প্রথমা

প্রিয়ার চাহনি (মে ২০১২)

Md. Mostafizur Rahman
  • ২৫
  • ৪৫
সিলভি টাওয়ারের মালিকের আঠার তলার রুম থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন সনৎ মাষ্টার । এলাকার সমস্যা এবং গ্রামবাসীদের দাবিদাওয়া গুলো তিনি এমপি সাহেবের কাছে বেশ সূচারুভাবেই উপস্থাপন করেছেন । রাস্তা, ব্রীজের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনে করিয়ে দেবার পাশাপাশি তিনি ক্লাব ঘরের জন্য একটি নতুন রঙ্গিন টেলিভিশনের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেছেন । হানিফ সাহেব তাদের এলাকার এমপি এবং দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি । বেশ কয়েকটি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক, এক নামেই সবাই চেনে । হানিফ গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর সন্মানিত চেয়ারম্যান তিনি ।
দান দক্ষিনাতে তুলনাহীন । তার গ্রামের বাড়ির আশপাশে দশ গ্রামের যত মসজিদ, মন্দির আছে সব কিছু ইতিমধ্যে পাকা তো হয়েছেই, কোন কোনটি আবার দোতলা ও হয়েছে, যদিও শুক্রবার ছাড়া পুরো সপ্তাহ মসজিদ ফাঁকাই পড়ে থাকে মুসল্লির অভাবে ।
হানিফ সাহেব তার সুসজ্জিত অফিস কক্ষে বসে আছেন । এই রুমে ঢুকতে গেলে যেকোনো দর্শনার্থীকেই কমন রিশিপসনে বসতে হয় । কাউকে দশ মিনিট, কেউ আবার সারাদিন বসেও তার দেখা পান না কারণ স্যারের ব্যবহারের জন্য আলাদা একটা লিফট আছে যেটা সরাসরি আঠারো তলায় স্যারের রুমেই থামে । কমন রিশিপসনের সুন্দরী মেয়েটির কাছ থেকে অনুমতি মিললে পঞ্চাশ ষাট ফুটের একটা করিডোর পার হয়ে যেতে হয় মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেবের আকর্ষণীয় রকমের সুন্দরী পার্সোনাল অফিসারের কক্ষে । ভিতরে যদি স্যার ব্যস্ত না থাকেন তবে পাঁচ/দশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না এখানে অবশ্য ।
একবার এক সুন্দরী পার্সোনাল অফিসার চাকুরী ছেড়ে চলে গেলে নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় দেশের প্রথম সারির প্রায় সবকটি দৈনিক পত্রিকায় । বলে রাখা ভাল আবেদনের প্রথম শর্তই হল সুন্দরী, আকর্ষণীয় দৈহিক গড়নের অধিকারিণী হতে হবে এবং অবশ্যই পুরুষ প্রার্থীরা আবেদনের যোগ্য হবেন না ।
মৌখিক পরীক্ষার দিন । মনে হচ্ছিল যেন পঞ্চাশটা পরী কে ডানা কেটে অফিসের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ।
অফিসের সবাই এতদিনে বুঝে গেছে যে চেয়ারম্যান স্যার তার একজন একান্ত সঙ্গিনী নিয়োগ দিচ্ছেন, পার্সোনাল অফিসার নয় । এটা নিয়ে মাঝে মাঝে অফিসে আলোচনা সমালোচনা, কোলাহল যে একেবারে হত না তা নয় । একদিনের ঘটনা । চেয়ারম্যান স্যার তার বিশ্রাম কক্ষে বিশ্রামে ব্যস্ত, সাথে যথারীতি পার্সোনাল অফিসার । হঠাৎ চেয়ারম্যান স্যারের স্ত্রী এসে হাজির । কোন বাধাই তিনি মানেননি তার স্বামীর কক্ষে যেতে । যা হবার তাই হল । অফিসের সবার গোপন গল্পের খোরাক হল কিছুদিনের জন্য ।

এত সুখ-শান্তি, স্বপ্নের মত যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা, তারপরও মাঝে মাঝে মনটা কেমন যেন উদাসী হয়ে যায় হানিফ সাহেবের । মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় বাপজানের সাথে দিনে পঞ্চাশ টাকা মজুরীতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ইটভাটায় কাজ করার কথা । সারাদিন কাঁদা আর বালি দিয়ে কাজ করে হাত যেত ক্ষয় হয়ে । কাজ শেষে বাড়ীতে ফিরলে মা পরম আদরে হলুদের গুঁড়া পানি দিয়ে মেখে ক্ষতে লাগিয়ে দিতেন । অসহ্য যন্ত্রণা হত, যতটা তার এর চেয়ে ঢের বেশি তার মায়ের । বাড়ি জেলা সদরের কাছাকাছি হওয়াতে বাপজানের সাথে চলে যেত সদরের বাজারে, দুজনের সারাদিনের আয় ওই একশ টাকা নিয়ে । বাপজান মাঝে মাঝে বাজার সদাই এবং খেয়া পার হবার চার আনা পয়সা হাতে দিয়ে তাকে আগে আগে বাড়ি ফিরে যেতে বলত ।
এক রাতের ঘটনা । হাতে বাজারের ব্যাগ । তাতে দুই সের চাল, আধা সের নুন, এক ভাগা গুঁড়া চিংড়ি, মিষ্টি কুমড়া আর সাথে একটা পানি কচু । বাপজান আজও তাকে বলেছে আগে আগে বাড়ি ফিরে যেতে । জেলা শহরের রাস্তায় টিম টিম করে জ্বলছে নতুন লাগানো ইলেকট্রিক বাতি । মাঝে মাঝে দু-একটি স্থানে আবার বাতি ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে একটা অদ্ভুত আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । কারেন্টের থামের নীচ দিয়ে যাবার সময় বিস্ময় নিয়ে বাতির দিকে তাকিয়ে প্রায়ই সে ভাবে কেরোসিন তেল ছাড়া এই বাতি কেমনে জ্বলে ? হঠাৎ করে রাস্তার পাশের একটি বাড়ির দুই পাটের জানালার উপরের খোলা অংশ দিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত সাদা আলোর নাচন দেখতে পায় সে । কৌতূহলবশতঃ রাস্তা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে ভিতরে কি হচ্ছে । কিন্তু জানালার নীচের পাট বন্ধ থাকায় জানালা বেয়ে উঠার চেষ্টা করে, অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে ছোট একটি বাক্সের মধ্যে ছোট ছোট মানুষ গান গেয়ে নাচছে আর এক মহিলা তার দুই সন্তানকে নিয়ে খাটের উপর শুয়ে দেখছে । মুগ্ধ হয়ে সেও এটা দেখতে লাগল কিন্তু হঠাৎ বেখেয়ালে হাত ফসকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল । কষ্ট করে যদিও সে পড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পেল কিন্তু তাতে একটা খটমট শব্দ হল, ইতিমধ্যে মহিলাটি ও তাকে জানালায় দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল । সে সাথে সাথে বাজার সদাই নিয়ে দিল ভোঁ দৌড় । ভাগ্য খারাপই বলতে হবে, গিয়ে পড়লো একেবারে ড্রেনের মধ্যে । পায়ে ব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরল সে ।

এই ঘটনার অনেক পরের ঘটনা । স্থানীয় শহীদ স্মৃতি ক্লাবে কিছু অনুদানের দ্রব্য এসেছে সরকার থেকে । এর মধ্যে ছিল ফুটবল, দাবা, ক্যারম বোর্ডসহ বিভিন্ন খেলাধুলার উপকরন । বিনোদনের আরো বিস্ময়কর বস্তুও ছিল । সবার সাথে সে ক্লাব ঘরের সামনের রাস্তায় প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাত আটটার খবরের পর বাংলা সিনেমা দেখতে যেত । দুই চার গ্রাম দূর হতেও দলে দলে মানুষ আসত সেই সিনেমা দেখতে । এত দূর পর্যন্ত দর্শক বসতো যে টিভিতে কি হচ্ছে তা বুঝা যেত না ভাল করে । তবে সিনেমা শুরু হলে পিনপতন নীরবতা নেমে আসত সবার মধ্যে । তখন কেউ একটা কাশি দিলেও অন্য সবাই বিরক্ত হয়ে উঠত ।
সেই ক্লাব ঘরের সামনের রাস্তার শতাধিক মানুষকে লুকিয়ে প্রথম প্রেমে পড়ে সে । তার প্রিয়া ! প্রথম ভালবাসা ! অন্যসময় কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখলেও সেই সিনেমা দেখার মোহনীয় সময়টায় সত্যিকারভাবেই তাকে দেখতে পাওয়া যেত । আবরনহীন মুখের রুপে, যাদুময় চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে থাকত হানিফ । ভুলেই যেত স্থান কাল পাত্রের বাস্তবতা । আর এত মানুষের ভীড়ে প্রিয়াও গোপনে নয় সরাসরিই হানিফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত । কখনো লজ্জা পেত হানিফ কখনো নিজেও আবিষ্ট হয়ে চোখে চোখ রাখত । এ কথা দুনিয়ার কেউই জানতনা ।
এক দুর্নিবার আকর্ষণ হানিফকে সারা মাস তাড়িয়ে ফিরত । অপেক্ষা করত সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণের । সারাদিন মজুরী খেটে অন্যদিন আর সম্ভাবনা থাকত না প্রিয়ার সাথে দেখা হওয়ার । অন্যসময় তার দেখা পাওয়ার সামান্য নিশ্চয়তা থাকলেও সে অবশ্যই ছুটে যেত সেখানে ।
কতবার দেরি করে যাওয়াতে প্রিয়াকে কাছ থেকে দেখতে না পেরে বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরেছে সে । জীবনটাকে তখন অর্থহীন মনে হয়েছে তার । আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে সামনের মাসের শেষ বৃহস্পতিবার সবার আগে সে ওখানে যাবে ।

এরপর অনেক সময় পার হয়েছে । মজুরদের সর্দার হয়ে কাজ না করে, অন্য সবাইকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে বেশি মজুরী নিজের পকেটে ঢোকাবার বিদ্যেটা সে শিখেছিল । তারপর ক্রমান্বয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা, মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং এলাকার এমপির ক্যাডার হয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে সে ।
রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি করে টাকা পয়সাও কামিয়েছে বিস্তর । ততদিনে সে জেনে গেছে চাইলে কিছু পাওয়া যায় না, কেড়ে নিতে হয় । সুযোগমত তার নিজের নেতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে একটুও চিন্তা করতে হয়নি তাকে । তারপর রাজনৈতিক দলের রীতি অনুযায়ী দলীয় মনোনয়ন পেয়ে উপনির্বাচনে এমপিও হয়ে গেছে তার নিজের এলাকার ।
“ এখন তো ঘরে ঘরেই রঙ্গিন টেলিভিশন, ক্লাবে আর দেখতে আসেনা কেউ । তবু বাংলাদেশের খেলা হলে ছেলেরা সবাই একসাথে ক্লাবে বসে হই-হুল্লোড় করে খেলা দেখতেই পছন্দ করে । তাই আগের সাদাকালো টিভিটা বদলে নতুন একটা একুশ ইঞ্চির রঙ্গিন টিভি যদি দেয়া যেতো...... “ সনৎ মাষ্টার কথা শেষ না করেই আগ্রহে হানিফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ।
আজ সাতান্ন ইঞ্চির এলসিডি টিভি হানিফ সাহেবের চেম্বারে, বাসায় । কিন্তু ক্লাবঘরের সেই চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন যে ছিল তার প্রথম প্রিয়া, যার আকর্ষণে সে ছুটে যেত, অপেক্ষা করত কখন তালা দেয়া বাক্সের কালো পর্দা খুলে দেখা দিবে, সেই প্রিয়ার মত কোন কিছুই এখন তাকে আর কেন যেন আনন্দ দেয়না ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমাদ মুকুল আমার কিন্তু খুব ভাল লেগেছে। শুরুর দিকের গল্পে বুনটের একটু সমস্যা থাকতেই পারে। সহসাই কেটে যাবে।
বিষণ্ন সুমন বেশ সাবলীল বর্ণনার গল্প । কাহিনিও বাস্তব ধর্মী । তবে শেষের দিকে বোধকরি একটু তারাহুরা করা হয়েছে । ভালো লাগছে অনেকদিন পর মুস্তাফিজের লিখা পড়তে পেরেছি বলে । নিয়মিত হবার অনুরোধ রইলো ।
রোদের ছায়া কিন্তু ক্লাবঘরের সেই চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন যে ছিল তার প্রথম প্রিয়া,..........এই প্রিয়ার চাহনি কেমন সেটা একটা রহস্যই রয়ে গেল , গল্পটি ভালো লাগলো ভাই .....শুভকামনা থাকলো..
আহমেদ সাবের গরীব থেকে ধনী হবার একটা গল্প। সত্য কথা - টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় না। সুন্দর গল্প। তবে লেখার গাঁথুনি আরও শক্ত হতে হবে।
মৃন্ময় মিজান বেশ সুন্দর গল্প। আরেকটু এগুতে পারত।
মিলন বনিক ভালই তো শুরু করেছিলেন..একটা ধারাবাহিকতা ছিল..আরো সময় নিয়ে আপনার গল্পের হাতটাকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন..আপনার হাতে সেই জাদু আছে..শুভ কামনা থাকলো....
মোঃ আক্তারুজ্জামান ভালো লিখেছেন| আর দু একটা লিখলেই চিন্তা শক্তিরা আকাশে মুক্ত ডানা মেলে উড়বে| তখন আমরা আর মাস্টারি করার সুযোগও পাব না| লেখাটা চলতে থাকুক সবসময়|
M.A.HALIM শুরুটা চমৎকার মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। অত তাড়াতাড়ি ইতি হবে বুঝেতে পারিনি। শুভ কামনা বন্ধুর জন্য।
মামুন ম. আজিজ শেষে এসে পাঠক হয়তো কিছূটা হতাশ হবে...ভালই জাল বুনছিলে ..জাল ক্লোজ হলোনা

০২ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪