সেদিন ছিল নববর্ষ। তোমাদের কলেজে এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল। তোমরা বান্ধবীরা মিলে একটি স্টল দিয়েছিলে। সাদা-লাল তাত পাড়ের শাড়ি তুমি পড়েছিলে। সুন্দর দেখ ছিল তোমায়। আগত লোকজনদের তুমি উল্কি একে দিচ্ছিলে । আমি ছবি তুলচ্ছিলাম। তোমাকে দেখছিলাম। এক ফাঁকে তোমাকে বলেছিলাম- একটু সময় হবে। কিছু বলার ছিল! তুমি এসেছিলে। দুজন কলেজের পুকুরের সিঁড়িতে বসেছিলাম।
তুমিই প্রথম বলা শুরু করলে, পহেলা বৈশাখের ইতিহাস তুমি জানো তো! বলালাম- না। কেন, তুমি না সাংবাদিক? তুমি জানোনা! বলছি শোন "কৃষকদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতে গিয়ে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তখনকার সময়ে এই কাজটি সম্পাদন করার দায়িত্ব পান সম্রাট আকবরের অন্যতম আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট সাহিত্য ও জ্যোতির্বিদ। ফসল ঘরে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়ে এই বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। যা বর্তমানে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বললাম- এতদিন পর তোমার সাথে আমার দেখা । কোথায় ভালবাসার কথা বলবে, তা না, "ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইতে শুরু করলে"। আমার কথা, তুমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললে,- বছরের প্রথম দিনে ভালবাসার কোন কথা নয়। শুধু দেশের কথা, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের কথা বল।
বিরক্ত হয়ে বললাম, "কিসের মাঝে কি পান্তা ভাতে ঘি"!
উত্তরে বললে,- কে বলেছে তুমি জানো না! এই যে, পান্তা ভাতের কথা বললে! জানো, তারও একটা ইতিহাস আছে। নিরুপায় হয়ে বললাম,- কি রকম? তুমি বললে- পুকুরের সিঁড়িতে বসবেনা। বললাম কোথায় যাবে? বললে- তুমি না আমাকে ভালবাসা। যদি বলি, নরকে যাব, তুমি যেতে পারবেনা! বোকার মতো বললাম- তাতো পারতেই হবে। পড়েছি মোঘলের হাতে, ভাতের বদলে আজ ঘাস খেতে হবে আমাকে" ইয়ার্কি করছো। বললাম- মোটেই না! তুমি বললে- আমাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরবে।
আমিতো মনে মনে তাই চেয়েছিলাম! আমাকে নিয়ে ঘুরবে! দুজনে সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করব। পাশাপাশি দুজন হাঁটবো। অন্যরা আমাদেরকে দেখে ঈর্ষান্বিত হবে! তুমি তোমাদের কলেজে নববর্ষ উপলক্ষে যে সমস্ত অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে, দেখালে এবং বললে- নিজ দেশে জন্ম গ্রহণ করে, যে নিজের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য জানে না, তার চেয়ে নাকি অধম কেউ হতে পারে না। বললাম- কথাটা যেন কে বলেছিল! বললে, মনে পড়ছে না। তুমি বললে-
বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে বর্ষবরণ নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এটি পালিত হয়ে আসছে বরং আগেকার তুলনায় বর্তমানে দিনকে দিন এটির বিস্তৃতি ঘটছে।
আমি বললাম- যেমন?
উত্তরে বললে,নববর্ষের প্রথম দিনটি একেক জনের একেক রকম হয়ে থাকে।,যেমন ধর, আমার কাছে এক রকম, তোমার কাছে অন্য রকম।
তোমার কথাই ধর না, কোথায় তুমি নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে, তা না, আমার কাছে আসছো ভালবাসার গল্প করতে।
বললাম,- নববর্ষ বলে কি ভালবাসার কথা বলতে নেই?
তুমি বললে, অবশ্যই নেই।
বললাম,- কেন? বললে,- আসলে দিনকে দিন তুমি বোকা হয়ে যাচ্ছ!
আমি বললাম- প্রেমে পড়লে মানুষ যে বোকা হয়ে যায়, তুমি জানোনা!
তুমি বললে,- প্রেমে পড়েছ নাকি ! কার? কেন তোমার !
তুমি বললে,- এই তো ভুল করে বসলে। আমার প্রেমের প্রেমে পড়বে কেন তুমি ?
বললাম,- তুমি সুন্দর তাই। তুমি হেসে উঠে বললে,- আমি কি দেশের চেয়েও সুন্দর নাকি! আমার প্রেমে পড়বে হবে!
বললাম,- কি আজ, তোমার মধ্যে এত দেশ প্রেম!
তুমি বললে,- দেখ, ভালবাসার কথা বলার জন্য ভালবাসা দিবস আছে। যা কদিন আগে গত হয়েছে। কই সে সময় তো তুমি ভালবাসার কোন কথা বলনি!
শোন- আগে দেশকে ভালবাসা, দেশকে জানো, তাতে সুন্দর মানুষ হওয়া যায়! আমি বললাম,- আমি কি দেখতে কম সুন্দর! তুমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথাই বললে, অবশ্যই দেশের চেয়ে না! প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললে- আমাকে নাগরদোলা দেখাবে এবং বলতে থাকলে প্রতিবছর এই দিনে সবাই ষোল আনা বাঙালি হয়ে যায়! তার কারণ কি বলতে পার?
বললাম, তোমার কি মনে হয়?
প্রশ্নের জবাবে বললে,- এক সময় কৃষকেরা মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসলে শুরু হতো এ উৎসব। যাকে বলা হতো নবান্নের উৎসব। বাড়ির বউ-ঝিরা মিলে ধানগুলোকে ঝাড়তেন, সিদ্ধ দিতেন, তারপর গোলায় তুলতেন। ১ মাস আগ থেকেই এর আগমন টের পাওয়া যেত। গায়ের বউ দিদিরা নতুন ধানের ভাত, পিঠা ও ক্ষীর রান্না করতেন। তাদের চোখে মুখে দেখা যেতো তৃপ্তির হাসি। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ একে আরো দ্বিগুণ করে তুলতো।
তোমাদের কলেজ থেকে আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলে নাগরদোলায় চড়াবে বলে। দুজন রিক্সায় পাশাপাশি বসেছিলাম। রিক্সায় চালককে বললে,-ছেলেদের কলেজ মাঠে নিয়ে যেতে। সেখানে নাগরদোলাসহ হারিয়ে যেতে বসা সকল অনুষ্ঠানেরই আয়োজন করা হয়েছে!
রিক্সা এগিয়ে চলছিল, কলেজ মাঠের দিকে, কিন্তু তুমি কথা থামালেনা। বলতেই থাকলে,- বৈশাখের প্রথম দিন শুরু হতো দোল পূজা। পহেলা বৈশাখ আসার দু-একদিন আগে থেকেই ঢাকের বাজনায় মুখরিত হতো গ্রামগুলো। নববর্ষের দিন দোল পূজা হওয়ায় ছেলে-বউরা ভোর সকালে পুকুরে স্নান করতে যেতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই দিনটিকে পবিত্র দিন মনে করতেন। এখনো অনেকে করেন। স্নান শেষে একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। মেলা বসত গ্রামগুলোতে। মেলার জন্য অপেক্ষা করতেন সবাই। মেলায় নানান জাতের খেলনা, গহনা, শাড়ি, বাসন-কোসন, এমনকি আসবাবপত্র পাওয়া যেত। নাগরদোলা পালা, যাত্রাগানও_হতো।
দেশের বিভিন্নস্থান থেকে নানারকম জিনিস নিয়ে মেলাতে হাজির হতো দোকানিরা। সাজাতো নানা রকম পসরা। বছরে একবার মেলা হতো বলে গ্রামের বউ-ঝিরা মাটির ব্যাংক অথবা ঘরে খুঁটি দেয়া বাঁশের মধ্যে ছোট গর্ত করে টাকা পয়সা জমাতেন। যাতে মেলা থেকে তারা শাড়ি, গহনাসহ বিভিন্ন পণ্য কিনতে পারেন।
পহেলা বৈশাখ নববর্ষ মানেই বাধ ভাঙ্গা উল্লাস আর নাকি নতুন কাপড় পড়ার ধুম তুমি বললে। হালখাতার সাদা-লাল রং এখন নাকি বৈশাখের রং হয়ে গেছে । সাদা-লালের সঙ্গে নারী পুরুষ সকলে নাকি মিশে যায়। নারীরা পরে সাদা-লাল তাতপাড়ের শাড়ি। ছেলেরাও পরে পাঞ্জাবি।
শুধু আমিই নাকি ব্যতিক্রম!
নববর্ষের দিনেও শার্ট, প্যান্ট ও সুট-বুট পড়ে তোমার কাছে গেছি! অথচ এই দিনে শার্ট-প্যান্ট, সু্যট বুট ছেড়ে, শাড়ি, ব্লাউজ আর পায়জামা পাঞ্জাবিতে একদিনের জন্য হলেও যেখানে লোকজন হয়ে উঠে বাঙালি।
সেখানে কেবল, আমিই নাকি অবাঙালি রয়ে গেলাম!
নববর্ষের দিনে মেয়েরা মাথার খোলা বেণীতে ফুল দেয়। তোমার দিকে তাকাতে বললে। তুমি চুলের খোপায় ফুল দিয়েছিলে! গেন্ডা ফুল। এতে করে তুমি নাকি ষোলআনা বাঙালি মেয়ে হয়ে গেছ ! বললাম- তাতো,- একদিনের জন্য।
লাভ কি হল? বললে- আবারও লাভের কথা! আমি প্রসঙ্গ, অন্য দিকে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু কোনভাবেই তুমি শুনছিলেনা। বাধ্য হয়ে তোমার কথাই শুনতে হল আমাকে। ইতোমধ্যে রিক্সাটি কলেজ মাঠে এসে গেছে।
চালক বলল,- আপা, এসে গেছি। ভাড়া দিয়ে চালক কে বিদায় করলে তুমি!
মেলা প্রাঙ্গণে হাটতে হাটতে বলতে থাকলে,- শুধু সাজগোজই নয়, তার পাশাপাশি দেশীয় বাংলা খাবারের আয়োজন করা হয় বর্তমান সময়ে। একদিনের জন্য হলেও মানুষ ফিরে যায় পুরনো পান্তা ইলিশের কাছে। পান্তা আর ইলিশ না হলে যেন নববর্ষ জমেই উঠেনা।
তুমি পান্তা- ইলিশ খেয়েছ?
উত্তরে বললাম- আমি এসব খাইনা!
তুমি আমাকে পান্তা আর ইলিশ খাওয়াবে বলে জোর করে একটা স্টলে নিয়ে গেলে।
বললাম,- এই ভর দুপুরে পান্তা ইলিশ! তুমি খাও! আমি খাবনা!
তুমি বায়না ধরলে,- আমি না খেলে নাকি তুমিও খাবেনা!
তোমাকে ভালবাসতে পারি, অথচ পান্তা খেতে পারিনা, এটা কেমন ভালবাসা! তুমি জেদ ধরলে! তোমার মন রাখতে সেদিন পান্তা-আর ইলিশ খেয়েছিলাম। পান্তা ইলিশের দাম প্লেট প্রতি ৮০ টাকা। দাম দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম আসল ইলিশ নয়!
সেদিন পান্তা আর ইলিশ খেতে খেতে বলছিলে, পহেলা বৈশাখ নাকি তারুণ্যের এক মহামিলন। পাশাপাশি হাঁটা আর 'এসো হে বৈশাখ এসো, বলে বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানানো_ সব মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্যের সূচনা হয় ।
পাশাপাশি দুজন হাঁটছিলাম। তখন পচা পান্তা ভাত এবং নকল ইলিশ খেয়ে, আমার যে কি হাল, সেদিন তুমি কিছুই টের পাওনি! কিছুক্ষণ পরপর বমির ভাব হচ্ছিল আমার। আমাকে তোমার গাল দেখিয়ে বললে, সবার মতো তুমিও নববর্ষের উল্কি এঁকেছ । এই উল্কি ছাড়া নাকি তারুণ্যের উচ্ছলতা প্রকাশই পায়না।
ভালবাসার কথা না বলে, তুমি ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলছিলে।
তাই বললাম- নাগরদোলায় চড়ানোর কথা বলে, পান্তা-ইলিশ খাওয়ালে! মেনে নিলাম।
নাগরদোলার দিকে আমাকে নিয়ে গেলে তুমি। মনে হল, ভয়ে কাঁপছি আমি। কিন্তু কেন? আগে কোন দিন চড়িনি বলে! হয়তো তাই!
তোমাকে বললাম- আমার ভয় করছে!
তুমি বললে- ভীতুর ডিম, ভয় কিসের!
যদি পড়ে যাই!
পড়বেনা,
তোমাকে আঁকড়ে ধরবো আমি!
দুজন নাগরদোলায় উঠেছি। খুব ভয় করছিল। এমনিতে ভরদুপুরে পান্ত-ইলিশ খেয়ে বমির ভাব হচ্ছিল। তার পর আকাশে উল্টো ঘুরা।
বললাম- আমার মাথা ঘুরচ্ছে! আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে তুমি!
এই দৃশ্য আমার খুব ভাল লেগেছিল। বমির ভাব মুহূর্তের জন্য কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল!
তুমি আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসা বলেই জড়িয়ে ধরেছিলে, নাকি ভিতু বলে। তা নিয়ে অবশ্য এখনও সংশয়ে আছি।
তুমি বলছিলে নববর্ষে মানুষের ঢল নামবে এটাই স্বাভাবিক। নামার পর হয়তো দেখব, অন্য দৃশ্য।
আমি বললাম- কি রকম?
তুমি বললে,- নববর্ষ সবার জন্য আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে। এ থেকে এক শ্রেণীর টিনেজরাও বাদ যায়না। দেখবে, তাদের যারা এখানে এসেছে, তাদের বেশির ভাগই ইতিহাস ঐতিহ্য জানার জন্য আসেনি।
বললাম- কি জন্য আসে?
বললে,- তারা মেয়েদের ধাক্কা দিবে! তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে বলে!
বছরের প্রথম দিনেই তাদের উৎপাত সইতে হবে অসহায় মেয়েদেরকে!
নাগরদোলা থেকে দুজন নেমে গেলাম। আমাকে নিয়ে গেলে, ছোটদের খেলনার দোকানে।
বললাম, পুতুল কিনবে নাকি! হাসতে হাসতে বললে, সত্যি তুমি বোকা ! পুতুল খেলার বয়স কি এখনও আমার আছে! তা নেই। তাহলে এখানে আসলে কেন? তোমাকে দেখাতে।
সত্যি কথা বলতে কি জানো?
কি?
তুমি বললে-আমরা এখনও পারিনি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ও বাংলা সনের প্রবর্তন করতে। রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমরা বাংলা সনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। তুমি এবার যেতে চাইলে!
আমি বললাম- আমাকে আর কিছু দেখাবেন!
তুমি বললে- কি!
নববর্ষ উপলক্ষে শহরে আর কি কি হয়, আমি কি জানি! সবই তো তুমি জানো!
উত্তরে বললে, ইয়ার্কি করা হচ্ছে?
বললাম- ভালবাসার মানুষের সাথে কি ইয়ার্কি করা যায়!
তুমি বললে- নববর্ষ উপলক্ষে যা কিছুর আয়োজন করা হয়েছে তার সবই দেখা হয়ে গেছে! তবে যাত্রা ও পালাগান ছাড়া!
বললে,- তা আগামীতে দেখাবে।
আমাকে এবং আগামী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বললে- প্রত্যেকের উচিত তার দেশকে জানা, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানা। বিশেষ করে একদিনের জন্য হলেও প্রত্যেককে নিজের নিজের শেকড়ে ফিরে যাওয়া উচিত।
তুমি চলে যেতে চাইলে।
বললাম- ভালবাসা কিছু কথা বলে যাও!
তুমি বললে- আমি নাকি দেশপ্রেমিক নই। দেশের প্রতি মায়া, মমতা, প্রেম সবকিছু হারিয়ে গেছে! যেদিন দেশপ্রেমিক হতে পারবো সেদিন আবার তুমি আসবে। কোন দিনও ফিরে যাবেনা।