হারু মুন্সীর বয়স ষাটের কাছাকাছি চলে গেলেও তাকে দেখলে বড় জোর তার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে বলেই মনে হয়। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল। মাথার একটা চুলও যেমন ঝরে পড়েনি তেমনি একটা চুলও সাদা হয়নি। খাটো খোট শক্ত পোক্ত গড়নের শরীর একদম ঋজু। চেহারায় চোখ পড়ার আগে তার পেটানো শরীরের সুস্পষ্ট পেশীগুলির দিকেই মানুষের নজর আটকে যায়। এই শরীরের পিছনে তার শ্রম দিতে হয়নি। বরং শ্রম দিতে গিয়ে কখন যে এই শরীর সুন্দর মজবুত হয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না। কর্মঠ মানুষের শরীর যে নিরোগ, মজবুত আর সুশ্রী হয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তাকে যে দেখেছে সে মেনে নিতে বাধ্য হবে।
মুন্সী বলতে আরিক অর্থে আমাদের দেশে যা বুঝায় সে ঐ রকম কিছুই না। নামের ধরণ দেখে মুন্সিগিরী তার পেশা ভাবলে ভূল হবে। সে পেশায় ছৈয়াল। আশে পাশের পাঁচ দশটা গ্রামের মানুষ তাকে এক নামে চেনে। শনের ঘরের চাল তার হাতে শিল্পকর্ম হয়ে উঠে। শুধু ঘরের চাল না- গৃহস্থালী কাজের নানা উপকরণ বেতের ঝুড়ি, বাঁশের চালুনি, ধানের গোলা থেকে শুরু করে নৌকার ছৈয়া কোন কিছুতেই তার জুড়ি মেলে না। দা আর বাঁশ, বেত তার হাতে খেলার বস্তু। বাঁশ বেতি করা অন্যের কাছে যখন প্রাণান্তকর তখন তার হাতে তা ছন্দময়। তার বেতির বুনন কিশোরীর মাথায় মায়ের বিলি কাটার মতই নান্দনিক!
আট শতক জমির উপর একটা চৌচালা শনের ঘর আর তার পাশে ছোট্ট একটা দোচালা রান্না ঘর নিয়ে হারু মুন্সীর সংসার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিন চারটা গরু রাখার মতো একটা গোয়াল ঘরও ছিল। পরে অবশ্য সংসারটা যখন ক্রমশ: বড় হতে লাগল তখন থাকার ঘরের পাশে বারান্দা দিয়ে তাতে একটা কোঠাও বানাতে হলো। এই সব বাদ দিয়ে আট শতক জমির যে অবশিষ্টাংশ থাকে তা কিন্তু গৃহস্থ পরিবারের জন্য অনেক কিছু না। তবে এই রকম পরিবার আমাদের দেশে অনেক। যাহোক বাকী জমিটুকুতে যে শাক সবজি তরিতরকারী ফলতো তাতে মুন্সীকে হাটে অন্তত তরকারীর বাজারের দিকে হাঁটতে হতো না।
বাড়ীর কাছেই বিল। বছরের ছয় মাস পানির নীচে থাকে। বিলের জমি এক ফসলি। ছয় মাস পানির নীচে থাকে বলেই হয়তো মাটি খুব উর্বর। বিলে হারু মুন্সীর দুই বিঘা জমি ছিল। বিলের জমিতে আগে আমবোরো, জাগলি, মোক্তহর জাতের দেশী বোরো ধান চাষ করা হতো। বিঘায় ফলন ছিল বড় জোর আট থেকে দশ মণ। মুন্সীর জমি থেকে সে বছরে পনের বিশ মন ধান পেতো। যা পেতো তাতে সংসার চলতো না। খেয়ে না খেয়ে বহু কষ্টে দিন কাটাতে হতো। শুধু তার না প্রায় প্রতিটা পরিবারই খুব খারাপ সময় গেছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের আট দশ বছর পর দেশে ধান চাষে যেন বিপ্লব ঘটে গেলো- ইরি আবাদী শুরু হলো, সরকারী সহায়তায় গভীর নলকূপের ব্যবস্থা হলো। ধান চাষে সেচ সুবিধা পেলে তাতে সাফল্য অবধারিত। ছোট খাটো অনেক গৃহস্থের মতোই হারু মুন্সীরও কপাল খুলে গেলো। তার দুই বিঘা জমিতে ধান ফলতে শুরু করলো পঞ্চাশ থেকে ষাট মণ।
হারু মুন্সীও সুখী মানুষ হয়ে উঠলো। আল্লাহ যেন মুখ তুলে তাকালেন। সত্যি আল্লাহ এলাকার মানুষের প্রতি যেন রহমতের দরজা খুলে দিলেন। আগে দেশি জাতের ধানের ফলনও ফলতো খুব কম তার উপর আবার প্রতি বছর খরা, বন্যা, শিলা বৃষ্টির মতো অনাসৃষ্টি যেন গৃহস্থের পিছু ছাড়তো না।
গরীবের কপালে সুখ সয় না। পাঁচ সাত বছরের মাথায় হারু মুন্সীর কপাল পুঁড়লো। ছেলেটা সবার বড় সে স্কুলে পড়ছে। মাথা ভাল বলে সবাই খুব প্রশংসা করে। একটা মেয়েও স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আরও ছোট মেয়ে দুটোর অবশ্য তখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। এই সংসার নিয়ে হারু মুন্সী যখন সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তখন যে ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল তা সে ঘুর্ণারেও বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারলো তখন বৈশাখ মাস। জমিটার ধানগুলি মাত্র সোনালী হতে শুরু করেছে।
সকাল বিকেল হারু মুন্সির তে ঘুরে দেখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কাঁকড়া কুঁচে আইল খুঁড়ে গর্ত করে সে সব গর্ত বন্ধ না করলে জমির পানি নেমে যায়। ইরি েেত পানি না থাকা মানে সর্বনাশ! তাছাড়া জমিও নাকি মালিক খোঁজে, নিয়মিত মালিক যদি জমিতে যায় তবে সে জমির ফলন অন্য রকম হয়। গ্রামের গৃহস্থরা এরকমই বলে থাকে। মুন্সীও মনে প্রাণে এসব কথা বিশ্বাস করে। আধা পাকা ধান কাটলে খুব লোকসান হয়ে যায়। ধান পুরোপুরি না পাঁকলে কাঁচা ধান কাটার পর তা শুঁকালে চাউল হৃষ্টপুষ্ট হয় না। ফলন কমে যায়। হারু মুন্সী তার অভিজ্ঞতা থেকে হিসেব নিকেশ করেছিল বৈশাখের দিন পনের গেলেই ধান কাটা যাবে। তাতে আর কোন লোকসান হবে না। সব কিছু একেবারে সঠিক পাওয়া যাবে।
গ্রামেরই এক বাড়ীর ঘরের চালের ছাউনী শেষ করে টুয়ায় শলা বাধার সময় হারু মুন্সীর ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে দু:সংবাদটা তাকে দিল। খবরটা শুনে হারু মুন্সী দা হাতে চাল থেকে লাফিয়ে পড়ে পড়লো। হাতে পায়ের অনেকটা জায়গা ছড়ে গেলো। নিজের হাতের দায়ে কেটে কুঁটে সে মরতেও পারতো। এসবের দিকে তার নজর দেয়ার মতো হুঁশ ছিল না। সে তীরের মতো ছুটে গেলো কিন্তু নিজের জমিটার কাছে যেতে পারলো না। দৌড়ে যেতে যেতেই তার চোখে পড়লো জনা দশেক লোক ধান কাটছে। আরও আট দশ জন লোক বল্লম, জুতি, টেঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সাইদ মাতব্বর হারু মুন্সীকে দেখা মাত্রই হাত উঁচু করে হুংকার দিয়ে দুরেই থামিয়ে দিল- জানে বাঁচতে চাইলে কাছে আইবি না। জমি আমার! এতদিন অনেক খাইছস। জমির ধারে কাছে আইছস্ ত মরছস।
হারু মুন্সী আর এগোতে পারল না, টলতে টলতে সে কোন মতে বাড়ী ফিরলো। বাড়ীতে তার বউ জ্ঞান হারিয়েছে। উঠানের এক কোণে মেয়ে তিনটা জড়াজড়ি করে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে। ছেলেটা প্রাণপণে নিজের কষ্ট সামাল দিয়ে মায়ের মাথায় পানি ঢালছে। সুখে দু:খে সবসময় পাশে থাকা পাড়া পড়শিরা আজ আর কেউ এগিয়ে এলো না। স্বপ্নের সংসার নিমিষেই হারু মুন্সির কাছে ভয়ানক ঝড়ে বিপর্যস্ত এক শশ্মানের মতো হয়ে গেলো। গরীবের কপালে সুখ সয় না কথাটা তার একবারও মনে পড়লো না তার বার বার শুধু মনে হতে লাগলো- ধনীরা গরীবের সুখ বরদাশত করতে পারে না!
******************************
হুজুর, যুগের পর যুগ আমি দা চালিয়েছি। কোন জিনিস এক কোপে কাটতে কি করা লাগে তা আমার চেয়ে ভালো খুব কম লোকেই জানে। সাইদ মাতব্বর তা বুঝতে পেরেই উপুড় হয়ে আমার দু পা জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। দু’হাত জোড় করে আমার কাছে সে প্রাণ ভিা চেয়েছিল। তেটাও ফেরত দিতে চেয়েছিল। আমি জানতাম মাতব্বর তেটা ফেরত দিতে পারলেও আমার এক মাত্র ছেলেটাকে আর কোনদিন ফেরত দিতে পারবে না।
বছরের পর বছর মামলা চালিয়েছি। উকিল মোক্তার শকুনের মতো হামলে পড়ে খুবলে খুবলে খেয়ে আমার সংসার শেষ করে দিয়েছে। ন্যায় বিচার পাওয়ার আশা দিয়ে ওরা আমাকে শোষণ করে করে একেবারে নি:শেষ করে দিয়েছে। শুধু এক তারিখের ফি দিতে পারিনি বলে আমার উকিল আমাকেই শত শত মানুষের সামনে চড় মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।
তারপরও এই উকিলের ফি জোগাতেই আমার ছেলেটা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দিন মজুরের কাজে নামলো। আমিও অপমানের কথা ভূলে গেলাম, কারণ দোষটা তো আমারই ছিল! তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে উকালতি পাশ করেছেন তাদের খরচ ঠিক মত দিতে না পারাটা চরম অন্যায় বৈকি!
হুজুর, ন্যায় অন্যায় বোঝার মতা থাকলেও গরীবের কিছু করার মতা থাকে না। আমিও ঠিক মতো থানা পুলিশ করতে পারছিলাম না। বড় মেয়েটা পুরোপুরি সাবালিকা হয়ে উঠার আগেই সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে চাইলো। ও শহরে চলে গেলো। রাত দিন পরিশ্রম করে ও যখন বড়লোকের বাসার ভালো একজন ঝি হয়ে উঠছে, বোনদের জন্য জামাটা, মায়ের জন্য কাপড়টা দিয়েও আমার হাতে মামলার খরচ হিসেবে কিছু টাকা তুলে দিচ্ছে তখন সাইদ মাতব্বররা আমার মেয়েটার চরিত্রে বেশ্যাগিরীর কালিমা মেখে যাচ্ছিলো।
আমার ছেলেটাকে ওরা সন্ধ্যা বেলা পিটিয়ে মেরে ফেললো। হুজুর, বাঁশের আঘাতে ছেলেটার মাথা হাঁ হয়ে ছিল। ওর ফাঁটা মাথায় এক ফোঁটা একটুও রক্ত ছিল না। থাকবে কি করে! অতটুকু ছেলে সংসারের জন্য খেঁটে ঁেখটে ওর সব রক্ত যে পানি পানি করে ফেলেছিল!
থানায় গেলাম। পুলিশের বড় কর্তা আমাকে লাথি মারলো। দুহাতে গলা চেপে ধরে বললো- হারামজাদা, ভেবেছিস কোন খবর রাখি না আমরা! গণ পিটুনীতে মারা যাওয়া ডাকাতের জন্য সমাজের ভালো মানুষের নামে মামলা নিয়ে আমি নিজের চাকুরী খোয়াবো?
থানা মামলা নিলো না। কোর্টে মামলা দিতেও দিন পনের লেগে গেলো। হুজুর, দারোগা যখন বড় লোক আসামীর বাড়ীতে খাসী পোলাও খায় তখন গরীব বাদীর মনে কেমন কষ্ট হয় তা যদি আপনি একটু উপলব্ধি করতে পারেন তবে ফাঁসিতে ঝুলেও আমার কোন কষ্ট থাকবে না। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি।
আপনারা মানুষের শান্তি বিধান করেন। হুজুর, আমাকে লঘু দন্ড কিংবা মুক্তি দিয়ে কষ্ট দিবেন না। ফাঁসি দিয়ে আমাকে মুক্তি দিন। আমি আমার এই সংসারে আর এক দিনও বাঁচতে চাই না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ইয়াসির আরাফাত
গল্প টি পড়ে ব্যথিত হলেও কষ্ট পাইনি । এগুলো স্বাভাবিক মনে হয় । তবে নিশ্চিত হয়ে গেলাম দেশের রুই কাতলারা সাইদ মাতব্বর আর আমরা হারু মুন্সী , আমরা বললে ভুল হবে আমার মত খেটে খাওয়া মানুষ গুলোই হারু মুনশি । দেশের মূর্খ চামচা রাই পুলিশ ।
মিলন বনিক
আক্তারুজ্জামান ভাই...অসাধারন জীবনধর্মী আর বস্তুনিষ্ঠ সাবলীল লেখনী...মন ছুঁয়ে গেলো....গল্প যে মানুষের কথা বলে জীবনের কথা বলে...তা আপনার গল্পে পুরোটায় পেলাম.....অনেক অনেক অভিন্ন্দন...আর নববর্ষের শুভেচ্ছা...
রনীল
আকু ভাই, আপনি না থাকলে এমন জীবনঘনিষ্ঠ লেখা আমরা কোথায় পেতাম। হারু মুন্সিদের জন্য লেখার খুব বেশি লোক নেই। আমরা তো এদের ভালো করে চিনিইনা। অতএব আপনাকে, আপনাদেরই পথ দেখাতে হবে... প্রথম আর দ্বিতীয় পরিচ্ছদের মাঝে একটা গ্যাপ থেকে গেছে। গল্পটা কম সময়ে লিখেছেন জানি, তবে আরেকটু বড় পরিসরে লিখলে মন্দ হতোনা ...
নিরব নিশাচর
চমৎকার গল্প আখতার ভাই। আপনার গল্পে সবসময় গ্রাম বাংলার অবহেলিত মানুষগুলোর চিত্র ভেসে উঠে। আরেকটা ব্যাপার খুব ভালো দেখিয়েছেন যে - আইনের প্রতি যখন মানুষের আস্থা থাকে না তখন মানুষ কি করে... এটাই বাস্তবতা... মাঝে মাঝে তাই খুনীকেও নিরপরাধী মনে হওয়ার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয় যেটা এখানেও হয়েছে...
তানি হক
পরিচিত আখতারুজ্জামন ভাইয়ের গল্পের চেনা স্টাইলের রূপ ছাড়িয়ে ..এক অন্য রকম গল্প উপহার পেলাম ...পুরো গল্পটি পরে আবেগে রুদ্ধ হলাম ..কিছু বলতে পারছিনা এই মুহুর্ত্যে ...শুধু আপনাকে ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা এই হৃদয় গ্রাহী গল্পটির জন্য ....
sakil
সমাজের অবহেলিত মানুষের গল্প।যেখানে সততা ন্যায় হারিয়ে যায় ক্ষমতা আর থেকের কাছে . সেখানে এই গরিব চাষী মৃত্যু ছাড়া আর কি কামনা করতে পারে হাকিমের কাছে
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।