোচ্ছে ।


মানুষ বেঁচে থাকলে তার কিছু প্রাকৃতিক ক্রিয়া কাজও থাকে । সব মিলিয়ে ঐ জায়গার যে পরিবেশ দাড়িয়েছিল গভীর দুঃস্বপ্নেও তা মানুষের কল্পনায় আসেনা । রেশমা স্বগোতক্তি করে ওঠে, ‘শোনরে মালিক শোনরে মজুতদার, তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড় , হিসাব কি দিবি তার ?’ সব পানি , আর খাবার শেষ । আর পারছেনা রেশমা । তবে কি সে হেরে যাবে, মৃত্যু এসে জয়াকে পরাজিত করবে ?
১০ইমে শুক্র্রবার দুপুরে হঠাৎ ই মানুষের কন্ঠস্বর ভেসে এলো, কাদের যেন পায়ের শব্দ ! উত্তেজনায় অধীর হয়ে একটা পাইপ ধরে নাড়াতে শুরু করে সে ।পাইপ নাড়াচাড়া দেখে উদ্ধারকারী দল চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কেউ কি আছেন ‘? ১৭ দিন পড়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে এটা তাদের বিশ্বাস হয়না । শান্ত ধীর গলায় রেশমা বলে, আমি রেশমা, আমাকে বাঁচান ‘।

৪৫মিনিটের উদ্ধার কাজ শেষে আলোয় ফেরে রেশমা । পৃথিবীর ইতিহাসে এর আর দ্বিতীয় নজির নেই ।৪১৬ ঘন্টা অন্ধকারে আটকে থাকার পড়ে জীবিত উদ্ধার ! সামরিক হাসপাতালে তাকে দেখতে দেশের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন । অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার এই ঘটনা সমগ্র মানব জাতিকে চিরকাল অনুপ্র্রানিত কররে ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
F.I. JEWEL N/A # বাস্তবতার আলোকে সুন্দর একটি গল্প ।।
মিলন বনিক একটা বাস্তব প্রেক্ষাপট আর সুন্দর বুনন...ভালই লাগলো...শুভ কামনা....
Md. Akhteruzzaman N/A অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে একেবারে দিন মান ক্ষণ তুলে ধরে ঘটনাটিকে বাস্তবতা দেয়ার জন্যে|
ধন্যবাদ , লতিফ ভাই ।আপনাকেউ ধন্যবাদ মোঃ আক্তারুজ্জামান ।
এশরার লতিফ ভয়াবহ সে দুর্ঘটনা দারুন কুশলতার সাথে তুলে ধরেছেন। ভালো লাগলো।
তাপসকিরণ রায় অদ্ভুত সুন্দর ভাবে গল্পটি লিখেছেন--বর্তমানকালের স্মরণীয় ঘটনা লোকসমক্ষে জ্বলন্ত ভাবে তুলে ধরেছেন।অন্ধকার বিষয়ের ওপরে লেখা গল্পটি তুলনাহীন।কিন্তু কজন পাঠক এ লেখার স্বাদ নিতে পেরেছে?
তাপসদা , আমি কিন্তু নিজের জন্যই লিখি , না লিখে থাকতে পারিনা ।
Lutful Bari Panna জীবন্ত বর্ণনা মনে হল। একটুখানি অতৃপ্তি সেটা শুধু আপানর লেখা পড়েই মনে হচ্ছে, এই গল্পটা যদি কেউ ডিটেলসে লিখত। কেমন হত!
খুঁজে নিয়ে হীরে চুনি , পান্না ; মুছে দাও গরীবের কান্না । শুধু বিজয়ী হবে কেন কবিতার ; গল্প লেখায় হাত দাও এবার ।।
সূর্য N/A ধীমান অত দূরে বসে লিখেছো, তবু মনে হলো সব ঘটনা তুমি নিজে দেখেছো। গল্পকারের তো এমনই হওয়া চাই। চরিত্রের আবেগ যদি লেখককে ছুয়ে না যাবে তবে সে লেখা হবে কৃত্রিম। এই যে বললে "গরীবের ভাগ্য সব দেশেই এক" এটাই সার কথা, গরীবরা সব সময়ই ধনীদের উপরে ওঠার সিড়ি হয়ে থাকে। তোমাকে অনেক সাধুবাদ।
নতুন সূর্য আলো দাও , আলো দাও ।।

০৬ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পরগাছা”
কবিতার বিষয় "পরগাছা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুলাই,২০২৫