পতন

শুন্যতা (অক্টোবর ২০১৩)

এশরার লতিফ
মোট ভোট ৭৩ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৭.১৭
  • ৩৭
  • ১১৭
হাই স্পিড লিফ্‌ট্‌। আটাশ তলা থেকে নীচে নামছে। সাথে আমিও।

এই লিফ্‌ট্‌ শুধু জোড় সংখ্যায় থামবে, ৩০, ২৮, ২৬, ২৪…………৬,৪,২। অন্য যে লিফ্‌ট্‌টি বেজোড় সংখ্যায় থামে তার মেইনটেন্যান্স চলছে।

মোকাম্মেল হকের অফিস উনত্রিশ তলায়। ফেরার সময় লিফ্‌ট্‌ ধরার জন্য এক ফ্লোর সিঁড়ি ভাঙতে হলো।

সচরাচর এসব কাজে এলে আমি সিঁড়ি ব্যবহার করি না। ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে ভয় হয়। যদি কেউ কেড়ে নেয়? তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দ্যায়?

মোকাম্মেল হক তো নিজেই লোক ফিট করতে পারে। এই যে একটা লিফ্‌ট্‌ বিকল কে জানে হয়তো মোকাম্মেলের কারসাজি।

টাকা একবার নিয়ে গেলে আর কিছুই করার নেই। শবে বরাতের রাতে ঘর থেকে বত্রিশ লাখ টাকা উধাও হলো। থানায় জিডি করতে গিয়েও করিনি। প্রথমেই জিগেস করবে আমার কাজ কী, বেতন কত। তারপর জানতে চাইবে একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হয়ে এত টাকা কোথায় পেলাম। উত্তরটা ওরা জানে কিন্ত আমি কি সেই উত্তর দেব? কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো সাংবাদিক। একবার খবর পেলে ব্ল্যাকমেইল করে ফানা ফানা করে দেবে।

লিফ্‌ট্‌টা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে উঠেলাম।

একটা চেনা পারফিউমের মৃদু সুঘ্রাণ বেশ অনেকক্ষণ ধরে স্মৃতির দরোজায় কড়া নাড়ছে। পাশ ফিরে তাকাতেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত ইতিহাস যেন লিফটে দাঁড়িয়ে আছে।

সুরাইয়া।

কতদিন সুরাইয়াকে খুঁজেছি। নিউমার্কেটে, বইমেলায়, পার্কে, বাসে, ট্রেনে, রিক্সায়। পাইনি। বাবা-মা প্রবাসী। আত্মীয়স্বজন অজ্ঞাত কারনে মুখে কুলুপ আঁটা। না পেয়ে পেয়ে ভেবেছি ও হয়তো টাকাওয়ালা কাউকে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেছে। কে জানে হয়তো আসলেই গ্যাছে, হয়তো বেড়াতে এসেছে।

অথচ সুরাইয়া একদিন আমার ছিল। ‘পারি দিতে নদী হাল ভাঙ্গে যদি ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি’- সেই রকমের আমার।

ক্র্যাঙ্ক… ধাতব শব্দ করে লিফ্‌ট্‌টা হঠাৎ থেমে গ্যালো। পাওয়ার কাট।

আঠারো আর উনিশ তলার মাঝামাঝি লম্বমান শূন্যতার ঘন অন্ধকারে পাঁচশ কিউবিক ফিটের লোহার ঘনকটি এই মুহূর্তে প্রায়-স্থির পেন্ডুলামের মত সামান্য দুলতে দুলতে অপ্রস্তুতভাবে ঝুলছে। ভেতরে মধ্য বয়সী এক জোড়া, না এক জোড়া নয় দু জন একক মানব-মানবী। লিফ্‌ট্‌টা যদি এই শূন্যতা থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়ে?

‘আজ কতদিন পরে সেই আলোকময় লোকময় পৃথিবী ছাড়িয়া এই ভয়ংকর জনশূন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে সুরবালা একাকিনী আমারই পার্শ্বে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। জন্মস্রোতে সেই নবকলিকাকে আমার কাছে আনিয়া ফেলিয়াছিল, মৃত্যুস্রোতে সেই বিকশিত পুষ্পটিকে আমারই কাছে আনিয়া ফেলিয়াছে— এখন কেবল আর-একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃন্তটুকু হইতে, খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই’।

আহা রবীন্দ্রনাথ। আমিও পড়েছি। ফেনিল আবেগে উদ্বেলিত হয়েছি। কিন্তু সুরাইয়া সুরবালা নয়, সুরাইয়া সুরাইয়া।

একদিন সুরাইয়া আমার স্ত্রী ছিল। খুব ঘটা করে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। পুরনো ঢাকা থেকে সুবরুদ্দিন বাবুর্চিকে আনা হয়েছিল। ইস্কাটন লেইডিজ ক্লাব উপচে পড়েছিল অভ্যাগতদের ভিড়ে। দুপক্ষ মিলিয়ে কম কর হলেও সাত শ অতিথি। মুরগীর রোস্ট টান পড়েছিল, শেষমেশ ক্যাফে ঝিল থেকে আলগা সাপ্লাই লেগেছে। বিয়ের হট্টগোলে ভরপুর হলঘরের ঠিক মাঝখানে সাজানো হয়েছিল সম্রাজ্ঞীর মুকুটের মত কারুকার্যময় বিয়ের মঞ্চ- আর সেই মঞ্চে কোহিনুর হীরের মত ঝলমল করছিল সুরাইয়া। ওর উজ্জ্বল লাবন্যপুঞ্জ ঘিরে ছিল জরির মিনা করা পেটানো কাজের রক্তাভ লাল জামদানী। হৈমন্তীর বরের মত আমিও ভাবছিলামঃ ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম'।

সেই রাত ছিল নক্ষত্রের রুপালী আলোয় অস্থির। আকশে মেঘ ছিল না মোটেও কিন্তু একটা নিম্ন চাপ ঘনীভূত হচ্ছিল ক্রমশ। ঝড় আসার ঠিক আগের একটা ঠাণ্ডা হাওয়া পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে বয়ে আনছিল বেলী ফুলের কামনাঘন মাতাল করা ঘ্রাণ। কোত্থেকে থেকে থেকে ভেসে আসছিল মৌসুমী ভৌমিকের গানঃ যদি ভালবাসা নাই থাকে, বড় একা একা লাগে, কোথায় শান্তি পাবো কোথায় গিয়ে…।

ইন দ্যাট ভেরি নাইট উই কনসুমেইটেড আওয়ার ম্যারেজ। ওর ক্রীড়াময় ব্রীড়াময় চন্দ্রনিভ দেহের বাঁক ও মোচড় কিছুই ছিল না সেদিন রূপস্পৃষ্ট-চন্দ্রাহত আমার অগোচর। তারপর কত সহস্রবার ওর ঘন চুলের গহন অরণ্যে অনবধানে হারিয়ে গেছি, ওর স্বচ্ছ চোখের অতল দীঘিতে অথই আবেগে হাবুডুবু খেয়েছি।

থিংস্‌ ফল অ্যাপার্ট, দি সেন্টার ক্যানট হোল্ড- একদিন সব কিছু ভেঙ্গে পড়ল।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে সুরাইয়ার প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ বোধ করছি। এই ফোটনকণা-বিবর্জিত পাঁচশ কিউবিক ফিটের লোহার ঘনকের ভেতর আমরা দুজন ছাড়া এখন আর কেউ নেই। ঠিক যেন ফুলশয্যার রাত। বেহুলার বাসরও কি ছিল এমন নিশ্ছিদ্র লোহার ঘরে? কী হবে একবার যদি ওকে কাছে টেনে নেই,স্পর্শ করি আমার রূপালী স্মৃতিকে?

একটা চুম্বক যেন আমাকে টানছে। ভূতে পাওয়ার মত আমিও এক পা দু পা এগোচ্ছি। সুরাইয়া কী কারনে বোধ হয় এক হাত নাড়ল একটু। চুড়ির ঝন ঝন শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেতেই মনে হলো আমার টাকার ব্যাগ, ব্যাগ কোথায়? এক লাফে পেছনে গিয়ে অন্ধের মত লিফ্‌টের কোনা হাতড়াতে লাগলাম। ব্যাগটা পাওয়ার পর বাইরে থেকে ধরে ধরে বোঝার চেষ্টা করলাম নোটগুলো ঠিক মত আছে তো। আশ্বস্ত হয়ে প্ল্যাস্টিকের হ্যান্ডেল্টা দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে রাখলাম, যেন এর ভেতরেই সুরাইয়ার প্রাণ-ভোমরা।

ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে এলো। লিফ্‌টের আলো আগের চাইতে মৃদু। বোধ হয় জেনারেটর চালু হয়েছে। আমি আড় চোখে সুরাইয়াকে লক্ষ্য করলাম। মাঝে কতগুলো বছর ইউক্যালিপটাসের বাঁকলের মত ঝরে গেছে কিন্তু ওর রূপ একটুও ঝরেনি। সামান্য রুগ্নতা বরং চেহারার ধার আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সুরাইয়া আমার দিকে একবারও চাইছে না। ও কি আদৌ আমাকে চিনতে পেরেছে? আমার তো আর আগের সেই কবি কবি চেহারার দাঁড়ি গোঁফ নেই উল্টো চোখে মুখে ‘লেট্‌স্‌ টক অ্যাবাউট বিজনেস’ গোছের চোয়াড়ে একটা ভাব এসেছে। পানপাত্রের আকর্ষণে চোখে লাগার মত ভুঁড়িও গজিয়েছে। উপরন্তু চোখের নীচে পুরু বালিশ। হয় সে আমাকে চিনতে পারেনি কিম্বা এড়িয়ে যাচ্ছে অথবা কোন গভীর ভাবনায় মগ্ন।

সুরাইয়াকে একদিন পুরনো পুঁথির মত পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। হারিয়ে যাওয়া সে বইয়ের নূতন মলাটটা ভালো মত নিরীক্ষা করার আগেই লিফ্‌ট্‌ বারো তলায় এসে থামলো। লিফ্‌টের ছবির মত খোলা ফ্রেম দিয়ে সুরাইয়া নির্লিপ্তভাবে বেরিয়ে গ্যালো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিষ্ঠুর স্লাইডিং ডোর দুটো ক্ষিপ্র বেগে অজানা রঙ্গমঞ্চের যবনিকা টেনে দিলো। হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয় সুরাইয়া আবারও আমার জীবন থেকে নিভে গ্যালো।

কিন্তু এক জীবনে একজন মানুষকে ক’বার হারানো যায়?

আমি পাগলের মত লিফ্‌টের সব গুলো বোতামে চাপ দিলাম। উফ্‌, লিফ্‌ট্‌ এখন ঘাটে ঘাটে থামবে। দশ তলায় নামা উচিত ছিল কিন্তু মাথা কাজ করছে না। লিফ্‌ট্‌ আট তলায় থামতেই দৌড়ে সিঁড়ির কাছে গেলাম। দুই ধাপ করে পা ফেলে সিঁড়ি বেঁয়ে উঠে এলাম বারো তলায়। আমার এখন হাঁপ ধরে গ্যাছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চেইন-স্মোকিং আর অনিয়ন্ত্রিত জীবন তার পাওনা বুঝিয়ে দিচ্ছে হাড়ে হাড়ে।

সিঁড়ির কাছ থেকে করিডোর দু’দিকে চলে গেছে। কী মনে করে বাঁ দিকে শেষ মাথা পর্যন্ত গেলাম। কেউ নেই। দৌড়ে আবার চলে এলাম সিঁড়ির পাশে। ডান দিকে করিডোর সামান্য এগিয়েই আবারও ডানে মোচড় নিয়েছে। কে একজন হেঁটে যাচ্ছে। না সুরাইয়া নয়, মধ্যবয়সী লোক। এক সাইজ বড় হাল্কা বাদামী রঙের জ্যাকেটটা খুব পরিচিত । থাইল্যান্ড থেকে আমিই এনে দিয়েছিলাম। তার চেয়েও চেনা লাগছে ওর ওই এক দিক ঝুঁকে খুঁড়িয়ে হাঁটা।

মোকাম্মেল হক? কী করছে এখানে? কখন নামল?

বেশীক্ষণ ভাবতে হলো না। মোকাম্মেল হক আরও পাঁচ গজের মত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ডান দিকের দরজা বরাবর থামলেন। বাঁ হাতের জ্যাকেটের হাতা সরিয়ে একবার সময় দেখলেন। তারপর হাল্কা ফিরোজা রঙের দরজায় তিন বার টোকা দিলেন। দরজাটা তখনই খুলে গ্যালো, যেন কেউ ভেতরে অপেক্ষায় ছিল। আমি দ্রুত মোকাম্মেল হককে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় এক ঝলক ঘুরে তাকালাম। চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সুরাইয়া, আমার সমগ্র ইতিহাস। আমি সামনে এগোতেই দরজাটা ঘাড়ের পেছনে খট্‌ করে বন্ধ হয়ে গ্যালো।

কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি আবার লিফ্‌টের কাছে ফিরে এলাম। অন্য লিফ্‌ট্‌টা চালু হয়েছে। কে জানে কেন এই ফ্লোরেই থেমে আছে। ভেতরে ঢুকে উন্ত্রিশ নম্বর বোতামে চাপ দিলাম। লিফ্‌টের দেয়ালে ব্রাশ্‌ড্‌ স্টিলের হ্যান্ড-রেইল। হ্যান্ড-রেইলে ভর দিতেই একটা আঠালো কিছুতে হাত আটকে গ্যালো। চুইংগাম। মোকাম্মেল কি এই লিফ্‌ট্‌ দিয়ে নেমেছিল?

ওরকম একটা কদর্য লোকের পক্ষেই সম্ভব পোকায় খাওয়া দাঁত দিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা ধরে চিবানো লালা-মাখা জীবাণু গিজ গিজ করা থকথকে নমনীয় একটা প্লাস্টিক দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে লিফ্‌টের পরিষ্কার ঝকঝকে হ্যান্ড-রেইলে আলগোছে লাগিয়ে রাখা।

উনত্রিশ তলায় উঠে সোজা মোকাম্মেলের অফিসে গেলাম। ওর টেবিলের উল্টো পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। আই নিড টু নো দা ফ্যাক্‌ট্‌স্‌!...।

অফিসের দুইটি দেয়াল কাঁচের। দেয়ালের পাশেই ট্রাইপডের উপর একটা লম্বা দূরবীন। আধ ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও যখন মোকাম্মেল এলো না, উঠে গিয়ে দুরবীনের আতশি কাঁচে চোখ রাখলাম। ফোকাস ঠিক করতেই ছোট একটা জলভূমি ভেসে উঠল, জলভূমির উপর কতগুলো সারস পাখী ঝিমুচ্ছে। আশ্চর্য, বায়স্কোপ নাকি, এমন ব্যস্ত এলাকায় লেইক আসলো কোত্থেকে? দূরবীন থেকে মাথা সরিয়ে খোলা চোখেই আগের দৃশ্য বরাবর তাকালাম। বঙ্গভবন। ভেতরে উত্তরদিকে বড় একটা জলাধার। বেশ আছেন মোকাম্মেল হক। কাজের অবসরে বঙ্গভবনে দূরবীন তাক করে পাখী দ্যাখেন, ইচ্ছে হলে নারীসঙ্গে যান। এই পৃথিবী কদর্য লোকগুলোর জন্য কত বিচিত্র আমোদের খোরাকই না জুটিয়ে রেখেছে!

ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর মোকাম্মেল হক এলেন। আমাকে দেখে বল্লেনঃ

‘আরে হুদা ভাই আবার? কাজে নাকি বেহুদা?’

হুদার সাথে বেহুদা মেলাতে পারার খুশীতে মোকাম্মেল খ্যাক খ্যাক করে হাসলেন। যথাসম্ভব ক্ষোভ চেপে বল্লামঃ

‘আপনার সাথে একটা সিরিয়াস কথা আছে’

‘কী কথা হুদা ভাই। আপনে কি পেইমেন্টে হ্যাপি না? পঁচিশ পারসেন্টের উপর কেমনে দেই কন? নেত্রীর ছেলেও তো এর চেয়ে...’ আমি কথা শেষ করতে না দিয়েই বল্লামঃ

‘টাকাপয়সা না,অন্য বিষয়’ আমার কথা শুনে মোকাম্মেলকে বোধ হয় আশ্বস্ত হলেন। গলা নরম করে বল্লেনঃ

‘আহ হুদা ভাই, টেনশনে ফালায় দিসিলেন। বলেন ভাইজান, আপনার মত একজন সিনিয়র ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের জন্য এই নালায়েক বান্দা অন্য কী করতে পারে’

‘আপনার কি ওইসব মেয়েদের সাথে কানেকশন আছে’

মোকাম্মেলের চোখ এখন চক চক করছে। আমার আরেকটা দুর্বলতা ওর আয়ত্তে এলো। সময়মত সুতা নাড়া যাবে। মোকাম্মেল বল্লেনঃ

‘ওই সব মেয়ে? থাকবে না কেন? এক্সপোর্টের ব্যবসা করি, ফরেন ক্লায়েন্টের জন্য রাখতেই হয়। দাদার আবার ‘ওই সব মেয়ে’র অভ্যাস আছে না কি?’

কথাটা বলেই মোকাম্মেল বাঁ চোখ টিপ দিলেন। দাদা বলা এবং চোখ টিপে মকারি করার অর্থ হলো আমার নৈতিক অবস্থান ওর চোখে আরও এক ধাপ নেমেছে। কিন্তু তাতে আমার কোন যায় আসে না। সুরাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে সুরাইয়ার প্রত্যাখানের যোগ্য করে তুলেছি। যতটা নীচে নামা যায় নেমেছি।

সুরাইয়ার সীমিত অবস্থানকালে আমার বেতনও ছিল সীমিত। একটা ক্লিশে কথা আছে না ‘অনেস্ট অফিসার’ তাই ছিলাম। ছেলেমেয়ে না থাকায় সংসার চলে যেত ঠিকই কিন্তু আলগা শখ মেটাবার মত কোন ডিস্পোজেবল ইনকাম থাকত না। সুরাইয়াও কখনো বলেনি চলো কক্সেসবাজার ঘুরে আসি কিম্বা হাল ফ্যাশনের দম্পতিদের মত ব্যংকক, পাতায়য়া, পেনাং, ল্যাঙকাউয়ি। নিজস্ব বাড়িগাড়ি, নিত্যনূতন গয়নাগাঁটির বায়নাক্কাও দেখিনি ওর ভেতর। সেই সুরাইয়া চতুর্থ বিয়ে বার্ষিকীর তিন রাত আগে ধুম করে হাওয়া হয়ে গ্যালো। এক সপ্তাহ পর উকিল নোটিশ এলো, বিবাহ বিচ্ছেদের। কারন দেখানো হয়েছে অমোচনীয় মানসিক দূরত্ব আর সাংসারিক টানাপড়েন।

শুরুতে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পুরোপুরি ভেঙ্গে যাইনি। এটা অ্যাড্যাপ্টেশন অ্যান্ড মিটিগেশনের যুগ। অ্যাড্যাপ্টেশনের শর্তই হলো টিকে থাকার জন্য পুরনো স্বত্বার অকেজো অংশগুলো বিকিয়ে দিতে হয়। সততা আর নৈতিকতার মত ওজনদার আত্মঘাতী গুণগুলো ঝেরে ফেলে আমিও চোয়াড়ে এবং ধুরন্ধর হয়ে উঠলাম।

প্রত্যেক ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের একটা আলাদীনের প্রদীপ আছে। চাইলে সে ঘষা দিতে পারে নাও পারে। আমিও আমার আলাদিনের প্রদীপটা ঘষা শুরু করলাম। ঢাকা শহরের বাতাসে যে লক্ষ লক্ষ টাকা অগ্নি-পতঙ্গের মত অস্থিরভাবে পাখা ঝাঁপটায়, তার একটা অংশ ঝাঁক বেঁধে আমার আলাদিনের প্রদীপের আত্মাহুতি দিতে লাগলো। অর্থে অনর্থে আমি ফুলে ফেঁপে উঠলাম। এই শহরে চন্দ্রাহত দেবদাসের আর্থিক সঙ্গ পেতে ইয়াবাখোর চন্দ্রমুখীরা মুখিয়েই থাকে। সুরাইয়া চলে যাবার পর ‘ওই সব মেয়ে’র অভাব আমার জীবনে কখনই ঘটে নাই। মোকাম্মেলের মত লোকেরা এটা ভালো মতই জানে, তবু ইচ্ছে করেই একটা মর‍্যাল হাই গ্রাউন্ড নেয়ার চেষ্টা করছে। চাইলে কান লাল করা কথা বলে আমিও এইসব মোকাম্মেলফোকাম্মেলকে ধসিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ সুরাইয়া।

মোকাম্মেলকে সুরাইয়ার রুমে ঢুকতে দেখেই বুঝেছি সুরাইয়া সুরবালা নয়, সুরাইয়া চন্দ্রমুখী। তাতে আমার আজ আর কোন খেদ নেই। সুরাইয়ায়র পতনের যোগ্য হবো বলে আমি নিজেও তো অনেক নেমেছি। আই হ্যাভ বিকাম আ ড্যামেজ্‌ড্‌ ম্যান ফর আ ড্যামেজ্‌ড্‌ লেইডি। ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই বারে বার’। তবু তো পাব। বিবাহিত অবস্থায় ওকে বিশেষভাবে বহন করতে পারিনি। অ্যাট লিস্ট আই ক্যান অ্যাফোর্‌ড্‌ হার নাও। ওর আউয়ারলি রেইট জেনে নিতে হবে। কত হবে? দশ হাজার? পনর হাজার? বিশ হাজার?

আর কথা না ভাঁড়িয়ে সরাসরি বল্লাম,

‘শুনুন,আপনি একটু আগেই টুয়েলফ্‌থ্‌ ফ্লোরে একটি মেয়ের সাথে ছিলেন। ডোন্ট আস্ক মি হাউ আই নো ইট। জাস্ট গিভ মি হার কন্টাক্ট ডিটেইলস। আই উইল ফাইন্ড আউট দি রেস্ট্‌’

হাতেনাতে ধরা পড়ে মোকাম্মেলের মুখ চুনা পাথরের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। হওয়াটাই উচিত। এখন তো সবখানে ক্যামেরা। কলমে পেন্সিলে মোবাইলে ফ্যানে লকেটে সকেটে ঘড়িতে চশমায় । উনি হয়তো ভাবছেন আমি গোপনে ছবিটবি তুললাম কিনা। একটু আসছি বলে মোকাম্মেল ঘরের লাগোয়া প্যান্ট্রি রুমে গেলেন। ফিস ফিস করে ফোনে কথা বললেন। ফিরে এসে বললেন,

‘ঠিক আছে, চলুন বরং সরাসরি সুরাইয়ার ওখানেই যাই’

বল যে এত দ্রুত গড়াবে বুঝিনি। হঠাৎ মনে হচ্ছে কী দরকার এসবের। যে গ্যাছে সে তো গ্যাছেই। আবার মনে হচ্ছে আমাদের বিচ্ছেদের ভেতর কোথায় যেন এঁটো থালার মত একটা অসমাপ্তির যন্ত্রণা আর অপমান লেগে আছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা, কিছু অপমানের প্রতিশোধ আর একটা পরিচ্ছন্ন পরিসমাপ্তি খুবই জরুরী। পায়ে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দিলে মানুষ যেমন ডুবতেই থাকে, অসমাপ্তির এই বোধ আমাকেও অতল থেকে অতলান্তে তলিয়ে নিচ্ছে। আবার এসব ভাবনার বিপ্রতীপে খুব একটা আর্‌জ্‌ হচ্ছে ওকে কাছে পাবার।

আমি এখন সুরাইয়ার রুমের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। একটা কবিতার পংক্তি অ্যাকুরিয়ামের মাছের মত বার বার মাথায় ঘুরছে - ‘সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে’। এবারও হাল্কা ফিরোজা রঙের দরজায় মোকাম্মেল তিনবার টোকা দিলেন। সুরাইয়া নয়, অন্য কেউ এসে দরজা খুললো। সামনে বড় একটা লবি। লবির সাথে অনেকগুলো ছোট কামরা। মোকাম্মেল আমাকে নাক বরাবর ঘরটায় নিয়ে গেলেন।

আমরা চেয়ার টেনে বসতেই একজন ভদ্রমহিলা এসে ঘরে ঢুকলেন। মোকাম্মেলের দিকে তাকিয়ে বল্লেনঃ

‘পেশেন্ট তো হঠাৎ রেস্টে গেলেন। অপেক্ষা করুন উঠে যাবে’

‘পেশেন্ট?’ আমি ভ্যাবার মত ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। এবার মোকাম্মেল হক মুখ খুল্লেনঃ

‘হুদা ভাই, মাই মিস্টেক। পরিচয় করিয়ে দেইনি। ইনি ডক্টর নাসিমা, সুরাইয়া আপার চিকিৎসা করছেন’

আমাকে একটা শক্‌ থেরাপী দিতে পেরে মোকাম্মেল চোখে মুখে বিজয়ী ভাব ফুটে উঠেছে। ডাজ হি হ্যাভ এনি আইডিয়া দ্যাট সুরাইয়া অয়াজ মাই ওয়াইফ? আমার পরিচয়ই বা কী দিয়েছে? আমি জানি না সুরাইয়া মোকাম্মেলের কী ধরণের আপা। তার চেয়ে বড় কথা এই প্রথম বুঝলাম আমি কোন ক্লিনিকে। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ্য করে ডক্টর নাসিমা বললেনঃ

‘চার বছর আগে ওনার ওভারির ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। লেইট স্টেইজ। দিল্লীতে দুটো অপারেশন হয়। প্রথমে হিস্টেরেকক্টমি করে ইউটেরাস রিমুভাল। তারপর ওফোরেক্‌টমি। ওফোরেক্‌টমি কি জানেন তো? গর্ভাশয় ফেলে দেয়া। সুরাইয়ার দুটো গর্ভাশয়ই কেটে বাদ দেয়া হয়েছে।’

আমি আর নিতে পারছিলাম না। ওনাকে থামানোর জন্যই বললামঃ

‘আপনাদের এটা কি ক্যান্সার চিকিৎসার ক্লিনিক?’

‘না। এটা আলঝেইমারের ক্লিনিক। ক্লিনিক না বলে অবশ্য হস্পেস বলতে পারেন। পেশেন্টরা এখানে লংটার্মের জন্য থাকেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত’

‘তাহলে সুরাইয়া এখানে কী করছে?’

‘ওভারি রিমুভাল এক ধরণের সার্জিক্যাল মেনোপোজ। ইয়াং বয়সে ওভারি রিমুভালের পর শরীরে এস্ট্রোজেন প্রোডাকশন এক রকম বন্ধই হয়ে যায়। বার্ধক্যজনিত সমস্যাগুলো এস্ট্রোজেনের অভাবে ইয়াং বয়সেই দেখা দেয়’

‘যেমন?’

‘যেমন ডিমেনশিয়া। ডিমেনশিয়ার একটা ফর্ম হলো আলঝেইমার, স্মৃতিলোপ। স্মৃতিলোপ না বলে স্মৃতি লোপাট বলাই ভালো। ইরাভারসিবল ডেটেরিওরেশন অফ মেমোরি। সুরাইয়া ইজ সাফারিং ফ্রম আলঝেইমার। ও এখনো অ্যাক্‌টিভ, কিন্তু ধীরে ধীরে ওর মোবিলিটিও কমে আসবে’

এই প্রথম আমার কাছে পরিষ্কার হলো কেন সুরাইয়া এখানে, কেন আমাকে চিনতে পারছে না আর কেনই বা সে আমাকে ছেড়ে গ্যাছে। সমস্ত জীবন ধরে ইউটেরাস আর ওভারিহীন সুরাইয়ার ভার আমি বহন করি তা সে চায়নি। বলতে গেলে সে আমার কারনেই গৃহত্যাগী। অথচ আমি একটু আগেই ভেবেছি সুরাইয়া একটা ভোগ্যপন্য যার সাথে রেইট নিয়ে দরদাম হাঁকা যায়, টাকার বিনিময় সহবাস করা যায়। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণায় গলা উগড়ে বমি চলে আসল। আমি দৌড়ে বেসিনের কাছে গেলাম।

এই ক’ বছরে সুরাইয়া যখন জগত সংসার ছেড়ে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল আমি তখন ক্রমাগত নীচে নামছিলাম। দু’দিক দিয়ে বেড়ে যাওয়া এই দূরত্ব আর কখনো কি মোচন হবে? কার সাথেই বা হবে? আমি মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

লিফ্‌ট্‌টা মৃদু ঝাঁকি দিয়ে আবার নীচে নামতে শুরু করেছে। আমার এক হাত স্টিলের হ্যান্ড-রেইলে। অন্য হাতে টাকার ব্যাগটা শক্ত করে বুকে চেপে রেখেছি। জানি না কার অধঃপতনে, লিফ্‌টের নাকি আমার, একটা শূন্যতা বোধ করছি। গভীর শূন্যতা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহমুদা rahman valo laglo, sobsomoy jeno lekhalekhi apnake akre thake...
আমির ইশতিয়াক অভিনন্দন আপনাকে।
হিমেল চৌধুরী অভিনন্দন আপনাকে।
রাজীব ভৌমিক অভিনন্দন ...
সহিদুল হক antorik অভিনন্দন
নাজনীন পলি অভিনন্দন !
তানি হক অনেক অনেক অভিনন্দন ভাইয়া !
কনিকা রহমান অভিনন্দন আপনাকে ...

০১ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

সমন্বিত স্কোর

৭.১৭

বিচারক স্কোরঃ ৪.৪৩ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৭৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪