স্মৃতি ছাড়া কোন নোটবুক নাই
কিছু টুকে রাখি, কিছু ভুলে যাই
নামকরণ নিয়ে একটু বলে নি আগে। অনেক আগে চটি বিষয়ক জটিলতা নিয়ে লেখা গল্পের নাম পন্ডিত দিয়েছিল চটিলতা। তাই আমি প্রেম বিষয়ক জটিলতার নাম দিলাম, প্রিতিলতা। সব পন্ডিতি পন্ডিত একাই করে ফেলবে তা কি করে হয়? তাছাড়া ইদানিং গল্পকবিতায় একজন তীব্র ক্ষোভবশত আমাকে জনে জনে বিশ্বপন্ডিত উপাধিতে ভূষিত করছেন। ভাবলাম মানুষ কত কষ্ট করে, পরিশ্রম খরচ করে (কেউ কেউ এমনকি অর্থ খরচ করে হলেও) পদক ইত্যাদি জোগাড় করেন। আর আমি কিনা বিনা পয়সায় পেয়ে যাচ্ছি। মাঝখান থেকে বেচারা পন্ডিতের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী জুটে গেল বিনা খরচায়।
এই ফেসবুক, চ্যাট আর এসএমএসের যুগে প্রেমপত্র ব্যাপক সেকেলে বস্তু বলে মনে হতেই পারে। তবে চিরকাল তো আর এমন অবস্থা ছিল না। আর সে অবস্থা যে খুব বেশীদিন আগের তাও না। একদিন হয়ত রূপকথার কাহিনী তৈরি হবে। 'সে অনেক অনেককাল আগের কথা। যখন প্রেমিক প্রেমিকারা কাগজ নামের একটি দাহ্য, গলনীয় এবং অল্পেই ছিঁড়িয়া যাওয়া বস্তুর উপরে মনের একান্ত বাণীগুলো লিপিবদ্ধ করিয়া ছিপিবদ্ধ করিতেন। অতঃপর বিবিধ এবং বিচিত্র প্রক্রিয়ায় সেইগুলি যথাস্থানে প্রেরণ করিতেন।'
সেদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম আমার অনেক পরে জন্ম নেয়া এক হৃদয়ধুকপুক(হার্টথ্রবের বাংলা করার অপচেষ্টা) রূপবতীর সংগে। তার কিশোরী বয়সে তার সংগে পরিচয়- তখনো তারবিহীন প্রযুক্তি বেশ দুর্লভই ছিল। তিনি কবিতা রচনা করতেন বলে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কবিতা বিনিময় হত। সেইসব কবিতাগুলো কবিতা হলেও ঠিক কবিতা ছিলনা। কবিতায় কবিতায় ভাববিনিময় আর কি? কথায় কথায় সে বলছিল, 'কেউ আমাকে কখনো প্রেমপত্র দিলই না।' বললাম, 'কেন? তোমার মত মেয়েদের রান্নাঘরে পাতাপত্রের অভাব হলেও প্রেমপত্রের অভাব হবার তো কথা না।' সে হেসে বলল, 'মনে হয় কেউ সাহস করে উঠতে পারেনি।' আমিও পাল্টা হেসে বললাম, 'যদ্দুর মনে আছে তোমার আমার কিছু পত্রবিনিময় হয়েছিল এককালে।' সে বলল, 'সে তো কবিতা।' বললাম, 'সে কি শুধু কবিতাই ছিল?' সে নস্টালজিক হয়ে উঠে গম্ভীরভাবে বলল, 'না। তবে সেসব ভেবে আর লাভ কি?'
সত্যি তো যা গেছে সেসব যন্ত্রণা খুঁচিয়ে তুলে লাভ কি? তবু মাঝে মাঝে মাথায় এক স্যাডিস্টের আবির্ভাব হয়। অন্যকে নয়, নিজেকে যন্ত্রণা দিয়েই আনন্দ পায় সে। তো তার প্রেরণায়ই কৈশোরকালের কিছু গপসপ করি। নাটক সিনেমা দেখে টেখে তখন মোটামুটি ধারণা জন্মে গেছে প্রেম একটি উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক বিষয়।
ঐ যে গান আছে না, 'পিরিত কাঞ্চন, পাইল যেজন, সফল জনম তার"
সফলের বিপরীত তো ব্যর্থতা। যে না পেল তার মানব জনম বৃথা বলেই বোধ হয় সবাই প্রেমে পড়ে। লোকে এত কথা যখন বলছে, বস্তুটা নিশ্চয়ই উপাদেয় কিছু হবে ভেবে কোন এক শুভক্ষণে(!?) এক কিশোরীর হৃদয় লক্ষ করে ক্যাচ নিবার মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ক্রিকেট মাঠের দুর্দান্ত ক্যাচুরে প্রথম সুযোগেই পপাত ধরণীতল। এটা যদি প্রেমে পড়া হয়- তাহলে প্রথম অভিজ্ঞতাটা নেহাত মন্দ না। অল্পের জন্য কম্পাউন্ড ফ্রাকচার থেকে রক্ষা পেয়ে ভাবলাম যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছি তার পিঠেই.... যারা প্রেম করে তারা অনেক চটপটে, তাহাদের চোখে-মুখে বিদ্যুৎ খেলে। আমিও তাদের প্রায় সমগোত্রীয়।
প্রায় বললাম কারণ কথা বলতে গেলে তা প্রায় গলার মুখ পর্যন্ত এসে আটকে যায়। তারপর ধরেন আশে-পাশে মেয়েদের দেখলে প্রায় স্মার্ট ভঙ্গীতে মুড নিয়ে দাঁড়াই, শুধু হাঁটু দুটো কি কারণে যেন আমার সাথে রসিকতা শুরু করে দেয়। তখন কোন দিক সামাল দেব বুঝে উঠতে কিঞ্চিত দেরী হয়ে যায়। তো এমতভাবে একদিন প্রেমের শুভ উদ্বোধন সমাপনান্তে ভাবলাম হাঁটু কিংবা ভোকাল কর্ড কোনটার উপরই যখন পর্যাপ্ত ভরসা করতে পারছিনা- অতএব একমাত্র পদ্ধতি প্রেমপত্র....
ছেলেবেলা থেকেই একটু কাব্য চর্চার বদভ্যাস ছিল। ভাবলাম এই ক্ষেত্রে সফল হওয়াটা অসম্ভব নাও হতে পারে। অনেক কায়দা কসরত করে একখানা পত্র রচনা করলাম। এখনো আমার ধারণা সেটা পত্রসাহিত্যে স্থান করে নিতে পারত। অনেকদিন পরে একটা চিঠি লেখা প্রতিযোগিতায় সেটার যেটুকু মনে ছিল তার সাথে এক আধটু যোগ করেই প্রথম পুরস্কার পেয়ে গেছিলাম। অতি ভাবাবেগযুক্ত চিঠিটার শেষ লাইনটি ছিল ধার করা- 'বালক জানেনা কতটা হেঁটে এলে ফেরার পথ নেই'। লেখালেখির মধ্যে প্রাণ বলে একটা বস্তু থাকে, যার অন্য নাম আবেগ। লেখার মান যাই হোক ঐ জিনিসটি থাকলে সেটার মধ্যে একটি বিশেষ কিছু চোখে পড়বেই। আমার চিঠিতে তা ছিল অফুরন্ত। একেবারে হৃদয় নিংড়ানো রক্ত দিয়ে লেখা তো। লিখলাম তো ভাল কথা কিন্তু দেই কিভাবে? হায় তখন যদি মোবাইল থাকত! চিঠি পকেটে নিয়া ঘুরি, দেবার সাহস হয়না- সাহসী লোকদের যা হয় আর কি!!!
প্রতিদিন তাকে দেখি, তার হাসি দেখি। (আমাকে দেখলেই বান্ধবীদের সংগে কি এক অদ্ভুত কারণে হেসে হেসে ভেঙে পড়ত- কেন কে জানে?) পাগল করে দেয়া মুখটি দেখি- পকেটের চিঠিটা দেখি। যে যার জায়গায় থেকে যায়। কারো সাথে কারো সেতুবন্ধন রচনা করার দুঃসাহস আমার হয়না। মুখ গোমড়া করে ঘুরি, সারাক্ষণ নিজের সংগে কথা বলি। বন্ধুরা বলে তোর কি হয়েছে- জবাব দিতে পারিনা। আমিই কি ছাই জানি কি হয়েছে। সবাই প্রেমে পড়ে- আমি পড়েছি প্রেমের ফাঁকে। এ বড় কঠিন ফাঁক- যে না পড়েছে তাকে বোঝানো যাবেনা- কি যাতনা বিষে...। তবে আশার কথা, এই ঢাকাইয়া লাড্ডুর (প্রাক বিবাহ বলিয়া ঢাকাইয়া, পরের পর্বে গেলে অবশ্যই দিল্লী যাইত। আপাতত বহুত দূর।) সাধ সবাই জীবনে অন্তত একবার পেয়েছেন বলে ধারনা করি। তার ঊপর শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব। তাকে কারো সংগে কথা বলতে দেখলেই সন্দেহ হয়.... আহা..... গেল বুঝি...। সুদর্শন বন্ধু-বান্ধবদের শত্রু মনে হয়। চিঠি দেবার সাহস হয় না।
একবার এক বন্ধুর প্রেমিকা দোলা বলল, 'তুমি সারাক্ষণ কি নিয়ে এত ভাব বলত? আমার কাছে বল, অন্তত।' বন্ধুর প্রেমিকারা বোধ হয় প্রেমিকের বন্ধুদের প্রতি একটু সহানুভূতিপ্রবণ। কিন্তু কেমনে কই? অবশেষে প্রবল চাপাচাপিতে স্বীকার করলাম আমার রক্তক্ষরণের ইতিবৃত্ত। সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'এ কোন ব্যাপারই না তোমার সব সমস্যা আমি সমাধান করে দেব। তুমি আমার সংগে পরিচয় করিয়ে দিও।'
দোলার আশ্বাসবাণী শুনে কলিজায় একটু দমের দুলুনি টের পেলাম। কিন্তু হায় তখনো আমি নিতান্ত এক সরল, অনভিজ্ঞ কিশোরই বটে। সুনীল বাবুর বিখ্যাত কবিতাটি তখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। যদি পড়তাম তাহলে হয়ত দোলার প্রতি অমন একটা অভিমানের দুলুনি বয়ে বেড়াতাম না। যেখানে, এক বোষ্টমী পঁচিশ বছর ধরে একটা মাত্র অন্তরা শোনাতে পারেনি। মামা বাড়ির আবদার বলে যেখানে কথা- সেই বাড়ির এক মাঝিও কিনা সামান্য একটা বিল দেখাতে নিয়ে যায়নি। আমার ভাগ্নে ছবছর বয়সে প্রায়ই আমার কথা না রাখা নিয়ে একটা বাক্য উচ্চারণ করত। 'মামা, তুমি না বলেছ....।' বাক্যটি শুনতে শুনতে 'তুমি না বলেছ' বাক্যবন্ধটি নিয়ে প্রায়ই একটা কাব্য রচনার কথা ভাবতাম। সে যাক মামাদেরই এই অবস্থা, বাবারা তো এমনিতেই সচরাচর কথা রাখেন না। কিন্তু বরুণা ম্যাডামের কথা ভাবুন। তুমি কথা রাখেবেনা ভাল কথা- সোজাসুজি বলে দিলেই পারতে। তা না করে খামাখা কোন আক্কেলে বেচারাকে পুকুরে-দিঘীতে চুবিয়ে, এত ঝামেলা পুষিয়ে পাঁচটা দশটা না, একেবারে একশ আটটা নীল পদ্ম যোগার করতে পাঠালে? ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধা কি চাট্টিখানি কথা। তাও আবার দুরন্ত ষাঁড়। বড় বড় ম্যাটাডোররা পর্যন্ত দিশে হারিয়ে ফেলে আর বেচারা প্রেমিককে কতবার যে গুঁতো খেয়ে ক্লিনিক, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, খুরের আঘাতে পাঁজরের হাড়ে চিড় ধরেছে- সে খবর যদি রাখতে।
সে যাক, এত বিখ্যাত চরিত্রগুলোই যখন কথা রাখতে পারেনি, তখন দোলার প্রতি যে ছেলেমানুষি অভিমানটুকু তোলা ছিল- তা শেষমেশ কোনমতে ভোলা গেল।
সে ছিল আমার তখনকার ঘনিষ্ঠতম (এক হিসেবে একমাত্র) বন্ধুর বোন। কাজেই ও বাসায় যাওয়াটা আমার কাছে ছিল ডাল-ভাত। তাছাড়া তখন জেলা পর্যায়ে চেসলীগে খেলতাম। ওর দুলাভাই খুব ভাল দাবাড়ু ছিলেন। তার সংগে প্রাকটিস করতে- রোজ বিকেলে ওদের বাসায় যেতাম। আমার যাওয়ার পথে সে তার সখীগণ সমব্যিবহারে আড্ডা মারত। আমাকে দেখা মাত্র কোন এক অজুহাতে- পেছনে বান্ধবীদের নানান রসাল টিকা টিপ্পনী উপেক্ষা করেও আমার পিছু পিছু বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হত। কীভাবে সহ্য করত কে জানে? কিছু কিছু বাণী-সম্ভার আমার প্রেমকালা মস্তিষ্কেও ঢুকেছিল দুএকবার। সে আর কহতব্য নয়। শুধু ভেবেছিলাম মেয়েরা এত পাজীও হয়।
পথ বেশী না হলেও একেবারে কম না। এই নাতিদীর্ঘ পথ রোজ পাড়ি দিলেও দুজনার মধ্যকার স্বল্প ব্যবধানটুকু -এমনকি কথা বলে পাড়ি দেয়াও আমার কাছে সাত-সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চাইতেও দূরুহ মনে হত। সেটাই পারিনি, আর চিঠি দেয়া....!!(একটা তীব্র দীর্ঘশ্বাস)। একটাই উপায় ছিল, চিঠিটা পায়ের কাছে ফেলে মানসম্মান পকেটে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালানো। একবারে যে কখনো ভাবিনি- তাও নয়। তবে মান-সম্মান বলে কথা- অমন দৌড় দৌড়ুলে সেটা যে যথাস্থানে থাকবে তেমন নিশ্চয়তা কি? আর পথে-ঘাটে হারিয়ে ফেললে- এতদিনের সযত্ন সঞ্চিত ইমেজ- আহা, কি দুর্গতিই না হবে তার। যদিও মনে মনে জানি এসব ভীরু প্রেমিকদের সান্ত্বনা অথবা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুই না। অতএব মানসম্মানের হাওয়া বেলুনে পুড়ে, কষে সুতো বেঁধে- ব্যোমভোলানাথ হয়ে মুখে ছিপি এঁটে রোজ হাঁটি। সে থাকে আমার পাশে। তবে সত্যি বলতে কি, আমার জীবনের সব আনন্দময় সময়ের- মধ্যে সে সময়টা ছিল সবার আগে।
তাছাড়া যতক্ষণ দুলাভাইয়ের সাথে দাবা খেলি- ততক্ষণ চা-বিস্কিট, মিষ্টি ডিমভাজা- কতকিছুই না নিয়ে আসে সে। লজ্জারক্ত সে পরিবেশন দেখে আমার মনে হত ডিমভাজা নয়, আমার প্লেটে বুঝি তার হৃদয়টাই..., মিষ্টি নয়, ও বুঝি তার মমতার পরশ। বুঝতেই পারছেন, চিঠি হয়ত দিতে পারিনি... কিন্তু চিঠি দিতে চাওয়ার উদ্দেশ্যটা বিফলে যায়নি একেবারে। হায় তুমি যদি জানতে মেয়ে... তোমার নাম যতবার জপ করেছি,, ততবার ঈশ্বরের নাম নিলে কত আগেই মুনি-ঋষি কিংবা আউলিয়া দরবেশ হয়ে যেতাম।
আপনারা নিশ্চয়ই গাধা দেখেছেন। অত্যন্ত উপকারী প্রাণী। গাধার কয়েকটি ট্রেডমার্ক বৈশিষ্ট্য আছে। একটি হল জীবটি ভারবাহী। তার পিঠে আপনি যত বোঝা চাপান, সে টু-শব্দটি না করে বয়ে নিতে থাকবে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল মুলোর পিছনে ছোটা। সাধারণভাবে গাধা কখনো দৌড়ুতে চায় না। কিন্তু নাকের সামনে একটা মুলো ঝুলিয়ে দেন- ব্যাস হয়ে গেল। পড়িমরি করে মুলো ধরার জন্য ছুটতে থাকবে। আর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল পানি ঘোলা করে খাওয়া। যে পানিটা সহজেই গলধকরণ করা যেত সেটা ঘোলা না করে গাধা খেতে পারেনা। জানি অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন এগুলো তো আমরা জানিই- গল্প বলার থাকলে গল্প বল, খামাখা ঐ নিরীহ চতুষ্পদটিকে নিয়ে টানাটানি কেন? টানাটানির একটা কারণ আছে- হিসেব নিকেশ করে দেখেছি এর তিনটি বৈশিষ্ট্যই আমার মধ্যে আছে। আর এ গল্পের পরিণতির জন্য এই বৈশিষ্ট্যগুলোই দায়ী।
তো যেখানে শেষ করেছিলাম- প্রতিদিন তাদের বাড়িতে দাবা খেলতে যাই। পথে বোবা সঙ্গী হিসেবে তার সাহচর্য পাই- বাসায় অনাবিল আদরযত্ন। আমার প্রায়ই মনে হত বাসায় সে একটা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে- আমার ব্যাপারে। মনে হত এখন শুধু একবার বললেই হয়- আর বলাটাও আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু আমার সেই গল্পের মত মনে হত - ঘেউ ঘেউ করা কুকুর কামড়ায় না সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু কুকুরটা জানে তো। সুতরাং না, বলা হল না। চিঠি দেওয়াও হল না। ইতিমধ্যে ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। ছুটির লম্বা সময়টা রাজধানীতে বোনের বাসায় বেড়ানোর উদ্দেশ্যে চলে গেল। আমি থেকে গেলাম পড়াশুনা আর তার স্মৃতি বুকে নিয়ে। সে ছাড়া আর কোন মেয়ে ভাল লাগেনা। সুতরাং ঐ অধ্যায় ক্লোজ।
সে ফিরে এলো দুই মাস পর। কেমন যেন রহস্যময় আচরণ। মনে হচ্ছে সেই আগের মেয়েটি আর নেই। অনেক পরে জেনেছিলাম তার কারণ। যেদিন সত্যি সত্যি একটা ঢোক গিলে হলেও তাকে বলার সাহস অর্জন করে ফেলেছি, সে ততদিনে অন্য একজনের সাথে মিতালী পাতিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর সব প্রেমিক তো আর আমার মত কাপুরুষ না। আমার মত প্রায় স্মার্টও না, তারা সত্যিকারের স্মার্ট। এ সংক্ষিপ্ত গল্পের মধ্যে অনেক ডিটেইলসের কাজ আছে। কিন্তু এটা তো গল্প না। হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ইতিহাস। তাই সেই ডিটেইলস থেকে বিরত রইলাম। "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।" (এতক্ষণ ধরে কি করলাম তবে?) শুধু প্রথমবার ক্যাচ মিসের মতই শেষ পর্যন্ত জেতা ম্যাচটা হাতছাড়া করে ফেললাম। আর তার চাইতেও বড় কষ্ট হল তার প্রেমিকটি ছিল আমারই এক ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।
তবে আমার বন্ধুর সাথেও তার সম্পর্কটি টেকেনি। একদিন তার এক ফুপাতো ভাইয়ের মাধ্যমে যে আমার ক্রিকেট টিমের সদস্য ছিল বলে আমার এক এক গ্রেট ফ্যান- আমার কাছে প্রস্তাব দিল 'সে' আমার সংগে কথা বলতে চায়। পরবর্তীকালে আমার এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম- অনেক অপমানের পরেও যখন তার প্রেমিকা তাকে উল্টো প্রেমের প্রস্তাব দিল তখন সে সংগে সংগে প্রস্তাবটি খপ করে লুফে নেয়। পরে তারা এক বিখ্যাত জুটি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু তখন কাঁচা বয়স- প্রেমের মত অভিমানটিও ছিল খুব তীব্র। কাজেই আমার বন্ধুর মত আমি প্রস্তাবটা লুফে নিতে পারিনি বা নেইনি।
অতএব যা হবার তাই হল। আর একটি অমর প্রেমকাহিনীর হয়তো সলিল না হোক সাবলীল সমাধিই হয়ে গেল। এ গল্পের যা কিছু বাদ পড়ে গেছে- তা বাদই থাক। সব কিছু যে মনে আছে তা ও তো নয়। শুরুতেই তো বলেছি-
স্মৃতি ছাড়া আর নোটবুক নাই
কিছু মনে রাখি, কিছু ভুলে যাই।
তবে পাঠকদের জন্য গল্পের ছোট্ট একটা পাদটীকা দিচ্ছি। পাদটীকার উৎস এক বৌদির অনুসন্ধিৎসা। আমার এই কাহিনী শুনে তিনি যে প্রশ্নটি করলেন সেটার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। বৌদি হুটহাট বিবিধ প্রশ্ন করে বসে প্রায়শই বিব্রত করে ফেলতেন। তিনি কড়া ফেমিনিষ্ট। একবার পাঠক না বলে পাঠিকা কেন বলা হবে না সে প্রশ্ন করে আমাকে একেবারে বেড়াছেড়া করে ফেলেছিলেন। তবে এবারে তেমন কিছু না - আমি গল্পে বলেছি, 'সবাই প্রেমে পড়ে, আমি পড়েছি প্রেমের ফাঁকে।' তার সরল প্রশ্ন, প্রেমে পড়া আর প্রেমের ফাঁকে পড়ায় তফাৎ কি? ভাবুন দেখি, 'প্রেমে ফাঁকের কোন অভাব আছে কিন্তু কিভাবে বোঝাই?' অনেক ভেবেচিন্তে বললাম-
আহা বৌদি লেখার মধ্যেই তো বলেছি-
এ বড় কঠিন ফাঁক- যে না পড়েছে সে কখনো বুঝবে না- কি যাতনা বিষে...।
তবু যদি বুঝতে চান, একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি। ধরুন আপনার কোন পরকীয়া প্রেমিক থাকে আপনাদের পাশের বিল্ডিং-এ। প্রতিদিন জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে হালকা রঙ্গ রসিকতার উপর চলছে। সিগন্যাল গ্রিন দেখে দুজনেই আর একটু এগোতে চাইলেন। দুই বিল্ডিং-এর মধ্যে যদি আঁকশি দূরত্ব থাকে তাহলে মোটামুটি চণ্ডিদাসের মাছ ধরার ছিপটি দিয়েই কাজ হয়ে যায়। ফাঁক কম থাকলে তো আরো সুবিধা- একটু কসরত করে হাত বাড়িয়েই..। (আরো বেশী ফাঁকের ব্যাপারটা এখানে প্রযোজ্য নয়) যাই হোক একদিন দাদার অনুপস্থিতিতে আমার মত পত্রসাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হলেন। মোটামুটি জিনিসটা হাতের নাগালে এসে যাচ্ছে যাচ্ছে- আর একটু হলেই হয়ে যায় আর কি...... এমন সময় দাদার গলাখাকারী (মিনসের কাজ কাম নেই নাকি.. অসময়ে অফিস থেকে ফেরা) তড়িঘড়ি করতে গিয়ে চিঠিটা গেল নীচে আর আপনি? গরম মেজাজটাকে ঠাণ্ডা লাচ্চির মত মোলায়েম করে (অস্কার কর্তৃপক্ষ দেখতে পেলে-পুরস্কার ঠেকানো যেতনা) বললেন, হ্যাঁ গো। এই গরমে ঘেমে-টেমে কোত্থেকে এলে গো।
তো চিঠিটা এবং আপনি দুজনেই একটা প্রেমের ফাঁকে পড়ে গেলেন। আর ওপাশে যিনি এখনো বোঝেননি- ঘটনাটা কি? উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছেন.. তিনি তো মহাফাঁকে.....
এরপরও যদি না বোঝেন, তাইলে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ কইরেন- বুঝাইয়া দিমুনে.....
বউদি এরপর শুধু একবার- চুপ চুপ বলেই চুপ হয়ে গেলেন। মৌনতা... না তা ভাবছি না। তবে এমন বেহায়া দেবরের সাথে বেশী কথা বলা যে নিরাপদ নয় তিনি সমঝে গেছেন। কিন্তু আমি ভাবছি তিনি তো ছাড়বার পাত্রী নন। আবার কবে যে পাঠক পাঠিকার মত আর একটা বিষয় বের করে ক্যাঁক করে চেপে ধরবেন ঘাড়... বড্ড ভয়ে ভয়ে আছি।