উনিশশ’ সত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের একটা ডেলিগেশন গিয়েছিল চায়না। আশরাফ ভাইও ছিলেন। মূর্তিটা সে সময় পিকিং থেকে কেনা।
আশরাফ ভাই বেঁচেছিলেন এর পর মাত্র এক বছর। একাত্তরের চৌদ্দই ডিসেম্বর বিকেলবেলা এক ছাত্র এসে কথা বলার নাম করে আশরাফ ভাইকে বাসা থেকে বাইরে নিয়ে যায়। আশরাফ ভাই আর ফেরেননি। এরকম আরও আরও অনেক শিক্ষকই সেদিন বাড়ি ফেরেনি।
বুদ্ধের মূর্তিটা সেই থেকে ভাবীর ঘরেই পড়ে আছে। বিয়াল্লিশ বছর ধরে অহিংসার ললিত বাণী নীরবে শোনাচ্ছে।
পনেরই জুলাই ঘাতক-প্রফেসরের বিচারের রায় হলো। একাত্তরে এই ঘাতক–প্রফেসরের নির্দেশেই জাতিকে মেধা-শূন্য করা হয়েছিল। জহির বুঝলেন, যথেষ্ট হয়েছে, এই সব অহিংসা-ফহিংসা কিম্বা সরকার-ফরকারের কোন মানে নাই। আশরাফ ভাইয়ের আত্মার শান্তির ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। ভাবীকে বলে কয়ে মূর্তিটা নিয়ে এলেন।
বুদ্ধের সেই মূর্তিটা এখন জহিরের ওয়ার্কশপে একটা বিশেষ ওভেনে গলছে। ওভেনের একপাশ থেকে গলিত প্লাস্টিক ফিতার মত বেরিয়ে আসছে। প্লাস্টিকের এই ফিতা ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের কালি।
কি প্রিন্ট করতে হবে তা আগেই ঠিক করা।
প্রিন্টারে এই ফিতা-কালি ভরে জহির কম্পিউটারে প্রিন্ট কম্যান্ড দিলেন। ঘন্টাখানেকের ভেতরে কতগুলো প্লাস্টিকের পাইপ আর যন্ত্রাংশ বেরিয়ে এলো। আরও ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে জহির প্লাস্টিকের টুকরোগুলো জোড়া দিলেন। একটা পুরোদস্তুর মডিফাইড ব্লেইসার আর নাইন্টি থ্রী হান্টিং রাইফেল। আর্মি কানেকশন থেকে কিছু বুলেট আগেই জোগাড়যন্ত্র করা আছে।
পরদিন বিকেলে জহির শাহবাগের ডায়াবেটিক হাসপাতালে গেলেন। কিডনির সমস্যার কথা বলে ছ’তলার একটা কেবিনে উঠে এলেন। এখান থেকে ঠিক উল্টো দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতাল। ঘাতক-প্রফেসর সেখানে বন্দী অবস্থায় ‘চিকিৎসাধীন’।
জহিরের এখান থেকে ওই হাসপাতালের এক পাশের কেবিন গুলো খালি চোখেই দেখা যায়। ঘাতক-প্রফেসরের কেবিনও। জহির বেশ ক’দিন ধরে দূরবীন দিয়ে ঘাতক-প্রফেসরের গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষা করলেন। তারপর এক বিকেলে স্পোর্টস ব্যাগ হাঁটে উঠে এলেন ছাদে। ব্যাগ থেকে বের করলেন গতকাল বানানো রাইফেলটা। বন্দুকটাকে রেলিংএ রেখে তাক করলেন ঘাতক-প্রফেসরের কেবিনের দিকে।
বিকেলের এই সময়টায় ঘাতক-প্রফেসর একবার পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালের কেবিন থেকে বের হন। করিডোরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কয়েকবার চক্কর দেন।
জহিরের আরেকটা সমস্যা হলো রেড-গ্রীন কালার ব্লাইন্ডনেস। একসময় বাংলদেশের পতাকা ছিল ভোরের সূর্যের মত লাল আর জলপাইয়ের মত সবুজ। এখন সাদাকালো।
চোখের এই অসুখটা আঘাতজনিত।
সত্তর দশকের দ্বিতীয়ভাগে এক মেজর জেনারেল ক্ষমতায় আসেন। মেজর সাহেবের ছিল ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ রোগ। খুব আতঙ্কে থাকতেন কখন কোন আর্মি অফিসার তাকে নিকেশ করে দেয়। তাই সময়ে-অসময়ে, সন্দেহে-অসন্দেহে নিয়ম করে তিনি আর্মি অফিসারদের ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাতেন। আশ্চর্যজনকভাবে মারা পড়ত কেবল মুক্তিযুদ্ধ ফেরত অফিসার আর সৈনিকরা। একাত্তরের বালক মুক্তিযোদ্ধা জহির তখন জুনিওর কমিশন্ড অফিসার। সামরিক ট্রাইব্যুনালে একদিন তাকেও ফাঁসানো হয়। প্রতিদিনই টর্চার, উল্টো করে গাছের ডাল থেকে দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, নাকে মুখে ফুটন্ত গরম পানির প্রবাহ আর রাইফেলের বাটের এলোপাতাড়ি আঘাত। ওপরওয়ালার অসীম কৃপাতেই হয়তো জহির তখন বেঁচে যায়। ক্ষতির ভেতর এই কালার-ব্লাইন্ডনেস আর ডিজনারেবল ডিসচার্জ।
টপ টপ করে এখন বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু করেছে। জহির রাইফেল তাক করে আছে উল্টো দিকের ভবনের চার তলার বারান্দায়। অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে । আজও বোধ হয় হবে না।
হঠাৎ বারান্দার পেছনের দরজা খুলে গেলো। প্রথমে একজন পুলিশ গার্ড, তার পর ঘাতক-প্রফেসর।
ঘাতক-প্রফেসর এখন করিডোরে চক্কর দিচ্ছে। একবার ও মাথায় যাচ্ছে, আরেকবার এ মাথায় আসছে। বৃষ্টির ছাঁটও দ্রুত বাড়ছে। কালার ব্লাইন্ডনেসের কারনে অনেক কিছুই সাদাকালো দেখাচ্ছে, ফোরগ্রাউন্ড ব্যাকগ্রাউন্ড গুলিয়ে যাচ্ছে।
নাও অর নেভার। সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাবার আগেই জহির ট্রিগারে চাপ দিলেন। একটা বুলেট কিছু ভর, কিছু বেগ আর কিছু ঘৃণা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে গ্যালো ঘাতক-প্রফেসরের দিকে।
বাসায় ফিরে জহির পেছনের ওয়ার্কশপে গেলেন। বন্দুকের পার্টসগুলোকে আলাদা করলেন। বিশেষ ওভেনটা চালু করে সেখানে টুকরোগুলো ভরে দিলেন। মেশিনের অন্যদিক থেকে ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের ফিতা বেরিয়ে এলো।
প্রিন্টারে প্লাস্টিকের ফিতা ভরে জহির কম্পিউটারে প্রিন্ট কম্যান্ড দিলেন। ডিজাইন আগে থেকেই ঠিক করা। ঘন্টাখানেকের ভেতরে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টাউট বেরিয়ে এলো। জহির ত্রিমাত্রিক প্রিন্টটা একটা কার্ডবোর্ড বক্সে ভোরে আশারফ ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা দিলেন।
ভাবী কুরআন খতম করছিলেন। আগামীকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আশরাফের অন্তর্ধান বার্ষিকী। প্রতি বছর এই সময় কুরআন খতম হয় লালবাগ এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য খাবারের আয়োজন হয়। কবর নেই, তাই জিয়ারত হয়না।
তিনবার কলিং বেল টিপতেই ভাবী দরজা খুল্লেন।
জহিরের হাতে কার্ড বোর্ডের বড় বাক্স। ভাবী আগ্রহ নিয়ে বক্সের দিকে তাকিয়ে বল্লেনঃ
‘কী এনেছিস এটা?’
‘খুলে দ্যাখো’
ভাবী আস্তে আস্তে কার্ড বোর্ড বক্স খুললেন। ভেতরে লোহার চারকোনা বেইসের উপর শহীদ বুদ্দিজীবী স্মৃতি সৌধের প্লাস্টিক মডেল।
‘কোথায় পেলি? এত বড় আর ডিটেইল মডেল আগে দেখিনি তো’
ড্রইং রুমের দক্ষিণ দেয়াল জুড়ে আশরাফের বড় একটা বাঁধানো ছবি। ছবির ঠিক নীচে একটা শো কেইস।
তানি হক
দারুন ভালো লাগলো ভাইয়া গল্প ... রহস্য ঘেরা টানটান উত্তেজনায় ভরা ... এবং শেষে এসে আত্ম তৃপ্তি ... খুব ভালো লাগলো ...আসলে একজন মুক্তি যোদ্ধা যে একাই একশো তা প্রমান করলেন জহির ... অসম্ভ বুদ্ধি মাত্রা খাটিয়ে যেভাবে বিশ্বাস ধাতক কে উপযুক্ত শাশ্তি এবং শহীদ বুদ্দিজীবী স্মৃতি সৌধের প্লাস্টিক মডেল। বানালেন তা মনে রাখার মতো ... আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ভাইয়া এই গল্পটির জন্য ... সেই সাথে আমাদের সব বীর সন্তান দের প্রতি অসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ।
নাজনীন পলি
প্রথম টা পড়ে ভেবেছিলাম ঘাতক প্রফেসরকে শাস্তি দেয়া হবে , কিন্তু শেষটা অন্যরকম হল । আপনার সব লেখাই অসাধারণ এবং একটি থেকে অন্যটি আলাদা ।
অনেক ভাললাগা ।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
বুনটের দিক থেকে কিছুটা হালকা মনে হলেও কাহিনী বিন্যাস এবঙ বর্ণনাশৈলীতে পাকা হাতের ছোয়া তা বোঝাই যায়....সুতরাং অসাধারণ লেচগছে আমার কাছে.....মুক্তি যুদ্ধ ভিত্তিক লেখা গুলো আমাকে ভীষণ টানে .....পড়ে মুগ্ধ হলাম.....লতিফ ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ............
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।