আমরা অপেক্ষা করছি। আমি আর রূপা।
অ্যাপ্রোন পরা একজন আমাদেরকে ইশারা করে ঘরে ঢুকতে বললো। রূপা আমার চেয়ে অনেক শক্ত। রূপা আগে আগে চলল, আমি পেছনপেছন। দরজার কাছে এসে আমার পা ভারী হয়ে এলো। বললাম,
‘রূপা, আমি পারব না, তুই দ্যাখ্’।
ঘরের একপাশে দুটো বড় স্টিলের ফ্রিজ। প্রতি ফ্রিজে চারটা দরজা। ডানদিকের ফ্রিজের মৃত দেহগুলো গত দু’ দিনের।
জানালা দিয়ে যথেষ্ট আলো আসছে। চল্লিশ পাওয়ারের দুর্বল বাল্বটা তবু করুণ কালো তারের মাথায় কুপির মত জ্বলছে। অ্যাপ্রোন পরা লোকটা হিম প্রকোষ্ঠের প্রথম দরজা খুললো। রূপা একটু ঝুঁকেদাঁড়ালো, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা ঝাঁকালো। লোকটা দরজা বন্ধ করল। এভাবে খোলা বন্ধ চলল। এবার নীচের শেষ দরজা। রূপা আবার ঘাড়টা নীচের দিকে কাত করলো। রূপাহঠাৎ দু হাতে মুখ ঢেকেকাঁদছে। আমার সমস্ত শরীর বরফ হয়ে এলো। আমি দৌড়ে রূপাকেজাপটে ধরলাম। তারপর হিম প্রকোষ্ঠের দিকে জোর করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।
লম্বা শরীরটা সটান হয়ে পড়ে আছে । পুরো মুখ আর মাথার একদিকথ্যাতলানো। কিন্তু কোঁকড়া চুল? না এ তো আমার জাহিদ না। জাহিদের চুল কোঁকড়া ছিল না। জাহিদ ওর বাবার চুল পেয়েছিল। রেশমের সুতোর মত, সোজা আর মসৃণ। ক্লাস সেভেনে ওঠার আগ পর্যন্ত জাহিদের চুল আমি নারকেল তেল মেখে আঁচড়ে দিয়েছি। ও কাঠের চিরুনী পছন্দ করত। শাহেদ যেবার চট্টগ্রাম গ্যালো, এক সেট বার্মিজ কাঠের চিরুনী নিয়ে এলো। তার একটা জাহিদ এখনো ব্যবহার করে।
আমি রূপাকে বললাম,
‘রূপা, তুই কাঁদছিস কেন?’
রূপা তবুও কাঁদছে। স্বস্তির কান্না। ছেলেটা আমার গাড়ি চাপা পড়েনি কিম্বা ছিনতাইকারীর হাতে খুন হয়নি।
আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছি। সারদিনের জন্য। সাড়ে তিন হাজার টাকা। গ্যাসের দাম আলাদা। মর্গ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার জিগেস করল, এখন কোথায়? বললাম, উত্তরা দুই নাম্বার সেক্টর, কৃষ্ণবাহিনীর অফিস। ড্রাইভারের ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তায় জ্যাম, কতক্ষণ লাগবে কে জানে।
জাহিদ আর রূপার জন্য আমার কষ্ট হয়। শাহেদ মারা যাওয়ার পর মালিবাগের বাড়িটা ছেড়ে দিতে হলো। রূপা কোলের শিশু। জাহিদের বয়স সাত অথবা আট। তল্পিতল্পা নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে উঠেলাম। আরিফ তখন ট্যানারির মোড়ে একটা টিনশেডের বাড়িতে থাকে। দুই রুম। তিন বাচ্চা নিয়ে ওদের নিজেদেরই হাঁসফাঁস। তারপরও আমাদের জন্য আরিফ পূবের ঘরটা ছেড়ে দিলো। মাস দুয়েক পর শাহেদের অফিস অনুগ্রহ করে টাইপিস্টেরচাকুরীটা দ্যায়। বেতন সামান্য। বাড়ির ভাড়া ভাগ করে আর চাল-ডাল-নুন কিনে কিছুই থাকত না।
এই সময় বাচ্চারা কত কি চায়। ম্যাচবক্স, খেলনা পিস্তল, ব্যাটারীর ট্রেন, ভিডিও গেইম, মিমি-চকলেট, চাইনিজে যাওয়া, ভালো দোকানের দই মিষ্টি, ভালো জামাকাপড়। আমি কিছুই দিতে পারতাম না। ছেলেমেয়ে দুটো হীনমন্যতা নিয়ে বড় হলো। ঠিকমত সমাজে মিশতে পারল না। জানালার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নিজেকে বড় অক্ষম মনে হলো।
তিনদিন হতে চললোজাহিদের কোন সন্ধান নেই। মোবাইলে ফোন করলে শুনি এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব না। ওর ফেইসবুকের আপডেট পাঁচ দিনের পুরনো। আগে কখনো এমন হয়নি। হয়তো বন্ধুদের সাথে এক দু’ রাত কোথাও কাটিয়েছে। যত দেরীই হোক ফোন করে জানিয়েছে।
মর্গ থেকে এগারোটায় রওনা হয়েছিলাম। কর্নেলফিরোজের ঘরে যখন ঢুকলাম তখন দুপুর পৌনে দুটো। কৃষ্ণবাহিনীর গেটে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনটা দমে গ্যাছে। কর্নেল ফিরোজ শামিমারবাবার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু। শামিমা আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী। এরকম পলকা পরিচয় ব্যাখ্যা করাই সমস্যা। শেষমেশকর্নেল ফিরোজকে ফোন করে ওরা আশ্বস্ত হয়েছিল।
কর্নেল ফিরোজ কম্পিউটার মনিটরের দিকে চোখ রেখে সিগারেট টানছিলেন। মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন,
‘আপনার ছেলের নাম?’
আমি নাম বললাম, ‘মুহম্মদ জাহিদ হাসান’
‘দলটল করত?’, কর্নেল ফিরোজ এবার আমার দিকে সরাসরি তাকালেন।
আমি কি উত্তর দিব? জাহিদের কি কোন আত্মবিশ্বাস ছিল? একবার এ দল করত তো আরেকবারঅন্যদল। কতবার বলেছি রাজনীতি-টাজনীতির সাথে না জড়াতে। ছাত্রনংঅধ্যয়নং তপঃ। কিন্তু একটা পরিবারে বাবা না থাকলে যা হয়। কোথাকার আজেবাজে বন্ধুরা যখন যা বুঝ দিত ও তা’ই করত। জাসদ, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ কিছু কি বাদ দিয়েছে? আমার বোকা ছেলে তো ট্যাক্টফুলিও চলতে জানে না। নিশ্চয় শত্রুটত্রুও বানিয়েছে অনেক।
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কর্নেল ফিরোজ বিরক্ত মুখে জিগেস করলেন,
‘পলিটিক্স করত নাকি?’
আমি বলার আগেই রূপা বলল,
‘আগে করত, এখন না। ইদানীং বরং ভাইয়াধর্মটর্ম… দু মাস আগ থেকে হঠাৎ মসজিদে যাওয়া আরম্ভ করেছিল।’
রূপার কথা শুনে কর্নেলজিগেস করলেন,
‘পাড়ার মসজিদ?’
রূপা বলল,
‘না, মিরপুরের কোথাও, বায়তুননুর না কী নাম’।
কর্নেলের মুখ এখন গম্ভীর, আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
‘ছেলে কোথায় যায় কী করে খবর রাখেন না? ওটাতো জঙ্গি বানানোর ফ্যাক্টরি’, তারপর রূপাকেবললো,
‘আপনি কীভাবে জানলেন ও বাইতুননুর মসজিদেই যেত?
রূপাবললো,
‘মাঝে মধ্যে এটা সেটা লিফ্লেট আনতো, ওখানে ঠিকানা আছে’।
জাহিদের অতি ধার্মিক হয়ে যাবার খবর আমার কাছে নূতন। ছোটবেলায় অনেক বলেছি কিন্তু জাহিদকে কখনো মসজিদমুখো করতে পারিনি। একবার দুবার গিয়েইবললো মসজিদে ওর ভয় লাগে। জিগেস করতাম কিসের ভয়। ও বলত মৃত্যুর ভয়। জীবনের নশ্বরতা ও প্রতিদিন পাঁচবার মনে করতে চায় না। আমি আর চাপ দিইনি। অথচ এখন...
কর্নেল ফিরোজ হঠাৎ রিসিভার উঠিয়ে কাউকে ফোন করলেন,
‘হায়দার, আমাদের এক আপাকে পাঠাচ্ছি। মিরপুর মসজিদের সাস্পেক্টগুলোকেঘুরিয়ে দেখাও।এনার ছেলে ক’দিন ধরে নিখোঁজ’
তারপর রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘সেলিনা এসে আপনাদের এক নম্বর ভবনে নিয়ে যাবে। আমি বলে দিয়েছি। ইন্টারোগেশন সেলে আপনার ভাই থাকতেও পারে। সবাই তো আর আসল পরিচয় দ্যায় না। আর আপনার কন্টাক্টডিটেইলস রেখে যান’
রূপা একটা কাগজে ওর মোবাইল নম্বর লিখে কর্নেলকেদিলো।
কৃষ্ণবাহিনীরজিপে সেলিনা নামের অফিসারটি কোন কথা বললো না। আমাদেরকে মেজর হায়দারের হাতে সমর্পণ করে কঠিন মুখে নিঃশব্দে বিদেয়নিলো। এক নম্বর বিল্ডিংএর ভেতর একটা মাঝারী সাইজের অডিটোরিয়াম। ক্যানভাসের পার্টিশন দিয়ে অনেকগুলো সেলে ভাগ করা। ভেতরে এত দুর্বল আলো জ্বলছে যে কতগুলো কম্পমান ছায়ারেখা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
একটা বড় সেলের কাছে এসে মেজর হায়দার থামলেন। রূপাকে বললেন,
‘এখানে গত তিন-চারদিনেরসাস্পেক্টগুলোকেইন্টারোগেট করা হচ্ছে। আপনি আসুন, উনি থাকুক’।
আমি বললাম,
‘আমিও আসব’।
মেজর হায়দারের উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি রূপারপেছনপেছন সেলের ভেতর ঢুকলাম। মেজর বাঁধা দিলেন না। কে একজন ডিমারের আলো বাড়িয়েদিলো। উজ্জল আলোয় দেখলাম হাত পা বাঁধা পাঁচ ছ’জন বন্দী বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কেউ যুবক, কেউ বৃদ্ধ, কেউ সবে কৈশোর পেরিয়েছে। কারো কারো মুখমণ্ডল কালো কাপড়ে ঢাকা। কাপড় থেকে পানির ফোটা চুইয়ে পড়ছে।
হঠাৎ একটা গোঙ্গানির শব্দে বাঁ পাশে তাকালাম। কিশোর বয়সী একটা ছেলে সটান হয়ে পড়ে আছে। গায়ে অন্তর্বাস ছাড়া কিছু নেই। ছেলেটার কপালে দুটো ফুটো। রক্ত হাল্কা জমাট বাঁধা। প্রথমে মনে হলো গুলি। কিন্তু পাশে পড়ে থাকা ড্রিল মেশিনের রক্তাক্ত শীর্ষ দেখে আমার পাকস্থলী কন্ঠে উঠে আসলো। আমি সাদাকালোমোজাইকেরমেঝেতে উবু হয়ে বমি উগড়ে দিলাম। মেজর হায়দার বিরক্তি ও বিবমিষা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বন্দীদের মুখের কাপড় সরাতে সরাতে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি দেখে নিন’
আমি দেখলাম। নরম, কমল, কঠিন, কত রকম মুখায়ব। কিন্তু এদের মাঝে জাহিদ নেই। থাকলেও কি জীবিত অবস্থায় ছাড়িয়ে আনা যেত? জানি না।
আমরা যখন ভাড়া গাড়ির কাছে চলে এসেছি, ঠিক তখনই কর্নেলফিরোজের ফোন এলো,
‘আপনার ছেলেকে শেষবার কি কাপড়ে বেরোতে দেখেছেন?’
আমি বললাম, ‘হলুদ জ্যাকেট আর জিন্স, ভেতরে টি শার্ট না কী এখন আর মনে নাই’।
জাহিদের এই একটাই জ্যাকেট। ভেবেছিলাম এলিফ্যান্ট রোড থেকে এ মাসে ভালো একটা উলের সোয়েটার কিনে দেব। আমার খালাতো বোনের ছোট ছেলের জন্মদিনের উপহার কেনায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
কর্নেলফিরোজের কন্ঠে এবার উষ্মা,
‘আপনি আগে বলেন নাই কেন আপনার ছেলের পুরো নাম জাহিদ হাসান রঞ্জু? শামীমাএইমাত্র ফোন করায় রঞ্জু নামটা জানতে পারলাম। আশুলিয়া বাজার চিনেন?’
আমি বললাম,
‘হ্যা, এলাকাটা চিনি’। বাসায় ছেলেকে জাহিদ বলে ডাকি। বন্ধুরা যে রঞ্জু নামে ডাকতো, এত ডামাডোলের ভেতর ভুলেই গিয়েছিলাম।
কর্নেল বললেন,
‘আশুলিয়া বাজারের মোড়ে আবুল মনসুর মার্কেটের কাছে এখুনি যান। একটা ক্রসফায়ার হয়েছে। রঞ্জু নামের একজন হেভিলিউন্ডেড অর এক্সপায়ারড’
আমি কিছু একটা বলব, এমন সময় কর্নেল ফিরোজ আবার বললেন, ‘দাঁড়ান, ওয়েট করেন, আপনার গাড়ি কোথায়, আমিও আসছি’
জানিনাশামিমা ফোনে কি বলেছে, কর্নেল সাহেব বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। রূপার অনেক বন্ধুই বাড়িতে আসে। শামিমাকে কখনো আসতে দেখিনি। অথচ বিপদের সময় অনাত্মীয়রাইহঠাৎ সবচেয়েআপন হয়ে যায়।
কর্নেল ফিরোজ সামনের সিটে উঠে ড্রাইভারকে কিসব বললেন। ড্রাইভার খুব জোরে গাড়ি টান দিল। টঙ্গিডাইভারসন রোড বরাবর গিয়ে গাড়ি আশুলিয়াহাইওয়েতে মোচড় নিলো। মনে হয় প্রায় ষোল বছর পর এই পথে এলাম। শেষবার এসেছিলাম শাহেদের সাথে। শাহেদের বন্ধুর গাড়িতে। জাহিদ তখন চার, রূপা হয়নি। গাড়িতে যায়গা হবে না দেখে জাহিদকে নানুর কাছে রেখে এসেছিলাম। জাহিদ আসার জন্য খুব কান্নাকাটি করেছিল।কে জানত আজ জাহিদের জন্যই এখানে আসতে হবে? আশুলিয়ার রোড ধরে তখন এত ঘন ঘনগাছগাছালি ছিল না কিন্তু পথের দু পাশে ছিল সমুদ্র সৈকতের মত চঞ্চল জলরাশি আর বুনো বাতাসের বিপুল দাপট। এখন অনেক জায়গা ভরাট হয়ে বাতাসে ধুলো উড়ছে। দুপাশেযেটুকু জল তাও কেমন স্তব্ধ, কোথাও কোথাও কচুরিপানার সবুজ তান্ডব।
ঘটনাস্থল চিনতে ড্রাইভারের খুব অসুবিধে হলো না। হলুদ ফিতে দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। ফিতের গায়ে একটু পর পর লেখা, ক্রাইমসিন, ডু নট ক্রস। সামান্য দূরে লোহার রোড বের করা একতলা একটা মার্কেটের পাশে জনা পঞ্চাশেক মানুষ জড়ো হয়েছে। কালো পট্টি, কাল উর্দি, কালো সানগ্লাস পরা কৃষ্ণবাহিনীর লোকেরা অতি উৎসাহীদেরধম্কে হলুদ বৃত্ত থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কর্নেল ফিরোজ বললেন,
‘আপনারা ওখানে দাঁড়ান, আমি আপনাদের ডাকব’
রূপা আর আমি ভিড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেছন থেকে কারো কথা কানে আসল,
‘এইহানেমরে নাই’
‘তুই কী কস?’
‘মুইএইহানেনাইটডিউটি দেই, রাইতে কালাবাহিনী বড় একটা টেরাকে আইসা লাশ ফালায় গেছে’
অদূরে কর্নেল ফিরোজ কৃষ্ণবাহিনীর কারো সাথে হাত নেড়ে কথা বলছে। আমাকে ইশারায় ডাকলেন। রূপা আমার হাতটা জোরে চেপে ধরল। নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাছে যেতেই কৃষ্ণবাহিনীর একজন হলুদ ফিতা উপরে টেনে ধরল। আমরা কৃষ্ণ বিবরে প্রবেশ করলাম।
শিশির ভেজা ঘাসে উপুর হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। মাথার চুল শেইভ করা। একহাত ভেঙ্গেমুচড়ে গায়ের চামড়ার সাথে ঝুলছে। হলুদ জ্যাকেটটা গায়ে নাই, একপাশে দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে। গায়ে একটা শাদা হাফ শার্ট। রক্তে প্রায় পুরো শার্টটাই লাল। জাহিদ কি জ্যাকেটের নীচে শার্ট পরেছিল? জাহিদের দুটো সাদা শার্ট আছে। হাফা হাতা শার্টটা আরিফের। ছোট হয় বলে জাহিদকে দিয়েছে। ফুল হাতা শার্টটা আমার কেনা, ঈদের এক সপ্তাহ পর ঢাকা কলেজের উল্টোদিকে অর্ধেক দামে পেয়েছিলাম। বোতামগুলো কাঠের। জাহিদ খুব পছন্দ করেছিল। প্রায়ই পরত। একবার পরলেই ধুলোবালি লেগে ময়লা হয়ে যেত।
রক্তভেজা শার্ট আর ন্যাড়া মাথা দেখে পরিচয় বোঝার উপায় নেই। আমি কর্নেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কর্নেল বললেন,
‘মুখ দেখলে কি সুবিধা হয়?’
আমি মাথা নাড়লাম। কৃষ্ বাহিনীর দু’জনদুদিক থেকে ধরে দেহটি উলটে দিলো। আমি মৃত ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। সারা গালে সিগারেটের পোড়া দাগ। আমারই মত অন্য কোন মায়ের হারানো ছেলে। আমি দৌড়ে বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এলাম।
ফিরে আসার সময় কর্নেল কানের কাছে এসে বললেন,
‘শুনুন,আপনার ছেলে কোন টাকা-পয়সার ঝামেলায় জড়ায়নি তো?’
আমি দু’দিকে মাথা নাড়লাম। কর্নেল বললেন,
‘আপনি সিওর?’
হঠাৎ মনে পড়ল শাহেদের জমিটার কথা। ওই জমির আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছি। বললাম,
‘আমার হাজবেন্ডের নামে মিরপুরে আড়াই কাঠার একটা জমি ছিল। ও বেঁচে থাকতে জমির নামজারি হয় নাই। এলাকার সরকারি এমপি ভুমি অফিসে গিয়ে তিনপুরুষ আগের দলিল পাল্টে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। জমিতে কাঁচা ঘর তুলে রিকশাওয়ালাদের ভাড়া দিয়েছে। রাজউকেঅ্যাপার্টমেন্টেরপ্ল্যানওসাবমিট করেছে। এসব নিয়ে কোটকাচারি আর মামলা মোকদ্দমা। মাস দু’ এক আগে জাহিদের সাথে এমপির লোকদের হাতাহাতির মত অবস্থা’।
কর্নেল বললেন, ‘আপনার কি মন্ত্রী-মিনিস্টার জানা আছে?’
আমি বললাম,
‘না, সেরকম নাই। একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন। মতলব হাইস্কুলে পড়েছেন। আমার দাদা তখন ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন’।
মতলব দক্ষিণ উপজেলা সমিতির পুনর্মিলনীতে প্রতিমন্ত্রী সাহেব প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। আমার পরিচয় পেয়ে ভিসিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিলেন, শোন মা, কখনো প্রয়োজন হলে ফোন দেবে, এটা আমার পার্সোনাল নাম্বার।
কর্নেল বললেন,
‘আমার ধারণা এটা গুমেরকেইস। গুমেরকেইস হলো পলিটিকাল লিডারদের ফিল্ড। দেখুন ওই প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন কিনা’
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সোজা শাওয়ারের নীচে চলে গেলাম। আমার সমস্ত শরীর বেঁয়ে জলের ধারা নামছিল আর আমি জাহিদেরকথভাবছিলাম। জাহিদ কি কখনো কাউকে কাউকেভালবেসেছিল? কখনো কি আঘাত পেয়েছিল? জাহিদ কি ওর বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করত? জাহিদের জীবনের ছোট ছোট আনন্দ বেদনার সাথে আমার যোগাযোগটা কখন যেন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
রাতে একটুও ঘুম এলো না। বিছানায় এপাশওপাশ করে কখন ভোরের সূর্যটা আবার দপ্ করেজ্বলেউঠলো।
ভোর থেকেই প্রতিমন্ত্রীকে ফোন ঘুরানো আরম্ভ করলাম। বিকেল পাঁচটায় ওনাকে পেলাম। উনি আমাকে চিনতে পারেননি। আবার নূতন করে পরিচয় দিতে হলো। প্রতিমন্ত্রী সন্ধ্যার পর মিন্টু রোডে চলে আসতে বললেন।
সন্ধ্যায় রওনা হয়ে যখন প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছুলাম তখন রাত পৌনে আটটা। ওনার পিএস বা ওরকম কেউ আমাদেরকে ড্রইং রুমে নিয়ে বসালেন। পাশে প্রতিমন্ত্রীর স্টাডিরুম। সেক্রেটারিয়েটটেবিলের উপর একটা লাল ফোন, একটা কালো ফোন। প্রতিমন্ত্রী লাল ফোনটাকানে ধরে আছেন। কথা শেষে ড্রইং রুমে এসে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর হটলাইন। বেজে উঠলেই ভয় হয়, চাকুরিটাগ্যালো কি না, হা হাহা। এখন বলো মামনি তোমার কি সমস্যা?’
আমার আশঙ্কার কথা আমিব্যাখ্যা করলাম। মন্ত্রী বললেন, ‘তোমার দাদা খুব কড়া মাস্টার ছিলেন। মিথ্যে বললে বেতিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। তখন থেকেই আমার সত্য বলার অভ্যাস। তোমাকে একটা কথা বলি, এত যে গুম হচ্ছে, কারা জড়িত আমি কিন্তু জানি না। একজন সংসদ সদস্য পর্যন্ত গুম হয়ে গ্যালো, ওনার কি কানেকশনের অভাব ছিল? কিন্তু পাঁচ বছরেও কোন খবর নাই। তোমার ছেলে গুম হলে আগামী পনেরো বছরেও দেখা মিলবে মনে কর?’
আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি কি মনে করি আর না মনে করি তাতে একজন মন্ত্রীর কি আসে যায়?
প্রতিমন্ত্রী এবার হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘আর এসব জমিজমার ঘটনায় তোমার ছেলে গুম হবে না।ওরা ডাইরেক্ট ক্রসফায়ারে দেবে। তুমি চাইলে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে দেখতে পারি। কিন্তু কোন কাজ হবে না’
বাড়ি ফেরার পর মুহুর্মুহুফোনের জবাব দিতেই জান অস্থির হয়ে গ্যালো।কখনো জাহিদের বন্ধুরা কখনো আত্মীয়স্বজন। রাত একটার দিকে একটু তন্দ্রা মত এসেছিল, হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কলিং বেল কি কাজ করছে না? দরজা খুলতেই কালো ইউনিফর্ম পরা কুরিয়ার সার্ভিসের লোক বললো,
‘ম্যাডাম আপনার পার্সেল, সাইন লাগবে না’
একটা বড় কালো বাক্স। বাক্সটা তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর রাখলাম। টেইপউঠিয়ে বাক্স খুলতেই দেখি ভেতরে আরেকটা কালো বাক্স। তার ভেতরে আরেকটা। শেষ বাক্সটা খুলতেই আতকে উঠলাম। একটা কাটা হাত।কড়ে আঙ্গুলে কালো তিল দেখে বুঝলাম এই হাত আমার জাহিদের। ছোটবেলায় স্কুলে দেবার সময় এই হাতটা আমার শাড়ি খামচে থাকত।
জাহিদের কাটা হাতে একটা মোবাইল ফোন শক্ত করে ধরা। ফোনটা হঠাৎ ক্রিং করে উঠল। চম্কে ঘুম ভেঙ্গেগ্যালো। আমার ব্যাগের ভেতরে রাখা ফোনটা তখন তারস্বরে বাজছে। লালবাগ থানার ওসি ইন্সপেক্টর জলিল ফোন করেছেন। কোন ভান ভণিতা না করেই বললেন,
‘আপনারা তো সকালে জিডি করে গ্যাছেন। একটা আপডেট আছে। ভাবলামটেনশনে আছেন, এখুনিজানিয়ে রাখি। সাতাশ তারিখ রাত তিনটায়নয়াপল্টনেকয়েকটাদুষ্কৃতকারী গ্রেফতার হয়েছে। একজন বলছে তার নাম জাহিদ হাসান। আপনাদের তল্লাবাগে বাসা।’
সারাদিনের হয়রানি আর মাঝরাতেরদুঃস্বপ্ন আমার সমস্ত মানসিক শক্তি ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিয়েছে। ইন্সপেক্টর কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। বললাম,
‘কে অ্যারেস্ট হয়েছে বলছেন? কোথায়? কি কারনে?’
ইন্সপেক্টর বললেন,
‘জাহিদ হাসান নামে একজন দু’দিন আগে অ্যারেস্ট হয়েছে, নয়াপল্টনের একটা আবাসিক হোটেল থেকে। ২৯১ ধারায় পল্টন থানায় চালান দিয়েছে। যেহেতু আসামী তল্লাবাগের, পল্টন থানা আমার সাথে কন্টাক্ট করেছে’।
জাহিদ নামটা আমার মস্তিষ্কেক্যাফেইন ছড়িয়ে দিলো। আমি জড়তা কাটিয়ে তটস্থ হয়ে জিগেস করলাম,
‘কি কারনে গ্রেফতার বললেন?’
ইন্সপেক্টর এবার বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘সেকশন টু নাইন্টি ওয়ান।অসামাজিক কার্যকলাপ। পাঁচ বন্ধু মিলে ভাড়াটে মেয়েমানুষ নিয়ে হোটেলে ফুর্তিফুর্তা … জঘন্য ব্যাপারস্যাপার। আপনার ছেলেই কিনা আমি কিন্তু সিওর না। আপনি ওদেরকে ফোন করে খবর নেন। লিখুন নম্বরটা…’।
অন্যসময় হলে আমার কী অনুভুতি হতো জানি না, কিন্তু সময়টা গুম, খুন আর ক্রসফায়ারের। আমি হাত জোড় করে সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করলাম,
‘হে আল্লাহ, এটাই যেন আমার জাহিদ হয়…’